রবিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১২

বৃষ্টির পানির যথাযথ ব্যবহার

১.

উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে মাত্র ৫৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার ছোট্ট একটি দেশ বারমুডা, যা কিনা মূলত ব্রিটিশ ওভারসীজ টেরিটরি। সর্বোচ্চ আড়াই কিলোমিটার প্রশস্ত আর পঁচিশ কিলোমিটার দীর্ঘ এই দেশটি আদতে চুনাপাথর দিয়ে গড়া ছয়টি বড় বড় দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। আয়তনে ছোট হলেও সর্বশেষ ২০১২ এর আদমশুমারি অনুযায়ী দেশটির অধিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৬৪ হাজার। ফলশ্রুতিতে জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে দেশটির অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। বারমুডাতে স্বাদু পানির কোন প্রবাহ বা নদী নেই, সেই সাথে মহাসাগরের বুকে অবস্থিত বলে ছোট আকৃতির এই দ্বীপটিতে ভূগর্ভস্থ পানির একটি বড় অংশ লবণাক্ত। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে এই বিপুল ঘনবসতির দেশটির স্বাদু পানির মূল উৎস কি? উত্তর হচ্ছে বৃষ্টির পানি। বারমুডায় সারাবছর প্রায় একই হারে (মাসে ১২০ মিমি) বৃষ্টিপাত হয় যার বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫০০ মিমি। ১৯৫১ সালের জনস্বাস্থ্য আইন অনুযায়ী বারমুডার প্রতিটি বাড়ির ছাদে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য ব্যবস্থা আর সেই সাথে সেই পানি সঞ্চয়ের জন্য ভূগর্ভস্থ বা ভূপরিস্থ জলাধার থাকা বাধ্যতামূলক। অনেক বাড়ির ক্ষেত্রে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালির জন্য পানির যোগান আসে এই সঞ্চিত পানি থেকেই। তবে অধিকাংশ বাড়ির জন্য এই সঞ্চিত পানিই যথেষ্ট নয়, ফলশ্রুতিতে তাদের নির্ভর করতে হয় পরিশোধিত ভূগর্ভস্থ বা সমুদ্রের পানি ও অন্যান্য স্থানে সংগৃহীত বৃষ্টির পানির উপর। গড়ে বারমুডার ৫৬ শতাংশ পানির উৎস বৃষ্টির পানি আর বাদবাকি আসে ভূগর্ভস্থ স্বাদু পানি, ভূগর্ভস্থ পরিশোধিত লবণাক্ত পানি ও পরিশোধিত সমুদ্রের পানি থেকে। 



কিন্তু কিভাবে বারমুডার বাড়ির ছাদগুলি একেকটি বৃষ্টির পানির ধরতি বা ক্যাচমেন্ট হয়ে উঠছে সেই দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। এখানকার বাড়ির ছাদগুলিতে প্রথমে ঢালু শক্ত কাঠের ফ্রেমের উপরে চুনাপাথরের ব্লক একের পর এক সিঁড়ির মত করে বিছিয়ে দেয়া হয়(ছবি-১)। এরপরে সেই চুনাপাথরের ব্লকের উপর দুই পরতের সিমেন্টের আস্তরের পর তাতে সাদা রঙের একটি বিশেষ সিমেন্ট পেইন্টের আবরণ দেয়া হয়। ছাদের চারদিকে ছোট চ্যানেলের মত থাকে যাতে ছাদে পতিত বৃষ্টির পানি এসে জমা হয় এবং তা পাইপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ জলাধারে সঞ্চিত করা হয়। ছাদকে ঢালু এবং সিঁড়ির মত করার কারণে বৃষ্টির পানি আস্তে আস্তে এসে চারদিকের চ্যানেলে সঞ্চিত হয়।


ছবি: ১- বারমুডার প্রত্যেকটি বাড়ির ছাদ বৃষ্টির পানি সংগ্রহের একেকটি ধরতি

(আলোকচিত্র: ডঃ মানস সোম)

প্রশ্ন উঠতে পারে এভাবে সংগৃহীত পানির গুনগত মান নিয়ে। জানিয়ে রাখা ভাল বারমুডার অধিবাসীরা প্রায় সাড়ে তিনশ বছর ধরে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করেই তাদের জীবন যাপন করে আসছে। ইদানীংকালে যদিও খাবার পানির ক্ষেত্রে অনেকেই বোতল-জাত পানি ব্যবহার শুরু করেছে তারপরেও বারমুডার বৃষ্টির পানির গুনগত মান কোনভাবেই জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সরূপ নয়।

২.

এবারে আরেকটি দেশের কথা শুনাই। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিচারে দেশটির অবস্থান বারমুডার পরেই, অর্থাৎ বিশ্বে নবম, যদিও দেশটির আয়তন বারমুড়ার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। দেশটির নাম নদীমাতৃক বাংলাদেশ। যদিও নদী দেশটির মাতা তবে সেই মাতাকে গলাটিপে হত্যা করতে দেশটির অধিবাসীদের একটুকুও বুক কাঁপেনা। এই দেশটির রাজধানীর গল্প জানা যাক। যেখানে মাঝখান দিয়ে একটি মাত্র নদী বয়ে গেলেই বিশ্বের বড় বড় শহরগুলির অধিবাসীদের জন্য প্রয়োজন মিটে যায় সেখানে ঢাকার চার দিকে রয়েছে নদী যা কিনা এই শহরটিকে বেষ্টনী করে রেখেছে। ঢাকার উত্তরে রয়েছে টঙ্গী খাল, পশ্চিমে তুরাগ, পূর্বে বালু আর শীতলক্ষ্যা আর দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। অথচ ঢাকা ওয়াসার ২০০৩ এর রিপোর্ট অনুসারে ঢাকা শহরের ৮৪% ভাগ পানি সরবরাহ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে আর বাকী ১৬% হচ্ছে নদী থেকে। ২০০২ এ সায়দাবাদ পানি পরিশোধন কেন্দ্র চালুর আগে এই পরিসংখ্যান ছিল ৯৫% ভূগর্ভস্থ থেকে আর বাকী ৫% নদী থেকে। অর্থাৎ ঢাকা শহরের এক্যুইফার থেকে আমরা অনবরত পানি উত্তোলন করে চলেছি। ২০০৩ সালের হিসাবমতে ঢাকা ওয়াসা দিনে ১১৬০ মিলিয়ন লিটার পানি উত্তোলন করে থাকে এর ৩৮৯ টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে। বিপরীত ক্রমে, ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকা হয় পীচ নয় সিমেন্টের অচ্ছাদনে ঢাকা থাকার কারণে বৃষ্টির পানির অধিকাংশই যায় খালে বা নালায় আর সেখান থেকে গড়িয়ে নদীতে। সুতরাং বৃষ্টির পানি থেকে ঢাকার ভূগর্ভস্থ এক্যুইফারে পানির যোগান অনেক কম। এছাড়া নগরায়নের মাধ্যমে ঢাকার আশেপাশের নিম্নাঞ্চল ভরাট করার ফলে এই সমস্যা দিনে দিনে আরও প্রকট হচ্ছে। এখন যেহেতু ঢাকার এক্যুইফারে পানির যোগান থেকে চাহিদা অনেক কম সেজন্য ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে এবং এই নেমে যাওয়ার হার আশঙ্কাজনক। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ওয়াসার পর্যবেক্ষণ নলকূপের উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা যায়, বছরে প্রায় ৩ মিটার করে নেমে যাচ্ছে ঢাকা শহরের পানির স্তর।

৩.

উপরের দুটি উদাহরণের মাঝে একটি মিল রয়েছে আর তা হচ্ছে দুটি ক্ষেত্রেই পানিসংকট প্রবল। তবে প্রথম ক্ষেত্রে সেই সংকট অনেকটা সমাধান করা হয়েছে ঐতিহাসিকভাবে বৃষ্টির পানির উপর নিজেদের নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানিকে কখনই সেরকম গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়নি যদিও ঢাকার বার্ষিক বৃষ্টিপাত (২০০০ মিমি) বারমুডার চেয়ে অনেক বেশি। তবে একটি পার্থক্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে বারমুডায় বৃষ্টিপাত হয় সারাবছর একটি নির্দিষ্ট হারে আর আর ঢাকায় ২০০০ মিমি বৃষ্টিপাতের শতকরা ৮০ ভাগই হয় বর্ষা মৌসুমে (জুন-অক্টোবর)। তাই এটি আশা করা উচিৎ নয় যে বারমুডার মত ঢাকাতেও বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে পানির চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব। তবে নিঃসন্দেহে কয়েকটি বিকল্প চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। ঢাকা শহরের জন্য এখন জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন কৃত্রিমভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে নিচে নেমে যাওয়া থেকে বিরত রাখা। সেটি করা যেতে পারে বৃষ্টির পানিকে যথাযথভাবে সংগ্রহ করে পাইপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উন্মুক্ত স্থানে কূপ খনন করে এক্যুইফারে প্রবেশ করিয়ে। ঢাকা শহরের প্রত্যেকটি বাড়ির ছাদ হতে পারে এক একটি বৃষ্টির পানির ধরতি। ঢাকা শহরকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে বৃষ্টির সময় সেই জোনের অন্তর্ভুক্ত সব বাসার ছাদ থেকে পানি যথাযথ ভাবে সংগ্রহ করে একটি কেন্দ্রীয় স্থানে কৃত্রিম ভাবে তা এক্যুইফারে প্রবেশ করানো যেতে পারে। আরেকটি বিকল্প সম্ভাবনা হতে পারে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিকে গৃহস্থালির কাজে লাগানো। সেক্ষেত্রে ছাদ থেকে পানি সংগ্রহ করে তা ভূগর্ভস্থ জলাধারে সঞ্চয় করে রাখা যেতে পারে। ঢাকা শহরের অধিকাংশ বহুতল ভবনেই এখন গ্যারেজ থাকে, সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি গ্যারেজের নিচে থাকতে পারে ভূগর্ভস্থ এই জলাধার। সেখান থেকে পানি কিছুটা পরিশোধন করে গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজে তা ব্যবহার করার বিষয়ে পরিকল্পনা করা যেতে পারে। সর্বশেষ বিকল্প হতে পারে, একটি নির্দিষ্ট জোনের অন্তর্গত সব বাসার বৃষ্টির পানি একটি কেন্দ্রীয় পরিশোধন কেন্দ্রে এনে সেখান থেকে তা পরিশোধনের পর ঐ এলাকায় সরবরাহ করা যেতে পারে।

৪.

এই নিবন্ধে পাশাপাশি দুটি দেশের উদাহরণ রেখে একটি থেকে আহরিত জ্ঞানের আলোকে অন্য স্থানে তা প্রয়োগের বিষয়ে কিছু যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই এই পরিকল্পনাগুলো নিবন্ধে যতটা সহজ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বাস্তবিক ভাবে তা ততোটা সহজ হবেনা। উদাহরণ সরূপ ঢাকার বাতাসে ধুলাবালির পরিমাণ, পাখির মল-মূত্র, বাতাসে অদগ্ধ কার্বন, ইত্যাদি অনেক অনেক সমস্যার প্রশ্ন আসতে পারে, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার নিমিত্তে ছাঁদের নকশা নিয়েও পরিবর্তন-পরিবর্ধন এর প্রশ্ন আসতে পারে, সরকারী বেসরকারি বিনিয়োগের জটিলতা আসতে পারে, কিন্তু একথা সত্যি যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সমস্যাগুলো সমাধান করেই উক্ত পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভব।



কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ডঃ মানস সোম, ভূপরিস্থ পানি বিশেষজ্ঞ, ওরলি পারসনস, কানাডা (WorleyParsons Canada) বারমুডার রেইনওয়াটার হারভেস্টিং এর আলোকচিত্রের জন্য।