বৃহস্পতিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১০

ড্যাপ (DAP) ও সেনাবাহিনী আবাসন প্রকল্প

সাম্প্রতিক কালে সেনাবাহিনী আবাসন প্রকল্প ( আর্মি হাউজিং স্কীম) বা AHS এর জের ধরে বাংলাদেশ  সেনাবাহিনী ও রূপগঞ্জের সাধারন মানুষের মধ্যে সংঘাত ঘটেছে। মিডিয়া মারফত প্রাপ্ত খবরে এবং সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষনে একথা স্পষ্ট যে  সেনাবিহিনী তাদের ক্ষমতা অপব্যবহার করেছে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। একটি জমির মালিকের এই স্বাধীনতা থাকা উচিৎ যে তিনি তার জমি কার কাছে বিক্রি করবেন কিংবা আদৌ বিক্রি করবেন কিনা। তবে যদি সেটা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে লাগে প্রয়োজনে সরকার তা কিনে নিতে পারে, কিন্তু সেনাবাহিনী আবসন প্রকল্প সেই ধরনের কোন প্রকল্প নয়। বাস্তবে তা হয়নি, সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ হয়েছে। এর প্রতিবাদ করায় সেখানে সাধারণ মানুষের সাথে সেনাবাহিনীর সংঘাত হয়েছে, হতাহত হয়েছে। অবশ্য বিবিসির সাক্ষাৎকারে এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিমুল গনি জানিয়েছেন  এই প্রকল্পের জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোন জোর জবরদস্তি করা হয়নি, সাধারণ মানুষের আবেগকে ব্যবহার করে এই ধরনের একটি পরিস্থিতি ঘটানো হয়েছে [৪]। আসলে কোনটি সত্য বা কতটুকু  সত্য সেটি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে এবং আমার এই পোষ্টের আলোচনা সেটিকে ঘিরে নয়। আমি মূলত এই স্কীমের প্রথম প্রকল্প ( রূপগঞ্জ) এলাকা এবং বর্তমান বাস্তবায়নাধীন ঢাকা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপের প্রেক্ষাপটে তার বৈধতা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই।


আর্মি হাউজিং স্কীম কি?
শুরুতে সেনাবাহিনী আবাসন প্রকল্প নিয়ে প্রাথমিক কিছু তথ্য জানা যাক। সেনাবাহিনীর সদস্যদের আবাসনের জন্য 'সেলফ ফাইনান্সড হাউজিং স্কীম ফর দি আর্মি' নামে একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে ( আর্মড ফোর্স ডিভিশন বা সংক্ষেপে AFD) এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর অফিস হয়ে অনুমোদন পায় ২০০৯ সালের নভেম্বরে। এই প্রকল্পই আর্মি হাউজিং স্কীম বা AHS নামে এখন প্রক্রিয়াধীন [২] যা আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় ২০০৯ এর ডিসেম্বরে। এই প্রকল্পের সাথে ডিওএইচএস এর পার্থক্য নিরূপম করা হয়েছে এই ভাবে,
"ডিওএইচএস প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারের স্পন্সরকৃত একটি প্রকল্প যেখানে সরকার বিনামূল্যে জমি প্রদান করবে এবং উন্নয়ন খরচ সংগৃহীত হবে সেনা সদস্যদের কাছ থেকে, অন্যদিকে আর্মি হাউজিং স্কীম প্রকল্পে সকল খরচ সংগৃহীত হবে সেনা সদস্যদের কাছ থেকে এবং এক্ষেত্রে  সেনাবাহিনী শুধু বিষয়টি ত্তত্বাবধান করবে" [৩]
অর্থাৎ এই প্রকল্পে সরকারের কোন দায়ভার নেই এবং এটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অলাভজনক প্রকল্প যেখানে তারা সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করবে মাত্র [১,৪]। এই তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রকল্পকে প্রাইভেট আবাসন প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার মধ্যে যেকোন আবাসন প্রকল্প করার জন্য রাজউকের অনুমোদন লাগে।এই প্রকল্পের খসড়া নথির [২] মাধ্যমে জানা যায় এই প্রকল্পের অনুমোদন এখনো প্রক্রিয়াধীন ( সর্বশেষ ডিসেম্বর ২০০৯ এর নথি অনুযায়ী)। সম্প্রতি রূপগঞ্জে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে বিবিসি কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিলাচলক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিমুল গনি বলেছেন,
"এটি এখনো প্রক্রিয়াধীন। তবে  আমরা সরকারের কাছ থেকে নীতিগত ভাবে অনুমোদন পেয়েছি।"
তিনি রাজউকের অনুমোদন প্রসংগে বলেছেন রাজউকের নীতিমালা অনুযায়ী (তার ভাষ্যমতে) একটি আবাসন প্রকল্পের অনুমোদনের জন্য প্রথমে কিছু জমি কিনে একটি পরিকল্পনা সহকারে রাজউকের কাছে তা উপস্থাপন করতে হবে। সেই ভিত্তিতে এ পর্যন্ত তারা প্রায় ১০০০ বিঘা জমি কিনেছেন এবং তাদের মাস্টার প্ল্যানের কাজ চলছে এবং তারা ফেব্রুয়ারী ২০১১ এর মধ্যে তারা তা উপস্থাপন করার আশা করছেন।[৪]
 প্রথম প্রকল্পঃ রূপগঞ্জ
এবারে এই আবাসন স্কীমের প্রথম প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক। যেকোন একটি নতুন আবাসন প্রকল্প যখন প্রক্রিয়াধীন থাকে তখন সর্বপ্রথম একটি প্রকল্প এলাকা কিন্তু বিবেচনা করা হয় যাকে ঘিরে ঐ প্রকল্পের কাজ এগুতে থাকে। একটি উদাহরন দেই, ধরুন মিঃ ক একটি নতুন আবাসন প্রকল্প করবেন। সেক্ষেত্রে তিনি আগে ঠিক করবেন ঠিক কোন যায়গার সেই প্রকল্পটি হবে। তার একটি সম্ভাব্য ম্যাপ প্রনয়ন করবেন এবং সেই আলোকে জমি ক্রয় করা শুরু করবেন। একই সাথে যারা জমি ক্রয়ের জন্য এলিজেবল তারা তাদের কাছ থেকে আবেদন পত্র বা অর্থ সংগ্রহ শুরু করবে। আর্মি হাউজিং স্কীম একই ভাবে ত্যাদের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। এই প্রকল্পের 'প্রায় জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন ও উত্তর' নথিটি  [৩] পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় এই প্রকল্পের জন্য অনলাইন ফরম পূরন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এইভাবে,
"25. you are req to fill up the online form given in the web address: http://ahsbd.wordpress.com"
তবে আর্মি হাউজিং স্কীম বা বাংলাদেশ আর্মির ওয়েবসাইটে এই প্রকল্পের কোন ম্যাপ দেখা যায়নি ( ভুল হলে ক্ষমা করবেন, কেউ পেলে জানাবেন আশা করি)। ওয়ার্ডপ্রেসের উল্লেখিত (http://ahsbd.wordpress.comওয়েবসাইটটিতে গেলে দেখা যায় যে সাইটটি পাওয়া যায়না। ধারনা করা হচ্ছে এটি সম্প্রতি মুছে ফেলা হয়েছে [৫]। ওয়েবসাইটটি মুছে ফেলার আগে তা থেকে বেশ কিছু তথ্য ও প্রকল্প এলাকা ম্যাপ বের করা হয় যা কিনা 'ডেইলি ষ্টারে' গত ২৪ অক্টোবর তারিখে ছাপা হয় [৬]।[এছাড়া ঐ ওয়েবসাইটে লিঙ্কড একটি এলবামে প্রকল্পের বেশ কিছু ছবির সন্ধান পাওয়া যায় [৭]। অবশ্য পরবর্তীতে গুগুল ক্যাশ থেকে http://ahsbd.wordpress.com সাইটটির তথ্য পুনঃরুদ্ধার করা হয়। সাইটটির একটি স্ক্রীন শট দেখুন নিচেঃ




এই পেইজের বাদিকে একটি মেনু রয়েছে "Pictures" নামে যাতে মাউস নিলে একটি পিকাসা এলবামের লিঙ্ক আসে। নিচের ছবিটিতে ওয়েবসাইটটির স্ক্রীনশটের বাদিকের অংশ জুম করে দেয়া হলো। লাল বক্সের মধ্যে লিঙ্কটির স্ক্রীনশট লক্ষ্য করুনঃ



এবারে এই পিকাসা এলবামের পূর্ন  স্ক্রীন শট ও  জুম করা অংশ দেখুন নিচের দুই ছবিতেঃ




এবারে  সমন্বয় করি। এই প্রকল্পের 'প্রায় জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন ও উত্তর' নথিটি  [৩] পাওয়া গিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওয়েবসাইট থেকে সুতরাং তা অফিসিয়াল তথ্য। এই অফিসিয়াল তথ্যে আগ্রহীদের অনলাইন ফরম ফিলাপ করতে বলা হয়েছে  http://ahsbd.wordpress.com ওয়েবসাইট থেকে সুতরাং নিঃসন্দেহে হলা যায় এটিও একটি অফিসিয়াল তথ্য কেন্দ্র ( যদিও সাইটটি ওয়ার্ডপ্রেসের মাধ্যমে করা) । সেই অফিসিয়াল তথ্য কেন্দ্র থেকে পাওয়া সব তথ্যকেও আমরা একই প্রকল্পের নির্ভরযোগ্য তথ্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। সেক্ষেত্রে এটি বলা যায় যে প্রকল্পের ছবিসহ পিকাসা এলবামটি নির্ভরযোগ্য একটি সুত্র।

উপরোক্ত আলোচনা বা অনুসন্ধানের মূলে ছিল আসলে AHS এর একটি খসড়া  প্রকল্প ম্যাপ নিয়ে বিশ্লেষন করার পূর্বে তার উৎস বা  নির্ভরযোগ্যতা  নিয়ে বিস্তারিত তথ্য পাঠকদের জানানো। আমি নিচে বাস্তবায়নাধীন ড্যাপের আলোকে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন বা বৈধতা কিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলব যা আদতে ঐ ম্যাপের ভিত্তিতে।
ড্যাপ ও রূপগঞ্জ প্রকল্প
গত ২২ জুন ২০১০ এ গ্যাজেট আকারে প্রকাশিত ড্যাপ বা ঢাকা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে উল্লেখ করা হয়েছে,
"স্ট্রাকচার প্ল্যান প্রকল্পে ঢাকা শহরের প্লাবনভূমিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল, একঃ মুখ্য প্লাবনভূমি (Flood Flow Zone) এবং গৌন প্লাবনভূমি (Sub Flood Flow Zone) এবং নির্দেশ ছিল যে একমাত্র কৃষি, নিষ্কাশন ও রাস্তাখাট ছাড়া ঐ সব এলাকায় কোন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হবেনা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছে যে গৌণ প্লাবনভূমিতে উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা দূরুহ হয়ে গিয়েছিল স্ট্রাকচার প্যানের কিছু দূর্বলতার জন্য। ফলে ড্যাপে এই দুই অঞ্চলক একত্রিত করে করা হয়েছে শুধু প্লাবনভূমি ( ফ্লাড ফ্লো জোন)"  
অর্থাৎ এই ফ্লাড ফ্লো জোনে কোন ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম করা যাবেনা বা করলে তা হবে অবৈধ। রাজউকের ওয়েবসাইটে ড্যাপের আওতায় পড়া ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার উন্নয়ন ম্যাপ পাওয়া যায় [৮]। রূপগঞ্জের আলোচিত ঐ এলাকা ড্যাপের গ্রুপ এ (Group A) এর আওতায় পড়ে। এই গ্রুপের বিশদ ম্যাপ ও তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায় বালু নদী ও শীতলক্ষ্যার মধ্যবর্তী অঞ্চল ড্যাপের পরিকল্পনায় ফ্লাড ফ্লো জোন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে কোন ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করা যাবেনা। যদিও এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম দেখা যায় রাজউকের নিজস্ব প্রকল্প পূর্বাচলের বাস্তবায়নে [৯]।

এবারে নিচে দুটি  ম্যাপ পর্যবেক্ষণ করা যাক। প্রথমটি ড্যাপের গ্রুপ এ এর ম্যাপ পরেরটি AHS  এর খসড়া প্রকল্প ম্যাপঃ
ছবি ১- গ্রুপ এ ম্যাপ, ড্যাপ


ছবি ২-AHS এর খসড়া ম্যাপ

উপরের দুটি ছবি থেকে এটি প্রতীয়মান যে প্রকল্পিত আর্মি হাউজিং স্কীম ড্যাপের ফ্লাড ফ্লো জোনে পড়ে, ফলে রাজউকের নীতিমালায় এই প্রকল্প অবৈধ।
এখানে কয়েকটি বিষয় আলোচনার দাবী রাখেঃ

প্রথমতঃ রাজউকের তথ্য অনুযায়ী ড্যাপের  কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৪ সালে [১০] এবং তা গ্যাজেট আকারে প্রকাশ পায় ২০১০ এর জুনে। AHS প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিমুল গনির সাক্ষাৎকার অনুযায়ী তারা সরকারের কাছ থেকে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছেন। যেহেতু এই প্রকল্পের নথি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদন পায় ২০০৯ এর নভেম্বরে  সেক্ষেত্রে ধরা যাক সরকারের "নীতিগত অনুমোদন" পেয়েছেও ২০০৯ এর নভেম্বরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ড্যাপের কথা কি সরকার জানেনা? যদি জেনে থাকে তাহলে ২০০৯ এর নভেম্বরে এই প্রকল্পের ছাড়পত্র কিভাবে আসে ?
দ্বিতীয়তঃ বিবিসি থেকে সাক্ষাৎকারের সময় সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী উল্লেখ করেছেন যে এই প্রকল্প ড্যাপের আওতাধীন। এর পরেও জেনারেল গনি তার সাক্ষাৎকারে দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে বলেছেন এই প্রকল্প অবশ্যই চলবে। আমার প্রশ্ন ড্যাপের আওয়ায় অবৈধ একটি প্রকল্প কিভাবে চলবে নাকি পূর্বাচলের মত AHS ও তথাকথিত " ওভারলে" বলে চালিয়ে দেয়া হবে?

আমরা আশা করি রাজউক বা সরকার এক্ষেত্রে পরিষ্কার ব্যাখ্যা প্রদান করবে এবং এই নিয়ে ঘটে যাওয়া সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের ক্ষতিপূরণ সহ এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ধারন করবে। অর্থৎ এই প্রকল্পের সঠিক ম্যাপ পর্যবেক্ষণ করে যদি তা ড্যাপের আওতায় ফ্লাড ফ্লো জেনে পড়ে তা অনতিবিলম্বে বাতিল করবে।



বিদ্রঃ পাঠক ড্যাপ নিয়ে বিস্তারিত প্রাথমিক তথ্য ও তথ্যসুত্রে জন্য দুটি পোষ্ট পড়ে দেখতে পারেনঃ

তথ্যসুত্রঃ
[১] আবাসন প্রকল্প রুপায়ণে সেনা পন্থা, বিবিসি বাংলা , ২৬ অক্টোবর ২০১০
[২] Draft Army Housing Scheme, Bangladesh Army.
[৩] Frequently Asked Question, AHS, Bangladesh Army.
[৪] রূপগঞ্জে সেনা ক্যাম্প ছিলো: ব্রি. গনি, বিবিসি বাংলা, ২৫ অক্টোবর ২০১০
[৬] Rupganj flies into fury , ডেইলি ষ্টার ২৪ অক্টোবর ২০১০।
[৭] AHS প্রকল্প ছবি এলবাম
[৮] গ্রুপ এ রিপোর্ট, ড্যাপ, রাজউক।
[৯] সংশোধিত ড্যাপ আবশ্যক , সচল জাহিদ, সচলায়তন।