শুক্রবার, ৩০ জুলাই, ২০১০

সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়

স্কুলে পড়ার সময় ভাব সম্প্রসারণ করতে হতো 'সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়'। যার মানে দাঁড়ায় সঠিক সময়ে সঠিক কাজ না করলে তা আরো সমস্যা তৈরি করে ভবিষ্যতে। জাতি হিসেবে আমরা পরীক্ষার খাতায় যা লিখি বাস্তব জীবনে তার খুব কমই প্রতিফলন ঘটাই। একথা শুধু সাধারণ আমজনতার জন্যই প্রযোজ্য নয় দেশের আমলা, রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের ক্ষেত্রেও তা অমেঘ সত্য। আমরা তখনই একটা সমস্যা নিয়ে কথা বলি যখন তা মাথায় কামড় দেয়, যখন তাকে আর সমাধান করার উপায় থাকেনা। সমস্যার গোঁড়াতে আমরা সময় ক্ষেপণ করি কখন তা সহ্যের বাইরে যায় তা দেখার জন্য।


ভারত ফারাক্কা প্রকল্পের পরিকল্পনা করে ১৯৫১ সালের দিকে যাতে গঙ্গা নদীতে ব্যারেজ নির্মাণ করে একটি বিকল্প খাল দিয়ে গঙ্গার পানিকে হুগলী নদীতে প্রবাহিত করে বন্দরের সঞ্চিত পলিকে স্থানচ্যুত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেই পরিকল্পনা পরিশেষে বাস্তবায়িত হয় ১৯৭৪-৭৫ সালে ‘ফারাক্কা ব্যারেজ’ নামে। ৫১ থেকে ৭৪ এই সুদীর্ঘ সময়ে এই প্রকল্পের বিষয়ে আমাদের অগ্রগতি একমাত্র  ১৯৭২ সালে আন্তঃসীমান্ত নদীসমুহের উন্নয়নের দিককে সামনে রেখে সংযুক্ত নদী কমিশন (জ়েআরসি) প্রতিষ্ঠিত হওয়া, এর বেশি কিছু নয়। এই সময়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম ভারতের এই কথাতে যে "ব্যারেজ নির্মানের পুর্বেই বাংলাদেশ ও ভারতের স্ব স্ব হিস্যা চূড়ান্ত করা হবে।" আদতে সেটা হয়নি, ১৯৭৪ থেকে ১৯৯৬ এই ২২ বছর ভারত প্রায় একতরফা ভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করেছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হারিয়েছে তার সবুজ আর লবনাক্ততা এসে গ্রাস করেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে। অবশেষে ১৯৯৬ সালে একটি চুক্তি হয়েছে। ফারাক্কা ব্যারেজের ক্ষতি যেমন বাংলাদেশের জন্য অপুরণীয় তেমনি গঙ্গা চুক্তির বাস্তবায়নও বাংলাদেশের পানিসম্পদের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। কারন ভারতের সাথে বাংলাদেশের অর্ধশতাধিকের অধিক আন্তঃসীমান্ত নদী আছে। তাই ধারণা করা হচ্ছিল গঙ্গা চুক্তির বাস্তয়ায়ন অন্যান্ন অভিন্ন নদীগুলোর সমস্যা সমাধান কল্পে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। আদতে তা হলোনা। ১৯৯৬ থেকে ২০১০ এই ১৪ বছরেও আমরা তিস্তা নদীর বিষয়ে কোন মতৈক্যে পৌঁছতে পারিনি। কেন পারিনি সেটা সংযুক্ত নদী কমিশন ভাল বলতে পারবে। তবে আমি এই ব্যর্থতার একটি দিক নিয়ে পাঠকের মনযোগ আকর্ষণ করতে চাই আর তা হলো সঠিক সময়ে সঠিক কাজ না করা।

লক্ষ্য করে দেখবেন তিস্তায় পানি নেই কিংবা গঙ্গায় পানি নেই এই জাতীয় কথাবার্তা নিয়ে আমাদের সংবাদ মাধ্যম, রাজনীতিবিদ, আমলা ও বুদ্ধিজীবিগণ সজাগ হন যখন শুষ্ক মৌসুম ঠিক তখন। কারন সমস্যা তখন মাথায় কামড় বসাচ্ছে, চাষ করবার জন্য প্রয়োজনীয় পানি নেই, কৃষক মাথা খুটে মরছে। ফলশ্রুতিতে এটি নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা শুরু হয়। সেই সাথে চলে মিটিং, যৌথ নদী কমিশনের সমীক্ষা, বিশেষজ্ঞ কিংবা সংসদীয় কমিটি গঠন ইত্যাদি, ইত্যাদি। এসব করতে করতে জুন জুলাই চলে আসে, নদীতে বান ডাকে। হুড় মুড়িয়ে পানি আসে নদীর দুকূল বেয়ে, আসে বন্যা। পেট ভরা অবস্থায় কি আর খাবারের কথা ভাল লাগে, সুতরাং আমরা এই সময়ে ভুলে যাই যে আমাদের কোন পানি সমস্যা আছে। সমস্যার কথা আবার মনে পড়বে সামনের নভেম্বর ডিসেম্বরের দিকে। এই প্রক্রিয়া চলবে ততদিন যতদিননা আমাদের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প একেবারে আইসিইউ তে যাবে। পাঠক লক্ষ্য করেছেন কিনা জানিনা তবে আমি মার্চের পর থেকে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোন আলোচনা দেখিনি, আশা করছি আগামী বছর জানুয়ারির দিকে দেখতে পাব।

২০০৯ সাল ছিল টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনার বছর। সংবাদ মাধ্যম, ব্লগ বা অন্যান্ন প্রচার মাধ্যম খুঁজে দেখুন লেখালেখি, ভিডিও, আর প্রতিবেদনের ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন। ১৯৫৪ সালে যে পরিকল্পনার শুরু ১৯৭৪ সালে তার বাস্তবায়নের স্থান নির্ধারণ আর ২০০৯ এর দিকে এসে তার নির্মাণ কাজ শুরুর কথা। আমাদের সংসদীয় কমিটি ভারত সফরে থেকে ফিরে এসে মন্তব্য করেছেন  'হেলিকপ্টারে খুব নিচু দিয়ে পরিভ্রমনকালে টিপাইমুখে কোনো অবকাঠামো প্রতিনিধিদলের দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রকল্পের ভাটিতে কোনো ব্যারেজ বা অবকাঠামো নির্মাণের কোনো রকম প্রস্তুতিও পরিলক্ষিত হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখনো কোনো প্রাথমিক ভৌত কার্যাদি শুরু হয়নি।’ সুতরাং কি কর নাক ডেকে ঘুমাও। আর তাছাড়া ভারত সরকার এমন কিছু করবেনা যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় ঠিক যেমনটা আশ্বাস দিয়েছিল ফারাক্কা ব্যারেজের সময়। সুতরাং 'নো চিন্তা ডু ফুর্তি'। আমরা বেমালুম ভুলে গেলাম টিমাইমুখের কথা। রাজনীতিবিদেরা, বিশেষজ্ঞরা অন্য কিছু নিতে মেতে উঠল আর টিপাইমুখ পড়ে থাকল বারাক নদীতে বাংলাদেশের মরণফাঁদ হয়ে। আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি টিপাইমুখ বাঁধ বাস্তবায়িত হচ্ছে আর সেই সাথে সাথে বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য গিয়ে পড়ছে টিপাইমুখের বাঁধ রুল কার্ভের উপর। আমারা আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করব সেই বাস্তবায়নের পরে। একথা সত্য যে এতবড় পরিকল্পনা করে ভারত টিপাইমুখের বাস্তবায়ন আজ বা কাল করবে কিন্তু তাতে যেন বাংলাদেশের স্বার্থও রক্ষা পায় সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কি আদৌ সেই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে নাকি 'বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হবেনা ' এই জাতীয় অবৈজ্ঞানিক আশ্বাসে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে সেটা বোধগম্য নয়।
ব্রহ্মপুত্র নিয়ে কথা আর নাইবা বললাম, আমরা কোন কিছু জানার আগেই তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদীতে বাঁধ হয়ে গেছে। এখন পরবর্তী কূটনৈতিক আলোচনা কি হবে সেই বিষয়ে পত্র পত্রিকাতে তন্ন তন্ন করে খূঁজেও কোন আলামত পাইনি। যাক আমরাত সুখি জাতি কি হবে এত কিছু ভেবে। ভাবত তখন যখন দেখব শুষ্ক মৌসুমে আমাদের সাধের যমুনাতেও পানি নেই।
ঢাকার পানিসমস্যা নিয়ে গবেষণা, লেখালেখি, আন্দোলন চলছে  অনেক বছর ধরে। পরিবেশবাদীরা অনেক ধরনের জনসংযোগ করছে। সরকার দেখেও না দেখার ভান করছে। কিছুদিন পর পর উচ্ছেদ করে অবৈধ দখলকারীদের আবার দুদিন বাদে তারা তাদের অবস্থান ফিরে পায়। এ যেন চোর পুলিশ খেলা। ঢাকায় জানজট অসহ্য লাগলে মনে হয় ঢাকার চারদিকের নদীগুলোকে নাব্যতা ফিরিয়ে দিয়ে বৃত্তাকার নদীপথ করতে হবে, ওয়াসার পানিতে ময়লা পেলে মনে হয় বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে হবে, বৃষ্টিতে ঢাকার রাজপথ ডুবে গেলে মনে হয় ঢাকার খালগুলিকে ফিরিয়ে আনতে হবে তারপর এগুলো সাময়িক ভাবে চলে গেলে আবার সেই একই অবস্থা। আমাদের সরকারও ভাবে পাঁচ বছরের জন্য এসেছি আগে বরং পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য মূলধন সংগ্রহ করি তারপর অন্যকিছু ভাবা যাবে।
এভাবে সময়ের সাথে আমাদের আলোচনা আবর্তিত হয়, সমস্যাগুলি থেকে যায় বছরের পর বছর। আমরা স্বপ্ন দেখি কোন এক দিন এক মহামানব এসে আমাদেরকে মুক্ত করবে কিন্তু তার আগমন যে আমাদের মধ্য থেকেই হতে হবে সেটা মনে রাখিনা।

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন
দ্বিতীয় প্রকাশঃ কালের কন্ঠ