বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০০৯

টিপাইমুখঃ সবই অরণ্যে রোদন

আজ টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে জাতীয় সংসদে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের খবর পড়লাম। যে সুর সেই প্রথম থেকেই শুনে আসছি সেই একই মূর্ছনার পূনঃরাবৃত্তি শুনলাম এই খবরে। টিপাইমুখ নিয়ে সংবাদপত্রে দেশ বরেণ্য পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞদের অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে যার মধ্যে ডঃ আইনুন নিশাত, ডঃ জহির উদ্দিন চৌধুরী, আসিফ নজরুল, ডঃ আকবর আলি খান এর লেখা অন্যতম। আমিও ব্যক্তিগতভাবে এই প্রকল্প নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেছি যার ফলশ্রুতিতে সচলায়তনে লিখেছি সাত পর্বের সিরিজ ( । পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩ পর্ব ৪ পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭ ।)। এই লেখাগুলির সংকলিত একটি রূপ "টিপাইমুখ বাঁধঃ বাংলাদেশের জন্য বিবেচ্য বিষয়গুলি" শিরোনামে প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে গত ২১ আগষ্ট ২০০৯ তারিখে। সচলের আমি, হিমু, ইশতি, স্বাধীন, ষষ্ঠ পান্ডব, শোহেইল মতাহির চৌধুরী সবাই মিলে এই টিপাইমুখ নিয়ে ইবুকের কাজ প্রায় সমাপ্ত করে ফেলেছি কিন্তু সবই আজ অরণ্যে রোদন বলে মনে হচ্ছে। দেশের সচেতন নাগরিকদের গবেষণালব্ধ বিভিন্ন লেখার কোন গুরুত্ত্বই সরকারের কাছে নেই। তাদের কাছে মুখ্য মনে হচ্ছে ভারতের আশ্বাস আর ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন যেখানে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। যদি সত্যি সত্যি এদেশীয় সচেতন নাগরিকদের মতামত সরকার গুরুত্ত্ব দিতেন তাহলে ঐ প্রতিবেদনে একটি অংশ রাখতে পারতেন এই বিষয়ে কিন্তু সে তারা তা করেননি।
কেন মনে হচ্ছে আমাদের অরণ্যে রোদন তা একটু ব্যখ্যা করলেই বুঝা যাবে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরের সুত্র ধরে দেখা যায়, সংসদীয় কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন,
‘হেলিকপ্টারে খুব নিচু দিয়ে পরিভ্রমনকালে টিপাইমুখে কোনো অবকাঠামো প্রতিনিধিদলের দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রকল্পের ভাটিতে কোনো ব্যারেজ বা অবকাঠামো নির্মাণের কোনো রকম প্রস্তুতিও পরিলক্ষিত হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখনো কোনো প্রাথমিক ভৌত কার্যাদি শুরু হয়নি।’ [প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০০৯]
এটি একটি হাস্যকর মন্তব্য, টিপাইমুখ প্রকল্পের নির্মান কাজ যে এখনো শুরু হয়নি সেটি জানার জন্য হেলিকপ্টারে করে প্রকল্প ঘুরে আসার প্রয়োজন ছিলনা, তথ্যটি এই তথ্যপ্রবাহের যুগে সবারই জানা। যেটি দরকার ছিল তা হলো এই প্রকল্পের বাংলাদেশে প্রভাব নিয়ে ভারতের গবেষণালব্ধ ফলাফলের প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করা। আমাদের নেতৃবৃন্দের হেলিকপ্টার ভ্রমণের খবর জানার জন্য দেশের জনগণদের এতদিন অপেক্ষা করার কোন কারণ ছিলনা। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ আছে,
'প্রতিনিধি দলটির সঙ্গে আলোচনাকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা ও বিদ্যুৎমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে নিশ্চিয়তা দিয়েছেন যে টিপাইমুখ প্রকল্পের আওতায় কোনো সেচ কম্পোনেন্ট নেই। ড্যামের ভাটিতে ফুলেরতল বা অন্য কোনো স্থানে ব্যারেজ কিংবা পানি প্রত্যাহারের কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে না। বরাক নদী হতে কোনো পানি প্রত্যাহার করা হবে না' [প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০০৯]
এটি আরো হাস্যকর। নিপকোর ওয়েবসাইটে অনেক আগে থেকেই এই প্রকল্পের যে পরিবেশগত প্রভাবের প্রতিবেদন (EIA ) পাওয়া গিয়েছে তাতে টিপাইমুখ বাঁধ এর সাথে ফুলেরতল সেচ প্রকল্পকে প্রস্তাবিত রাখা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তা এখন বাস্তবায়িত হবেনা। সুতরাং ভারতে গিয়ে এই আশ্বাস নিয়ে আসার কিছু নেই আর তার থেকে বেশী জরুরী হলো এই আশ্বাসে বাংলাদেশের খুশি বা আশ্বস্ত হবার কিছু নেই, কেন নেই তা আমি আমার সিরিজ গুলিতে এবং প্রথম আলোতে প্রকাশিত লেখাতে ব্যখ্যা করেছি।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় কর্মকর্তারা বাংলাদেশের এই সংসদীয় প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছেন,
‘প্রকল্পটি শুধুমাত্র জলবিদ্যুৎ তৈরি ও বন্যার প্রকোপ হ্রাসের জন্য বাস্তবায়ন করা হবে। ড্যামের ভাটিতে পানি প্রত্যাহারমূলক অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে না' [প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০০৯]
পানি প্রত্যাহার না করলেই যে সব সমস্যা শেষ এই মর্মে কিভাবে বাংলাদেশ নিশ্চিত হলো?
প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ টিপাইমুখ প্রকল্পের তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত একটি প্রতিবেদন এই কমিটিকে হস্তান্তর করেছে। আমাদের দাবী হচ্ছে যেই তথ্য ও উপাত্ত সবার কাছে উন্মোক্ত করা হোক। তার থেকে বেশী জরুরী কি কি উপাত্ত প্রয়োজন তা কি সংসদীয় কমিটি হলফ করে বলতে পারে ? কেন দেশের বিশেষজ্ঞদের কাছে থেকে জেনে নেয়া হচ্ছেনা ঠিক কি কি উপাত্তের ভিত্তিতে এই বিষয়ে গবেষণা শুরু করা যেতে পারে।
একেবারে সর্বশেষে এসে,
'টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্পের ইতিপূর্বে প্রাপ্ত, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের পরিদর্শনকালীন প্রাপ্ত ও ভবিষ্যতে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে সমীক্ষা পরিচালনার কথাও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে' [প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০০৯]
কিন্তু এই সমীক্ষা কবে হবে ? টিপাইমুখ প্রকল্পের কাজ শুরু হবার পরে? দুই দেশের সরকার পর্যায়ে কি এই মর্মে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে বাংলাদেশের পরিচালিত সমীক্ষার পূর্বে ভারত কাজ শুরু করবেনা ?
আমরা শুধু ভারতীয় মন্ত্রী, আমলা আর বিশেষজ্ঞদের কথায় কি আশ্বস্ত হয়েই থাকব নাকি নিজেদের বিশেষজ্ঞদের এই বিষয়ে গবেষণা করার সুযোগ তৈরী করে দেব? সরকারকে বোঝা উচিৎ সব ইস্যু নিয়ে রাজনীতি করা ভাল নয়। সমস্যাটা শুধু রাজনৈতিক নয় বরং কারিগরীগত তাই সংসদীয় কমিটির উচিৎ ছিল সংসদে এই প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে সফর শেষ করে এসে এই বিষয়ে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সাথে মতবিনিময় করা।
আমার মনে হয় আমরাও স্থিমিত হয়ে যাচ্ছি এই ইস্যুটি নিয়ে। একবার সাধারণ মানুষদের চোখের আড়াল হলে এই বিষয়টি নিয়ে মানুষের সচেতনতা কমে যাবে। এযাবত প্রকাশিত অধিকাংশ লেখালেখিতে দেশবরেণ্য বিশেষজ্ঞরা টিপাইমুখ প্রকল্পের অসংখ্য নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন অথচ সরকারের এই বিষয়ে কোন বিবৃতি চোখে পড়েনি, সরকারের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত আমি এই প্রকল্পের নেতিবাচক দিক নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা করার কোন নজিরও দেখেনি শুধু দেখেছি তাঁদের কথায় আশ্বস্ত (!!) হতে। কিন্তু দুঃখিত সংসদীয় কমিটি, আমরা সাধারণ জনগণরা আশস্ত হতে পারছিনা।

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন