মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর, ২০১০

তিস্তা পানিবন্টন চুক্তিঃ ইতিহাস ও পর্যালোচনা

ভূমিকাঃ


কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে চাষাবাদের ক্ষেত্রে সেচের ভূমিকা অপরিসীম আর বাংলাদেশে নদীভিত্তিক যেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প একটি সফল মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের ২০০১ সালের তথ্যমতে, এই দেশের মোট জনসংখ্যার ৮.৫ শতাংশের আবাসস্থল তিস্তা অববাহিকায় রয়েছে মোট আবাদি জমির শতকরা ১৪ ভাগ। এই অববাহিকার শতকরা ৬৩ ভাগ আবাদি জমি সেচের আওতাধীন, যেখানে দেশের গড় সেচ-আবাদি জমির শতকরা হার ৪২। সেচের পানির প্রাপ্যতা এই অঞ্চলে বছরে দুটি ফসল ঘরে তোলার সুযোগ করে দিয়েছিল। কৃষিতে উন্নতি এই অঞ্চলের কৃষক-শ্রমিকের জীবনযাত্রার মানে প্রভাব পড়েছিল। প্রাপ্ত তথ্যমতে এই প্রকল্প এলাকায় শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ। কিন্তু তিস্তায় পানির প্রবাহ ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়ায় এই প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে উত্তরবঙ্গের মানুষ।

শুরুতে পরিকল্পনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের দুটি ফেইজ ছিল, যার মধ্যে ফেইজ-১ সম্পন্ন হয়েছে যা মূলত রংপুর ও নীলফামারী জেলায় সেচের সুবিধা দিচ্ছে। দ্বিতীয় ফেইজে পরিকল্পনা ছিল দিনাজপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও জয়পুরহাটকে অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু ভারতের গজলডোবায় ব্যরেজ নির্মানের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়াতে সেই পরিকল্পনা এখন হুমকির সম্মুখীন। এই মূহুর্তে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি তাই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ।







পানিবন্টন আলোচনার ইতিহাসঃ


১৯৭২ সালে আন্তঃসীমান্ত নদীসমুহের উন্নয়নের দিককে সামনে রেখে ভারত বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (জ়েআরসি) প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ।।১৯৮৩ সালে তিস্তা নদীর ভারতীয় অংশে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ও বাংলাদেশ অংশে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে প্রায় একই সময় গ্রীষ্মকালীন সেচের জন্য ব্যারেজ নির্মান কাজ শুরু হলে তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে আলোচনা অধিক গুরুত্ত্বের সাথে বিবেচিত হতে থাকে। ব্যারেজ নির্মান করলে যেহেতু দুই দেশই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করবে সেক্ষেত্রে এই আন্তঃসীমান্ত নদীর অভিন্ন পানিবন্টন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায় মূলত ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের কাছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে ১৯৮৩ সালে যৌথ নদী কমিশনের ২৫ তম বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারত তিস্তার পানি বন্টনের জন্য একটি এডহক চুক্তি করার বিষয়ে সম্মত হয়েছিল বলে জানা যায়। সেসময় তিস্তার মোট প্রবাহের ২৫% কে অবন্টনকৃত রেখে বাকী ৭৫% শতাংশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্টন করার প্রস্তাব করা হয়েছিল যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল ৩৬% আর ভারতের ছিল ৩৯%।তবে এই বন্টন কোথায় এবং কি পদ্ধতিতে হবে সেটি নিয়ে দ্বিমতের জের ধরে সেই এডহক চুক্তিটি বাস্তবের দেখা পায়নি।







১৯৮৭ সালে ভারতের গজলডোবায় ব্যারেজ নির্মান কাজ শেষ হয়।৯.২৩ লক্ষ হেক্টর এলাকায় সেচ প্রদানের প্রকল্প হাতে নিয়ে ভারত আস্তে আস্তে ৫.৪৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের জন্য ব্যারেজ দিয়ে তিস্তার পানি প্রত্যাহার শুরু করে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারেজের নির্মান কাজ শেষ করে ১.১১ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচ প্রকল্প শুরু করে।শুরুতে ব্যারেজ নির্মানের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এই অংশে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিস্তা থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহারের ফলে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহ আস্তে আস্তে কমতে থাকে।তবে এই সময়ে তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে ইতিবাচক কোন আলোচনা হয়নি।


১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গাচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে মূলত তিস্তা পানি বন্টনের আলোচনা বেগবান হয়।গঙ্গাচুক্তির অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী, 'পক্ষপাতবিহীন ও সাম্যতাপ্রসূত এবং কোনো পক্ষেরই ক্ষতি না করে দুই সরকারই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহমান অন্যান্য আন্তসীমান্ত নদীসমূহের চুক্তির ব্যাপারে একক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে একমত'। অর্থাৎ গঙ্গাচুক্তি মেনে নিলে এই ধারা অনুযায়ী অন্য নদীগুলো নিয়ে আলোচনার বাধ্যবাধকতা দুই দেশের ওপরেই চলে আসে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সচিবপর্যায়ের বৈঠকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয় এবং যৌথ নদী কমিশনের নির্দেশক্রমে এই কমিটির কাজ ছিল মূলত তিস্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অন্যান্য অভিন্ন নদীর ক্ষেত্র স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি পানি বণ্টন ফর্মুলা প্রণয়ন করা। বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু করে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রায় সাতটি বৈঠকে মিলিত হয় তবে এই বিষয়ে কোন ঐক্যমতে দুই দেশ পৌঁছাতে পারেনি। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারী ২০১০ ভারত বাংলাদেশ যুক্ত নদীকমিশনের দুই দিন ব্যাপী সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে ইছামতি নদী খনন প্রকল্প ও ফেনী নদী থেকে পান উত্তোলন নিয়ে বাংলাদেশ ভারতে ঐক্যমতে পৌঁছেছেকিন্তু তিস্তার বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয়নি। ইছামতি নদীতে পলির কারণে উজানে, বিশেষ করে ভারতীয় অংশে, সৃষ্ট বন্যা সমস্যা ও শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ কমে যাওয়ার সমস্যা সমাধানকল্পে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদোগে ইছমতি নদী খনন করবে। ফলে ভারতে বন্যা সমস্যা দূর হবে, সেই সঙ্গে ফেনী নদী থেকে ভারত ১.৮ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে খাবার পানি প্রকল্পের জন্য। সুতরাং সহজ করে বলতে গেলে সর্বশেষ যুক্ত নদী কমিশনের বৈঠক থেকে বাংলাদেশের জন্য কিছুই আসেনি। যদিও দীর্ঘ সময় ধরে ধরে চলা আপস আলোচনায় ইছামতি ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সব সময় ছিল যে, 'একমাত্র তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত সম্মত হলেই এই দুই নদীর বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছবে।'


দুই পক্ষের প্রস্তাবঃ


এই দীর্ঘ সময়ের আলোচনার ফলেও সফল একটি পানিবন্টন চুক্তিতে না আসার মূল কারন আসলে বাংলাদেশ ও ভারত পানি বণ্টন নিয়ে একটি একক ফর্মুলায় একমত না হতে পারা। পানিবন্টনের ফর্মুলা নির্ধারনে মূলত কয়েকটি জিনিস চলে আসে। প্রথমতঃ বন্টন নদীর কোন স্থানের প্রবাহের ভিত্তিতে হবে, দ্বিতীয়তঃ কত বছরের হিস্টরিকাল প্রবাহের ভিত্তিতে বন্টন করা হবে, তৃতীয়তঃ বন্টনে নদীর নিজস্ব হিস্যা এবং দুই দেশের হিস্যা কত হবে , চুতর্থতঃ পানিবন্টনের সময়কাল কি হবে ইত্যাদি। তিস্তা ব্যারেজের পানিবন্টন আলোচনায় এই বিষয়গুলি নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা হয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের সিদ্ধান্ত মতে ভারতের দোমোহনী ও বাংলাদেশের ডালিয়াতে প্রবাহ পরিমাপ কেন্দ্রের ১৯৭৩-১৯৮৫ এই ১৩ বছরের হিস্টরিকাল প্রবাহের উপাত্ত নিয়ে পানিবন্টন ফর্মূলা নির্ধারণ করা হবে। যেহেতু ভারত ১৯৮৭ সাল থেকে গজলডোবায় ব্যারেজ চালু করে তাই এর পরের বছরের প্রবাহের উপাত্ত বিবেচনায় আনা হয়নি।পানিবন্টনের সময়কাল নির্ধারণ করা হয় প্রতিবছরের ১ অক্টোবর থেকে পরের বছর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। তবে এই বন্টনের মূল অংশ হচ্ছে হিস্যা নির্ধারণ। এক্ষেত্রে সাধারণ তিনটি হিস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, প্রথমতঃ নদীর ন্যুনতম প্রবাহ যা কিনা মৎস্য, নৌচলাচলহ সহ নদীখাত সংরক্ষণে রাখা হবে, দ্বিতীয়তঃ ভারতের অংশের হিস্যা, তৃতীয়তঃ বাংলাদেশ অংশের হিস্যা।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যৌথ নদী কমিশনের সভায় এই হিস্যা সমূহের জন্য তিনটি প্রথম উত্থাপনের চিন্তা ভাবনা করা হয়ঃ


প্রস্তাব ১ : ভারতের গজলডোবায় লব্ধ পানির শতকরা ২০ ভাগ নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকবে, আর বাকি শতকরা ৮০ ভাগ পানি বাংলাদেশ ও ভারত সমভাবে ভাগ করে নেবে।



প্রস্তাব ২ : ভারতের গজলডোবায় লব্ধ পানির শতকরা ২০ ভাগ নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকবে, আর বাকি শতকরা ৮০ ভাগ পানি ১৯৮৩ সালে প্রস্তাবিত এডহক চুক্তি অনুযায়ী ৩৬:৩৯ অনুপাতে বাংলাদেশ ও ভারত ভাগ করে নেবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ পাবে ৩৮ শতাংশ আর ভারত পাবে ৪২ শতাংশ।



প্রস্তাব ৩ : ভারতের গজলডোবায় লব্ধ পানির শতকরা ১০ ভাগ নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকবে, আর বাকি শতকরা ৯০ ভাগ পানি ১৯৮৩ সালের এডহক চুক্তি অনুযায়ী ৩৬:৩৯ অনুপাতে বাংলাদেশ ও ভারত ভাগ করে নেবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ পাবে ৪৩ শতাংশ আর ভারত পাবে ৪৭ শতাংশ।



এখানে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ মূলত প্রথম প্রস্তাবটিই যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে উত্থাপন করে। কিন্তু এই প্রস্তাব নিয়ে ভারত সম্মত না হওয়ায় বাকী দুটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা এগোয়নি। এর বিপরীতে ভারতের যুক্তি ছিল কিছুটা একপেশে। ভারত প্রস্তাব করে নদীর জন্য ১০ শতাংশ পানি রেখে বাকী ৯০ শতাংশ পানি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সেচ প্রকল্প এলাকার ভিত্তিতে বন্টন করার। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে ভারতের গজলডোবায় প্রকল্প এলাকা (৫.৪৬ লক্ষ) আর বাংলাদেশের দোয়ানীতে প্রকল্প এলাকার (১.১১ লক্ষ )অনুপাত ৫:১। সুতরাং ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের হিস্যা দাড়ায় ১৫ শতাংশ আর ভারতের ৭৫ শতাংশ। পরবর্তীতে ভারত দাবী করে যেহেতু ভারতের গজলডোবা থেকে ছেড়ে দেয়া পানি বাংলাদেশের ডালিয়া অংশে পৌঁছবে সুতরাং এই দুইয়ের মাঝখানে নদীখাত সংরক্ষণের জন্য আলাদা করে কোন প্রবাহ বন্টন দরকার নেই। আর বাংলাদেশে তিস্তা নদীর ডালিয়া থেকে ব্রহ্মপুত্রে পড়ার আগ পর্যন্ত নদীখাত সংরক্ষণের জন্য আলাদা কোন হিস্যার দরকার নেই।


নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে ব্যবচ্ছেদঃ


এখন পর্যন্ত আলোচনায় তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের প্রস্তাব এর একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবারে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে এই প্রস্তাবগুলোর একটু ব্যবচ্ছেদ করা যাক। এখানে উল্লেখ্য যে আন্তঃসীমান্ত বা ট্রান্সবাউন্ডারি নদীর ক্ষেত্রে পানিবন্টনের জন্য কোন একক সুত্রের অস্তিত্ত্ব পৃথিবীতে নেই। একমাত্র আপস আলোচনাই এনে দিতে পারে একটি মানানসই পানিবন্টন ফর্মুলার। এই বন্টন নিয়ে দেশে দেশে এমনকি এক দেশের বিভিন্ন অংগরাজ্যের মধ্যে দীর্ঘ আপস আলোচনা নজীর আছে। ভারত বাংলাদেশের গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নদীসমুহের ব্যবহার (নৌচলাচল ব্যাতিরেকে) সম্পর্কিত আইনেও আপস আলোচনার মাধ্যমে এই জাতীয় সমস্যা সমাধানের কথা বলা আছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় আলোচনার দাবী রাখে, প্রথমতঃ কোন পক্ষের ক্ষতি না, করে দ্বিতীয়তঃ সাম্যতা বা ইক্যুয়িটি, এবং তৃতীয়তঃ শেয়ার্ড স্যাক্রিফাইস বা ক্ষয় ক্ষতি ভাগ করে নেয়া ।


একটি পানিবন্টন চুক্তিতে প্রথমত লক্ষ্য রাখা উচিৎ যেন বন্টন এমন না হয় তা কোনপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়।সেই সাথে বন্টন এমন ভাবে করা উচিৎ যেন তা দুই দেশের মধ্যে সমভাবে বিস্তৃত হয়। এখানেই মূল বিপত্তি এসে দাঁড়ায় আর তা হলো ‘কোন ক্ষতি না করা’ আর সমভাবে বন্টন কিভাবে একসাথে সিদ্ধ করা যায়। নিঃসন্দেহে প্রত্যেকটি দেশ তার নিজস্ব লাভ বা ক্ষতি নিয়ে সচেতন থাকে। অনেক সময় দেখা যায় সমান ভাবে বন্টন করলে কোন দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় আবার অসমভাবে বন্টন করলে অন্য দেশটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই এক্ষেত্রে শেয়ার্ড স্যাক্রিফাইস বিবেচনা করা হয় যেখানে দুই দেশই তার কিছুটা স্বার্থ ছাড় দেবে একটি সফল বন্টন ফর্মুলার জন্য।


তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির আলোচনায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এর ভারতীয় অংশে গজলডোবা ব্যারেজ ও সেচ প্রকল্প আর বাংলাদেশের অংশে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প। এখানে উল্লেখ্য যে তিস্তার উপরে এই দুই সেচ প্রকল্প ছাড়াও রয়েছে ভারতীয় অংশে দুইটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ। সুতরাং সেই বিচারে ভারতে তিস্তার প্রবাহের গুরুত্ত্ব অপরিসীম। এখানে আরো উল্লেখ্য যে তিস্তার ভারতীয় অংশে ব্যরেজ ভারতে এই নদীর একদম ভাটিতে অবস্থিত, অর্থাৎ এর পরে তিস্তার পানি ব্যব্যহার করার সুযোগ ভারতে আর নেই। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে প্রবেশের পর তিস্তার পানির প্রথম ব্যবহার তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য। এর পরে তিস্তা নদীকে আরো অনেক পথ পাড়ি দিয়ে তিস্তামুখ ঘাট নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হতে হবে। সুতরাং বাংলাদেশে তিস্তার পানির ব্যবহার শুধুমাত্র সেচ কাজের জন্যই বরাদ্ধ নয় বরং নৌচলাচল, মৎস্য, গৃহস্থালী ও শিল্পকারখানার জন্যও পানির চাহিদা রয়েছে। সেই বিচারে নদীখাত সংরক্ষণের জন্য হিস্টরিকাল প্রবাহের ভিত্তিতে শতকরা ১০% বা ২০% পানির হিস্যার বাংলাদেশি প্রস্তাব যথেষ্ট যৌক্তিক এবং এর বিপরীতে ভারতের নদীখাত সংরক্ষণে কোন হিস্যা না রাখার প্রস্তাব নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কারন ভারত থেকে শুধুমাত্র সেচ কাজের জন্য বাংলাদেশে ছেড়ে দেয়া পানি গজলডোবা থেকে লালমনিরহাটের দোয়ানী পর্যন্ত নদীখাত সংরক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে বিবেচিত হলেও দোয়ানী থেকে তিস্তাখাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা তিস্তার পানির উপর নির্ভরশীল তা এর ফলে পানির জোগান হারাবে।


এবারে আসা যাক ভারতের সেচ প্রকল্প এলাকার অনুপাতে পানিবন্টনের যুক্তির আলোচনায়।প্রাপ্ত তথ্যমতে ভারতের গজলডোবা প্রকল্পে পরিকল্পনাধীন কমান্ড এরিয়া ৯.২৩ লক্ষ হেক্টর আর বাস্তবায়িত হয়েছে ৫.৪৬ লক্ষ্ হেক্টর। বাংলাদেশে তিস্তা ব্যরেজ সেচ প্রকল্পের পরিকল্পনাধীন কমান্ড এরিয়া ৫.৪০ লক্ষ্ হেক্টর আর বাস্তবায়িত হয়েছে ১.১১ লক্ষ হেক্টর। ভারতীয় পক্ষের যুক্তি তিস্তার পানি বন্টন হোক বাস্তবায়িত প্রকল্প এলাকার ভিত্তিতে। বাস্তবায়নের ভিত্তিতে ভারতের সেচ প্রকল্প বাংলাদেশের ৫ গুন আর তাই ৫:১ অনুপাতে পানিবন্টন করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা। অথচ পরিকল্পিত কমান্ড এরিয়া তুলনা করলে এই অনুপাত দাঁড়ায় ১৭:১০। যেহেতু তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের জন্য নির্মিত ব্যারেজ, সংযোগ খাল কিংবা অন্যান্ন স্থাপনাগুলির নকশা করা হয়েছে পরিকল্পিত কমান্ড এরিয়ার জন্য তাই বাস্তবায়িত কমান্ড এরিয়ার ভিত্তিতে পানিবন্টন না করে বরং পরিকল্পিত কমান্ড এরিয়ার ভিত্তিতে বন্টন করলে তা অধিক যৌক্তিকতার দাবী রাখে।সুতরাং কোন যুক্তিতেই ভারতের প্রস্তাব পানিবন্টন চুক্তির সাম্যতা ও কোন পক্ষের ক্ষতি না করে বা শেয়ার্ড স্যাক্রফাইস নীতিতে পড়েনা।


এপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রস্তাব সমুহের একটি ব্যবচ্ছেদ করা যাক। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া অর্ধশতাধিক নদ-নদী থাকলেও আজ পর্যন্ত সফল পানিবন্টন চুক্তি হয়েছে একমাত্র গঙ্গার ক্ষেত্রে। আর গঙ্গাচুক্তিতেই যেহেতু অন্যান্ন আন্তসীমান্ত নদীসমূহের চুক্তির ব্যাপারে একক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে একমত হবার ধারাটি রয়েছে তাই ভারতের সাথে যেকোন পানিবন্টনের খসড়াতে গঙ্গা চুক্তির অনুকরণ যৌক্তিক বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। এবারে দেখি গঙ্গা চুক্তিতে ফারাক্কায় পানিবন্টন কি অনুপাতে করা হয়েছেঃ



১) ফারাক্কায় পানির প্রবাহ ৭০,০০০ কিউসেক (১ কিউসেক=সেকেন্ড ১ ঘনফুট) এর কম হলে ভারত ও বাংলাদেশের হিস্যার অনুপাত ১:১ বা বাংলাদেশ ৫০% ও ভারত ৫০%


২) ফারাক্কায় পানির প্রবাহ ৭০,০০০-৭৫,০০০ কিউসেকের মধ্যে হলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫,০০০ কিউসেক আর ভারত পাবে বাদবাকী। এক্ষেত্রে হিস্যর অনুপাত ১:১ থেকে ৮:৭ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে অর্থাৎ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ন্যুনতম হিস্যা দাঁড়ায় ৪৭%।


৩) ফারাক্কায় পানির প্রবাহ ৭৫,০০০ কিউসেকের উপরে মধ্যে হলে ভারত পাবে ভারত পাবে ৪০,০০০ কিউসেক আর বাংলাদেশ পাবে বাদবাকী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ন্যুনতম হিস্যা দাঁড়ায় ৪৭%।


অর্থাৎ গঙ্গা চুক্তিতে বাংলাদেশের ন্যুনতম হিস্যা ছিল ৪৭%। সেই বিচারে তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রথম প্রস্তাবে নদীখাতের জন্য শতকরা ২০ ভাগ পানি বরাদ্ধ রেখে বাকী ৮০ ভাগ পানি ৪০ শতাংশ করে সমভাগে ভাগ করে নেয়ার যুক্তি কোনমতেই উচ্চাভিলাষী বলে বিবেচিত হয়না। সেই সাথে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রস্তাব অর্থাৎ শতকরা ১০ ভাগ নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ রেখে বাকি শতকরা ৯০ ভাগ পানি ১৯৮৩ সালের এডহক চুক্তি অনুযায়ী ৩৬:৩৯ অনুপাতে বাংলাদেশ ও ভারত ভাগ করে নেয়ার প্রস্তাব প্রকারান্তরে ভারতের প্রতি বাংলাদেশে বন্ধুভাবাপন্ন মতাদর্শের পরিচায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়।


বর্তমান পরিস্থিতিঃ


আগেই উল্লেখ করেছি যে ২০১০ এর জানুয়ারীতে যুক্ত নদী কমিশনের দুই দিন ব্যাপী সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে দুই পক্ষ ইছামতি ও ফেনী নদীর ক্ষেত্রে একক সমঝোতায় পৌঁছালেও তিস্তার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে না আসায় বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ভারত সফরে তিস্তাচুক্তির সম্ভাব্যতার মৃত্যু ঘটে। গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১০ কালের কন্ঠে আবেদ খানের "চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে মনমোহনের নির্দেশ" শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে তিস্তাচুক্তি নিয়ে ভারতের অবস্থানের সর্বশেষ খবর পাওয়া যায়।প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্য মতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে সাম্প্রতিক একটি খসড়া তৈরি করেছে যাতে তিস্তার পানির ৮৩ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে রেখে ১৭ শতাংশ বাংলাদেশে ছাড়ার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। এবারে এই খসড়া প্রস্তাবটিকে একটু বিশ্লেষণ করা যাক। ৮৩% ও ১৭% এর আনুপাতিক হার হচ্ছে ৫:১ অর্থাৎ ভারতের সর্বশেষ খসড়াটিতেও তিস্তার দুই পার্শে সেচ প্রকল্পের বাস্তবায়িত কমান্ড এরিয়ার অনুপাতে পানিবন্টনের স্বপক্ষে তাদের আগের অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি উপরন্তু ইতিপূর্বে যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠকে গৃহীত ১০% হিস্যা নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দেরও বলি ঘটেছে এই খসড়ায়। উল্লেখিত প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা যায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেচ দপ্তরের মন্ত্রী সুভাষ নস্কর ওই খসড়ার নোটে লিখেছেন, “যেহেতু বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেশ, তাই শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানির ২৫ শতাংশ বাংলাদেশকে দিলেও রাজ্যের কোনো ক্ষতি নেই।“ মন্ত্রীর মন্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশের হিস্যা ২৫% হলেও ভারতের কোন ক্ষতি হবেনা অথচ এই ২৫% পানির হিস্যা পেলে বাংলাদেশের কি ক্ষতি হবে যে সম্পর্কে তারা আদৌ ওয়াকেবহাল নয় এবং হয়ত প্রয়োজনও অনুভব করেনি। সেক্ষেত্রে শেয়ার্ড স্যাক্রিফাইসের কোন নমুনা এই খসড়ায় দেখা যায়না অথচ ইতিপূর্বে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে দুই পক্ষই এই মর্মে সম্মত হয় যে দু’দেশের মধ্যে পানিবন্টন শেয়ার্ড স্যাক্রিফাইস নীতির ভিত্তিতে হবে।


আমাদের করণীয়ঃ

তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে একটি সফল সমাপ্তির ক্ষেত্রে আপস আলোচনার বিকল্প নেই।তবে সফল আপস আলোচনার জন্য সমস্যা সমাধানের মানসিকতা থাকতে হবে। বলতে দ্বিধা নেই প্রয়োজনীয়তার দিক বিবেচনায় তিস্তার পানিবন্টন বাংলাদেশের জন্য অধিক জরুরী কিন্তু সার্বিক ভাবে প্রতিবেশি এবং বন্ধুপ্রতিম দুটি দেশের জন্য নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই চুক্তি উভয় দেশের জন্যই ইতিবাচক। তবে যেহেতু দুই দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তির অনুচ্ছেদ ৯ উল্লেখ আছে 'পক্ষপাতবিহীন ও সাম্যতাপ্রসূত এবং কোনো পক্ষেরই ক্ষতি না করে দুই সরকারই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহমান অন্যান্য আন্তসীমান্ত নদীসমূহের চুক্তির ব্যাপারে একক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে একমত', সেক্ষেত্রে সাম্যতা বজায় রেখে ও শুধু একপক্ষের ক্ষতি সাধন না করে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করা দুই দেশের জন্যই কিছুটা বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে পড়ে। তাছাড়া ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ভারতকে ইছামতি ও ফেনী নদীর ক্ষেত্রে যে ছাড় প্রদান করেছে সেই বিষয়টিও আলোচনায় উল্লেখ করা উচিত। এখানে মনে রাখা উচিৎ যে দুই পক্ষই তাদের স্ব স্ব অবস্থানে অনড় থাকলে এই প্রক্রিয়া শুধুই বিলম্বিত হবে। এপর্যায়ে ভারত কতৃক উত্থাপিত সেচ প্রকল্পের কমান্ড এরিয়ার ভিত্তিতে পানিবন্টন ফর্মুলাকে সংশোধিত করে আলোচনা করা যেতে পারে।দুটি প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারেঃ


প্রস্তাব ১: ২০% হিস্যা নদীখাতের জন্য বরাদ্দ রেখে বাকী ৮০% পানি ভারত ও বাংলাদেশের সেচ প্রকল্পের পরিকল্পিত এলাকার ভিত্তিতে (ভারত কতৃক উত্থাপিত বাস্তবায়িত এলাকার ভিত্তিতে নয়) বন্টন করার কথা প্রস্তাব করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ১৭:১০ অনুপাতে বাংলাদেশের হিস্যা হবে ৩০% ও ভারতের ৫০%। নদীখাতের জন্য ছেড়ে দেয়া পানি যেহেতু মূলত বাংলাদেশে প্রবেশ করবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট হিস্যা দাড়াবে ৫০% আর ভারতের ৫০%।


প্রস্তাব ২: ১০% হিস্যা নদীখাতের জন্য বরাদ্দ রেখে বাকী ৯০% পানি ভারত ও বাংলাদেশের সেচ প্রকল্পের পরিকল্পিত এলাকার ভিত্তিতে (ভারত কতৃক উত্থাপিত বাস্তবায়িত এলাকার ভিত্তিতে নয়) বন্টন করার কথা প্রস্তাব করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ১৭:১০ অনুপাতে বাংলাদেশের হিস্যা হবে ৩৪% ও ভারতের ৫৬%। নদীখাতের জন্য ছেড়ে দেয়া পানি যেহেতু মূলত বাংলাদেশে প্রবেশ করবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মোট হিস্যা দাড়াবে ৪৪% আর ভারতের ৫৬%।



এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে শতকরা কতভাগ পানি নদীখাতের জন্য বরাদ্দ থাকলে তা নৌচলাচল, শিল্পকারখানা সহ মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণে সহায়ক হবে সে বিষয়ক তথ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের থাকা উচিত। সেই মোতাবেক উপরের প্রস্তাব দুটিকে পরিবর্তন করা যেতে পারে।পরিশেষে আশা করি সফল কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে উপনীত হবে, রক্ষা পাবে আমাদের গর্ব তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প আর সেইসঙ্গে আশার আলো দেখবে তিস্তার ওপর নির্ভরশীল উত্তরবঙ্গের মঙ্গাপীড়িত মানুষ।


বিদ্রঃ লেখাটি দৈনিক কালের কন্ঠের রাজকূট ফিচার পাতার জন্য লেখা। লেখাটি  প্রকাশিত হয়েছে ১৩ অক্টোবর ২০১০ তারিখে (বাংলাদেশ সময়)।