মঙ্গলবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১১

সরকারকেই কি জাতীয় পানিনীতি উপেক্ষা করতে হবে?

সম্প্রতি সরকার একটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেয়েছে। জানা যাচ্ছে, নতুন এই বিমানবন্দরের নাম হবে 'বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর' এবং এটির সংলগ্ন 'বঙ্গবন্ধু নগরী' গড়ে তোলা হবে। বিমানবন্দর থেকে রাজধানী পর্যন্ত থাকবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মনোরেল ইত্যাদি। প্রকল্পটির প্রাক-সম্ভাব্যতা (প্রি-ফিজিবিলিটি) পর্যায়ে বিমানবন্দরের জন্য বর্তমানে নির্ধারিত আড়িয়াল বিল ছাড়াও সম্ভাব্য তিনটি স্থান পর্যালোচনা করা হয়েছে, যার মধ্যে ময়মনসিংহের ত্রিশালে দুইটি এবং টাঙ্গাইলের মধুপরে একটি স্থান।এই প্রাক-সম্ভাব্যতা বিষয়ক বিস্তারিত কোনো তথ্য সবার কাছে উন্মুক্ত নয়, তবে ধারণা করা যায় অন্যান্য স্থানে মানুষের বসতি থাকায় সরকার নীতিগত ভাবে মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা জেলার আড়িয়াল বিলেই এই প্রকল্পটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্প শুরুর নীতিগত সিদ্ধান্ত দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি। প্রাপ্ত তথ্য মতে প্রকল্পটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় বাস্তবায়িত হবে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।


এখানে কিছু বিষয় আলোচনার দাবি রাখেঃ

এক. বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ কতটা যৌক্তিক,

দুই. প্রাক-সম্ভাব্যতা পর্যায়ে পরিবেশগত কোন প্রভাব বিবেচনা না করে নতুন বিমানবন্দরের নির্মাণ স্থান হিসেবে আড়িয়াল বিলকে বেছে নেওয়া সমীচীন কি না,

তিন. জাতীয় পানিনীতি ও জাতীয় পানি আইনের আলোকে আড়িয়াল বিলে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ আদৌ বৈধ কি না।
প্রথম প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার জন্য বড় আকারে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন যা এই মুহূর্তে আলোচনা সম্ভব নয়। তবে আপাতদৃষ্টিতে এই প্রকল্পটিকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি উচ্চাভিলাসী প্রকল্প বলেই মনে হচ্ছে। ঠিক কী কারণে বাংলাদেশে একটি বিশালাকারের নতুন বিমানবন্দর প্রয়োজন এর কোনো তথ্য-উপাত্ত জনগণের কাছে উন্মুক্ত নয়। সম্ভবত বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ট্রানজিট হাব হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করার স্বপ্ন বর্তমান সরকারের রয়েছে এবং শাহজালাল বিমানবন্দর সেই চাহিদা মেটাতে পারছে না। আবার এমনও হতে পারে যে, অবকাঠামোগত চাপ কমাতেই সরকার ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে বিমানবন্দরকে সরিয়ে নিতে চাইছে। প্রথমোক্ত কারণ বিশ্লেষণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই প্রয়োজন, ঠিক কী কারণে বর্তমান বিমানবন্দরে সেই সুযোগ-সুবিধা নেই সেটিরও সমীক্ষা প্রয়োজন। দরকার মনে হলে, শাহজালাল বিমানবন্দরকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আরো উন্নীতকরণ বা সমপ্রসারণ করা উচিত। এর কোনটিই যদি অর্থনৈতিক ভাবে সিদ্ধ না হয় সেক্ষেত্রেও নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ না করে চট্টগ্রাম বা সিলেটের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে আধুনিককরণ অধিক যুক্তিযুক্ত। তবে ট্রানজিট হাব হিসেবে কাজ করার উদ্দেশ্য থাকলে বিমানবন্দরের উন্নতকরণের চেয়ে বাংলাদেশ বিমানকে একটি শক্তিশালী বেসামরিক বিমান সংস্থায় পরিণত করা বেশি জরুরি। আমরা যদি সিঙ্গাপুর, দুবাই বা ব্যাঙ্কক এসব ট্রানজিট হাবের কথা বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাই যে এদের বিমানবন্দরের পাশাপাশি নিজস্ব বিমান সংস্থাও অনেক উন্নত। তবে যদি বর্তমান বিমানবন্দরকেই ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে সেক্ষেত্রে এমন স্থান নির্বাচন করা উচিত যা পরিবেশের ওপর উল্লেখযোগ্য কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না ফেলে।

এবারে আসি প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের নির্বাচিত স্থান প্রসঙ্গে। বিল মূলত একধরনের বড় নিচু জলাভূমি যেখানে আশপাশের এলাকা থেকে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি ছোট ছোট নালার মাধ্যমে ঢোকে। বর্ষা মৌসুমে যখন উচ্চ প্রবাহের ফলে নদীর পক্ষে বৃষ্টির পানি বহন করা সম্ভব হয় না তখন সেই অতিরিক্ত প্রবাহ বিলে প্রবেশ করে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেখানে চাষাবাদ হয় এবং বর্ষা মৌসুমে মৎস ও অন্যান্য জলজপ্রাণীর একটি অবাধ বাস্তুসংস্থানে পরিণত হয়। বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রেখে এই বিল ভূগর্ভস্থ পানির জোগান নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের যেকোনো বিলই গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক জলাধার যা একাধারে অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান ও দেশের পানিসম্পদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিলের মধ্যে আড়িয়াল বিল অন্যতম । ঢাকার দক্ষিণে গঙ্গা ও ধলেশ্বরীর মধ্যবর্তী প্রায় ৭২৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই বিল বিস্তৃত। এই বিলে বর্ষা মৌসুমে মাছের পাশাপাশি আমন ধানের চাষ হয়, শুষ্ক মৌসুমেও রবি শস্যেরও ফলন হয়। বেশ কিছু বিরল প্রজাতির হাস ও পাখির প্রজননক্ষেত্র হিসেবেও আড়িয়াল বিল বিখ্যাত।

প্রস্তাবিত নতুন বিমানবন্দর প্রকল্প এই বিলে বাস্তবায়িত হলে তার প্রভাব পানিসম্পদ ও পরিবেশের ওপর কতটা পড়বে তা নির্ধারণের জন্য দরকার এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর মাহমুদ হোসেন বলেছেন যে প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ শেষ হলে আগ্রহী উদোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে এবং তারাই প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা ও এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করবে! এই প্রক্রিয়াটি বিতর্কের জন্ম দেবে। প্রথমত, প্রাক-সম্ভাব্যতা পর্যায়ে স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রেই পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ে কি না সেটা বিবেচনা করা উচিত ছিল, বিশেষ করে যেখানে জলাশয় সংরক্ষণ, জাতীয় পানিনীতির আওতায় পড়ে। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিকভাবে স্থান নির্বাচন করলেও জমি অধিগ্রহণ না করে আগে এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করাটাই যৌক্তিক ছিল।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার তত্ত্বাবধানে ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানিনীতি প্রণীত হয়। জাতীয় পানিনীতির আর্টিকেল ৪.১৩-এর বিষয় হচ্ছে 'হাওর-বাঁওড়-বিল সংরক্ষণ'-এর ওপর। সেখানে স্বীকার করা হয়েছে যে বাংলাদেশের হাওর-বাঁওড়-বিল এ অঞ্চলে স্বকীয়তা নিয়ে অবস্থান করছে এবং এগুলোর অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত মূল্যমান অনেক। এসব জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য জাতীয় পানিনীতিতে নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে বলা আছে,

ক. জলজ পরিবেশ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে জাতীয় জলাভূমিসমূহ যেমন বিল, হাওর এবং বাঁওড়সমূহকে সংরক্ষণ করা হবে।

খ. শুধুমাত্র সে সব পানিসম্পদ প্রকল্পই হাতে নেওয়া হবে যা কিনা এই জলাভূমিসমূহের জলজ বাস্তুসংস্থানের জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না।

অর্থাৎ জাতীয় পানিনীতিকে মেনে নিয়ে আড়িয়াল বিলে প্রস্তাবিত বিমানবন্দর নির্মাণ পরিবেশগত ভাবে সিদ্ধ নয়। এতে আড়িয়াল বিলের জলজ বাস্তুসংস্থান বিঘ্নিত হবে। পানি নিষ্কাশন ও বন্যা সমস্যার কথাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন তিনিই কিন্তু জাতীয় পানিনীতি স্বাক্ষর করেছিলেন যেখানে তিনি লিখেছিলেন :

'আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে এই নীতি অতিসত্বর বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিচ্ছি'

এবারে আসি খসড়া জাতীয় পানি আইন ২০১০-এর আলোকে এই প্রকল্পের বৈধতা প্রসঙ্গে। এই আইনের পরিচ্ছেদ ১২ (নদ-নদী, প্লাবনভূমি, জলাধার সংরক্ষণ, উন্নয়ন, পুনরুদ্ধার ও ভরাট নিয়ন্ত্রণ)-এর আর্টিকেল ৯১ (জলাশয় ও প্লাবণভূমি ভরাট নিয়ন্ত্রণ) এ উল্লেখ আছে:

'সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ ভূমি জরিপ নকশায় চিহ্নিত বিল, হাওর, বাঁওড়, প্লাবনভূমি অথবা জলাশয় সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ভরাট করা যাবে না (১ ক)'

'দেশের বিভিন্ন নদ-নদী, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়, ঝিল, হ্রদ, প্লাবনভূূমি, জলাশয়ের 'মৎস্য সম্পর্কিত জৈবিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহ' যাহা মৎস্য গবেষণা অথবা সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চিহ্নিত করা হয়েছে সেই এলাকায় কোনো প্রকার সংরক্ষণ, উন্নয়ন, মাটি ভরাট ও নিয়ন্ত্রণের পূর্বে পানিসম্পদ মন্ত্রণালইয়ের অনুমিত গ্রহণ করিতে হইবে(১ গ)

প্রাকৃতিক অথবা কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট জলাশয়ের পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখিতে হইবে(২ খ)

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে নীতিমালা অনুযায়ী 'সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি' নিলেই তো সবকিছু আইনসম্মত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে দুইটি সম্ভাবনা আছে, 

এক. ধরে নেওয়া গেল যে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ করছে। তারা প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করে, এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করে তা পরিবেশ অধিদপ্তর না পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে জমা দিল। এখন পরিবেশ বা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে সবকিছু বিবেচনা করে এই প্রকল্পের ছাড়পত্র দেওয়া বা না দেওয়া। আইনে সবসময় কিছুটা নমনীয়তা রাখা হয়; কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পরিবেশের ক্ষতি না করে প্রকল্প ছাড় দেওয়া,

দুই. একাধিক অনুচ্ছেদ একসঙ্গে বিবেচনা করা হলে কিন্তু ছাড়পত্র পেতেও অনেক সমস্যা হবে। যেমন, 'সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ ভূমি জরিপ নকশায় চিহ্নিত বিল, হাওর, বাঁওড়, প্লাবনভূমি অথবা জলাশয় সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ভরাট করা যাবে না' আর 'প্রাকৃতিক অথবা কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট জলাশয়ের পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখিতে হইবে' এই দুই আইনকে একসঙ্গে সিদ্ধ করতে গেলে আড়িয়াল বিলে প্রকল্প অনুমোদিত হওয়ার নৈতিক ভিত্তি থাকে না। জাতীয় পানিনীতি (১৯৯৯) কিংবা জাতীয় পানি আইন (২০১০), কোনোটার আলোকেই প্রস্তাবিত স্থানে বিমানবন্দর নির্মাণ বৈধতা পাওয়ার কথা নয়।

বাংলাদেশের উন্নয়ন সব নাগরিকেরই কাম্য। আমরাও স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের একটি বিমানবন্দর হোক; কিন্তু এই মানের একটি প্রকল্পের জন্য যতটুকু সম্ভাব্যতা যাচাই করা প্রয়োজন মনে হচ্ছে সে পরিমাণ যাচাই করা হয়নি। স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিবেশকে ন্যুনতম বিবেচনায় আনা হয়েছে। সাধারণত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও পরিবেশ, একে-অপরের বিপরীতে অবস্থান করে; কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া কমিয়ে আনতে পারে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : অনলাইন লেখক সমাবেশ সচলায়তনের পাঠক ও লেখক, যারা এই ইস্যুটি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনায় বিভিন্ন তথ্য, যুক্তি ও উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করেছেন।

বিদ্রঃ লেখাটি ৫ জানুয়ারী কালের কন্ঠে প্রকাশিত হয়েছে।