১)
বাংলাদেশের নদীসমূহে নৌপরিবহন নিশ্চিত করার জন্য, অর্থাৎ শ্রেণীভেদে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সম্ভাব্য গভীরতা বা LAD বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (BIWTA) কাজ করে থাকে। তাদের একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ এই নৌপথসমুহের নাব্যতা রক্ষা করা যা অনেক সময় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে করতে হয়। কিন্তু অর্থাভাবে তা সবসময় নিশ্চিত করা যায় না। এছাড়া দেখা গেছে, অধিকাংশ সময়ে প্রাধান্য থাকে পদ্মা, যমুনা এবং মেঘনা ফেরী ক্রসিং এর নৌপথ নিশ্চিত করা; ফলে মূল নদীপথ রক্ষণাবেক্ষণ থাকে অর্থাভাবে অবহেলিত। বাংলাদেশের নদীসমুহের মধ্যে গঙ্গা-পদ্মা ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে চুক্তি অনু্যায়ী সীমিত পরিমাণ পানি পায় শুষ্ক মৌসুমে, এর সাথে দক্ষিণাঞ্চলের নদীসমুহের পানিপ্রবাহ সম্পর্কিত। যমুনাতে পানির পরিমানের সমস্যা না থাকলেও পলি সমস্যা প্রকট।অন্যদিকে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনাতে নাব্যতা সমস্যা অন্য নদীসমূহের তুলনায় কম। বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল নৌপথকে সরকারী-বেসরকারী উভয়ক্ষেত্রে সঠিক ও অর্থনৈতিক ভাবে মুনাফা অর্জনকারী পণ্য পরিবহন কাজে ব্যবহার করতে পারলে দুই দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে। এই লেখায় খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হবে যে বাংলাদেশ ভারত বর্তমান প্রটোকল নৌপথ সংরক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নদীসমূহের নাব্যতা সংরক্ষণ করা যায় কিনা। একই সাথে বলে রাখা ভাল যে এটি অবশ্যই প্রারম্ভিক আলোচনা, বিশদ বিশ্লেষণ এক্ষেত্রে আবশ্যক এবং তা অবশ্যই কারিগরী দৃষ্টিকোন থেকে করতে হবে।
২)
বাংলাদেশে মোট নৌপথের দৈর্ঘ্য ২৪,০০০ কিমি হলেও নৌপরিবহনযোগ্য নৌপথের দৈর্ঘ্য মাত্র ৫,৯৬৮ কিমি তাও সেটি আবার শুষ্ক মৌসুমে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩,৮৬৫ কিমি এ। নৌপথের সম্ভাব্য ন্যূনতম গভীরতার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের এই অভ্যন্তরীন নৌচলাচল গতিপথকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়ঃ ক্লাস ১, ক্লাস ২, ক্লাস ৩ এবং ক্লাস ৪। চারটি প্রধান নদীপথের সমন্বয়ের প্রায় ৬৯৩ কিমি দীর্ঘ ক্লাস ১ নৌপথ গঠিতঃ চট্টগ্রাম থেকে চৈকিঘাটা, চাঁদপুর ও শম্ভুপুরা হয়ে নারায়নগঞ্জ (বা ঢাকা); শম্ভুপুরা থেকে ডেমরা; শম্ভুপুরা থেকে ভৈরববাজার (বা আশুগঞ্জ); এবং চৈকিঘাটা থেকে বরিশাল, মংলা, খুলনা হয়ে মহেশ্বরপাড়া। ক্লাস ১ নৌপথ দেশের সর্বমোট পরিহনযোগ্য নৌপথের মাত্র ১১ শতাংশ এবং এই নদীপথের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী নৌপথ হচ্ছে ক্লাস ২, ক্লাস ৩ ও ক্লাস ৪ নৌপথ। এই চার ধরনের নৌপথের মধ্যে একমাত্র ক্লাস ৪ নৌপথগুলি মূলত মৌসুমী, বাকী নৌপথগুলি সারা বছর ধরে চালু থাকে। অন্যদিকে, ভারতের অভ্যন্তরীন নৌপথ মোট পাঁচটি জাতীয় নৌপথের সমন্বয়ে গঠিত। গঙ্গা-ভাগিরথী-হুগলী নদী ব্যবস্থার সমন্বয়ে জাতীয় নৌপথ-১ , ব্রহ্মপুত্র নদের সাদিয়া থেকে বাংলাদেশ-ভারত সীমারেখা পর্যন্ত অংশ নিয়ে জাতীয় নৌপথ-২, উদয়গমন্ডল খাল এবং চম্পাকরা খাল নিয়ে জাতীয় নৌপথ-৩, গোদাবরী ও কৃষ্ণা নদী এবং কাঁকিনাড়া ও পন্ডিচেরীর মধ্যকার সংযোগ খাল নিয়ে জাতীয় নৌপথ-৪, এবং সর্বশেষে ব্রাহ্মণী নদী ও মহানন্দা বদ্বীপ এবং পশ্চিম উপকূলীয় খাল নিয়ে জাতীয় নৌপথ-৫।
৩)
বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল নৌপথের ইতিহাস বেশ পুরোনো। কথিত আছে ব্রিটিশ আমলে কলকাতা বন্দর থেকে আসাম পর্যন্ত পণ্য পরিবাহিত হতো। ১৯৫০ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে স্ব স্ব নৌপথ অন্যদের দ্বারা ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের জন্য ‘Protocol on Inland Water Transit and Trade’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা কিনা ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগ পর্যন্ত বলবত ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মার্চ বাংলাদেশ এবং ভারত আগের চুক্তিটি পুনরায় বলবৎ করে এবং আটটি প্রটোকল নৌপথ নির্ধারিত করে। এগুলো হচ্ছেঃ কলকাতা থেকে রায়মঙ্গল, চালনা, খুলনা, মংলা, কাউখালি, বরিশাল, নন্দির বাজার, চাঁদপুর, আরিচা, সিরাজগঞ্জ, বাহাদুরাবাদ, চিলমারি, ধুব্ড়ি হয়ে পান্ডু; বিপরীতক্রমে পান্ডু থেকে কলকাতা; কলকাতা থেকে রায়মঙ্গল, মংলা, কাউখালি, শ্রীপুর, ফেঞ্চুগঞ্জ, জকিগঞ্জ হয়ে করিমগঞ্জ; বিপরীতক্রমে করিমগঞ্জ থেকে কলকাতা; রাজশাহী থেকে গোদাগারি হয়ে ধুলিয়ান; বিপরীতক্রমে ধুলিয়ান থেকে রাজশাহী; ভৌরববাজার থেকে মিঠামইন, ইটনা, লালপুর, সুনামগঞ্জ হয়ে ছাতক; এবং বিপরীতক্রমে ছাতক থেকে ভৈরববাজার।
বাংলাদেশে ভারত প্রটোকল নৌপথের ‘পোর্ট অফ কল’ বা যেখানে পণ্য বা যাত্রীবাহী নৌযান লোডিং-আনলোডিং এর কাজ করে থাকে, মোট আটটি। বাংলাদেশে পোর্ট অফ কল হচ্ছেঃ নারায়নগঞ্জ, খুলনা, মংলা, ও সিরাজগঞ্জ; ভারতে হচ্ছেঃ কলকাতা হালদিয়া, পান্ডু, ও করিমগঞ্জ। সারসংক্ষেপ বললে, এই প্রটোকল নৌপথের গুরুত্ত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছেঃ কলকাতা থেকে পান্ডু, কলকাতা থেকে করিমগঞ্জ, এবং করিমগঞ্জ থেকে পান্ডু। সুতরাং বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল নৌপথের সাথে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে ভারতের জাতীয় নৌপথ-১ ও জাতীয় নৌপথ-২। নদীব্যবস্থার আলোকে বললে এই প্রটোকলের সাথে জড়িয়ে আছে ভারতের গঙ্গা-ভাগিরথী-হুগলী, ব্রহ্মপুত্র, বারাক নদীব্যবস্থা এবং বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা, গঙ্গা-পদ্মা, যমুনা, কচা, পশুর নদীব্যবস্থা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১০ এর ভারত সফর কালে স্বাক্ষরিত বাংলাদেশে ভারত যৌথ ইশতেহারে বাংলাদেশের আশুগঞ্জ ও ভারতের শীলঘাট নতুন ‘পোর্ট অফ কল’ স্বীকৃতি পায়। এছাড়া ঐ ইশতেহারে বিশাল আকারের কার্গো পরিবহনের জন্য যাবতীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ-ভারত যৌথ দল সম্ভাব্যতা যাচাই করার আশা ব্যক্ত করা হয় যাতে ভারত প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করবে এবং দুই দেশই তা বাস্তবায়ন করবে।
চিত্রঃ ভারত বাংলাদেশ প্রটোকল নৌপথ।
বাংলাদেশ ভারত প্রটোকল নৌপথের ব্যবহার দিক দিয়ে একচেটিয়া এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে এই নৌপথ দিয়ে মোট ২৫৪০টি পণ্যবাহী নৌযান পরিবাহিত হয়েছে যার সবকটিই বাংলাদেশের। ২০০৭-২০০৮ সালে মোট পরিবাহিত ২৯৮০ টি নৌযানের মধ্যে ভারতের রয়েছে মাত্র ২টি। ২০০৮-২০০৯ সালে মোট ১০৪২ টি পরিবাহিত নৌযানের মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছে ১০৩১ টি আর ভারতের ১১ টি। সর্বশেষ ২০০৯-২০১০ সালে ১৩০৮ টি পরিবাহিত নৌযানের মধ্যে ভারতের ৭টি আর বাংলাদেশের ১৩০১ টি। অর্থাৎ, সামগ্রিক বিচারে ভারত গত চার বছরে (২০০৬-২০১০)এই নৌপথের শতকরা মাত্র ০.২৫ ভাগ ব্যবহার করেছে। পণ্য পরিবহনের পরিমানের বিচারেও বাংলাদেশ একচেটিয়া এগিয়ে আছে। ২০০৬-০৭, ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রটোকল নৌপথ দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত পণ্য পরিবহনের পরিমানের তুলনামূলক হার হচ্ছে যথাক্রমে – ১০০ বনাম ০, ৯৯.৮ বনাম ০.২, ৯৮.৪৮ বনাম ১.৫২, এবং ৯৯.৬২ বনাম ০.৩৮। ২০০৭ থেকে ২০১০ এর মার্চ পর্যন্ত ভারতীয় নৌযান দ্বারা আটটি প্রটোকল নৌপথের মধ্যে মাত্র তিনটিতে পন্য পরিবহন সংঘটিত হয়েছে। কলকাতা থেকে পান্ডু পথে পরিবাহিত হয়েছে শতকরা ৪৩ ভাগ পণ্য, কলকাতা থেকে করিমগঞ্জ পথে পরিবাহিত হয়েছে শতকতা ৫৬ ভাগ এবং করিমগঞ্জ থেকে কলকাতা পথে পরিবাহিত হয়েছে শতকরা মাত্র ১ ভাগ। যদিও প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারত কার্গো পরিবহন ৫০:৫০ অনুপাতে হওয়ার কথা কিন্তু বাস্তবিক ভাবে এই অনুপাত একচেটিয়া বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকে পড়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছেঃ
প্রথমত, পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে অধিক হওয়ায় ভারতের বেসরকারী কার্গো পরিবহনকারী সংস্থাগুলো এক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করেনা। যেমন, ডিজেলের দাম ভারতে বাংলাদেশের তুলনায় অধিক। আবার ভারতের নৌযান চালনা নীতি অনুযায়ী একটি ভারতীয় নৌযান পরিচালনার সময় ন্যূনতম ১০ জন লোক থাকতে হবে সেখানে বাংলাদেশের নৌযানগুলি মাত্র দুইজন লোক নিয়েই পণ্য পরিবহন করে থাকে।
দ্বিতীয়ত, প্রটোকলের আওতায়, দুই দেশই প্রটোকল নৌপথ দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহন করতে পারে কিন্তু এক দেশ তার অভ্যন্তরীন পণ্য পরিবহন করতে পারে না (এটি মূলত ভারতের জন্যই খাটে) । ফলে বাংলাদেশী নৌযান ভারতের অভ্যন্তরীণ পণ্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পরিবহনের সুযোগ পায়। আবার বাংলাদেশী নৌযানগুলি সহজেই তাদের মাল খালাস করে কলকাতা বা হালদিয়া থেকে বাংলাদেশ কতৃক আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে ফিরে যায়। এই কারণে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের নৌযানগুলি ভারতীয় নৌযানের চেয়ে কম মূল্যে পণ্য পরিবহন করতে পারে এবং প্রতিযোগিতার বিচারে ভারতীয় নৌযানগুলি পিছিয়ে পড়ে।
৪)
এবারে বাংলাদেশ-ভারত বর্তমান প্রটোকল নৌপথ সংরক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নদীসমূহের নাব্যতা সংরক্ষণ প্রসংগে আসা যাক। বাংলাদেশ এই প্রটোকল নৌপথের মাধ্যমে এর নদীসমুহের নাব্যতা রক্ষণ করার জন্য ভারতের সহযোগীতা নিশ্চিত করতে পারে। সেটি হতে পারে কয়েক ভাবেঃ
প্রথমত, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন সংস্থার যেহেতু অবকাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে নৌপথ সংরক্ষণে, এক্ষেত্রে যৌথভাবে এই নৌপথগুলো সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।ভারত এক্ষেত্রে পরোক্ষ পরামর্শগত ও পরোক্ষ কারিগরী সহায়তা দিয়ে নাব্যতা রক্ষা, নদী শাসন, বন্দরের উন্নয়ন ইত্যাদি নিশ্চিত করতে পারে। ইতিমধ্যে যৌথ ইশতেহারের ধারা ২২ এ এই সহযোগীতার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ভারত প্রটোকল নৌপথের রাজশাহী থেকে গোদাগারি হয়ে ধুলিয়ান এবং বিপরীতক্রমে ধুলিয়ান থেকে রাজশাহী, এই অংশটির কোন ব্যবহার নেই। এর একটি কারন হতে পারে এই নৌপথটি অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক বা গুরুত্ত্বপূর্ণ নয় কিংবা ফারাক্কা ব্যারেজের কারনে এই পথে পর্যাপ্ত LAD নেই। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই নৌপথে সারা বছর ক্লাস-১ মানের LAD বজায় রাখার জন্য ভারত যাতে ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে প্রয়োজনীয় জলপ্রবাহ সরবরাহ করতে বাধ্য থাকে সেই দিক বিবেচনা করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত্ ভারত উজানের দেশ হওয়াতে অর্ধশতাশিক আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক টানাপড়েন রয়েছে। পারস্পরিক সহযোগীতার মাধ্যমে এবং অবশ্যই বাংলাদেশের নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এই নদীসমূহের পানিবণ্টন চুক্তির ক্ষেত্রে প্রটোকল নৌপথ রক্ষণাবেক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি বরাদ্দ নিশ্চিত করা যেতে পারে। উদাহরনস্বরূপ যেকোন আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবন্টন চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষের সবসময়ের দাবী শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ নদীখাতের (নৌপথ, বাস্তুসংস্থান) জন্য সংরক্ষণ করে বাকি পানি সমভাবে বণ্টন করা, কিন্তু ভারত এক্ষেত্রে সবসময় বিরোধিতা করে থাকে। যদি নদীখাত সংরক্ষণ দুই দেশের জন্যই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট (যেমন প্রটোকল নৌপথ) করা যায় সেক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছানো তুলনামূলকভাবে সহজতর হতে পারে।
একই সাথে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল নৌপথ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থও আলোচনার দাবী রাখে। ভারত তার জাতীয় নৌপথ-১ এর সাথে জাতীয় নৌপথ -২ এর সংযোগ স্থাপন করতে পারে এবং সেটা প্রটোকল মেনেই। তবে এখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রটোকলের আওতায় ভারতকে তার অভ্যন্তরীন পণ্য পরিবহন করতে দেয়া যেতে পারে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। এর সাথে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের নৌপরিবহন খাতের আয় এবং ভারতের প্রটোকল নৌপথ ব্যবহারের হার। নিঃসন্দেহে এই সুবিধা ভারতকে দিলে প্রটোকল নৌপথে ভারতীয় নৌযানের চলাচল বাড়ার কথা যা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। আবার এর ফলে বাংলাদেশি নৌযানগুলি প্রটোকল নৌপথে এখন যে সুবিধা পাচ্ছে তা হ্রাস পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া ভাল আর তা হলো জাতীয় নৌপথ-১ এর সাথে জাতীয় নৌপথ -২ এর সংযোগ আর ভারতের ‘আন্তঃনদী সংযোগ’ এক জিনিস নয়। জাতীয় নৌপথ-১ এর সাথে জাতীয় নৌপথ -২ সংযোগ বলতে বোঝায় প্রাকৃতিক ভাবে এই সংযোগ আছে কিন্তু মাঝখানে বাংলাদেশের ভূখন্ড থাকায় নৌচলাচলের অনুমতি নেই, সেটা হতে হবে প্রটোকল নৌপথ মেনে নিয়ে। অর্থাৎ গঙ্গা-ভাগিরথী-হুগলী, ব্রহ্মপুত্র এবং বারাকের নৌপথ সংযোগ। অন্যদিকে আন্তঃনদী সংযোগের একটি উদাহরণ হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের সাথে গঙ্গার প্রবাহকে সংযোগ খালের মাধ্যমে যুক্ত করা এবং গঙ্গায় পানি বৃদ্ধি করা। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে বাংলাদেশের জন্য আন্তঃনদী সংযোগ মেনে নেয়া আত্মঘাতী একটা সিদ্ধান্ত হবে।
ভারত তার জাতীয় নৌপথ-১ এর সাথে জাতীয় নৌপথ -২ এর সংযোগ স্থাপন করলে কলকাতা বন্দর থেকে পণ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাংশে (আসাম, মনিপুর, মিজোরাম বা ত্রিপুরা) পরিবহনে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। উদাহরণসরূপঃ সম্প্রতি ত্রিপুরা সরকারের কেনা ৭২৬ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ জেনারেটর কলকাতা বন্দর থেকে আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরায় পরিবহন এক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে দেখা যেতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে যে বিষটি লক্ষ্যনীয় তা হচ্ছে কোনটি অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনকঃ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে বাংলাদেশের সড়ক পথে ট্রানজিট নিয়ে ভারতে পরিবহন করা নাকি ভারতের কলকাতা বন্দরে পণ্য খালাস করে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল নৌপথ দিয়ে ভারতে পরিবহণ করা। দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংরক্ষণ করে এই বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে।
এই প্রারম্ভিক আলোচনায় বাংলাদেশ-ভারত বর্তমান প্রটোকল নৌপথ সংরক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নদীসমূহের নাব্যতা সংরক্ষণ করা যায় কিনা তার যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে পরিবেশগত কিছু সমস্যা এক্ষেত্রে বিশদ বিশ্লেষনের দাবী রাখে। যেমন, নৌযানগুলি মূলত ডিজেল চালিত। সুতরাং প্রটোকল নৌপথে ভারতীয়/বাংলাদেশি নৌযানের সংখ্যা বেড়ে গেলে নদীর পানির দূষনের হার বাড়বে। সেক্ষেত্রে দূষণরোধে কার্যকরী নীতিমালা থাকতে হবে এবং তার বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া, ছোট নদীগুলোর ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হবার কথা। ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচলের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম ঠেউ এর ফলে নদীর পাড় ভাঙ্গা একটি সধারণ সমস্যা। প্রটোকল নৌপথের ক্ষেত্রে এটি ভেবে দেখতে হবে। এমনকি বড় নদীর ক্ষেত্রেও নৌযান যদি তীর থেকে যথেষ্ট দূরে না থাকে সেক্ষেত্রেও এই সমস্যা প্রকট হতে পারে, বিশেষত যমুনার ক্ষেত্রে।
এখানে ট্রানজিট চুক্তিটির একটি মাত্র অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা করায় এটি শেষ কথা এমন বলা যাচ্ছে না। চুক্তিটি নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করে সেটিকে বাংলাদেশের পক্ষে লাভজনক করে তোলাটা সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব। তাছাড়া স্বাক্ষরিত চুক্তির ক্ষেত্রে সেটি সংশোধন-সংযোজন-পরিবর্তন-পরিবর্ধণের সুযোগ ও সীমা নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার। বস্তুতঃ এই ধরনের বিষয়ে হুটহাট করে চুক্তি না করে পাবলিক ফোরামে আলোচনা করা, সংসদে আলোচনা করা, বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহন করা উচিত ছিলো। কিন্তু তা না করে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় এটি নিয়ে এখনই আলোচনা করে এর ত্রুটিগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরতে হবে।
তৃতীয়ত্ ভারত উজানের দেশ হওয়াতে অর্ধশতাশিক আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক টানাপড়েন রয়েছে। পারস্পরিক সহযোগীতার মাধ্যমে এবং অবশ্যই বাংলাদেশের নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করে এই নদীসমূহের পানিবণ্টন চুক্তির ক্ষেত্রে প্রটোকল নৌপথ রক্ষণাবেক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি বরাদ্দ নিশ্চিত করা যেতে পারে। উদাহরনস্বরূপ যেকোন আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবন্টন চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষের সবসময়ের দাবী শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ নদীখাতের (নৌপথ, বাস্তুসংস্থান) জন্য সংরক্ষণ করে বাকি পানি সমভাবে বণ্টন করা, কিন্তু ভারত এক্ষেত্রে সবসময় বিরোধিতা করে থাকে। যদি নদীখাত সংরক্ষণ দুই দেশের জন্যই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট (যেমন প্রটোকল নৌপথ) করা যায় সেক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছানো তুলনামূলকভাবে সহজতর হতে পারে।
একই সাথে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল নৌপথ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থও আলোচনার দাবী রাখে। ভারত তার জাতীয় নৌপথ-১ এর সাথে জাতীয় নৌপথ -২ এর সংযোগ স্থাপন করতে পারে এবং সেটা প্রটোকল মেনেই। তবে এখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রটোকলের আওতায় ভারতকে তার অভ্যন্তরীন পণ্য পরিবহন করতে দেয়া যেতে পারে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। এর সাথে জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের নৌপরিবহন খাতের আয় এবং ভারতের প্রটোকল নৌপথ ব্যবহারের হার। নিঃসন্দেহে এই সুবিধা ভারতকে দিলে প্রটোকল নৌপথে ভারতীয় নৌযানের চলাচল বাড়ার কথা যা প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। আবার এর ফলে বাংলাদেশি নৌযানগুলি প্রটোকল নৌপথে এখন যে সুবিধা পাচ্ছে তা হ্রাস পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া ভাল আর তা হলো জাতীয় নৌপথ-১ এর সাথে জাতীয় নৌপথ -২ এর সংযোগ আর ভারতের ‘আন্তঃনদী সংযোগ’ এক জিনিস নয়। জাতীয় নৌপথ-১ এর সাথে জাতীয় নৌপথ -২ সংযোগ বলতে বোঝায় প্রাকৃতিক ভাবে এই সংযোগ আছে কিন্তু মাঝখানে বাংলাদেশের ভূখন্ড থাকায় নৌচলাচলের অনুমতি নেই, সেটা হতে হবে প্রটোকল নৌপথ মেনে নিয়ে। অর্থাৎ গঙ্গা-ভাগিরথী-হুগলী, ব্রহ্মপুত্র এবং বারাকের নৌপথ সংযোগ। অন্যদিকে আন্তঃনদী সংযোগের একটি উদাহরণ হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের সাথে গঙ্গার প্রবাহকে সংযোগ খালের মাধ্যমে যুক্ত করা এবং গঙ্গায় পানি বৃদ্ধি করা। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে বাংলাদেশের জন্য আন্তঃনদী সংযোগ মেনে নেয়া আত্মঘাতী একটা সিদ্ধান্ত হবে।
ভারত তার জাতীয় নৌপথ-১ এর সাথে জাতীয় নৌপথ -২ এর সংযোগ স্থাপন করলে কলকাতা বন্দর থেকে পণ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাংশে (আসাম, মনিপুর, মিজোরাম বা ত্রিপুরা) পরিবহনে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে। উদাহরণসরূপঃ সম্প্রতি ত্রিপুরা সরকারের কেনা ৭২৬ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ জেনারেটর কলকাতা বন্দর থেকে আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরায় পরিবহন এক্ষেত্রে ইতিবাচক হিসেবে দেখা যেতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে যে বিষটি লক্ষ্যনীয় তা হচ্ছে কোনটি অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনকঃ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে বাংলাদেশের সড়ক পথে ট্রানজিট নিয়ে ভারতে পরিবহন করা নাকি ভারতের কলকাতা বন্দরে পণ্য খালাস করে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল নৌপথ দিয়ে ভারতে পরিবহণ করা। দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংরক্ষণ করে এই বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে।
৫)
এই প্রারম্ভিক আলোচনায় বাংলাদেশ-ভারত বর্তমান প্রটোকল নৌপথ সংরক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নদীসমূহের নাব্যতা সংরক্ষণ করা যায় কিনা তার যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে পরিবেশগত কিছু সমস্যা এক্ষেত্রে বিশদ বিশ্লেষনের দাবী রাখে। যেমন, নৌযানগুলি মূলত ডিজেল চালিত। সুতরাং প্রটোকল নৌপথে ভারতীয়/বাংলাদেশি নৌযানের সংখ্যা বেড়ে গেলে নদীর পানির দূষনের হার বাড়বে। সেক্ষেত্রে দূষণরোধে কার্যকরী নীতিমালা থাকতে হবে এবং তার বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া, ছোট নদীগুলোর ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হবার কথা। ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচলের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম ঠেউ এর ফলে নদীর পাড় ভাঙ্গা একটি সধারণ সমস্যা। প্রটোকল নৌপথের ক্ষেত্রে এটি ভেবে দেখতে হবে। এমনকি বড় নদীর ক্ষেত্রেও নৌযান যদি তীর থেকে যথেষ্ট দূরে না থাকে সেক্ষেত্রেও এই সমস্যা প্রকট হতে পারে, বিশেষত যমুনার ক্ষেত্রে।
এখানে ট্রানজিট চুক্তিটির একটি মাত্র অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা করায় এটি শেষ কথা এমন বলা যাচ্ছে না। চুক্তিটি নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করে সেটিকে বাংলাদেশের পক্ষে লাভজনক করে তোলাটা সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব। তাছাড়া স্বাক্ষরিত চুক্তির ক্ষেত্রে সেটি সংশোধন-সংযোজন-পরিবর্তন-পরিবর্ধণের সুযোগ ও সীমা নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার। বস্তুতঃ এই ধরনের বিষয়ে হুটহাট করে চুক্তি না করে পাবলিক ফোরামে আলোচনা করা, সংসদে আলোচনা করা, বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহন করা উচিত ছিলো। কিন্তু তা না করে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় এটি নিয়ে এখনই আলোচনা করে এর ত্রুটিগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরতে হবে।