শনিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১০

তবে কি ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি?



একটি শোনা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক।গল্পের মূল বক্তব্যেকে ঠিক রেখে স্থান কাল পাত্র পরিবর্তন করা হয়েছে। ধরে নেই সেই গল্পের প্রধান চরিত্রটির নাম বর্ণ, একজন বইপাগল কিশোর। স্কুল ছুটিতে ট্রেনে করে নানাবাড়ি যাচ্ছে। মাঝখানের কোন এক স্টেশন থেকে একজন যাত্রী উঠলেন তাদের কামরায়। ভদ্রলোকের হাতে একটি কিশোর উপন্যাস ছিল। লোকটির সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বইটি হাতে নিয়ে পড়া শুরু করল বর্ণ। অপরিচিত এক লেখকের, আস্তে আস্তে ঢুকে যেতে লাগল সে বইটির ভেতরে, এ যেন অসাধারণ এক কাহিনী, চমৎকার ভাবে এর চরিত্রগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

-আমি নেমে যাচ্ছি।
হঠাৎ লোকটির কথায় সে বইয়ের জগৎ থেকে বাইরে আসল।
-আমার নামার স্টেশন চলে এসেছে, বইটা দেবে খোকা? এটি আমার ছেলের জন্য এনেছি লাইব্রেরী থেকে, সেও তোমার মত বইপাগল।
কিন্তু বইটি যে তার পড়া শেষ হয়নি আর মাত্র কয়েকটা পৃষ্ঠা বাকী। কিছু করার নেই অবশ্য, তাড়াতাড়ি করে বর্ণ বইটির আর লেখকের নাম টুকে রেখে তাকে ফিরিয়ে দিল।
গল্পটি এখানেই শেষ নয়, নানাবাড়ি যেয়ে পরেরদিনই সে ছোটমামাকে নিয়ে ট্রেন স্টেশনে আসল বইয়ের দোকানে। স্টেশনের সব কয়টি দোকান তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বর্ন যখন বইটা পেলনা তখন ছোটমামা তাকে বুঝিয়ে বলল ঢাকায় ফিরে কিনিস সেখানে অসংখ্য দোকান নিশ্চয়ই পাবি। পুরো ছুটির সময় বর্ণের খুব খারাপ কাটল এবং যে কয় দিন থাকার চিন্তা ভাবনা করে এসেছিল তার কিছুটা আগেই সে ঢাকাতে চলে আসল। ফিরে এসেই বর্ণ তার বড় ভাইয়াকে নিয়ে একে একে আশেপাশের সব বইয়ের দোকান ঘেঁটেও যখন বইটা পেলনা তখন হতাশা ছাড়া তার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকলনা।বইটি না শেষ করতে পারার যন্ত্রনা তার পিছু ছাড়ছিলনা, কি ছিল ঐ শেষ পৃষ্ঠাগুলিতে?
আস্তে আস্তে সময় বয়ে যায়, বর্ণও স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে একসময় কর্মজীবনে চলে আসে। সরকারী চাকুরী সুবাদে তার পোষ্টিং হয় একটি মফস্বল শহরে। অফিসের ব্যস্ততার শেষে তার সময় কাটত শহরটির পাবলিক লাইব্রেরীতে বই পড়ে। একদিন সেই লাইব্রেরীতেই খুঁজতে খুঁজতে বর্ণ অবশেষ ছেলেবেলার শেষ না করা সেই বইটি পেয়ে গেল। বইটি যে আবার পড়তে পারবে তার আশা সে ছেড়েই দিয়েছিল। তাড়াতাড়ি সেটি নিয়ে সে শেষ পৃষ্ঠাগুলিতে চলে গেল। কিন্তু এ কি পড়ছে সে ? এত খুবই সাধারণ মানের একটি বই, কাহিনীও তেমন চমকপ্রদ কিছু নয়। যে আগ্রহ নিয়ে বর্ণ পড়তে শুরু করেছিল তা নিমিষেই মিলিয়ে গেল, বইটি আর শেষ করা হলনা তার। বইটির কোন পরিবর্তন হয়নি কিন্তু সেই সময়টা হারিয়ে ফেলেছে বর্ণ একথাটি মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হয় তার।
স্কুলে পড়ার সময় অন্যদিন পড়াশুনা করি আর না করি বুধবারে সন্ধ্যে লাগার পরপরই বাসায় এসে বই নিয়ে বসতাম আর একটু পরপর ঘড়ি দেখতাম কখন ৯ টা বাজবে। পড়াশুনা ঠিকঠাক মত করলে টিভি দেখার অনুমতি মিলবে এই প্রত্যাশায়, কারন বুধবারেই যে ম্যাকগাইভার হয়। তার অনেক বছর পর আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি থেকে বের হয়ে যাচ্ছি তখন আবার ম্যাকগাইভার সিরিজ টিভিতে দেখানো শুরু করল। একদিন বেশ আগ্রহ নিয়ে বসলাম সেটি দেখার জন্য এবং বলতে দ্বিধা নেই প্রতি পদক্ষেপে যুক্তি খোঁজা শুরু করলাম এবং একসময় মনে হলো ম্যাকগাইভার সিরিজ আসলে একটা গাঁজাখুড়ি কাজকারবার।
একবার স্কুল ছুটিতে গিয়েছি দাদাবাড়ি। টিভিতে তখন 'আলিফ লায়লা' সিরিজের রমরমা অবস্থা। 'চিমা মস্তকে হুর হুর' তখন আমাদের মুখে মুখে। মালেকা হামিরাহ, কেহেরমান, শাহাজাদা জালাল তালিব, কিংবা চিমা দেব আর লিমা দেব চরিত্রগুলো তখন আমাদের কল্পনায় ঘুরে ফিরে বেড়ায়।যাই হোক শুক্রবারে আলিফ লায়লা হবে সড়ে আটটায়, হঠাৎ করে সেই সময় কারেন্ট চলে গেল। চাচাত ভাইদের কেউ একজন খবর দিল বাজারে কারেন্ট আছে। সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের একটুও দেরি হলোনা, সবাই মিলে জোরে দিলাম দৌড়। হাঁপাতে হাঁপাতে যখন বাজারে পৌছলাম তখন সবে আলিফ লায়লার টাইটেল মিউজিকটা শুরু হয়েছে, আমাদের মনে হলো আমরা বিশ্ব জয় করেছি। তার থেকে অনেক বছর পরে বাংলাদেশের প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলিতে আবার যখন আলিফ লায়লা দেখাত তখন আর ম্যাকগাইভার সিরিজের মত নিরীক্ষণ করে দেখার ইচ্ছে হয়নি তবে লক্ষ্য করতাম আমার সাত বছর বয়সী ভাগনেটার মধ্যে আমার আগের দিনের সেই উম্মাদনা কাজ করছে সপ্তাহের বিশেষ ঐ দিনের বিশেষ সময়টাতে।
একসময় ছবি দেখতে খুব ভালবাসতাম। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজী সবকিছু গোগ্রাসে গিলতাম। কিছু দেখতাম বিনোদনের জন্য আবার কিছু দেখতাম নিছক বন্ধুদের সাথে আড্ডার বিষয়ের জন্য। আজ যখন ছিনেমা দেখতে বসি তখন সবার আগে লক্ষ্য পড়ে সেটার চিত্রনাট্য, নির্দেশনা কিংবা সম্পাদনার দিকে। সহজ কথায় বলতে গেলে আগের সেই বিনোদন আর পাইনা। বেশ ভাল ছিলাম যখন এত কিছু বুঝতামনা।
আমরা দুই ভাই বোন যখন বিটিভির নাটকগুলো মজা করে দেখতাম লক্ষ্য করতাম বাবা মার সেগুলো নিয়ে তেমন কোন উম্মাদনা নেই। 'বাকের ভাইয়ের' ফাঁসি হবে কিনা সেটা নিয়ে আমরা যতটা চিন্তিত ছিলাম তারা ঠিক ততটাই উদাসীন ছিল। এখন লক্ষ্য করি আজকালকার নাটকগুলি দেখে অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে। যে 'ইত্যাদি' একবার দেখতে না পারলে মাথা খুটে মরতাম সেই 'ইত্যাদিও' আজ ভয়াবহ বিরক্তি লাগে। একবার ভাবি নাটক, গান, কিংবা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মান কি পড়ে গেছে, পরক্ষণে মনে হয় আসলে ওগুলোর মান হয়ত ঠিকই আছে বরং আমরা আমাদের সেই সময়টাকে হারিয়ে ফেলেছি।
ছেলেবেলায় ভাবতাম কখন বড় হব, কখন বাবার মত স্বাধীন হব, আর আজকে বড়বেলায় এসে মনে হয় সেই জীবনটাই অনেক ভাল ছিল, যুক্তিহীন আবেগময় একটা সময়, সবকিছুতেই যেন নির্মল বিনোদন। ছেলেবেলা এমন একটা সময় যখন বাবা গাছ থেকে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে আর আমি ভয় না পেয়ে বাবার বোকামী দেখে হাসছি, যখন যখন নিছক বাগান করা নিয়ে দুই ভাই বোনের মধ্যে প্রথমে মারামারি পরে তা মনোমালিন্যে রূপ নিচ্ছে, যখন বাসায় প্রাইভেট টিউটিরের কাছে পড়তে বসে হাগু পাচ্ছে কিন্তু লজ্জায় বলছিনা অবশেষে বসে বসেই ....., যখন পহেলা বৈশাখের মেলায় বাবার হাত ধরে টমটম গাড়ি কিনে নিয়ে আসার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেটার জীবন শেষ করে দিচ্ছি, যখন বাবার বকুনির ভয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করছি দুপুর বেলায় আর বাবা ঘুমিয়ে পড়লেই রেডিওটা নিয়ে দুয়ারে গাছের নিচে পাটি বিছিয়ে নাটক শুনছি।
আজকে ব্যস্ত নাগরিক জীবনে চোখ বন্ধ করে তাই মাঝে মাঝে ফিরে যেতে চাই সেই ছোটবেলায়। মাঝে মাঝে ফ্যান্টাসি ছবি দেখি যাতে ফিরে যাই সেই যুক্তিহীন মুক্তির আনন্দে, কিন্তু সেই আনন্দ আর ফিরে আসেনা। ঠিক যেমন বড়বেলায় মেলা থেকে কিনে আনা তালপাতার বাঁশি আগের মত আর বাঁজেনা।

Get this widget |Track details |eSnips Social DNA


প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন