মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১১

জলবায়ু পরিবর্তনঃ পর্ব-১

প্রাক কথনঃ


জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের একটি বহুল পরিচিত বিষয় যা বিজ্ঞানীদের গবেষনাগার থেকে শুরু করে চায়ের টেবিলে আড্ডা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে বিবৃতি, কিংবা রাজনীতিবিদদের বক্তৃতায় আলোচিত হয়ে আসছে। তবে বলতে দ্বিধা নেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আমরা যতটা ওয়াকেবহাল এর কারন বা এর পেছনের সুনির্দীষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে আমরা ঠিক ততটাই উদাসীন বা অজ্ঞ। এমনকি প্রায়শই আমরা শুনে থাকি বা পড়ে থাকি যে বিশ্বের অধিকাংশ বিজ্ঞানী বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একমত নয়। কিন্তু আসলেই কি তাই?

 

একটি জরিপের গল্প তাহলে শোনা যাক [১]। জলবায়ু পরিবর্তন প্রসংগে এই সময়ের ভূ-বিজ্ঞানীরা(Geo-Scientists)কি ভাবছেন সেটি জানার জন্য একটি জরিপের ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১০,২৫৭ জন ভূ-বিজ্ঞানীদের কাছে দুটি প্রশ্ন জানতে চাওয়া হয় ঐ জরিপে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক এবং বিভিন্ন সংস্থায় (যেমন NASA, ইউএস জিওলোজিক সার্ভে, NOAA ইতাদি) কর্মরত গবেষকবৃন্দ। জরিপে প্রশ্ন দুটি ছিলঃ

  1. অষ্টাদশ শতাব্দীর (১৮০০) পূর্বের তুলনায় বর্তমান সময়ে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে, নাকি কমেছে, নাকি অপরিবর্তিত রয়েছে?
  2. আপনি কি মনে করেন বৈশ্বিক তাপমাত্রা পরিবর্তনে মানুষের কার্য্যক্রমের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে?

যাই হোক মোট ৩,১৪৬ জন ( প্রায় ৩০ শতাংশ) এই দুটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। প্রশ্নগুলোর উত্তর বিশ্লেষন করে দেখা গেল ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আগের তুলনায় বর্তমান সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ৮২ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন বৈশ্বিক তাপমাত্রা পরিবর্তনে মানুষের কার্য্যক্রমের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।

কিন্তু এতো গেলো বিশেষজ্ঞদের মতামত। সাধারন মানুষ কি মনে করে? গ্যাল্লাপ (The Gallup Organization) থেকে এই বিষয়ক একটি জরিপের ব্যবস্থা করা হয় যাতে সাধারণ জনগনের মতামত পাওয়া যেতে পারে [১, ২]। সেখানে মূলত উপরের জরিপের দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর চাওয়া হয়। উল্লেখ্য যে, এটি একটি চলমান জরিপ এবং সর্বশেষ ২০১১ সালের মার্চ মাসের হিসেব অনুযায়ী মাত্র ৫২ শতাংশ সাধারন মানুষ মনে করেন বৈশ্বিক তাপমাত্রা পরিবর্তনে মানুষের কার্যক্রমের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে [২]।



climate change survey চিত্রঃ ১ - বৈশ্বিক তাপমাত্রা পরিবর্তনে মানুষের কার্যক্রমের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে কিনা জরিপ[১]।


এই মতের পার্থক্য ( ৮২% বনাম ৫২%) আমাদের সামনে যে বিষয়টি নিয়ে আসে তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আমাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে সেই সাথে রয়েছে এই বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের সাথে সাধারণ মানুষের মিথস্ক্রিয়ার অভাব। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর মানুষ হিসেবে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সাম্যক জ্ঞান থাকা উচিৎ, সেই প্রয়াসেই এই সিরিজের সূচনা। এই সিরিজের লেখাগুলো মূলত কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ভিক্টোরিয়ার Pacific Institute for Climate Solutions (PICS) কতৃক প্রনীত অনলাইন কোর্স Climate Insights 101 এর উপর ভিত্তি করে তৈরী। এই সিরিজে আমাদের আলোচনা শুরু হবে জলবায়ু বিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞান দিয়ে। এর পরে ক্রমান্বয়ে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব; জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া; জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির নিবৃত্তিকরন; ও পরিশেষে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হবে।


আবহাওয়া-জলবায়ু-জলবায়ুর পরিবর্তনঃ

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা শুরু পূর্বে আগে জেনে নেয়া যাক আসলে জলবায়ু কি ? আবহাওয়ার সাথে জলবায়ুর আদৌ কোন পার্থক্য আছে কিনা ? জলবায়ুর পরিবর্তন বলতেইবা আমরা কি বুঝি?

একটি উদাহরণ দিয়েই শুরু করা যাক। ধরুন কয়েকজন বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করেছেন সেন্টমার্টিন যাবেন। সফরের সব পরিকল্পনা শেষ কিন্তু শেষ মূহুর্তে বাঁধ সাধল নিরস টিভি সংবাদ, জানানো হলে যে পূর্বাভাসে বলা হয়েছে যে বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে, সতর্কতা বিপদসংকেত ৬, আগামী দুই তিন দিনে ঐ এলাকায় সমুদ্র উত্তাল থাকবে। ব্যাস, মন খারাপ করে বসে থাকলেন সারাদিন। ভেবে দেখুন যখন পরিকল্পনা করছিলেন তখন কিন্তু এই পরিস্থিতি হবে জানতেননা।

আরেকটি উদাহরন দেই। আমি থাকি কানাডার এডমন্টন শহরে। এখানে শীতকালে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত নামে। সুতরাং এই দেশে বাইরে বের হবার আগে টিভিতে বাইরের অবস্থা জেনে বের হতে হয়; যেমনঃ বাইরে তাপমাত্রা কেমন, বাতাস আছে কিনা ( বাতাস থাকলে তাপমাত্রা আরো কমে যায়, এটাকে উইন্ড চিল বলে), তুষার পড়বে কিনা ইত্যাদি। তাপমাত্রার সীমার উপর ভিত্তি করে পোষাক পড়তে হয়। হয়ত পরিষ্কার রৌদ্দজ্বল আকাশ দেখে ভাবলেন, আহা আজ একটি টি শার্টের সাথে পাতলা জ্যাকেট পড়েই বের হই, আসলে তাপমাত্রা তখন হয়ত -৩০ ডিগ্রি, সাথে উইন্ড চিল যোগ করলে সেটা দাঁড়াবে -৪০ ডিগ্রিতে। হলফ করে বলে দিতে পারি, যদি এইভাবে ঘন্টাখানেক থাকতে হয় বাইরে একেবারে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হবে আপনার।

উপরের দুটি উদাহরনেই দেখুন আমরা আমাদের বাইরের স্থানীয় জগতের তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ( বা তুষারপাত) ইত্যাদির দৈনন্দিন অবস্থা জানার বা বোঝার বা অনুভবের চেষ্টা করেছি। এই যে স্বল্প সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বায়ুমন্ডলের অবস্থা, যা কিনা তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ইদ্যাতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেটাই হচ্ছে আবহাওয়া। সুতরাং আপনি যদি বলেন যে ঢাকাতে আজকে ঠান্ডা কিন্তু কালকে তুলনামূলক ভাবে আজকের থেকে গরম তাহলে ধরে নেব যে আপনি ঢাকার আবহাওয়ার কথা বলছেন।

তাহলে জলবায়ু কি ? আরেকটি উদাহরন দিয়ে শুরু করা যাক। ধরুন আপনার এক ভিনদেশী বন্ধু আছেন যিনি ইউরোপে থাকেন। ইউরোপে গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি একবার চিন্তা করলেন বাংলাদেশ ঘুরে আসবেন। আপনাকে ফেইসবুকে জানালেন যে, বন্ধু আমি বাংলাদেশ আসছি, তোমার সাথে দেখা করতে সেই সাথে বাংলাদেশ ঘুরে দেখতে, এখন আমাকে বলো আমি কি ধরনের কাপড়-চোপড় নিয়ে আসব। আপনি চিন্তা করে দেখলেন বন্ধু আসছে মে মাসে, তখনতো প্রচন্ড গরম পড়বে, বৃষ্টিবাদলা হবারও সম্ভাবনা আছে। সুতরাং ফিরতি মেসেজে জানালেন, বন্ধু তুমি বেশি করে শর্টস আর টি-শার্ট নিয়ে আসো, আর পারলে একটা রেইনকোট। গরম কাপড় আনার দরকার নেই একেবারেই।

এই যে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল মানে গরম সেই ধারনা কিন্তু আপনার একদিনেই হয়নি। আপনি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন যে মে জুন মাসে বাংলাদেশে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের উপরে ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি থাকে, সেই সাথে থাকে অত্যাধিক আর্দ্রতা যা সৃষ্টি করে ভ্যাপসা গরম। ফলশ্রুতিতে আপনি যে তথ্য আপনার বন্ধুকে দিয়েছেন সেটা মূলত অনেক বছরের ভিত্তিতে আপনি যে স্থানে থাকেন সেই স্থানের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত বা আরো ভাল করে বললে আবহাওয়ার গড় অবস্থা। এভাবে কোন নির্দিষ্ট স্থানের দীর্ঘ সময়ের, সাধারণত ৩০ বছরের (বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সংগা অনুযায়ী) আবহাওয়ার বিভিন্ন অবস্থার গড় হিসাবই ঐ স্থানের জলবায়ু। সুতরাং আপনি যদি বলেন যে আপনি যেখানে থাকেন সেখানে গ্রীষ্ম কাল গরম আর শীতকাল ঠান্ডা তাহলে ধরে নেব আপনি সেই স্থানের জলবায়ুর কথা বলছেন। এই একই আলোকে এক কথায় আমরা বলি বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ, মরু অঞ্চলের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন, কিংবা কানাডা শীতপ্রধান দেশ।

এবারে আসি জলবায়ু পরিবর্তন প্রসংগে। জলবায়ু পরিবর্তন কি? কীবা তার সরূপ? এটা কি এরকম একটি বিষয় যে একদিন ঘুম ভেঙে দেখলেন যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সমুদ্রের জলে ডূবে গিয়েছে, কিংবা মেরু অঞ্চলের সব বরফ গলে গিয়েছে? অবশ্যই না । জলবায়ু পরিবর্তন মূলত কোন জায়গার গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদী ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন, আরো ভাল করে বললে প্রায় ৩০ বছরের (বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সংগা অনুযায়ী) জলবায়ুর গড় পরিবর্তন। সুতরাং যদি বলি যে গত একশ বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে, অথবা যদি বলি প্রাপ্ত তথ্য মতে এভাবে চলতে থাককে আগামী একশ বছর পরে পৃথিবীর তাপমাত্রা এখনকার চেয়ে ১ থেকে ২ ডিগ্রি বেড়ে যাবে সেটা হচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন। অর্থাৎ এই আলোকে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রতল প্রতি বছর একটু করে বেড়ে গিয়ে আজ থেকে একশ বছর পরে কিছু অঞ্চলের ডুবে যাওয়া কিংবা মেরু অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য পরিমান বরফ আগামী একশ বছরে গলে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের উদাহরন হতে পারে।

আজকের পর্বে জানা হলো আবহাওয়া কি? জলবায়ু কি ? আর জলবায়ু পরিবর্তনই বা কি? সেই সাথে আমরা আরো জানলাম যে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানুষের কার্যক্রমের অবদানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী ও সাধারন মানুষের বোধের অমিল রয়েছে যা নিরসনে আমাদের প্রয়োজন জলবায়ু বিজ্ঞানের মৌলিক ধারনাগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া। আগামী পর্ব থেকে আমরা জলবায়ু বিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞান অর্জনের পথে একটু একটু করে পা বাড়াব।


(চলবে)

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছি গত কয়েক বছর ধরে। ফলশ্রুতিতে আবহাওয়া, জলবায়ু ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশ পড়াশুনা করতে হয়েছে। কিন্তু এত সহজ করে এই জিনিসগুলোকে সাধারন পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করা যায় তা ইউনিভার্সিটি অফ ভিক্টোরিয়ার Pacific Institute for Climate Solutions (PICS) কতৃক প্রনীত অনলাইন কোর্স Climate Insights 101 না দেখতে বোঝা যেতোনা। তাই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই কোর্সের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। এই কোর্সের একটি ট্রেইলার নিচে দেয়া হলো। আগ্রহী পাঠক এই সিরিজ পড়াকালীন সময়ে কোর্সটিও ঘুরে আসতে পারেন অনলাইনে।



সেই সাথে চমৎকার এই অনলাইন কোর্সের খোঁজ দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি স্বাধীন ভাইকে।

তথ্যসুত্রঃ

[১] Peter T . Doran and Maggie Kendall Zimmerman, 2009. “Examining the Scientific Consensus on Climate Change” EOS, Volume:90 Number 3.
[২] GALLUP POLL: And from what you have heard or read, do you believe increases in the Earth's temperature over the last century are due more to -- [ROTATED: the effects of pollution from human activities (or) natural changes in the environment that are not due to human activities]?