সোমবার, ২ আগস্ট, ২০১০

ঐতিহ্য বনাম অর্থ

এডমন্টনকে বলা হয়ে থাকে কানাডার ফেস্টিভাল সিটি। বছরের ছয় থেকে সাত মাস তুষারে ঢাকা থাকলেও বসন্ত আর গ্রীষ্মের সময় এডমন্টন আসলেই উৎসবে মেতে উঠে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে যে উৎসব সবার নজর কাড়ে তা হলো এর হেরিটেজ ফেস্টিভাল যাকে বাংলায় বলা যেতে পারে 'ঐতিহ্য মেলা'। কানাডা আসলে বহু জাতির মানুষদের নিয়ে গড়া একটি দেশ। এখানকার শিশুরাও এই মাল্টি কালচারাল পরিবেশে বেড়ে উঠে। নানা সংস্কৃতির মিলনমেলা এই দেশটিতে তাই স্ব স্ব সংস্কৃতি প্রদর্শনের সুযোগ থেকে যায় গুটি কয়েক উৎসবে। এডমন্টনের ঐতিহ্য মেলা সেরকমই একটি উদাহরণ। ১৯৭৬ সালে মাত্র ১১ টি জাতির সংস্কৃতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসবে এবারে ( ২০১০) অংশগ্রহণ করছে প্রায় ষাটটির মত দেশ। প্রতিবছর  আগষ্টের প্রথম লং উইকেন্ডে ( শনি রবি সোম বার) তিন দিন ধরে এডমন্টনের হরেলাক পার্কে এই বহু সাংস্কৃতির মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। কতটা জনপ্রিয় এই ঐতিহ্য মেলা তার একটা নমুনা দেই। যেখানে ২০০৬ সালের আদমশুমারীতে এডমন্টনের জনসংখ্যা রেকর্ড করা হয়েছিল ৭৩০ হাজার সেখানে একই বছর হেরিটেজ ফেস্টিভালে দর্শক উপস্থিতির সংখ্যা ছিল ৩৭০ থেকে ৪২০ হাজার ( তথ্যসুত্র )। এরকম একটি ভিত্তিতে নিজেদের সংস্কৃতি প্রদর্শনের সুযোগ আসলেই লুফে নেয়া উচিৎ।


 এডমন্টনের এই হেরিটেজ ফেস্টিভালে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ত্ব করে আসছে 'বাংলাদেশ কানাডা এসোশিয়েশন অফ এডমন্টন, সংক্ষেপে বিসিএই। এখানে প্যাভিলিয়ন দিতে কতৃপক্ষের অনুমোদন লাগে সুতরাং বলাই বাহুল্য যে এখন পর্যন্ত বিসিএই হচ্ছে একমাত্র বৈধ সংগঠন যারা এই মেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ত্ব করার দায়িত্ব পায়। সুতরাং সার্বিক ভাবে ধরে নেয়া যায় বাংলাদেশের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি প্রদর্শনের যাবতীয় দায়ভার বর্তায় বিসিএই এর উপর সেটা তারা চাইলেও কিংবা না চাইলেও। কারন একজন আফ্রিকান কিংবা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান নাগরিক যখন দেখবে একটি প্যাভিলিয়নের উপর  'BANGLADESH' কথাটি লেখা তখন সে ধরে নেবে এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রদর্শক। এখানে গেলে বাংলাদেশের পোষাক দেখব, কুটির শিল্প দেখব, সংগীত, চারু কিংবা কারুকলা দেখব, বাংলাদেশি মানুষের সাথে মিশব, বাংলাদেশি খাবার খাব। একই কথা কিন্তু শোভা পাচ্ছে হেরিটেজ ফেস্টিভালের উদ্দেশ্যের মধ্যেঃ
"The Edmonton Heritage Festival is specifically designed to be a family-friendly, alcohol-free event, in which each pavilion is able independently to offer a sampling of their unique foods, entertainment, arts and crafts, and customs".
ভাবার্থ করলে দাঁড়ায়ঃ
"এডমন্টন ঐতিহ্য মেলা এমন একটি মিলন মেলা যেখানে প্রত্যেকটি প্যাভিলিয়ন তাদের নিজস্ব খাবার, বিনোদন, শিল্প ও ঐতিহ্য প্রদর্শন করবে।"
এখানে যেহেতু প্যাভিলিয়নগুলো একেকটি দেশের পরিচায়ক সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায় যে দেশের নামে যে প্যাভিলিয়ন থাকবে সেখানে সে দেশের ঐতিহ্য দেখা যাবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি গত চার বছর ধরে এই মেলায় যাই, এবং স্বভাবতই সবার আগে যাই নিজের দেশের প্যাভিলিয়নে। বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন মূলতঃ ব্যস্ত থাকে তাদের খাবার দাবার বিক্রি নিয়ে।আগেই বলেছি প্রচুর লোক সমাগম হয় আর খাবার দাবার প্রস্তুতিতে সবাই স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় থাকে সুতরাং খাবার বিক্রি করে এসোশিয়েশনের বেশ বড় রকম একটা লাভ থেকে যায়। এটি ইতিবাচক ভাবেই দেখি কারন একটি এসোশিয়েশনের নিজস্ব বড় মাপের ফান্ড তাকে অনেক ভাবেই সচল হতে সাহায্য করে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবেনা এই ঐতিহ্য মেলায় ঐতিহ্য প্রদর্শনের অনেকগুলি দিকের মধ্যে একটি হচ্ছে খাবার এর বাইরে রয়েছে আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য এসবের প্রদর্শনী। সাধারনত অধিকাংশ দেশ তাদের প্যাভিলিয়নের সামনে একটি করে মঞ্চ নেয় যেখানে তাদের শিল্পীরা সংগীত, নৃত্য, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের প্রদর্শনী করে। আগ্রহী দর্শনার্থীরা ঘুরে ঘুরে এসব দেখে। যাদের নিজস্ব মঞ্চ থাকেনা তারাও প্যাভিলিওনের ভেতরে বিশেষ কোন অংশ জুরে তাদের ঐতিহ্যের পরিচায়ক বিভিন্ন বস্তু সাজিয়ে রাখে। বাংলাদেশ এসবের ধার তেমন একটা ধারেনা, তাদের খাবার বিক্রি করে টাকা আসলেই তারা খুশি। গত বছর একটা মঞ্চ নেয়া হয়েছিল যেখানে আমাদের এখানকার শিশুশিল্পীরা তাদের সংগীত, নৃত্য ইত্যাদি প্রদর্শন করেছিল। প্যাভিলিয়নের সামনে আমাদের বাংলাদেশি মেয়েরা মেহেদী লাগিয়ে দিত অগ্রহীদেরকে। আশা করেছিলাম এবছর বোধকরি সেটা আরো বড় আঙ্গিকে দেখা যাবে। কিন্তু বিধিবাম এবারে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নের সামনে মঞ্চত নেইই বরং দুটি প্যাভিলিয়নের একটিতে প্রায় সবকটি টেবিল সাবলেটে ভাড়া দেয়া হয়েছে অন্যদেশি কিছু মানুষকে। প্রথমে বিষয়টা খেয়াল করিনি কিন্তু প্যাভিলিয়ন ঘুরে পুরো বিষয়টা যখন বুঝতে পারলাম তখন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতেও লজ্জাবোধ হচ্ছিল একজন বাংলাদেশি হিসেবে। ভাগ্যিস সাথে অন্যদেশীয় কোন বন্ধু বান্ধব ছিলনা থাকলে আমার দেশের প্যাভিলিয়নে অন্যদেশীয় ফেরিওয়ালা দেখে হয়ত আমাদের সম্পর্কে ওদের ধারণাই পালটে যেত।
ছবিঃ বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নের পসরা সাজিয়ে বসেছে ভিনদেশি একজন ( ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ রূপক মুতসুদ্দী) 

প্রবাসে যারা স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন তাদের একটি বড় রকম সমস্যা হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে। এখানে বেড়ে উঠা বাংলাদেশি প্রজন্ম কিন্তু মনে প্রানে ধ্যানে লালন করে কানাডাকে আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেহেতু আমাদের হৃদয়ে লালিত হয় বাংলাদেশ আর যেহেতু বহুসাংস্কৃতিক এই দেশে বিভিন্ন জাতি তাদের নিজেদের মত করে সাংস্কৃতি লালন করে তাই আমাদের সন্তানদেরও বাংলাদেশি সংস্কৃতির একটা ছোঁয়া দেবার জন্য হেরিটেজ ফেস্টিভালের গুরুত্ত্ব অপরিসীম। সেই সাথে অন্যান্ন দেশীয় মানুষদেরকে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলার জন্যও সেটা জরুরী।  এই বিষয়গুলো যদি আমাদের মাথায় না আসে সেক্ষেত্রে শুধু প্যাভিলিয়ন নিয়ে সং সেজে খাবার বিক্রি করার  কোন মানে হয়না।

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন