আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস আর মহান একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষ্যে কানাডিয়ান রক্ত কেন্দ্রে আয়োজিত রক্তদান অনুষ্ঠানে গিয়েছি। প্রাথমিক নিবন্ধনের পরে একজন নার্সকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আরো কিছু তথ্য সংগ্রহের জন্য, বিশেষ করে রক্তদানের নিয়ম কানুন এবং ঝুকি নিয়ে আলোচনা করার জন্য। মাঝবয়সী নার্সের প্রথম উক্তিঃ
আমি কিছুটা বিষ্মিত, বাবার স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটিয়ে প্রকৌশল শিক্ষায় নাম লিখিয়েছিলাম, ভবিষ্যতে বড়জোর নামের পুর্বে একটা ড: অদ্যক্ষর বসার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে, এর বেশিকিছুত নয়। পরক্ষনে মনে পড়ল আমার নমের প্রথম অংশ ( MD. Zahidul) এদের কাছে বিশেষ কিছু বহন করে (কানাডাতে MD মানে Medical Doctor)। যাই হোক আমি ভদ্রমহিলার ভুল ধরিয়ে দিলাম এবং যতুদূর সম্ভব ব্যাখ্যা করে দিলাম আমার নামের প্রথম দুটি অক্ষরের মহাত্ম, সেই সাথে এও বলে দিলাম যে এরকম ডাক্তার (!!) বাংলাদেশে ভুরি ভুরি আছে।
তখন সবে কানাডাতে এসেছি। আমার বিভাগের অগ্রজ জুবায়ের ভাইকে নিয়ে গিয়েছি ব্যাংক একাউন্ট করতে।এক ভদ্রমহিলা আমার সব কিছু শুনে নাম নিবন্ধন করতে যাচ্ছেন। তার প্রথম প্রশ্নঃ
‘তোমার নামের প্রথম অংশ?’
আমি জবাব দেই ‘MD. Zahidul’
ভদ্রমহিলার পরবর্তী উক্তি, ‘তুমি কিভাবে এটা উচ্চারণ কর ?’
যাই হোক, মিনিট দশেক চেষ্টার পরেও ভদ্রমহিলার যখন পরিগণক যন্ত্রে আমার নাম নিবন্ধন করতে পারলেননা ( বিশেষত MD) তখন আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হল ওই Zahidul নিয়েই। আমাকে অবশ্য আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে কোন দাপ্তরিক চিঠি পত্র লাগলে আমার পুরো নাম বিশেষ ভাবে লিখে দেবে। পরে অবশ্য ( এক বছরান্তে) বিশেষ ব্যবস্থায় আমার নাম নিবন্ধিত হয়েছে M D Zahidul হিসেবে (M আর D এর মাঝখানে সংক্ষিপ্ত ফাঁকা জায়গা সহযোগে) ।
এখানকার নিবন্ধন দপ্তরে গিয়েছি গাড়ি চালানোর অনুমতিপত্র নিতে। এখানে নাকি এটা আবার আমার প্রধান পরিচয়পত্র গুলোর মধ্যে একটি। যথারীতি সমস্যা শুরু আমার নামের প্রথম অংশ নিয়ে। জনৈকা সহকারী কোন মোটেই MD নিবন্ধন করতে দিবেননা।
আমি বললাম ‘এটা আমার নাম, নাম ভুল হলে আমার পরিচয় ভুল হবে’
তার যুক্তি ‘এটাত তোমার বিশেষণ, তুমি মেডিক্যাল ডক্টর এটা তার পরিচায়ক। আমরা নামের আগে কোন বিশেষণ অনুমোদন করিনা’
আমি যতই তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি আমি ডাক্তার না, আমি প্রকৌশলী সে কিছুতেই ব্যাপারটা মানতে পারেনা।
আমি বলি, ‘এটা মূহাম্মাদ (সাঃ) এর সংক্ষিপ্ত রূপ’
বলে, ‘তাহলে পুরোটা লিখলে কি সমস্যা?’
আমি তাকে কিভাবে বুঝাই যে আমার পাসপোর্টেও নামের বানান ঐ MD দিয়েই শুরু, আমি ইচ্ছে করলেই পরিবর্তন করতে পারিনা।যাই হোক এ যাত্রায় কিছুতেই রক্ষা পেলামনা। আমাকে MD ছাড়াই নিবন্ধন করতে হল। পরে অবশ্য আরো উচ্চ দপ্তরে যোগাযোগ করে রীতিমত যুক্তিতর্ক আর পাসপোর্টের অনুলিপি দেখিয়ে আমি ফিরে পেলাম আমার আসল নাম।
ঘটনা ৪
একবার ‘ফল সেমিষ্টারে’ বাংলাদেশ থেকে পুরকৌশল বিভাগেই এসেছে দুজন। তাদের নামঃ
MD. Toihidul Islam ও MD. Tazul Islam
আমি প্রমাদ গুনলাম কারন এতমধ্যেই পুরকৌশল বিভাগে আমরা দুজন আছি যাদের নামঃ
MD. Zahidul Islam ও MD. Rashedul Islam
ফলাফল যা হলো কিছুটা এরকম। নামের শেষ অংশের প্রথম অদ্যক্ষর বিশিষ্ট সবার জন্য বিভাগের অফিসে একটাই চিঠিবাক্স। নির্বোধ কিছু সহকারীর হাত দিয়ে Toihidul এর এক প্রয়োজনীয় কাগজ চলে এলো আমার নামে । এবং যেহেতু বিভাগের চিঠিবাক্স আমি কদাচিৎ খুলি সেট পরে রইল সপ্তাহদুয়েক। মাঝখানে ভোগান্তি হল ব্যাচারা Toihidul এর।
সৈকতের পুরো নাম অনেক বড়, যেভাবে ও বাংলাদেশ থেকে নিবন্ধন করেছে তা কিছুটা এরকমঃ MMA Syed Rushed, সভাবতই নামের প্রথম অংশ MMA ( বলাই বাহুল্য MMA এর প্রথম M যথারীতি MD এর M). সৈকত আসার কিছুদিন পরের কথা, কেমিকৌশল বিভাগের জনৈক অধ্যাপক আমাদের এক বড় ভাইয়াকে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করছেঃ
ভাইয়া কিছুটা হতবাক এবং বিব্রত, এই নামেরত কেউ আসে নাই, যতদূর জানে এসেছে সৈকত যার ভাল নাম Rushed. যাই হোক আরো কিছুদূর আলাপচারিতার পরে জানা গেল আসল সত্য। এখন অবশ্য নামের প্রথমে MD দেখেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই বুঝে এটা বাংলাদেশ হতে আমদানী।
উপরের ঘটনাপ্রবাহের পরে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম নিজের ছেলের নামের শুরুতে আর যাই হোক MD রাখবনা। ২০০৭ এর পহেলা সেপ্টেম্বর। ঘর আলো করে আসল আমাদের ছেলে। আমি তখন কানাডাতে। ছেলের আকীকার ব্যাবস্থা করছে আমার বাবা, সুতরাং নাম প্রয়োজন।
বাবা বললেন, ‘ভাল কিন্তু MD কই ?’
কথাটা যুক্তিসঙ্গত, আমার দাদা, বাবা ও আমি শুদ্ধ আমাদের সবার নামের আগে আছে MD আমার ছেলের নামের আগে থাকবেনা কেন ? আমি আবার যথারীতি বুঝানো শুরু করলাম বাবাকে। মনে মনে ভাবলাম হায়রে MD, দেশে সমস্যা না রাখার জন্য আর এখানে সমস্যা রাখার জন্য।