বুধবার, ১৯ মে, ২০১০

ভুল

তীব্র এক শব্দে ফারুকের ঘুম ভেঙে যায়, বাইরে বজ্রপাত হচ্ছে। কাল রাতে ঘুমানোর সময় থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল এখন বেগটা বেড়েছে মনে হচ্ছে । অন্ধকারে হাতড়িয়ে ফারুক হারিকেনটা খুঁজে বেড়ায় কিন্তু পায়না। শুধু আজ না কখনই সে পায়না। ঘুম থেকে উঠে সবসময় মনে হয় সে এক ঘোরের মধ্যে আছে, তার আশেপাশের সবকিছুকে কেমন যেন অচেনা মনে হয়। মিনিট কয়েক এই অবস্থা থাকে তার পর আবার সব ঠিক হয়ে যায়। ছোটবেলায় এই সমস্যাটা হলে সে মাকে ডেকে ভয়ে কেঁদে উঠত, বড় হবার সাথে সাথে কান্নাটা আর আসেনা, কিন্তু ভয়টা থেকেই যায়। খাটের পাশের জানালার ছিটকিনিটা খুলে ফারুক পাল্লা ছড়িয়ে দেয়, সাথে সাথে এক ঝাপটা ভেজা বাতাস এসে তার মুখে লাগে। শোয়ার কাঁথাটা মুড়ি দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বৃষ্টির সাথে বিদ্যুতের ঝিলিকে নিভে যাওয়া হারিকেনটা চোখে পড়ে। জানালাটা বন্ধ করে ফারুক আবার বিছানায় শোয়, কিন্তু ঘুম আসেনা।
কটা বাজতে পারে এখন? অনেকদিন থেকে তার ঘড়িটা নষ্ট, বাজারে এক মেকানিক অবশ্য বলেছিল ব্যাটারী বদলে ফেললেই আবার চলবে কিন্তু ইচ্ছে করেই ফারুক তা করেনি। সময় থেকে পালিয়ে বেড়াতে ইদানিং তার আর খারাপ লাগেনা। আর লাগবেইবা কেন? সেতো জীবন থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এভাবে কতদিন কাটাতে হবে সেটা সে জানেনা। শেষবার রুহুল যখন এসেছিল তখন ওকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল,
-'মানিক ভাই আরো কিছুদিন এখানে থাকতে বলেছে।'
'কিছুদিন মানে কতদিন?' রেগে উঠেছিল ফারুক।
-'সেটা বলেনি'
আর কোন প্রশ্ন করেনি ফারুক। মেনে নিয়েছে। আজকাল অনেক কিছুই সে মেনে নেয়, এমনকি ঢাকা থেকে চলে আসার চার মাস পরে রুহুল যখন খবর দিল ওর বাবা মারা গেছে, সেটাও ফারুক মেনে নিয়েছিল খুব সহজ ভাবেই। যেন তার চলে আসা, বাবার মরে যাওয়া সব স্বাভাবিক।
বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ে, টিনের চালের এক পাশ দিয়ে চুয়ে চুয়ে পানি আসে, সিলিং ভিজিয়ে সেটার মাটিতে পৌঁছতে কিছু সময় লাগে। এঁটেল মাটি দিয়ে লেপা ঘরে সেই পানি পড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ফারুক আবার উঠে দাঁড়ায়, তবে এবার পিছলে পড়ার ভয়ে আরো সাবধানে। বালিশের নিচ থেকে ম্যাচ আর সিগেরেটের প্যাকেট বের করে। একটা সিগেরেট ধরিয়ে দরজা খুলে সে ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় আসে। বারান্দায় চেয়ারটা ভেজা, গামছা দিয়ে মুছে সেটাতে বসে পা টা বারান্দায় গ্রীলে তুলে দেয় সে। ছিটে আসা বৃষ্টির পানিতে পা ভেজাতে বেশ ভাল লাগে তার।
এমনি এক বৃষ্টির দিনে হলের গেষ্ট রুমে সে বসেছিল নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে। রুহুল, জয়ন্ত, মানিক ভাই আর অনিও ছিল সেখানে। নতুন নাটক নিয়ে কথা বলা শুরু করে রুহুল,
'এই স্ক্রিপ্টটা জমবে?'
'জমা জমির প্রশ্ন আসছে কেন?' অনি জিজ্ঞেস করে
'না মানে দর্শকের দিকটাওতো ভেবে দেখতে হবে' রুহুল যোগ করে
'স্পার্টাকাস নিয়ে দর্শকদের মন যোগানো কঠিন, চেষ্টা করা যেতে পারে।' জয়ন্ত মতামত দেয়।
'ঠিক আছে তাহলে তোরা রিহার্সেল কবে থেকে শুরু করবি?' মানিক ভাই জিজ্ঞেস করে।
'সব ঠিক ঠাক থাকলে আগামী সপ্তাহ নাগাদ' ফারুক উত্তর দেয়।
স্ক্রিপ্টটা নিয়ে সেদিন আলোচনা গড়িয়েছিল নির্দেশনা কে দিবে সেটা নিয়ে। ফারুক বলেছিল মানিক ভাইকে একজন প্রফেশনাল নির্দেশক নিয়ে আসতে কোন প্রতিষ্ঠিত গ্রুপ থেকে। আলোচনা শেষে সবাই চলে যাবার পরে মানিক ভাই ওকে তার রুমে নিয়ে গিয়েছিল জরুরী কথা আছে বলে।
বৃষ্টিটা থেমে গেছে। বেশ ঠান্ডা একটা বাতাস আসছে। স্মৃতিগুলো কেন জানি আজ ঝেঁপে আসছে ভেতর থেকে। থামাতে চাইলেও মানতে চাইছেনা যেন। ফারুক আরেকটা সিগেরেট ধরায়, চোখ বন্ধ করে সেদিনের আলাপচারিতা মনে করে সে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সে করেছিল তারপরেই যার ফলাফল তার আজকের এই অনিশ্চিত জীবন।
'একটা কাজ করতে পারবি আমার জন্য?'
-'কি কাজ?'
'তেমন কোন কঠিন কাজ না, পরশুদিন চানখারপুলের কিছু পোলাপান আসব হলে, সেগুলাকে একটা বিশেষ রুমে দিয়ে আসতে হবে।'
'কি কারণে আসবে ওরা'
-'একটা টেন্ডার বাক্স সামলাইতে'
'আমার কাজটা তাহলে কি'
-'একটু সাথে থাকা'
'আপনে কোথায় থাকবেন'
-'আমার একটা মিটিং আছে, নাহলে আমিই থাকতাম। ওরা বাইরের পোলা, হল টল ঠিক মতন চিনেনা। তুই ওগোরে ২০৫ নাম্বার রুমে নিয়া যাবি।'
ফারুক ইতস্তত করেছিল সেইদিন। কিন্তু কেন জানি না করতে পারেনি। মানিক ভাই তাদের সাথে নাটক করলেও এর বাইরে তার একটা বেশ পরিচয় ছিল ক্যাম্পাসের ছাত্র সংগঠনের নেতা হিসেবে। তাকে চিন্তিত দেখে মানিক ভাই বলেছিল,
'তেমন ঝামেলার কোন কাজ না, তুই শুধু সাথে থাকিস।'
মানিক ভাইয়ের কথামত সেদিন হলের গেটের সামনেই ছিল সে। দুপুরের দিকে চার পাঁচ জন ছেলে আসে। সবার পিঠে ব্যাক প্যাক। হলের দাড়োয়ান ভেবেছিল ওগুলো তার বন্ধু বান্ধব হবে। মানিক ভাইয়ের নির্দেশমত ওদেরকে নিয়ে গিয়েছিল ২০৫ নাম্বার রুমে। তারপর যা ঘটেছিল তার জন্য নিজেকে কখনই ক্ষমা করতে পারবেনা ফারুক। ছেলেগুলো ঐ রুমে গিয়েছিল আসলে কাপড় পরিবর্তন করতে। মূহুর্তের মধ্যে ওরা ব্যাগ থেকে লুঙ্গি বের করে প্যান্টের উপরে পড়ে নেয়। ব্যাগ থেকে বেশ বের হয় দু'টি নাইন শ্যুটার গান আর বেশ করেকটি কাটা রাইফেল। সেগুলো ওরা কোমরে গুজে লুঙ্গির ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। ফারুক হতবাক হয়ে দেখছিল ওদের কাজ, যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলনা। ওরা বের হয়ে যাবার কয়েক মিনিট পরে কান ফাটা শব্দে ফারুক মেঝেতে শুয়ে পড়ে। কতক্ষণ এভাবে ছিল জানেনা, হঠাৎ একটি ফোনে সে বাস্তবে ফিরে আসে।
বৃষ্টিস্নাত আকাশটা দেখার মত, সন্ধ্যা থেকেই আকাশে মেঘ ছিল বলে চারদিক ঘুট ঘুট অন্ধকার ছিল, এখন একটু আধটু আলো দেখা যাচ্ছে। ভোর হতে খুব বেশি বাকি নেই বোধহয়। ফারুক প্যাকেটের শেষ সিগেরেটটা ধরায়। সেদিন ঐ ঘটনার পর ফোনে মানিক ভাই বলেছিল,
'ফারুক একটা ঝামেলা হয়ে গেছে'
-'বস এগুলো কারা, আমিতো কিছুই বুঝতেছিলা, এত গোলাগুলিই বা হচ্ছে কেন?'
'ফারুক তুই তাড়াতাড়ি হল থেকে বের হয়ে ঠাঁঠাঁরি বাজারে যা, আমি বাকী সব কিছু ফোনে কইতাছি'
-'না আমি কোথাও যাবনা, আপনি আগে সব খুলে বলেন। আর আমারে পালাতে বলতেছেন কেন? আমিতো কিছু করি নাই'
'আমার এত কথা বলার সময় নাই, হলের দাড়োয়ান তরে খুব ভাল করেই চিনে, শুধু এইটুকু জেনে রাখ ক্যাম্পাসে একটা ছেলে মারা গেছে। আর শোন, হলের পেছনের গেট দিয়ে বের হবি।'
ব্যস অতটুকুই কথাবার্তা হয়েছিল সেসময়, তারপরে মানিক ভাই ফোন কেটে দিয়েছিল। ঠাঁঠাঁরি বাজারে আসার পরে সে মানিক ভাইকে ফোন করলে ফোন বন্ধ পায়। ক্ষাণিক পরে মানিক ভাই অন্য একটা নাম্বার থেকে ফোন করে। মানিক ভাইই তাকে এই জায়গার ঠিকানা দেয় আর বলে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে। বলে পরে একজনকে পাঠিয়ে বিস্তারিত জানাবে। দিন সাতেক পরে রুহুল এসে জানায় তার নামে নাকি কেইস হয়েছে হত্যা মামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে, পত্রিকায় নাকি এসেছে ফারুক একজন ভয়াবহ সন্ত্রাসী, ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার।
ভোর হয়ে আসছে, আর কিছুক্ষণ পরেই সূর্য্য উঠবে, ফারুক অনেকদিন এই দৃশ্য দেখেনা। সেই ছোটবেলায় বাবার সাথে সে যখন সকালে হাঁটতে বের হতো মাঝে মাঝে তখন দেখত। কিন্তু আজ সূর্যের আলো বড্ড চোখে লাগে ফারুকের। সে দু'হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখে।

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন