শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১০

ট্রান্সবাউন্ডারি নদীপথ বাংলাদেশ ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক

ভূমিকাঃ

একটি দেশ গড়ে উঠে রাজনৈতিক ভাবে, ফলে তার একটি রাজনৈতিক গন্ডি বা সীমারেখা থাকে। অন্যদিকে নদীর জন্ম হয় ভূপ্রকৃতি আর জলবায়ুকে কেন্দ্র করে, ফলে তার বিস্তৃতিও হয় প্রাকৃতিক ভাবে। একটি নদী মূলত একটি নির্দীষ্ট ভূপ্রাকৃতিক এলাকার পানিকে তার নিজের ভেতর ধারণ করে অর্থাৎ ঐ নির্দীষ্ট ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলে বৃষ্টি হলে তার পানি সর্বশেষে ঐ নদীতে প্রবাহিত হয়। এই বিশেষ অঞ্চলকে নদী অববাহিকা বলা হয়। বাংলাদেশে মূলত চারটি নদী অববাহিকা রয়েছেঃ গঙ্গা-পদ্মা নদী অববাহিকা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী অববাহিকা, সুরমা-মেঘনা নদী অববাহিকা এবং চট্টগ্রাম অঞ্চল নদী অববাহিকা। এর মধ্যে শেষেরটি বাদে বাকি তিনটি মিলে গঠিত হয়েছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা যা মেঘনা নদী নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের নদীভিত্তিক পানিসম্পদের সিংহভাগ আসে এই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকা থেকে। সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে নদীমাতৃক বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি কিংবা মানুষের জীবন যাপনের সাথে জড়িয়ে আছে এই অববাহিকা।





ছবিঃ ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা-মেঘনা নদী অববাহিকা ( সুত্রঃ বাংলাপিডিয়া)

প্রাকৃতিক ভাবে নদীঅববাহিকা বা নদীর গতিপথ ও প্রবাহ রাজনৈতিক সীমারেখা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়না। একটি নদীর গতিপথ যখন রাজনৈতিক ভাবে দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বিভক্ত হয় তখন তাকে আন্তঃসীমান্ত বা ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার বলে। এই ট্রান্সবাউন্ডারি নদীগুলোর প্রবাহকে যখন রাজনৈতিক ভাবে নিয়ন্ত্রন করার প্রয়াস আসে তখনই ঐ দেশগুলোর মধ্যে তা নিয়ে সমস্যা শুরু হয় যা আস্তে আস্তে দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে মোট ৫৮ টি ট্রান্সবাউন্ডারি নদী রয়েছে যার মধ্যে সাঙ্গু, মাতামুহুরি আর নাফ বাদে বাকী ৫৫ টিই এসেছে ভারত থেকে। ভারতের সাথে এই ট্রান্সবাউন্ডারি নদীগুলো নিয়ে বাংলাদেশের রয়েছে সংকট নিরসনে দীর্ঘ আলোচনার ইতিহাস। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশের উজানে রয়েছে ভারতের ফাঁরাক্কা ব্যারেজ যার পানিবন্টন নিয়ে ভারত বাংলাদেশের (ও পূর্ব পাকিস্তানের) প্রায় ৪৫ বছরের আলোচনার ইতিহাস রয়েছে যা আপাতত শেষ হয়েছে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তির মাধ্যমে, তিস্তা নদীর পানিবন্টন নিয়ে নিয়ে গত ৩৮ বছর ধরে আলোচনা চলছে, মেঘনার উজানে ভারতের বারাক নদীতে নির্মিতব্য টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সাম্প্রতিক কালে আলোচনা পর্যালোচনা চলছে, মনু ও ফেনী নদী নিয়ে সাম্প্রতিক কালে বন্টন চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ব্রহ্মপুত্র নদীতে চীনের বাঁধ নির্মান নিয়েও বাংলাদেশের সাথে ভারতের আলোচনার সুযোগ রয়েছে। সুতরাং সার্বিক ভাবে বাংলাদেশ ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে এই ট্রান্সবাউন্ডারি নদী। আজকের আলোচনায় এই ট্রান্সবাউন্ডারি নদী এবং তা নিয়ে ভারত বাংলাদেশ কুটনৈতিক সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ করা হবে। এই আলোচনায় মূলত গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ এবং তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে আলোচনার ইতিহাস তুলে ধরা হবে। সেই সাথে থাকবে প্রযুক্তিগত আলোচনা এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে কিছু পর্যালোচনা।


গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তিঃ

আমাদের দেশে যাকে আমরা বলি প্রমত্তা পদ্মা সেটারই ভারতের অংশের নাম গঙ্গা।গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করে শুভ্র হওয়া বাঙ্গালীর কাছে গঙ্গা বা পদ্মা শুধু একটি নদীর নামই নয় বরং তা আমাদের শাশ্বত বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক ও বাহকও বটে। হিমালয় পর্বতমালার গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন ভাগীরথী নদী আর নন্দা দেবী, ত্রিশুল, ক্যামেট ইত্যাদি হিমবাহ থেকে উৎপন্ন অলকানন্দা এই দুটি উপনদী মিলেই গঙ্গার মূল ধারাটির সৃষ্টি হয়েছে । পরবর্তীতে জাহ্নবী নদীও এর সাথে মিলিত হয়ে সম্মিলিত প্রবাহ হিমালয়ের গিরীসঙ্কট পার হয়ে ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের গোয়ালন্দে এসে এটি যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে এবং এই সম্মিলিত ধারাটি পরে আবার চাঁদপুরে সুরমা আর কুশিয়ারার মিলিত প্রবাহের সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নির্মান করা কলকাতা বন্দর ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে পূরাতন বন্দর ও একসময়কার প্রধান বন্দর ছিল। হুগলী নদীর তীর ঘেঁষে এই কলকাতা বন্দরে ষাটের দশকে নদী থেকে বয়ে আসা বিপুল পলি বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধা সৃষ্টি করে। যার প্রতিকারে ভারত সরকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় ১৯৫১ সালে, যাতে গঙ্গা নদীতে ব্যারেজ নির্মান করে একটি বিকল্প খাল দিয়ে গঙ্গার পানিকে হুগলী নদীতে প্রবাহিত করে বন্দরের সঞ্চিত পলিকে স্থানচ্যুত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই পরিকল্পনা পরিশেষে বাস্তবায়িত হয় ১৯৭৪-৭৫ সালে ‘ফারাক্কা ব্যারেজ’ নামে।

১৯৫১ সালে ফারাক্কা ব্যারেজের পরিকল্পনা প্রকাশের পর থেকে শুরু হওয়া বিতর্ক, আলোচনা ও সংঘাতের অবসান ঘটে ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তির মাধ্যমে। শুরুতে ব্যারেজ নির্মানের পূর্বেই গঙ্গার পানির সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করার চেষ্টা ছিল বাংলাদেশের ( তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)। ফলশ্রুতিতে মূল আলোচনা কেন্দ্রীভুত ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের নিজস্ব দাবীদাওয়া এবং তার যৌক্তিকতার মধ্যে। বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পর বিপরীতে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশ গঙ্গার পানির সম্পূর্ন প্রবাহের দাবীতে অটুট থাকে এবং দাবী করে যে ফারাক্কার আরো উজানে অবস্থিত জলাধার সমুহ ভারতের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট, সেই সাথে গঙ্গায় ব্যারেজ নির্মান করে এর প্রবাহকে বিকল্প খাল দিয়ে হুগলী নদীতে স্থানান্তর করে কলকাতা বন্দরের পলি সমস্যা সমাধানের কারিগরী দিকের পরিকল্পনারও সমালোচনা করে। অন্যদিকে ভারত দাবী করে যে বাংলাদেশের আসলে খুব বেশী পরিমান পানি প্রবাহের দরকার নেই কারন গঙ্গায় প্রবাহিত পানির সিংহভাগই বঙ্গোপসাগরে অপচয় হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এই বিষয়ে প্রথম অগ্রগতি হয় যখন এই আন্তঃসীমান্ত নদীসমুহের উন্নয়নের দিককে সামনে রেখে সংযুক্ত নদী কমিশন (জ়েআরসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সাথে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মতৈক্যের ভিত্তিতেই ব্যারেজের কার্যক্রম শুরু হয় যাতে উল্লেখ থাকে যে ভারত বিকল্প খাল দিয়ে ১১,০০০ থেকে ১৬,০০০ কিউসেক ( ১ কিউসেক=প্রতি সেকেন্ডে ১ ঘনফুট পানির প্রবাহ) পানি গঙ্গা থেকে অপসারন করবে আর বাকী প্রবাহ বাংলাদেশে চলে যাবে। এই পরীক্ষামুলক পানিবন্টন মাত্র ৪১ দিন স্থায়ী হবার পর ১৯৭৬ সালে আগের মতৈক্যের নবায়ন না করে ভারত একতরফা ভাবে গঙ্গার পানি অপসারন করে যার ভয়াবহ প্রভাব পড়ে পদ্মানদী কেন্দ্রিক বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপর এবং একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৭৭ সালে। বাংলাদেশ বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করে এবং সাধারন পরিষদ এক্ষেত্রে একটি মতৈক্যের বিবৃতি দেয় যার ফলশ্রুতিতে বিষয়টির একটি সুষ্ঠূ সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত ঢাকাতে মন্ত্রীপরিষদ পর্যায়ের বৈঠকের ব্যাপারে একমত হয়। ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারী থেকে মে) গঙ্গার পানি প্রবাহ বন্টনের বিষয়ে একটি পাঁচ বছর মেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে, ২১ থেকে ৩০ এপ্রিল এই দশ দিন সময়ের মধ্যে বাংলাদশের জন্য ৩৪,৫০০ কিউসেক এবং ফারাক্কার বিকল্প খাল দিয়ে কলকাতা বন্দরের জন্য ২০,৫০০ কিউসেক পানি বরাদ্দ করা হয়।সেই সাথে চুক্তিতে পানি বন্টনের (১০ দিনের ভিত্তিতে) জন্য একটি নির্দীষ্ট সময়সুচী নির্ধারন করা হয়। আগেই বলেছি যে ফারাক্কায় গঙ্গার পানি বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল ফারাক্কার উজানে ভারতে বা নেপালে জলাধার নির্মান করে বর্ষা মৌসুমে পানি সঞ্চয় করা, অপরদিকে ভারতের প্রস্তাব ছিল ব্রহ্মপুত্র থেকে সংযোগ খাল কেটে গঙ্গাতে পানি বৃদ্ধি করা এবং কোন দেশের প্রস্তাবই অন্য দেশ কতৃক গৃহীত হয়নি। ফলশ্রুতিতে 'চুক্তির আইনগত বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত হয়নি' এই অজুহাতে ১৯৭৭ সালের পানি চুক্তি ১৯৮২ সালের নভেম্বরের পরে আর নবায়ন করা সম্ভব হয়নি ।১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালের শুস্ক মৌসুমের পানি বন্টনের জন্য জন্য ১৯৮২ সালেরই অক্টোবর মাসে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্টান্ডিং ‘৮২) স্বাক্ষরিত হয়। ’৮২ এর সমঝোতা স্মারক ১৯৮৪ সালে মেয়াদউত্তীর্ন হয়ে যায় এবং পরবর্তী বৎসর গুলির জন্য কোন আনুষ্ঠানিক সমঝোতাই আর বাকী থাকেনা। বাংলাদেশ তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যায় একটি আনুষ্ঠানিক সমঝোতার জন্য কিন্তু ব্যার্থ হয়। কোন সমঝোতা না থাকায় ১৯৮৫ সালের শুস্ক মৌসুমে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়। পরবর্তীতে আরো অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে দুই দেশ ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে আরও একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে যা কিনা ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত শুস্ক মৌসুমের জন্য বহাল থাকবে। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে কোন চুক্তি না থাকায় ভারত একতরফা ভাবে গঙ্গার পানি বিকল্প পথে হুগলী নদীতে স্থানান্তর করে যার ভয়াবহ প্রভাব বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান স্বাদু পানির প্রবাহ গড়াই নদী যা কিনা গঙ্গারই শাখানদী শুস্ক মৌসুমে সম্পুর্নভাবে শুকিয়ে যায়। ভারতের এই একচেটিয়া পানি উত্তোলনের হলে ১৯৯২ সালের মার্চে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে গঙ্গায় ইতিহাসের সর্বনিম্ন প্রবাহ (১২,৫২১ কিউসেক) পরিলক্ষিত হয় অথচ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই সময়ের গড় প্রবাহ হওয়া উচিৎ ছিল ৭৫,০০০ কিউসেক । এই পর্যায়ে পানিবন্টনের জন্য আলোচনা চলতে থাকলেও তার কোন সফলতা পরিলক্ষিত হয়নি।১৯৮৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের সরকার প্রধানের বৈঠকে গঙ্গা সহ অন্যসব আন্তসীমান্ত নদীসমুহের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী পানির প্রবাহ বন্টন সমীকরন প্রনয়নের জন্য উভয় দেশের পানিসম্পদ সচিবদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়।১৯৯০ এর এপ্রিল থেকে ১৯৯২ এর ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এই তিন বছরের মধ্যে সচিব কমিটি ঢাকা ও দিল্লীতে পরপর ৬ বার মিলিত আলোচনায় বসে।তাদের মূল গুরুত্ত্বের বিষয়টি ছিল জরুরী ভিত্তিতে গঙ্গা ও তিস্তার পানি বন্টন। কিন্তু দূঃখের ব্যাপার হল এই কমিটিও পানিবন্টনের কোন গ্রহনযোগ্য নীতি নির্ধারন করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেরই সরকার পরিবর্তনের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় পর্যায়ে পানি বন্টনের বিষয়টি পুনরালোচনায় আসে এবং শীঘ্রই এই বিষয়ে একটি সমাধানের ক্ষেত্রে উভয় দেশ একমত হয়। পরিশেষে সুদীর্ঘ সময়ের উত্তেজনাপুর্ন কার্যক্রমের পর ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ঐতিহসিক গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ১৯৯৭ সালের জানুয়ারী থেকে কার্যকর হয় যা ২০২৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হবে।


টিপাইমুখ বাঁধঃ

১৯৩০ সালের দিকে ভারতের আসামের কাছাড় উপত্যকায় এক ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হবার পর থেকেই মূলত একটি দীর্ঘমেয়াদী বন্যা নিয়ন্ত্রন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৫৪ সালে ভারতের সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন একটি বহুমুখী জলাধারের জন্য সমীক্ষার কাজ হাতে নেয়। বাঁধ তৈরীর জন্য মাইনাধর, ভুবনধর ও নারাইনধর নামক আরো তিনটি প্রস্তাবিত স্থান প্রকৌশলগত কারনে বাতিল হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৪ সালে টিপাইমুখ বাঁধের চুড়ান্ত স্থান হিসেবে নির্ধারিত হয়। এই স্থানটি তুইভাই নদী ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থল থেকে ৫০০ মিটার ভাটিতে এবং বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ২০০ কিমি উজানে। এই বরাক নদীই বাংলাদেশে প্রবেশের আগে দু’ভাগ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে প্রবেশ করেছে, যা পরিশেষে মিলিত হয়েই মূলত মেঘনা নদী গঠন করেছে। এই সুরমা-মেঘনা নদী সিস্টেম গঙ্গা বদ্বীপ তৈরীর তিনটি সিস্টেমের মধ্যে একটি।

প্রাপ্ত তথ্যমতে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ একটি রকফিল ড্যাম, উচ্চতা ১৬২.৮ মিটার, নুন্যতম বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪৩৪ মেগাওয়াট, সর্বোচ্চ ক্ষমতা ১৫০০ মেগাওয়াট, বাঁধের কারনে সৃষ্ট জলাধারের ফলে প্লাবিত এলাকা প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার যাত প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগই মনিপূর রাজ্যের আর বাকী ৫ ভাগ মিজোরাম রাজ্যের। এই বাঁধ নির্মানে ভারতের ব্যাপক উৎসাহের পেছনে কিছু তথ্য হচ্ছে এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষদের উন্নয়নের পথে নিয়ে আসা যাবে(ভারতের অন্যান্য রাজ্যের গড় বিদ্যুতের ব্যবহার যেখানে ২৭০ কিলোওয়াটঘন্টা সেখানে এই অঞ্চলে তা মাত্র ৮০ কিলোওয়াট ঘন্টা), এটি বন্যা নিয়ন্ত্রন করবে যা বাৎসরিক ৪৫ কোটি রূপীর ক্ষয়ক্ষতি রোধ করবে। টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্প থেকে ৯৫ কিলোমিটার ভাটিতে ফুলেরতল ব্যারেজ নির্মানের প্রস্তাব রয়েছে যা পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ছেড়ে দেয়া পানিকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ১,২০,৩৩৭ হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় নিয়ে আসবে, প্রকল্পের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম হ্রদে মৎস্য চাষের মাধ্যেমে বার্ষিক আয় হবে ১৪ কোটি টাকা, প্রকল্প এলাকা একটি উৎকৃষ্ট পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে এবং সৃষ্ট হ্রদ উজানের এলাকার মানুষদের নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করবে সেই সাথে প্রকল্পের ফলে বছরের বিভিন্ন সময় নদীর পানির গভীরতার উঠা নামা কমে যাওয়ায় কলকাতা বন্দর থেকে বাংলাদেশ হয়ে শীলচর পর্যন্ত পন্য পরিবহণের সম্ভাব্যতা দেখা যাবে।

প্রকৃতির একটি নিজস্ব ছন্দ আছে আর আমরা যখন সেই ছন্দকে পরিবর্তিত করি প্রকৃতি তার শোধ নেয় তার নিজের মত করে। আজ থেকে এক দুই দশক আগেও আমরা পরিবেশ নিয়ে আগে এতটা উৎসুক ছিলামনা যতটা আজকে আছি। আগে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রয়োজন দেখা হত আর এখন মানুষই শুধু না সেই সাথে জীববৈচিত্রের ভালমন্দ দেখভাল করার দায়িত্ত্বও আমাদের কারন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমাদের বেঁচে থাকা আসলে নির্ভরশীল একটি পরিপূর্ন বাস্তুসংস্থানের উপর। সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে এই সব কিছু সম্পর্কিত, আর তাই আমরা আজ পরিবেশ নিয়ে অনেক সচেতন । একটি বাঁধের মূলত দুই দিকেই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, প্রথমতঃ বাঁধের উজানে আর দ্বিতীয়তঃ বাঁধের ভাটিতে।যেকোন বাঁধই তার উজানে একটি কৃত্রিম জলাধার তৈরী করে এবং এই জলাধারকে কেন্দ্র করেই কিন্তু উজানে বাঁধের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে ভাটিতে মূল সমস্যা সৃষ্টি করে বাঁধের কারনে সৃষ্ট নিয়ন্ত্রিত প্রবাহ। অর্থ্যৎ ভাটিতে আগে যেখানে প্রাকৃতিক ভাবে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হতো সেখানে বাঁধের কারনে প্রবাহের পরিমান কৃত্রিম ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। এই প্রবাহের মান ও বছরের বিভিন্ন সময়ে তার বন্টনের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হবে তার উপর নির্ভরশীল জীব বৈচিত্র এবং পরিবেশ। একথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশ টিপাইমুখের ভাটিতে থাকায় বাংলাদেশে তার প্রভাব পরবে দ্বিতীয় ভাবে।

এখন পর্যন্ত গবেষণামতে টিপাইমুখ প্রকল্পই বাংলাদেশের ইতিবাচক নয়। FAP 6 (ফ্লাড একশন প্ল্যান), IWM( ইনষ্টিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং) কিংবা টিপাইমুখ প্রকল্পের EIA (পরিবেশগত প্রভাব যাচাই) রিপোর্টে যেটি প্রথমেই উঠে এসেছে তা হলো বাঁধের কারনে বর্ষা মৌসুমে পানি প্রবাহের হ্রাস এর বিষয়টি। FAP 6 এর রিপোর্টে বলা হয়েছে বাঁধের কারনে বর্ষা মৌসুমে অমলসিদে পানির প্রবাহ ২৫% হ্রাস পাবে, অন্যদিকে IWM এর রিপোর্টে উঠে এসেছে যে জুন, জুলাই আগষ্ট আর সেপ্টেম্বরে পানির প্রবাহ হ্রাস পাবে যথাক্রমে ১০%, ২৩%, ১৬%, ১৫% অর্থাৎ এই চার মাসে গড়ে ১৬% প্রবাহ কমবে। একই চিত্র দেখা যায় ভারতের EIA রিপোর্টে, যেখানে ৩০% প্রবাহ হ্রাসের কথা বলা হয়েছে। এই পানি প্রবাহ হ্রাসের কথা বলে যুক্তি দেয়া হচ্ছে যে এর ফলে ভাটিতে অর্থাৎ বাংলাদেশে ফ্ল্যাশ ফ্লাড কমবে এবং সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকা সহ বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল বন্যা মুক্ত হবে। কিন্তু আসলে বরাক নদীর ভাটির দিকের অঞ্চল সিলেটের হাওড় এলাকায় বর্ষার শুরুতে আগাম বন্যা হয় আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি কমে আসে।টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের পর বর্ষার শুরুতে রিজার্ভারে পানি ধরে রাখার প্রয়োজন পড়বে আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। এর ফলে বর্ষার শুরুতে বন্যা কমে আসতে পারে আবার বর্ষার শেষে বন্যার প্রকোপ বাড়তে পারে অর্থাৎ বন্যা মুক্ত হবার যে কথা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়, যেটি হতে পারে তা হলো বন্যার স্বাভাবিক সময় পরিবর্তিত হতে পারে। আরো যে বিষয়টি গুরুত্ত্বপূর্ণ তা হলো বাঁধের কারনে এর উজানে জলাধারে সব পলি সঞ্চিত হবে। যে পানি বের হয়ে আসবে তাকে এক কথায় বলা যায় “রাক্ষুসী পানি”। এই পানি পলিমুক্ত বলে এর পলিধারন ক্ষমতা অনেক বেশী আর তাই এটি বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিমি ব্যাপী ব্যাপক নদী ক্ষয়ের সৃষ্টি করবে।বাংলাদেশ বাঁধের ২০০ কিমি ভাটিতে থাকায় এই বিপুল পরিমান পলি বরাক নদী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। কিন্তু পানির প্রবাহ তুলনামূলক ভাবে কমে যাওয়ায় পলি বহন করার ক্ষমতা কমে যাবে, এবং তা সুরমা ও কুশিয়ারার বুকে জমা হবে। এতে নদীর নাব্যতা ও গভীরতা হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে আগে যেটা স্বাভাবিক বর্ষাকালীন প্রবাহ ছিল প্রকারান্তরে তা বন্যা আকারে আসতে পারে এই এলাকায়।আর যদি ধরেই নেই যে বাঁধের ফলে সিলেট আর মৌলভীবাজার এলাকা বন্যামুক্ত হবে সেখানেও প্রশ্ন আসে, এই তথাকথিত বন্যামুক্ত হওয়া কতটা ইতিবাচক? আমরা জানি বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল অর্থাৎ মেঘনা-সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকার একটি সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে আর তা হলো এর হাওড়গুলি। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে ছোট বড় মোট ৪১১ টি হাওড় প্রায় ৮০০০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত যা কিনা বাংলাদেশের এই অঞ্চলের মোট ক্ষেত্রফলের শতকরা ২৫ ভাগ। এই হাওড়গুলির কিছু হচ্ছে 'রাইপেরিয়ান জলাভুমি অর্থাৎ যেগুলো প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। এগুলো নদীর সাথে সরাসরি যুক্ত বলে নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি বা কমের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রভাবিত হয়।আবার কিছু আছে 'নন-রাইপেরিয়ান জলাভূমি' যা আসলে পানির যোগান পায় আশে পাশের নদী থেকে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ থেকে।এখন বর্ষাকালে পানির প্রবাহ কমে গেলে রাইপেরিয়ান হাওড়গুলিতে পানি যাবেনা এবং সেই সাথে ভূগর্ভস্থ প্রবাহ কমে যাওয়ায় নন-রাইপেরিয়ান হাওড়গুলিও পানি পাবেনা।বৃষ্টির পানি থেকে একমাত্র নন-রাইপেরিয়ান জলাভূমিগুলি পানির যোগান পেতে পারে কিন্তু তাও এই হাওড়গুলির আয়তনের তুলনায় নগন্য। এই হাওড়গুলি বর্ষা মৌসুমে দেখতে অনেকটা সমুদ্রের মত হয় এবং বন্যার পানি সরে গেলে তা জলজ প্রাণী বিশেষ করে নিভিন্ন প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রমে পরিনত হয়। যেহেতু বছরের একটি বিশেষ সময় ধরে এই হাওড় এলাকা জলপূর্ন থাকে তাই এলাকার মানুষদের জন্য মৎস্য শিকার অন্যতম প্রধান পেশা।বাঁধের কারনে বন্যার সময় পানি না আসায় এই হাওড়গুলি একসময় ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে সেই সাথে বিলুপ্ত হবে বেশ কিছু প্রজাতি। এই এলাকার মানুষদের তখন বর্ষা মৌসুমে জীবিকার জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা।

টিপাইমুখ বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে বলা হচ্ছে। FAP 6 এর রিপোর্ট অনুযায়ী অমলসিদে পানির সর্বোচ্চ প্রবাহ শতকরা ১০০ ভাগ থেকে ২০০ ভাগ বাড়বে এবং পানির পরিমান শতকরা ৬০ ভাগ বেড়ে যাবে অন্যদিকে টিপাইমুখ প্রকল্পের EIA রিপোর্টেও বলা আছে বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ ১১০% বেড়ে যাবে। এখন এই বর্ধিত পানি কি আমাদের জন্য আশীর্বাদ না কি অভিশাপ সেটা গবেষণার দাবী রাখে। FAP 6 এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এই বর্ধিত প্রবাহের ফলে নৌচলাচল, সেচ ও মৎস্য চাষ বৃদ্ধি ঘটবে কিন্তু কিছু কিছু এলাকা থেকে পানি নিষ্কাশন ব্যহত হবে আর ভারতের দাবী এই বর্ধিত পানি দিয়ে রবি শস্য ফলানো ।তবে যে বিষয়টি খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ তা হলো বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের এই হাওড়গুলি শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় তখন কৃষকরা সেখানে বোরো ধান বপন করে যা এই অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে উঠে যা এই লোক গুলির বছরের একমাত্র শর্করার যোগান দেয়।বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এই এলাকার চাষাবাদ ব্যহত হবার আশঙ্কা আছে। আর যদি ধরেও নেই যে এই বর্ধিত প্রবাহ চাষাবাদের জমিকে খুব বেশী প্লাবিত করবেনা সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়। এই জমিগুলো বন্যার সময় প্লাবিত হওয়ায় বিপুল পরিমান পলি জমে। এখন বর্ষা মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় তা আগের মত আর প্লাবিত হবেনা ফলে জমিগুলো তাদের উর্বরতা হারাবে।

কখনো কখনো পর্যায়ক্রমে কিছু বছর থাকে যেখানে যেসময় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক গড় প্রবাহ থেকে অনেক কমে যায়। প্রাপ্ত তথ্য মতে বরাক অববাহিকায় ১৯৭৯-১৯৮১ পর্যন্ত এরকম একটি পর্যায় গিয়েছে যেখানে শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম ছিল। টিপাইমুখ বাঁধ হবার পরে এরকম অতিশুষ্ক বছর যদি আসে সেক্ষেত্রে ফার্ম প্রডাকশনের জন্য শুষ্ক মৌসুমে জলাধারের পানির স্তর ক্রিটিকাল লেভেল বা আর কাছাকাছি চলে আসবে। সেক্ষেত্রে পরের বর্ষা মৌসুমও যদি অপেক্ষাকৃত শুষ্ক হয় তাহলে জলাধারে পানির স্তর খুব বেশী উপরে উঠবেনা এবং এর পরের শুষ্ক মৌসুমে ফার্ম প্রডাকশনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি থাকবেনা এবং এ অবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। এই পরিস্থিতিতে শুষ্ক মৌসুমে বাঁধের টারবাইন থেকে যে পরিমান পানি ভাটিতে প্রবাহিত হবে তা বাঁধ পূর্ব পরিস্থিতির সাথে তুলনা করলে অনেক অনেক কম। এই পরিস্থিতি তিন চার মৌসুম ধরে চললে তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসবে বাংলাদেশে। এই প্রাকৃতিক কারনগুলো ছাড়াও যদি কোন যান্ত্রিক কারনে বাঁধের টারবাইনগুলো অকার্যকর হয় অথবা গ্রীডের কোন সমস্যার কারনে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয় তখন কি হবে? যেহেতু এটি পানিবিদ্যুৎ বাঁধ সেক্ষেত্রে টারবাইন ছাড়া অন্য কোন পথ দিয়ে সেই সময়ে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা থাকবে কিনা সেটিও বিবেচ্য বিষয়।

এই যখন টিপাইমুখ বাঁধ প্রসংগে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা সেখানে ভারতের নর্থ ইষ্টার্ন ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন যা এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্বায়িত্বে নিয়োজিত তাদের টিপাইমুখ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব যাচাই রিপোর্টটির দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে খুব সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয় বাংলাদেশের প্রসংগ যেখানে বলা হয়,

“বাঁধের কারনে বর্ষা মৌসুমে পানি ৩০% কমে যাবে আর শুষ্ক মৌসুমে ১১০% বেড়ে যাবে, এবং এই বর্ধিত পানি দিয়ে সেচের মাধ্যমে রবি শস্য ফলানো যাবে।“

এভাবে একটি বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের EIA তে ভাটি অঞ্চলকে প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে উপেক্ষা করা ভারতের মত প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ আশা করতে পারেনা। যদিও এই রিপোর্টের গবেষণা দলে আছেন পানিসম্পদ, ফরেস্ট্রি, ইঞ্জিয়ারিং জিওলোজি, এগ্রিকালচার, ইকোলজি (প্রাণিজ ও উদ্ভিজ), বয়োডাইভার্সিটি ও সামাজিক অর্থিনীতির সব বিশেষজ্ঞবৃন্দ।

টিপাইমুখ ইস্যু নিয়ে ভারত বাংলাদেশ কূটনৈতিক আলোচনা বেশ গড়ায়। এই আলোচনাগুলিতে ভারতের ভূমিকা থাকে মূলত আশ্বাস প্রদান করা অর্থাৎ এই মর্মে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করা যে ভারিত এমন কিছু করবেনা যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। হতাশাজনক হলেও সত্য বাংলাদেশও ভারতের এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হবার চেষ্টা করে কোনরূপ বিচার বিবেচনা না করেই। ২০০৯ এ টিপাইমুখ সম্পর্কিত বাংলাদেশের সংসদীয় দল ভারত সফরে থেকে ফিরে এসে মন্তব্য করেছেন,

'হেলিকপ্টারে খুব নিচু দিয়ে পরিভ্রমনকালে টিপাইমুখে কোনো অবকাঠামো প্রতিনিধিদলের দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রকল্পের ভাটিতে কোনো ব্যারেজ বা অবকাঠামো নির্মাণের কোনো রকম প্রস্তুতিও পরিলক্ষিত হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখনো কোনো প্রাথমিক ভৌত কার্যাদি শুরু হয়নি।’

কিন্তু এখানে লক্ষ্যনীয় যে টিপাইমুখের মত এতবড় একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা করে ভারত তার বাস্তবায়ন আজ বা কাল করবে কিন্তু তাতে যেন বাংলাদেশের স্বার্থও রক্ষা পায় সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কি আদৌ সেই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে নাকি 'বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হবেনা ' এই জাতীয় অবৈজ্ঞানিক আশ্বাসে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে সেটা বোধগম্য নয়।



তিস্তা পানিবন্টন চুক্তিঃ

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে চাষাবাদের ক্ষেত্রে সেচের ভূমিকা অপরিসীম আর বাংলাদেশে নদীভিত্তিক সেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প একটি সফল মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু তিস্তায় পানির প্রবাহ ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়ায় এই প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে উত্তরবঙ্গের মানুষ। শুরুতে পরিকল্পনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের দুটি ফেইজ থাকলেও ভারতের গজলডোবায় ব্যরেজ নির্মানের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়াতে সেই পরিকল্পনা এখন হুমকির সম্মুখীন।

১৯৭২ সালে আন্তঃসীমান্ত নদীসমুহের উন্নয়নের দিককে সামনে রেখে ভারত বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (জ়েআরসি) প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।১৯৮৩ সালে তিস্তা নদীর ভারতীয় অংশে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা ও বাংলাদেশ অংশে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে প্রায় একই সময় গ্রীষ্মকালীন সেচের জন্য ব্যারেজ নির্মান কাজ শুরু হলে তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে আলোচনা অধিক গুরুত্ত্বের সাথে বিবেচিত হতে থাকে। ব্যারেজ নির্মান করলে যেহেতু দুই দেশই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করবে সেক্ষেত্রে এই আন্তঃসীমান্ত নদীর অভিন্ন পানিবন্টন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায় মূলত ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের কাছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে ১৯৮৩ সালে যৌথ নদী কমিশনের ২৫ তম বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারত তিস্তার পানি বন্টনের জন্য একটি এডহক চুক্তি করার বিষয়ে সম্মত হয়েছিল বলে জানা যায়। সেসময় তিস্তার মোট প্রবাহের ২৫% কে অবন্টনকৃত রেখে বাকী ৭৫% শতাংশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্টন করার প্রস্তাব করা হয়েছিল যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল ৩৬% আর ভারতের ছিল ৩৯%।তবে এই বন্টন কোথায় এবং কি পদ্ধতিতে হবে সেটি নিয়ে দ্বিমতের জের ধরে সেই এডহক চুক্তিটি বাস্তবের দেখা পায়নি।

১৯৮৭ সালে ভারতের গজলডোবায় ব্যারেজ নির্মান কাজ শেষ হবার পরে ভারত আস্তে আস্তে ব্যারেজ দিয়ে তিস্তার পানি প্রত্যাহার শুরু করে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারেজের নির্মান কাজ শেষ সেচ প্রকল্প শুরু করে।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিস্তা থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহারের ফলে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহ আস্তে আস্তে কমতে থাকে।

১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গাচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে মূলত তিস্তা পানি বন্টনের আলোচনা বেগবান হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সচিবপর্যায়ের বৈঠকে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয় এবং যৌথ নদী কমিশনের নির্দেশক্রমে এই কমিটির কাজ ছিল মূলত তিস্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অন্যান্য অভিন্ন নদীর ক্ষেত্র স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি পানি বণ্টন ফর্মুলা প্রণয়ন করা। বিশেষজ্ঞ কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু করে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রায় সাতটি বৈঠকে মিলিত হয় তবে এই বিষয়ে কোন ঐক্যমতে দুই দেশ পৌঁছাতে পারেনি। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারী ২০১০ ভারত বাংলাদেশ যুক্ত নদী কমিশনের দুই দিন ব্যাপী সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষেও তিস্তার বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয়নি।

এই দীর্ঘ সময়ের আলোচনার ফলেও সফল একটি পানিবন্টন চুক্তিতে না আসার মূল কারন আসলে বাংলাদেশ ও ভারত পানি বণ্টন নিয়ে একটি একক ফর্মুলায় একমত না হতে পারা। পানিবন্টনের ফর্মুলা নির্ধারনে মূল অংশ হচ্ছে হিস্যা নির্ধারণ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যৌথ নদী কমিশনের সভায় এই হিস্যা সমূহের জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় যাতে ভারতের গজলডোবায় লব্ধ পানির শতকরা ২০ ভাগ নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ রেখে, আর বাকি শতকরা ৮০ ভাগ পানি বাংলাদেশ ও ভারত সমভাবে ভাগ করে নেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।এর বিপরীতে ভারতের যুক্তি ছিল কিছুটা একপেশে। ভারত প্রস্তাব করে নদীর জন্য ১০ শতাংশ পানি রেখে বাকী ৯০ শতাংশ পানি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সেচ প্রকল্প এলাকার ভিত্তিতে বন্টন করার। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে ভারতের গজলডোবায় প্রকল্প এলাকা (৫.৪৬ লক্ষ) আর বাংলাদেশের দোয়ানীতে প্রকল্প এলাকার (১.১১ লক্ষ )অনুপাত ৫:১। সুতরাং ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের হিস্যা দাড়ায় ১৫ শতাংশ আর ভারতের ৭৫ শতাংশ। পরবর্তীতে ভারত দাবী করে যেহেতু ভারতের গজলডোবা থেকে ছেড়ে দেয়া পানি বাংলাদেশের ডালিয়া অংশে পৌঁছবে সুতরাং এই দুইয়ের মাঝখানে নদীখাত সংরক্ষণের জন্য আলাদা করে কোন প্রবাহ বন্টন দরকার নেই। আর বাংলাদেশে তিস্তা নদীর ডালিয়া থেকে ব্রহ্মপুত্রে পড়ার আগ পর্যন্ত নদীখাত সংরক্ষণের জন্য আলাদা কোন হিস্যার দরকার নেই।

এখানে উল্লেক্ষ্য যে আন্তঃসীমান্ত বা ট্রান্সবাউন্ডারি নদীর ক্ষেত্রে পানিবন্টনের জন্য কোন একক সুত্রের অস্তিত্ত্ব পৃথিবীতে নেই। একমাত্র আপস আলোচনাই এনে দিতে পারে একটি মানানসই পানিবন্টন ফর্মুলার। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নদীসমুহের ব্যবহার (নৌচলাচল ব্যাতিরেকে) সম্পর্কিত আইনেও আপস আলোচনার মাধ্যমে এই জাতীয় সমস্যা সমাধানের কথা বলা আছে। একটি পানিবন্টন চুক্তিতে লক্ষ্য রাখা উচিৎ যেন বন্টন এমন না হয় তা কোনপক্ষের ক্ষয়ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়।সেই সাথে বন্টন এমন ভাবে করা উচিৎ যেন তা দুই দেশের মধ্যে সমভাবে বিস্তৃত হয়।তবে অনেক সময় দেখা যায় সমান ভাবে বন্টন করলে কোন দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় আবার অসমভাবে বন্টন করলে অন্য দেশটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এক্ষেত্রে শেয়ার্ড স্যাক্রিফাইস বিবেচনা করা হয় যেখানে দুই দেশই তার কিছুটা স্বার্থ ছাড় দেবে একটি সফল বন্টন ফর্মুলার জন্য।

গজলডোবা ব্যরেজ ভারতে তিস্তার একদম ভাটিতে অবস্থিত, অর্থাৎ এর পরে তিস্তার পানি ব্যবহার করার সুযোগ ভারতে আর নেই। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে প্রবেশের পর তিস্তার পানির প্রথম ব্যবহার তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য। সুতরাং বাংলাদেশে তিস্তার পানির ব্যবহার শুধুমাত্র সেচ কাজের জন্যই বরাদ্ধ নয় বরং নৌচলাচল, মৎস্য, গৃহস্থালী ও শিল্পকারখানার জন্যও পানির চাহিদা রয়েছে। সেই বিচারে নদীখাত সংরক্ষণের জন্য হিস্টরিকাল প্রবাহের ভিত্তিতে শতকরা ২০% পানির হিস্যার বাংলাদেশি প্রস্তাব যথেষ্ট যৌক্তিক এবং এর বিপরীতে ভারতের নদীখাত সংরক্ষণে কোন হিস্যা না রাখার প্রস্তাব নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কারন ভারত থেকে শুধুমাত্র সেচ কাজের জন্য বাংলাদেশে ছেড়ে দেয়া পানি গজলডোবা থেকে লালমনিরহাটের দোয়ানী পর্যন্ত নদীখাত সংরক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে বিবেচিত হলেও দোয়ানী থেকে তিস্তাখাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা তিস্তার পানির উপর নির্ভরশীল তা এর ফলে পানির জোগান হারাবে।

এবারে আসা যাক ভারতের সেচ প্রকল্প এলাকার অনুপাতে পানিবন্টনের যুক্তির আলোচনায়।প্রাপ্ত তথ্যমতে ভারতের গজলডোবা প্রকল্পে পরিকল্পনাধীন কমান্ড এরিয়া ৯.২৩ লক্ষ হেক্টর আর বাস্তবায়িত হয়েছে ৫.৪৬ লক্ষ্ হেক্টর। বাংলাদেশে তিস্তা ব্যরেজ সেচ প্রকল্পের পরিকল্পনাধীন কমান্ড এরিয়া ৫.৪০ লক্ষ্ হেক্টর আর বাস্তবায়িত হয়েছে ১.১১ লক্ষ হেক্টর। ভারতীয় পক্ষের যুক্তি তিস্তার পানি বন্টন হোক বাস্তবায়িত প্রকল্প এলাকার ভিত্তিতে। বাস্তবায়নের ভিত্তিতে ভারতের সেচ প্রকল্প বাংলাদেশের ৫ গুন আর তাই ৫:১ অনুপাতে পানিবন্টন করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা। অথচ পরিকল্পিত কমান্ড এরিয়া তুলনা করলে এই অনুপাত দাঁড়ায় ১৭:১০। যেহেতু তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের জন্য নির্মিত ব্যারেজ, সংযোগ খাল কিংবা অন্যান্ন স্থাপনাগুলির নকশা করা হয়েছে পরিকল্পিত কমান্ড এরিয়ার জন্য তাই বাস্তবায়িত কমান্ড এরিয়ার ভিত্তিতে পানিবন্টন না করে বরং পরিকল্পিত কমান্ড এরিয়ার ভিত্তিতে বন্টন করলে তা অধিক যৌক্তিকতার দাবী রাখে।সুতরাং কোন যুক্তিতেই ভারতের প্রস্তাব পানিবন্টন চুক্তির সাম্যতা ও কোন পক্ষের ক্ষতি না করে বা শেয়ার্ড স্যাক্রফাইস নীতিতে পড়েনা।

পক্ষান্তরে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বন্টন সুত্র সাম্যতার বহিপ্রকাশ দেখা যায় কারন তা ভারত ও বাংলাদেশের গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তির আদলে করা।গঙ্গা চুক্তিতে বাংলাদেশের ন্যুনতম হিস্যা ছিল ৪৭%। সেই বিচারে তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রথম প্রস্তাবে নদীখাতের জন্য শতকরা ২০ ভাগ পানি বরাদ্ধ রেখে বাকী ৮০ ভাগ পানি ৪০ শতাংশ করে সমভাগে ভাগ করে নেয়ার যুক্তি কোনমতেই উচ্চাভিলাষী বলে বিবেচিত হয়না।সাম্প্রতিক কালে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী জানা যায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে সাম্প্রতিক একটি খসড়া তৈরি করেছে যাতে তিস্তার পানির ৮৩ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে রেখে ১৭ শতাংশ বাংলাদেশে ছাড়ার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ এখানেও তিস্তার দুই পার্শে সেচ প্রকল্পের বাস্তবায়িত কমান্ড এরিয়ার অনুপাতে পানিবন্টনের স্বপক্ষে তাদের আগের অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি উপরন্তু ইতিপূর্বে যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠকে গৃহীত ১০% হিস্যা নদীখাত সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দেরও বলি ঘটেছে এই খসড়ায়। প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা যায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেচ দপ্তরের মন্ত্রী সুভাষ নস্কর ওই খসড়ার নোটে লিখেছেন,

“যেহেতু বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেশ, তাই শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানির ২৫ শতাংশ বাংলাদেশকে দিলেও রাজ্যের কোনো ক্ষতি নেই।“

মন্ত্রীর মন্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশের হিস্যা ২৫% হলেও ভারতের কোন ক্ষতি হবেনা অথচ এই ২৫% পানির হিস্যা পেলে বাংলাদেশের কি ক্ষতি হবে যে সম্পর্কে তারা আদৌ ওয়াকেবহাল নয় এবং হয়ত প্রয়োজনও অনুভব করেনি। সেক্ষেত্রে শেয়ার্ড স্যাক্রিফাইসের কোন নমুনা এই খসড়ায় দেখা যায়না অথচ ইতিপূর্বে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে দুই পক্ষই এই মর্মে সম্মত হয় যে দু’দেশের মধ্যে পানিবন্টন শেয়ার্ড স্যাক্রিফাইস নীতির ভিত্তিতে হবে।

পরিশেষেঃ

উপরের তিনটি ইস্যু নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ভারত বাংলাদেশ পানিসম্পদ বিষয়ক কূটনৈতিক সম্পর্কের অবস্থা অনুধাবন করা যায়। এখানে উল্লেখ্য যে পানিবন্টন নিয়ে একটি সফল সমাপ্তির ক্ষেত্রে আপস আলোচনার বিকল্প নেই।তবে সফল আপস আলোচনার জন্য সমস্যা সমাধানের মানসিকতা থাকতে হবে। বলতে দ্বিধা নেই প্রয়োজনীয়তার দিক বিবেচনায় গঙ্গা বা তিস্তার পানিবন্টন বা প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ বাংলাদেশের জন্য অধিক জরুরী কিন্তু সার্বিক ভাবে প্রতিবেশি এবং বন্ধুপ্রতিম দুটি দেশের জন্য নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি এই সব সমস্যার বন্ধুত্ত্বপূর্ন সমাধান চুক্তি উভয় দেশের জন্যই ইতিবাচক। বিশেষ করে গঙ্গা চুক্তির পর তা দুই দেশের জন্য প্রায় বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে পড়ে।হয়।কারন গঙ্গাচুক্তির অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী,

“পক্ষপাতবিহীন ও সাম্যতাপ্রসূত এবং কোনো পক্ষেরই ক্ষতি না করে দুই সরকারই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহমান অন্যান্য আন্তসীমান্ত নদীসমূহের চুক্তির ব্যাপারে একক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে একমত”

গঙ্গাচুক্তির আলোচনা থেকে একথা প্রতীয়মান যে একসময় ট্রান্সবাউন্ডারি নদী নিয়ে দুই দেশেরই ধারনা ছিল যে নদীর পানির উপর তাদের স্ব স্ব অধিকার সর্বাধিক কিন্তু গঙ্গা চুক্তির বাস্তবায়ন সেই অধিকারকে সাম্যতা আর অন্যের ক্ষতি না করে তথা শেয়ার্ড স্যাক্রিফাইসের আদল দিয়েছে।কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গাচুক্তির সফল আমরা অন্যান্ন ইস্যু যেমন টিপাইমুখ বা তিস্তার ক্ষেত্রে নিতে পারছিনা এমনকি সাম্প্রতিককালে ফেনী নদী বা ইছামতি নদীর ক্ষেত্রে ভারতকে ছাড় দেয়ার পরেও তিস্তার বিষয়ে ইতিবাচক কোন মনোভাব দেখা যায়নি।এক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক দৌর্বল্য আর কিছু ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগীতা বা বন্ধুপ্রতীম দেশের প্রতি সহমর্মিতার অভাব উল্লেখ্য। আশা করি নিকট ভবিষ্যতে ভারত ও বাংলাদেশ তাদের স্ব স্ব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে পানিসম্পদ ইস্যুতে বিরোধগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে।
বিদ্রঃ লেখাটি মাসুদা ভাট্টি সম্পাদিত পাক্ষিক একপক্ষ এর জন্য লেখা।  লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ১৫ অক্টোবর ২০১০ তারিখে। পাক্ষিক একপক্ষ বর্ষ ১ সংখ্যা ৮, ১-১৫ কার্তিক ১৪১৭

লিঙ্কঃ এখানে