শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১০

ব্রহ্মপুত্রের উপর বাঁধ নির্মাণ শুরু করল চীন

সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষ চীন স্বীকার করল ইয়ারলুং সাংপুর (ব্রহ্মপুত্র) উপর বাঁধ নির্মাণের কথা। ২০০৯ এর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সচলায়তনে 'দক্ষিণ এশিয়ার পানিবিরোধঃ চীনের ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি প্রত্যাহার প্রকল্প' সিরিজটির শেষ পর্বে উল্লেখ করেছিলাম যে, ভারতের জাতীয় রিমোট সেন্সিং এজেন্সি এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছে যে চীন ব্রহ্মপুত্র নদীতে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে দিয়েছে। এর মন্তব্যে প্রকল্পের কথা অস্বীকার করে বলে চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র এক সাংবাদিক সম্মেলনে উল্লেখ করেছিলেন যে চীন একটি দ্বায়িত্ত্বশীল দেশ এবং এমন কিছু করবে না যা অন্যের জন্য ক্ষতিকর হবে। কিন্তু দিনের শেষে চীন দ্বায়িত্ত্বশীলতার (!!) পরিচয় দিয়েই এই বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে।

এই প্রকল্প নিয়ে চীন যা বলছে বা ভাল করে বললে সংবাদ মাধ্যম থেকে যতটুকু জানা যাচ্ছে তার সারাংশ নিম্নরূপঃ
  1. ৫১০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প হবে।
  2. এটি 'রান অফ দি রিভার প্রকল্প' অর্থাৎ নদীর প্রবাহকে কাজে লাগিয়েই টারবাইন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে ফলশ্রুতিতে এতে কোন জলাধার থাকবে না সুতরাং ভাটির অঞ্চলে প্রভাব পড়বেনা।
শুরুতেই পানিবিদ্যুতের 'রান অফ দি রিভার' পদ্ধতি একটু ব্যাখ্যা করি। সাধারণত পানিবিদ্যুৎ বলতেই আমাদের চোখে ভাসে কাপ্তাইয়ের কথা, অর্থাৎ একটি বাঁধ তার উজানে বিশাল একটি জলাধার আর বাঁধের ধারে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। কথা সত্য, সাধারণ পদ্ধতিতে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন বিষয়টা সেরকমই। যেহেতু নদীতে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পানি আসে আর শুষ্ক মৌসুমে ন্যূনতম পানি থাকে সুতরাং পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটি স্থির ধারায় পানির প্রবাহ নিশ্চিৎ করার জন্য প্রকল্পের উজানে বিশাল জলাধার নির্মাণ করা যায় যাতে বর্ষা মৌসুমের উদ্বৃত্ত পানি ধরে রাখা হয় আর শুষ্ক মৌসুমে তা ব্যবহার করা করা হয় ফলে সারা বছর একটি মোটামুটি স্থির মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সবচাইতে দুর্বল দিক হচ্ছে উজানের জলাধার নির্মাণের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় আর ভাটি অঞ্চলের নদীতে বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রবাহের কোন তারতম্য না হওয়া যা কিনা নদীর ঐ অংশের জলজ বাস্তুসংস্থান নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।সেই সাথে ভাটিতে নদী ক্ষয় এবং সেই ক্ষয়িত পলির আরো ভাটিতে পরিবাহিত হওয়াও এর মধ্যে পড়ে। এর বিপরীতে 'রান অফ থে রিভার' পদ্ধতিতে যা করা হয় তা হচ্ছে, নদীতে আড়াআড়ি বরাবর বাঁধ দিয়ে প্রবাহকে ঢালু টানেলে (Penstock) করে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়া হয় তার পর সেই ঢালু টানেলের উচ্চতার ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
Ohakuri_Dam_Blue_Penstocks
চিত্র ১- ঢালু টানেল বা Penstock [সুত্র উইকিমিডিয়া কমনস]
575px-Hydroelectric_dam.svg
চিত্র ২- ঢালু টানেল বা Penstock [সুত্র উইকিমিডিয়া কমনস]
এই পদ্ধতির সুবিধে হিসেবে বলা হয়ে থাকে উজানে পানি ধরে রাখার দরকার নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে প্রাকৃতিক প্রবাহের কারণে তাই উৎপাদনে হার পরিবর্তনশীল এবং অপেক্ষাকৃত কম।
এবারে আসি চীনের গৃহীত প্রকল্প বিশ্লেষণে। প্রকল্পটি 'রান অফ দি রিভার প্রকল্প' হবে সেকথা আমরা জানতে পেরেছি চীনের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে, সুতরাং ধরে নেয়া যায় তা কূটনৈতিক ভাবে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে তা সঠিক, তবে মেনে নেয়া বেশ কঠিন অন্ততপক্ষে প্রযুক্তিগত দিক থেকে। আশঙ্কা কেন আসে সেটা ব্যাখ্যা করছিঃ
প্রথমতঃ হিমালয়ের পাদদেশে তিব্বত বা চীনে বছরের শতকরা ৮০ ভাগ বৃষ্টিপাত হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আর বাকি আট মাসে মাত্র শতকরা ২০ ভাগ বৃষ্টিপাত হয়। তাই এই অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট সবসময়ই প্রকট। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলে 'রান অফ দি রিভার' পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প অর্থনৈতিক ভাবে ফিজিবল হবার কথা নয়।
দ্বিতীয়ত চীনের উত্তর-দক্ষিণ পানি স্থানান্তরের পরিকল্পনা এই প্রকল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত সেক্ষেত্রে মাত্র ৫১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘোষণা সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয় যেখানে চীনের আগের পরিকল্পনা ছিল ৪০০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পানিকে ইয়ারলুং সাংপু নদী থেকে স্থানান্তর করে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াঙ ও গানসু (Xinjiang and Gansu) প্রদেশে নিয়ে যাওয়া। যদিও চীন অদ্যবধি এই প্রকল্পকে অস্বীকার করে আসছে। ২০০৯ এর নভেম্বরে ভারতের তথ্য প্রমাণের বিপরীতে সেসময় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালর এই প্রকল্পের কথা অস্বীকার করেছিল। অথচ আজ মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে আমরা এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরুর ঘোষণা দেখছি। সুতরাং চীন আজকে যা বলছে যা আগামীকালের জন্য যে কতভাগ সত্য তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তৃতীয়ত আন্তর্জাতিক নদী আইন স্বাক্ষর করি আর নাই করি পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য হলেও চীনের উচিৎ ছিল এই প্রকল্পের কথা এই ভাটির দেশ ভারত ও বাংলাদেশকে পরিকল্পনা বা নির্মাণ কাজ শুরুর আগেই অবহিত করা অথচ চীন তা করেনি, অবশেষে তখন করেছে যখন হাতেনাতে ধরা পড়েছে। সুতরাং এর ভেতরে আরো কত কথা আছে তা আমাদের জানার কোন মাধ্যম নেই আপাতত।
আমি জানিনা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে চীনের সাথে কোন কূটনৈতিক আলোচনা হয়েছে কি না। সেই সাথে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমও খুব বেশি তৎপর নয় বলে আমার ধারণা কারণ এটি নিয়ে বিশেষ কোন সংবাদ অন্তত আমার চোখে পড়েনি গতকাল বা আজকে। অথচ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ত্ব বহন করে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের জন্যই।
পাদটীকা
১) চীনের ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণের ঘোষণার খবরের লিঙ্কঃ
| লিঙ্ক-১ | লিঙ্ক-২ | লিঙ্ক-৩ |
২) এই প্রকল্প নিয়ে বিস্তারিত জানা যাবে আমার 'দক্ষিণ এশিয়ার পানিবিরোধঃ চীনের ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি প্রত্যাহার প্রকল্প' সিরিজটি থেকে। আমি নিচে লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি, আগ্রহী পাঠক পড়তে পারেনঃ
| প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব | তৃতীয় পর্ব | চতুর্থ পর্ব | শেষ পর্ব |
৩) এই প্রকল্পের উপরে একটি লেখা গত ২৭ জানুয়ারী ২০১০ এ দৈনিক কালের কন্ঠের রাজকূট ফিচার পাতায় প্রকাশিত হয়। লেখাটি উপরোক্ত সিরিজের সংক্ষেপিত রূপ বা সারমর্ম। আমি নিচে লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি, আগ্রহী পাঠক পড়তে পারেনঃ
এবার ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করবে চীন
অথবা সচলায়তনের এই লিঙ্ক থেকেঃ
এবার ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করবে চীন

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন