মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল, ২০১০

স্বপ্ন অথবা বাস্তব

বিকেলের সময়টা ওরা হলের ক্যান্টিনে অথবা ক্যাম্পাসের খেলার মাঠটাতে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেয়, কখনো ক্যাফেটেরিয়ার সামনের লনটাতে চেয়ার নিয়ে বসে। ওরা মানে তিন বন্ধু প্লাবন, মারুফ আর রবি। তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। সেরকমই একটি আড্ডা, কোন এক গোধূলী বিকেলে কিংবা সন্ধ্যার কিছুটা পরে,

প্লাবনঃ পাশ করার পরে কি করবি চিন্তা ভাবনা করেছিস?

মারুফঃ একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তবে এখনো চুড়ান্ত করিনি। তবে আর যাই কিছু করি প্রকৌশল বিদ্যায় ইতি টানছি শেষ পরীক্ষার দিন এটা নিশ্চিত।

রবিঃ তার মানে এমএসসির কোন চিন্তা ভাবনা নেই?

মারুফঃ ঠিক সেটা বলিনি, বলেছি প্রকৌশল বিদ্যায় আর থাকবোনা। এমনকি কর্মক্ষেত্রেও না।



প্লাবনঃ একটু পরিষ্কার কর, তুই প্রকৌশলী হতে যাচ্ছিস কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সেটাকে বেছে নিবিনা এটা বোঝাতে চাচ্ছিস ?



মারুফঃ ঠিক তাই।



রবিঃ তাহলে কি বাণিজ্যের পথে যাবি যেটা অনেকেই এখন করে, মানে এমবিএ?



মারুফঃ না, আমি সিরিয়াসলি বিসিএস দিব, প্রথম দিকে থাকব মেধাতালিকায় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করব, কূটনৈতিক হব।



প্লাবনঃ কিন্তু সেটাতো অনেক সময়ের ব্যাপার, অন্তত পক্ষে দুই বছর, এর মধ্যে কি করবি ?



মারুফঃ এখনো ভাবিনি, তবে ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলে পড়াতে পারি, বিসিএস প্রস্তুতির সময়ে ভাল কিছু পয়সা আসবে হাতে।



রবিঃ তুই কিভাবে নিশ্চিত হলি যে তুই পররাষ্ট্র পাবি ? তোর রাজনৈতিক কোন ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, মেধায় উপরের দিকে থাকলেও তোকে নিচে নামিয়ে দেবে।



মারুফঃ তুই জানিস আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি, আপাতত নেতিবাচক কিছু ভাবছিনা।



অর্ডার দেয়া গরম পুরি আর হালিম আসে। হালিমে চুবিয়ে চুবিয়ে পুরি খাবার অভ্যেস প্লাবনের অনেকদিনের। গরম গরম পুরি এক কামড় মুখে পুড়ে প্লাবন খাবার দিতে আসা পিচ্চিটাকে আবার ডাকে। কাছে এলে তিনটা গরম গরম চা দিতে বলে খানিক পরে।



মারুফঃ প্লাবন তোর কি পরিকল্পনা ?



রবিঃ ওর আবার পরিকল্পনা কি ? রেজাল্ট ভাল, ডিপার্টমেন্টে জয়েন করবে, ক্লাসে ঢুকে ভাব নিবে আর ছাত্রীদের সাথে টাংকিবাজী।আর দুই বছর পরে ফুরুৎ, মেধা পাচার।



মারুফঃ ফাজলামো রাখ রবি।



প্লাবনঃ আমার পরিকল্পনা খুব সাধাসিধে, যদি সুযোগ হয় তাহলে বিভাগে জয়েন করব, তারপর এখানেই মাষ্টার্স শেষ করে চাকরী স্থায়ী করে বাইরে যাব, পিএইচডি করে দেশে ফিরে এই পেশাতেই থেকে যাব। ছাত্র ছাত্রীদেরকে পড়ানো, গবেষণা আর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়ে ভালই কেটে যাবে জীবন।



রবিঃ আমি হলফ করে বলতে পারি তুই ফিরে আসবিনা।



প্লাবনঃ সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ, আমি বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে।সুতরাং দেশের স্বার্থে না, নিজের স্বার্থেই আমি ফিরে আসব। আর আমার ধারনা এখানে শিক্ষকতার পেশাটা আমি উপভোগ করব। যাই হোক রবি এবার তোর কথা বল।



রবিঃ আমার পরিকল্পনা আরো সাধারণ, পাশ করে সরকারী চাকরীতে ঢুকবো, তার পর পাঁচ বছরের মাধ্যে ঢাকাতে নিজের ফ্ল্যাট।



মারুফঃ পাঁচ বছরের মধ্যেই !!



রবিঃ এর আগেও হতে পারে নির্ভর করছে কোথায় পোষ্টিং হয় তার উপর।



প্লাবনঃ তার মানে অসৎ রোজগার করবি?



রবিঃ দোস্ত এটা আপেক্ষিক, আসল কথা হচ্ছে উপার্জন করা। সবাই যা করছে তা মেনে নিতে দোষ কোথায়।



ইচ্ছে ছিল এটা নিয়ে তর্কে নামার কিন্তু আজকের সন্ধ্যাটাতে তা আর করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা প্লাবনের। সে প্রসংগ ঘুরিয়ে নতুন আলোচনা শুরু করে ফুটবল নিয়ে। এবারের বিশ্বকাপ কে নিতে পারে সেটা নিয়ে তিন বন্ধুর বিশ্লেষন শুরু হয়ে যায়।



সেদিনের সেই বিচ্ছিন্ন আলোচনা হয়ত মিলিয়ে যায় প্রাত্যহিক জীবন যাপন, ক্লাস আর পরীক্ষার যাঁতাকলে কিন্তু স্বপ্নগুলো থেকে যায় তিনজনেরই মনে। পাশ করার পর সবাই যার যার স্বপ্ন পূরণে মনোযোগী হয়, কর্মব্যস্ততায় নিজেরদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ কমে গেলেও বন্ধুত্ত্ব অটুট থেকে যায় আগের মতই।



সেই দিন গত হবার বেশ কিছু বছর পর তিন বন্ধুর আবার দেখা হয়েছে । এই সময়ের মধ্যে ঘটে গিয়েছে অনেক কিছু তার কিছুটা নিজেরা জানে, কিছুটা তিনজনই জানে। চলুন আজকে এই তিনজনের অবস্থান দেখি,



মারুফের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য তাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। পাশ করার পরে কোন চাকরীতে না ঢুকে সে সত্যি সত্যি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জয়েন করে। বাবার পেনশনের পর থেকে পরিবারের জন্যও টাকা দরকার। ক্লাস, টিউশিনির পর সিরিয়াসলি বিসিএস এর জন্য পড়তে থাকে। প্রিলিমিনারী পরীক্ষা আর লিখিত পরীক্ষায় অসম্ভব ভাল ফলাফল করে, ভাইভাটাও দূর্দান্ত হয়। তবে সবকিছুর পরেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাওয়া হয়না তার। নিজের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিতে কষ্ট হয় যখন দেখে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর থেকে যাওয়া ল্যাগার ভাইয়াটা ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক হবার ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছে বিশেষ মানুষদের আশীর্বাদে। একবার ভাবে নতুন করে শুরু করবে ততদিনে চলে গিয়েছে তিনটি বছর, সুতরাং প্রকৌশল চাকরীর মিছিলে সে পিছিয়ে গেছে। মারুফের স্বপ্নের মৃত্যু হয়, যদিও আততায়ী সে নয়, তাকে প্রশাসন নিয়েই খুশি থাকতে হয়।



পাশ করার পর প্লাবন বিভাগে জয়েন করে তার পেশাকে মন প্রান দিয়ে উপভোগ করতে থাকে। একসময় তার মাস্টার্স শেষ হয়, সুযোগ আসে বিদেশে পিএইচডি করার। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুসারে সে একসময় উচ্চশিক্ষার জন্য ছুটির আবেদন করে, কিন্তু খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে তার সে আবেদন নাকচ হয়। সে সাময়িক ভাবে তার উচ্চশিক্ষার আবেদন ছয়মাস পিছিয়ে দেয়। ছ'মাস পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ছুটির আবেদন করে, আবারো একই ঘটনা মঞ্চায়িত হয়। প্রায় চার বছর শিক্ষকতা করার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই প্রতিদান পেয়ে প্লাবন দ্বারে দ্বারে ঘোরে ছুটির জন্য। হতাশ দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার তাকে জানায়, 'এদেশে থেকে কি করবে বাইরের জীবন কত উন্নত সেখানে যাও, কি করবে এখানে পড়ে থেকে'। নিজের যোগ্যতা দিয়ে সারাজীবন চলা প্লাবন এইখানটাতে বড্ড বেশি ধাক্কা খায়। হতাশা তাকে গ্রাস করে, একসময় তার সবচেয়ে প্রিয় পেশাটি ছেড়ে দিয়ে অভিমানে দেশ ছেড়ে আসে সে।



প্রিয় পাঠক সবাই নিশ্চয়ই রবির স্বপ্নের কি হলো সেটি জানতে উৎসুক। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন তাহলে। রবির ঢাকায় নতুন বাসায় নাকি জব্বর আড্ডা হচ্ছে এই তিন বন্ধুর, আমি বরং সেখান থেকে চা টা খেয়ে আসি।



বিদ্রঃ চরিত্রগুলোর নাম কাল্পনিক হলেও এই স্বপ্নগুলো, স্বপ্ন ভাঙ্গার ব্যাথাগুলো কিংবা স্বপ্নপূরণের আনন্দগুলো আর তার সাথের এই মানুষগুলোর বিচরণ কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবনেই, হয়ত আমার আপনার আশে পাশেই।

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন