একটি ভাষা শুধু তার সংস্কৃতির পরিচায়কই নয় বলতে গেলে ভাষাকে ঘিরেই গড়ে উঠে সংস্কৃতির অবকাঠামো।মানুষের আচার অনুষ্ঠান, উৎসব, সামাজিকতা, চাল চলন, বিনোদন সেই অবকাঠামোটির একটা অবয়ব দেয় মাত্র।তাই ভাষার সমৃদ্ধতা যেমন সংস্কৃতিকে পরিপুষ্ট করে তেমনি ভাষার দৈন্যতা সাংস্কৃতিক দৈন্যতারই বহিপ্রকাশ।তবে বাংলাদেশে থেকে পহেলা বৈশাখে ছোটবেলায় বাবার সাথে সাতসকালে হালখাতা খেয়ে কিংবা যৌবনে রমনার বটমুলে এসো হে বৈশাখ গানের সাথে নববর্ষের সুর্যোদয় দেখে, বা পহেলা ফাল্গুনে বাসন্তি রঙের বসন পরে চারুকলার আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়ে যে বাংলা সংস্কৃতিকে অনুভব করতে পারিনি তা পেরেছি এই সংস্কৃতির বেদি থেকে থেকে হাজার মাইল দূরে এসে। এটা কিছুটা সেই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা না বুঝার মত।টাঙ্গাইলের চমচম যে এত মজা তা যেমন বুঝেছিলাম ঢাকায় এসে তেমনি নিজের ভাষা, নিজের দেশ, সর্বোপরি নিজের সংস্কৃতি যে এত আরাধনার তা বুঝেছি পরবাসে এসে। অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে মানুষ তার ভাষাকে, সংস্কৃতিকে গভীরভাবে অনুভব করতে পারে সেই সংস্কৃতির বৃত্ত থেকে যখন ছিটকে পড়ে।
(১)
বুয়েটে থাকার সময় নব্বই এর দশকের শেষের দিকের কথা। ক্যাম্পাসে তখন সুজয় নামে এক নেপালি বড়ভাই ছিল অসম্ভব সুন্দর গান গাইতেন। নেপালি হয়েও বাংলাভাষার ব্যান্ডসংগীতের গানগুলি এমন ভাবে গাইতেন যে না জানা থাকলে বিশ্বাষ করার উপায় ছিলনা যে সে বাংগালী নয়।সুজয় দার কনসার্টে সবাই চলে আসত অডিটিরিয়ামে সেই সাথে নেপালি ছাত্রছাত্রীরাও। কনসার্টের মাঝখানে সুজয় দা সবসময় একটি বা দু’টি নেপালি গান গাইতেন। সেইসময় দেখার মত এক দৃশ্যের অবতারনা হত, পুরো অডিটরিয়ামের একটি স্থানে জড়ো হয়ে উন্মাদের মত নাচতে দেখা যেত নেপালি ছেলেদের, বিদেশের মাটিতে নিজের ভাষাকে ওরা যেন নিজেদেরকে উজাড় করে দিত তার আরাধনায়।
(২)
কানাডাতে আসার পর থেকেই দেখছি বাংলাদেশের আর ভারতের বাংগালীরা এক সাথে মিলে বাংলা উৎসবের আয়োজন করে। দুই বাংলার শিল্পীদের সম্মেলন কেন্দ্রে পরিনত হয় তখন উৎসবস্থল। ২০০৯ সালে মাঝামাঝি কোন এক সময়ে সেরকমই একটি অনুষ্ঠানে নাটক করার জন্য দলবল নিয়ে গিয়েছি ক্যালগেরীতে। রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে একজনের বাসায়, আমাদের সমবয়সী, বন্ধুসম।আমরা কয়েকজন মিলে এপার্টমেন্টের নিচে নেমেছি সিগেরেট খাবার জন্য এবং সভাবতই বেশ জোড়ে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ কানে আসল,
-‘দাদারা কি বাংলাদেশি না কলকাতার ?’
আমরা শব্দের উৎস খুঁজে উপরে তাকালাম দেখি দোতালার বারান্দায় সেন্ডো গেঞ্জি গায়ে আর লুঙ্গি পরিহিত এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
-‘দাদা আমরা বাংলাদেশী’, আমাদের কেউ জবাব দিল।
-‘না মানে হঠাৎ শুনলাম বাংলায় কথা হচ্ছে তাই বাইরে আসলাম, ভাবলাম আমাদের মতই কেউ হবে।’
ছোট্ট একটি ঘটনা, কিন্তু ভাষার প্রতি মমত্ত্ববোধ প্রকাশে যথেষ্ট। আজ ঘটনাটি ঢাকায় বা কলকাতায় হলে সেটা আমার মনে থাকতনা কিন্তু এটা থেকেছে কারন পরবাসে আমরা ভাষার নাড়ি বর্জিত মানুষ। চারপাশে নানাদেশের মানুষ আরা তাদের বিচিত্র রকমের ভাষা তার ভীরে নিজের মাতৃভাষার স্বাদটাই অন্যরকম।
(৩)
সম্প্রতি ভাষা নিয়ে এক সমস্যায় পড়েছি। আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী ছেলের জন্ম বাংলাদেশে। কানাডায় যখন সে আসে তখন তার বয়স দুই। সুতরাং বাংলাদেশে থেকে ভাষার খুব বেশি শক্ত গাঁধুনি নিয়ে আসেনি। দুই থেকে তিন এই এক বছরের মধ্যেই তার ভাষা শিক্ষা সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এই সময়টাতে সে পুরোপুরি বাসায় থাকায় তার বাংলার দখল বেশ প্রবল, সেই সাথে টিভি দেখে বা পার্কে বন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতে ইংরেজী শেখা। আস্তে আস্তে তার ইংরেজী বলার প্রবণতা বেড়েও গেলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল শব্দে, যেমন ‘বাবা কাউ কি খায়?’ বা ‘বাবা আমি টয় কিনব’ এইরকম। গত মাস দুয়েক ধরে সে ডে কেয়ারে যাচ্ছে এবং তার পর থেকেই অনেক ক্ষেত্রে তার মনের ভাব প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইংরেজীর ব্যবহার এখন শব্দকে ছাড়িয়ে বাক্যে রূপ নিচ্ছে। আগে ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ’ কিংবা ‘তাতীর বাড়ি ব্যঙের বাসা’ ছড়াগুলি শোনাত, আজকাল ছড়া বলতে বলাতেই শোনায় ‘টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল’ কিংবা ‘ওল্ড ম্যাকডোনাল্ড…’। একথা সত্য যে এদেশে যেহেতু বড় হচ্ছে তার প্রধান ভাষাই হচ্ছে ইংরেজী, কিন্তু সেটা মেনে নিতে ভাল লাগেনা। মন চায় ছেলেটা আমাদের মত বাইরে কাজের ক্ষেত্রে বা স্কুলে ইংরেজী বলুক আর বাসায় বাংলা। যেহেতু কানাডা বহুজাতিক মানুষের দেশ তাই এখানে স্কুল বা ডে কেয়ারগুলিতেও সেই কথা বার বার বলা হয় যে তুমি তোমার সন্তানকে বাসায় তোমার নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা শিক্ষা দাও।
ছেলের ভাষার পরিবর্তন পীড়া দেয়, আমি তাই ছেলের সাথে আলাপচারিতায় আসি,
‘বাবা, বাবা বাসায় কি ভাষায় কথা বলে?’
-‘বাংলায়’
‘মা কি ভাষায় কথা বলে?’
-‘বাংলায়’
‘তাহলে তুমি কি ভাষায় কথা বলবে?’
-‘বাংলায়’
‘গুড, তুমি বাসায় বাংলায় আর বাইরে ইংরেজীতে কথা বলবে, ঠিক আছে?
-‘হ্যা, বাবা তুমিও কি বন্ধুদের সাথে ইংরেজীতে কথা বল?’
‘হ্যা বাবা আমি বাইরে বন্ধুদের সাথে ইংরেজীতে কথা বলি’
-‘আমিও স্কুলে বন্ধুদের সাথে ইংরেজীতে কথা বলি’
‘খুব ভাল বাবা, তুমি বাসায় বাংলায় কথা বললে সামনের সপ্তাহে তোমাকে একটি খেলনা কিনে দিব’
ছেলের সাথে আলাপচারিতায় মুগ্ধ হই, তাকে বাসায় বাংলা বলানোর জন্য খেলনা কিনে দেবার লোভ দেখাই। সেই লোভে ছেলে বাংলায় কথা বলে আবার কিছুক্ষণ পড়ে ভুলে যায়।
-‘বাবা, ক্যান ইউ প্লে উইথ মি?’
‘বাবা আমি বলেছি বাসায় বাংলা’
-‘সরি বাবা’,
সে কিছুটা মন খারাপ করে।আমি বলি তুমি বাংলায় আবার বল।
-‘বাবা তুমি কি আমার সাথে খেলবে?’
‘হ্যা খেলব’
………
এভাবেই চলছে। ছেলে ইংরেজীতে একেকটি বাক্য বলার পড়ে মনে করিয়ে দেই বাংলায় বল, সে মন খারাপ করে আবার সেটা বাংলায় বলার চেষ্টা করে। কিন্তু কতদিন এই প্রচেষ্টা থাকবে জানিনা। ভাবছি একটু বড় হলে যে যতবার একটি বাক্য ইংরেজীতে বলবে ততবার তাকে দেখিয়ে একটি টালি বানাবো। একটি ইংরেজী বাক্য মানে একটি টালি, এভাবে প্রতি সপ্তাহে সে কতটি বাক্য ইংরেজীতে বলে তার উপর ভিত্তি করে সপ্তাহান্তে ‘গিফট’ কিনে দেয়া নির্ভর করবে!