সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১০

ভারতের এক পেশে তিস্তা চুক্তির খসড়া

কালের কন্ঠে আজ ২১ সেপ্টেম্বর ২০১০ আবেদ খানের "চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে মনমোহনের নির্দেশ" শীর্ষক প্রতিবেদনটি বিশদ পড়ে যার পর নাই বিষ্মিত হয়েছি। শিরোনামটি ভারত বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক হলেও এর ভেতরে তিস্তা নদীর পানিবন্টন নিয়ে প্রাপ্ত তথ্য বাংলাদেশের জন্য চরম হতাশা এবং তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের জন্য অপরিনাম দূর্গতি নিয়ে আসতে পারে ভবিষতে।প্রতিবেদনে উল্লেখিত তথ্য মতে পশ্চিমবংগ রাজ্য সরকার তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে একটি খসড়া তৈরি করেছে যাতে তিস্তার পানির ৮৩ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে রেখে ১৭ শতাংশ বাংলাদেশে ছাড়ার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে।  সবচেয়ে হাস্যকরে হচ্ছে নিচের লাইনটিঃ



"তবে দুই দেশের 'বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের' ইতিহাস টেনে রাজ্য সরকারের সেচ দপ্তরের মন্ত্রী সুভাষ নস্কর ওই খসড়ার নোটে লিখেছেন, যেহেতু বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেশ, তাই শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানির ২৫ শতাংশ বাংলাদেশকে দিলেও রাজ্যের কোনো ক্ষতি নেই।" 

চমৎকার বন্ধুত্বের নমুনা দেখানো হয়েছে পশ্চিমবংগ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে।এরকম নমুনা  বন্ধুত্বের নতুন সংগায়নের দাবী রাখে। ঠিক জানিনা বাংলাদেশে সরকারের এই মূহুর্তে প্রতিক্রিয়া কি। তবে নিঃসন্দেহে ভারতের এই অবস্থানের পেছনে সর্বশেষ যুক্ত নদী কমিশনের সভায় ব্যাপারে কূটনীতিতে আমাদের কিছু দৌর্বল্যকে দায়ী করা যেতে পারে।

তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনার ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও ( ১৯৭২ সাল থেকে) এই বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় আসলে গঙ্গাচুক্তির পর থেকে (১৯৯৬)। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সচিবপর্যায়ের বৈঠকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয় এবং যৌথ নদী কমিশনের নির্দেশক্রমে এই কমিটির কাজ ছিল মূলত তিস্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অন্যান্য অভিন্ন নদীর ক্ষেত্র স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি পানি বণ্টন ফর্মুলা প্রণয়ন করা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তিস্তার পানি বণ্টন (প্রতিবছর ১ অক্টোবর থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ এপ্রিল) নিয়ে তিনটি প্রস্তাব আলোচিত হয়েছে।

প্রস্তাব ১ : ভারতের গজলডোবায় লব্ধ পানির শতকরা ২০ ভাগ নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকবে, আর বাকি শতকরা ৮০ ভাগ পানি বাংলাদেশ ও ভারত সমভাবে ভাগ করে নেবে।

প্রস্তাব ২ : ভারতের গজলডোবায় লব্ধ পানির শতকরা ২০ ভাগ নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকবে, আর বাকি শতকরা ৮০ ভাগ পানি ১৯৮৩ সালে প্রস্তাবিত এডহক চুক্তি অনুযায়ী ৩৬:৩৯ অনুপাতে বাংলাদেশ ও ভারত ভাগ করে নেবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ পাবে ৩৮ শতাংশ আর ভারত পাবে ৪২ শতাংশ।

প্রস্তাব ৩ : ভারতের গজলডোবায় লব্ধ পানির শতকরা ১০ ভাগ নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকবে, আর বাকি শতকরা ৯০ ভাগ পানি ১৯৮৩ সালের এডহক চুক্তি অনুযায়ী ৩৬:৩৯ অনুপাতে বাংলাদেশ ও ভারত ভাগ করে নেবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ পাবে ৪৩ শতাংশ আর ভারত পাবে ৪৭ শতাংশ।

এর বিপরীতে ভারতের প্রস্তাব ছিল অতিমাত্রায় একপেশে; যাতে উল্লেখ করা হয়, শতকরা ১০ ভাগ পানি নদীর জন্য রেখে ভারতের গজলডোবা ও বাংলাদেশের দোয়ানীতে সেচ প্রকল্পের কমান্ড এরিয়ার অনুপাতে পানি বণ্টন করা হবে। গজলডোবায় সেচ প্রকল্পের কমান্ড এরিয়া ৫.৪৬ লাখ হেক্টর আর দোয়ানীতে ১.১১ লাখ হেক্টর_সেই বিচারে ১০ শতাংশ পানি নদীর জন্য রেখে বাকি ৯০ শতাংশ পানি ৫:১ অনুপাতে বণ্টন করার প্রস্তাব করে ভারত, যাতে বাংলাদশের ভাগে জুটবে মাত্র ১৫ শতাংশ আর ভারতের ভাগে ৭৫ শতাংশ।

এই সুদীর্ঘ সময়ে যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন তিস্তা ছাড়াও ইছামতি ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন নিয়েও আলোচনা করেছে। যদিও প্রায় এক যুগ ধরে চলা আপস আলোচনায় ইছামতি ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সব সময় ছিল যে,

'একমাত্র তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত সম্মত হলেই এই দুই নদীর বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছবে।' 


অথচ প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ভারত সফরে যুক্ত নদী কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইছামতি ও ফেনী নদী নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছে তিস্তার পানিবন্টনকে বাদ দিয়েই। ইছামতি নদীতে পলি সমস্যার কারনে উজানে বিশেষ করে ভারতীয় অংশে বন্যা সমস্যা দেখা দিত আর মৌসুমে প্রবাহ কমে যেত সুতরাং বাংলাদেশ ভারত যৌথ উদোগে ইছমতি মদী খনন করলে ভারতের বন্যা সমস্যা দূর হবে, অন্যদিকে ফেনী নদী থেকে ভারত ১.৮ কিউমেক পানি উত্তোলন করবে খাবার পানি প্রকল্পের জন্য এবং এই দুই সেই বিষয়েই ঐক্যমতে পৌঁছেছে ভারত ও বাংলাদেশ।

পশ্চিমবংগ সরকারের সর্বশেষ খসড়ায় ( বাংলাদেশ ১৭%, ভারত ৮৩%) আমরা ভারতের আগের অবস্থানেরই ( বাংলাদেশ ১৫%, ভারত ৭৫%, নদীর জন্য ১০%) পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি উপরন্তু  নদীর জন্য রেখে দেয়া ১০% থেকে ভারত নিয়েছে ৮% আর বাংলাদেশকে দিতে চাচ্ছে ২%। তাহলে আলোচনা করে কি অগ্রগতি হলো অথচ মাঝখান দিয়ে ভারতকে ইছামতি আর ফেনি নদীর ক্ষেত্রে সুবিধা দেয়া হলো।

এক্ষেত্রে একটি আইনগত বাধ্যবাধকতার কথা বলা প্রয়োজন। গঙ্গাচুক্তির অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী, 'পক্ষপাতবিহীন ও সাম্যতাপ্রসূত এবং কোনো পক্ষেরই ক্ষতি না করে দুই সরকারই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহমান অন্যান্য আন্তসীমান্ত নদীসমূহের চুক্তির ব্যাপারে একক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে একমত'। অর্থাৎ গঙ্গাচুক্তি মেনে নিলে এই ধারা অনুযায়ী অন্য নদীগুলো নিয়ে আলোচনার বাধ্যবাধকতা দুই দেশের ওপরেই চলে আসে।  সেই সাথে  'পক্ষপাতবিহীন ও সাম্যতাপ্রসূত এবং কোনো পক্ষেরই ক্ষতি না করে' কথাটি মেনে নিলে ভারতের ৭৫:১৫ কিংবা ১৭:৮৩ অনুপাতের বণ্টনের যুক্তি ভিত্তিহীন এবং প্রকারান্তরে তা গঙ্গাচুক্তি লঙ্ঘনের শামিল।

আশা করি বাংলাদেশ সরকার সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে এক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সেই সাথে আলোচনার নামে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণেরও ইতি ঘটবে।

আগ্রহী পাঠক ইচ্ছে করলে এই বিষয়ে ইতিপূর্বে প্রকাশিত দুটি নিবন্ধ পড়ে দেখতে পারেনঃ
সচলায়তনেঃ  
দৈনিক কালের কন্ঠেঃ
প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন