বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ, ২০১০

সম্পর্ক

লাবলুকে যখন খানসেনারা ধরে নিয়ে যায় রাহেলা সেসময় দুই মাসের পোয়াতি। সেদিনের কথা এখনও মনে আছে তার, বিকেল থেকেই ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল।একেতো আষাঢ় মাস তার উপর যুদ্ধের কারনে বাজারে তেমন কিছু পাওয়া যায়না বলে ডাল চাল দিয়ে খিচুড়ী রান্না করছিল রাহেলা। লাবলু বেরিয়েছে সেই সকালে, যাবার আগে বলে গিয়েছিল যে রসুলপুর স্কুলে খানসেনাদের ক্যাম্পের বিস্তারিত খবর গোপনে শামীমদের পৌঁছে দিয়েই ফিরে আসবে সে। সেই ফিরে আসা আর হয়নি, তার দুদিন পরে পুংলী নদীর পাড়ে স্কুলঘরটার পেছনে বটগাছের নিচে লাবলুর লাশ পাওয়া যায়, শিয়াল শকুনে ছিড়ে কুড়ে খেয়েছে, গ্রামের একটা লোকও সাহস পায়নি লাশটিকে গোসল করিয়ে দাফন করতে।

শামীমরা ক্যাম্প করেছিল রসুলপুর গ্রাম পেরিয়ে পুংলী নদীর ঐ ধারে। পুংলী ব্রিজটাতে গিজ গিজ করছে পাকবাহিনী আর রাজাকারের দল, ব্রিজ পেরিয়ে এপারে আসার চেষ্টা করা বোকামী, তাই পরিকল্পনা ছিল সুযোগ মত নদী পেরিয়ে এসে পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমন করবে। শামীমরা যখন ভারতে ট্রেনিংয়ে যায় তখন ওদের সাথে লাবলুরও যোগ দেবার কথা ছিল, কিন্তু ঘরে নতুন অতিথি আসছে, বাবা মাও বেঁচে নেই, তাই খালি বাড়িতে অন্তস্বত্তা বউকে রেখে যেতে বিবেকে বাঁধছিল লাবলুর। যুদ্ধে না যেতে পারার কারনে কিছুটা হলেও অনুশোচনায় ভুগত সে, তাই এবার যখন শামীমদেরকে সাহায্য করার সুযোগ আসল লাবলু আর কিছু ভাবার সময় নেয়নি। সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নদী সাতরিয়ে সে উপারে পৌঁছল। শামীমদের ক্যাম্পে যেয়ে ওদেরকে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে নিরাপদেই ফিরে আসছিল সে, মাঝপথে বিপত্তি ঘটাল হারুন। লাবলু সবে নদী পেরিয়ে এইপারে এসেছে, সামনে দেখে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে হারুন, সাথে অস্ত্রধারী দুই সৈন্য। হারুন সম্পর্কে লাবলুর চাচাত ভাই, ছোটবেলা থেকে প্রায় একই সাথে বেড়ে উঠেছে দুইজন। খানসেনারা যখন রসুলপুরে ঘাঁটি গাড়ে, যে কয়জন মানুষ তাদেরকে পাকিস্তানের পতাকা হাতে নিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছিল তার মধ্যে হারুনের বাবা একজন। লাবলুকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাবার পর রাহেলা পাগলের মত ছুটে গিয়েছিল হারুন আর ওর বাবার কাছে, হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছিল লাবলুকে ছেড়ে দেয়ার জন্য, কিন্তু তাতে ওদের মন গলেনি। পাকসেনাদের ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে একবারের জন্যও লাবলু মুখ ফুটে বলেনি শামীমদের কথা। শেষের দিকে কথা বের করতে না পেরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে লাবলুকে।

লাবলু মারা যাবার ঠিক দুই দিন পরে রাহেলার ঘরে আসে হারুন, চোখের চাহনি দেখে বুঝার বাকী ছিলনা কি চায় সে। পায়ে পড়ে কেঁদে কেটেও যখন হারুনকে থামাতে পারছিলনা, তখন একটাই আকুতি ছিল তার আর তা হলো তাকে যেন সে স্ত্রীর সম্মানটুকু দেয়, তার পেটে সে সন্তান আছে সে যেন জারজ হিসেবে এই পৃথিবীতে পরিচিত না হয়। যুদ্ধ হারুনকে অমানুষ করলেও কেন জানি রাহেলায় কথায় সে রাজী হয়, সেই সাথে রাজী করাতে পারে তার বাবাকে এখলাস মিঞাকেও। শুরু হয় রাহেলার দ্বিতীয় জীবন। রসুলপুর পাক সেনামুক্ত হতে সময় লেগেছিল অনেক, শামীমরা দুই দুইবার আক্রমন করেও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছিল। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে তারা অবশেষে সফল হয়।যে রাতে শামীমরা পাকসেনাদের ঘাটি আক্রমন করে সেই রাতে এখলাস মিঞাও ধরা পড়ে, কোনমতে রাহেলাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে হারুন।

সারা দেশ যখন বিজয়ের উল্লাসে মাতম করছে হারুন তখন অন্যত্র যেয়ে গা ঢাকা দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে, কেমন করে যেন সে বেঁচেও যায়। পালাবার সময় লুট করা টাকা পয়সা সাথে নিয়ে এসেছিল, তাই দিয়ে ময়মনসিংহ শহরে একটা ব্যাবসা শুরু করে। যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতিতে একসময় ফুলে ফেঁপে উঠে তার ব্যবসা। নিজের বেশভুষা পরিবর্তন করে একসময় পূর্বইতিহাসটা প্রায় ঝেড়ে ফেলে দেয় শরীর থেকে। তবে এসবের একমাত্র সাক্ষী রাহেলা, মনের মধ্যে পুষে রাখা অসম্ভব ঘৃনা নিয়েও রাহেলা হারুনের সাথে ঘর করে যাচ্ছিল শুধুমাত্র তার সন্তান কৌশিকের কথা ভেবে। একথা ঠিক যে স্ত্রী হিসেবে তার কোন অমর্যাদা কখনো করেনি হারুন কিন্তু মনের পুঞ্জীভূত ক্রোধ ভেতরে ভেতরে কুঁড়ে খাচ্ছিল তাকে। সে জানত এর থেকে তার মুক্তি নেই তাই সুখ না থাকলেও সন্তানের কথা ভেবে স্বস্তিকে পুঁজি করে কেটে যাচ্ছিল তার জীবন।

সময় গড়িয়ে যায়, আস্তে আস্তে বড় হয় কৌশিক। হারুনকেই বাবা বলে জানে সে আর হারুনও কৌশিককে নিজের সন্তানের মতই স্নেহ আর আদরে বড় করে। মফস্বলের স্কুল কলেজের গন্ডি পেরিয়ে কৌশিক একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেয়। হলে উঠে কৌশিকের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয় আবীর। দুইজনেই সাংবাদিকতায় পড়ে, ভাল আবৃত্তি করে, নিয়মিত নাটকের মহড়ায় যায়। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় কৌশিকদের বিভাগের জাফর স্যার সব ছাত্রকে একটি এসাইনমেন্ট দেয় আর তা হলো সবাইকে নিজ নিজ গ্রামে যেয়ে একাত্তরের অন্তত একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলে একটি রিপোর্ট তৈরী করতে হবে। নিজের গ্রামের প্রসঙ্গে কৌশিক কিঞ্চিত বিব্রত হয় কারন জন্মের পর থেকে সে শুধু শুনেছে যে রসুলপুর তার গ্রামের নাম, কিন্তু কোন এক অজানা কারনে তার বাবা মা তাকে কখনই গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায়নি। স্কুল ছুটিতে সবাই যখন দাদাবাড়ি নানাবাড়িতে যেত কৌশিক তখন সময় কাটাত গল্পের বই পড়ে। একটা বয়সের পর সে তাই কখনো তার বাবা মাকে নিজের গ্রামের কথা আর জিজ্ঞেস করতনা। জাফর স্যারের এসাইনমেন্ট পেয়ে কোন এক শীতের সকালে কৌশিক তার বাবা মাকে না জানিয়েই আবীরকে সাথে নিয়ে আসে রসুলপুরে।

ঢাকা থেকে বাসে করে দুই বন্ধু রসুলপুর স্টেশনে নেমে চা বিস্কিট খায়। আসার আগে তেমন কোন খোঁজ খবর নিয়ে আসেনি, তাই তাদেরকে নির্ভর করতে হয় চায়ের দোকানদার ছাত্তারের উপর। আবীর আর কৌশিকের কথা শুনে ছাত্তার ওদেরকে শামীমের সাথে দেখা করতে বলে। কৌশিক এতকাল শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নাম শুনেছে, টিভিতে দেখেছে, গল্পে উপন্যাসে পড়েছে, কিন্তু নিজের চোখে এই প্রথম। শামীমকে দেখে তাই সে পুলকিত হয়। শামীমের অনুরোধে দুই বন্ধু সেদিনের মত তার বাড়িতেই থেকে যায়। রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে বৈঠকখানায় বসে শামীম পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন শুরু করে। এক পর্যায়ে কৌশিকের গ্রামের বাড়ি রসুলপুর শুনে সে তার বাবার নাম জিজ্ঞেস করে। এর উত্তরে হারুনের নাম শুনে শামীমের ভ্রু কুঞ্চিত হয়, নামটি একবার দুইবার নিজের মনে আওড়ায় সে। আরো নিশ্চিত হবার জন্য তার জন্মসাল জিজ্ঞেস করে সে। এক নিমিষে তেইশ বছর পেছনে চলে যায় সে, তার মনে পড়ে যার লাবলুর সাথে তার শেষ মূহুর্তগুলি। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে অনেকবার সে হারুন ও রাহেলার খোজ করেছে কিন্তু পায়নি তাই এত বছর পরে বোধকরি এরকম একটি ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলনা শামীম। চোখের সামনে লাবলুর সন্তানের মুখে বাবা হিসেবে হারুনের নাম শুনে শামীম নিজেকে স্থির রাখতে পারেনা, তার সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ে রাহেলার উপর। আবীর আর কৌশিক দুই জনই শামীমের হঠাৎ বদলে যাওয়া মুখ দেখে অবাক হয়, এর কারন জিজ্ঞেস করলে শামীম অনেকক্ষন নিশ্চুপ থেকে সবকিছু খুলে বলে কৌশিককে।

পরদিন আবীর চলে যায় ঢাকায় কিন্তু কৌশিক যায়না, আরো ভাল করে বললে সে যেতে পারেনা। নিজের শেকড়কে নতুন করে জানতে পেরে তার কষ্ট বা আনন্দ কোনটাই হয়না, শুধু অভিমান হয় মায়ের উপর। সন্ধ্যায় দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে এসে দাঁড়ায় পুংলী নদীর ধারে। যেমনটা বলেছিলেন শামীম চাচা সেরকম বড় সড় কোন নদী বলে মনে হয়না তার, তবে স্কুলঘরটার পেছনে বটগাছের পাশে শুকিয়ে যাওয়া নদীর তীরটাতে বসে যে মানুষটিকে সে কখনই দেখেনি, যার স্পর্শ সে কখনো পায়নি, অথচ যার রক্ত তার দেহে বহমান তার কথা ভেবে কৌশিকের চোখের কোণে কয়েক বিন্দু পানি জমে। আঙুলের ডগা দিয়ে তা মুছে দেয় কৌশিক, কিন্তু আবার ভিজে আসে। এবার কৌশিক আর মুছার চেষ্টা করেনা বরং হঠাৎ করে তার মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে। সে দ্রুত স্টেশনে যেয়ে ময়মনসিংহের বাস ধরে।

মাঝরাত্রিরে ছেলেকে দেখে যতটা অবাক হয় রাহেলা তার থেকেও সে বেশি বিচলিত হয় কৌশিকের চোখ দেখে। কোত্থেকে এল, কিভাবে এলো সেরকম কিছুই জিজ্ঞেস করা হয়না রাহেলার শুধু হাতমুখ ধুয়ে খেতে আসতে বলে সে। চুপচাপ কিছু একটা মুখে দিয়ে কৌশিক তার ঘরে যায়। একসময় রাহেলা ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু কৌশিক পারেনা, বিছানায় শুয়ে আশপাশ করে, তার কল্পনায় বার বার ফিরে আসে রসুলপুর গ্রাম, পুংলী নদী, পেছনের স্কুলঘর আর তার পাশে নদী তীরের বটগাছটা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার চোখে একটা মানুষের অবয়ব ফুটে উঠতে চায় যাকে সে কখনো দেখেনি। কৌশিক বলতে গেলে নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে হারুনের ঘরের দিকে এগোয়। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তাকায় বহুদিনের পরিচিত মানুষটির দিকে, জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা বাইরের আবছা আলোতে সেই মুখটা দেখে তার ঘৃনা জন্মে, ভুলে যায় তার প্রথম ঘুড়ি উড়ানো এই লোকটাকে সাথে নিয়ে, তার প্রথম সাইকেলে চড়া এর হাত ধরে, বৈশাখী মেলায় টমটম গাড়ির বায়নাও করতো সে এর কাছে। হঠাৎ কি যেন হয় তার, মুখ থেকে একদলা থুতু সে ছিটিয়ে হারুনের মুখে আর দুই হাত দিয়ে গলাটা চেপে ধরে। হঠাৎ গোঙ্গানীর আর পা ছোড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় রাহেলার, চোখের সামনে আলো আঁধারিতে কৌশিককে হারুনের গলা চেপে ধরে থাকতে দেখে সে অবাক হয়, মূহুর্তের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় তাকে। কৌশিক আর দাঁড়ায়না, এক দৌড়ে বের হয়ে আসে বাসা থেকে, পাশের মাঠটাতে এসে হাটু গেড়ে বসে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে সে। রাতের নিঃশব্দতা ছাপিয়ে কৈশিকের কান্না চলে যায় অনেক দূর, হয়তবা রসুলপুর স্কুলের পেছনটাতে সেই বটগাছের নিচে পুংলী নদীর তীরেও তার রেশ পাওয়া যায়।

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন ৪ মার্চ ২০১০
দ্বিতীয় প্রকাশঃ বকলম ১৭ আগষ্ট ২০১০