বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০১০

আমাদের অসচেতনতার বলি আরেকটি মৃত্যু

সালটা মনে নেই, তবে ২০০২ বা তার আগে হবে কারন তখনো আমি বুয়েটে পড়ি। পলাশী বাজার থেকে সোনালী ব্যাঙ্ক বুয়েট শাখার সামনের রাস্তা দিয়ে বকশী বাজারে যাবার রাস্তাটায় রাস্তা পার হবার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী মারা যায়। মূহুর্তের মধ্যেই বুয়েট আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা ঐ এলাকায় যানবাহন ভাংচুর থেকে শুরু করে আন্দোলন, রাস্তা অবরোধ শুরু করে। ঐ দলে আমিও ছিলাম, মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। এমনিতেই বুয়েটের সামনের এই রাস্তাটায় বেপরোয়া গাড়ি চলাচল করে, কোন গতিসীমাতো দূরের কথা সামান্যতম সাবধানতাও অবলম্বন করেনা তারা। ঐ ঘটনার পর ছাত্ররা পলাশী বাজার থেকে শুরু করে ফজলে রাব্বী হল পর্যন্ত রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয় বাঁশ দিয়ে বেরিকেড করে।
আমি তখন 'বুয়েট সেফটি মুভমেন্ট' করতাম। মনে পড়ে দুর্ঘটনার দিন বা তার পরের দিন বুয়েটের তৎকালীন ছাত্রকল্যাণ পরিচালক জয়নুল আবেদীন সারের সাথে আমাদের একটি মিটিং ছিল যেখানে আমরা দাবি জানাই বুয়েটের সামনের এই রাস্তায় যেন গাড়ি না চলে তার ব্যবস্থা করতে। উনি বলেছিলেন সেটা আসলে বুয়েট কতৃপক্ষ করতে পারেনা কারন তাদের সেই আইনগত ক্ষমতা নেই, এটি একমাত্র পুলিশ কমিশনার( ট্রাফিক) করতে পারে। আমরা বলেছিলাম, বুয়েট কতৃপক্ষের কিছু করতে হবেনা, আমরা ছাত্ররা রাস্তা বন্ধ করে রাখব, আপনারা শুধু আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করবেননা। যাই হোক পরবর্তীতে বুয়েটের সামনের রাস্তায় দুই দিকে দুটি গেইট হয় যা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত যানবাহন চালনা করা শুরু হয়। একটি গেইট পলাশী বাজারে আরেকটি ফজলে রাব্বি হলের কাছে চৌরাস্তায়।
ট্রাফিক কতৃপক্ষ বাসগুলিকে সাময়িক ভাবে আজিমপুর থেকে ঢাকেশ্বরী হয়ে বকশীবাজার দিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে। এর পরে নির্মিত হয় বুয়েটের শহীদ মিনারের সামনে এযাবতকালের সবচেয়ে বর কৌতুক ফুট-উভারব্রিজ। ত্রিশ ফুট একটি রাস্তা পার হবার জন্য বিশ ফিট উপরে উঠে ত্রিশ ফিট পার হয়ে আবার বিশ ফিট নেমে তবেই রাস্তার উপার। প্রথম কয়েকমাস কাউয়ারা আরামে ত্যাগ করল সেখানে বসে, পরে কিছু পোলাপান ব্যাচের র‌্যাগের বা লেভেল পূর্তির সিনেমা বা নাটক বা মিউজিক ভিডিও নির্মানের সুটিং স্পট হিসেবে সেটাকে ব্যবহার করতে লাগল। মাঝে সাঝে বিড়ি ফোঁকার জন্য কিংবা শহীদ মিনারের সামনে থেকে চানাচুর কিনে সেখানে যেয়ে কাওকে কাওকে খেতে দেখতাম। এর বাইরে সেই ওভারব্রিজের কোন ব্যবহার দেখিনি, দেখার কথাও না। শেষবার দেশে গিয়ে দেখেছিলাম আবার পুরোদমে ঐ রাস্তা দিয়ে দূর্বার গতিতে বাস চলছে।
আজিমপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত বিভিন্ন রুটে অসংখ্য বাস চলে। এই এলাকায় আছে গার্হস্থ অর্থনীতি কলেজ, ইডেন কলেজ, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বদরুন্নেসা কলেজ। ক্যাম্পাসের সাথেই হলগুলি থাকায় এই রাস্তাগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের অনবরত রাস্তা পার হতে হয় অথচ এখানে নেই কোন গতিসীমা না মানার জন্য কঠোর শাস্তি কিংবা জরিমানা। একেক ড্রাইভার বিদ্যুৎ গতিতে গাড়ি চালিয়ে যায় এবং এর মধ্য দিয়েই ছাত্র ছাত্রীরা ঝুকি নিয়ে রাস্তা পার হয় ফলে ঘটে দুর্ঘটনা যার শেষ শিকার খান জাহান সম্রাট। এই মৃত্যুকে ঘিরে আবার হয়ত কিছু বাস ভাংচুর হবে, ক্যাম্পাস অশান্ত থাকবে, বেরিকেড পড়বে তারপর কিছুদিন গেলে সব আগের মত হয়ে যাবে। যেকোন দিন আবার যেকেউ নতুন শিকার হবে। কিন্তু এর সমাধান কি? সেটা নিয়ে ভাবতে হবে বুয়েট কতৃপক্ষ সহ এই আলাকার অন্যান্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ট্রাফিক কতৃপক্ষকে।
বলা হয় বুয়েটের সামনের এই রাস্তাটি অত্যাধিক গুরুত্ত্বপূর্ন তথাকথিত 'এশিয়ান হাইওয়ে', সুতরাং এটি দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করলে সমস্যা হবে। তাহলে বিডিআরের মধ্য দিয়ে সাত মসজিদে যাবার রাস্তাটা খুলে দেননা ভাই দেখি কেমন পারেন। শুনেছিলাম ঢাকা শহরের যানজট সমস্যা সমাধানে দুটি পরামর্শ ছিলঃ সেনানিবাস আর সচিবালয় ঢাকার বাইরে নেয়া, মন্তব্য এসেছিল এই পরিকল্পনার পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু সেনানিবাস ঢাকাতেই থাকবে। সুতরাং সেনানিবাস বা বিডিআর এর মধ্যে দিয়ে সোজা রাস্তা থাকলেও তার ভেতর দিয়ে যাওয়া যাবেনা কিন্তু ঠিকই ক্যাম্পাসের মধ্যে দিয়ে বাস চলাচল করবে। কারন দুই চারটা ছাত্র দুই তিন বছর পর পর মরলে কি বা এসে যায়!
মেনে নিলাম তালগাছ আপনাদের, ক্যাম্পাসে গাড়ির রাস্তা রাখবেনই, তাহলে সাবধানতা বাড়ান, গতিবেগ ৩০ ঘন্টায় কিমি এ নিয়ে আসেন, যদি তা থেকে থাকে তাহলে তা মানানোর জন্য ব্যবস্থা করেন, যদি তাও না পারেন তাহলে সেই সেনা অফিসারের মত ( এক সেনা অফিসার ঢাকার রাস্তা ঘাটের দেখাশোনার দ্বায়িত্ব পেয়ে সেনানিবাসের সংস্কৃতি রাজপথে খাটাতে গিয়েছিলেন) চার পাঁচ ঢেউয়ের গতিরোধক একটু পর পর বসান, দেখি কেমনে বেগ তুলে। আর তাও যদি না পারেন আমাদের ক্যাম্পাসই বাইরে পাঠিয়ে দেন। তাতেও অন্তত সম্রাটরা বেঁচে থাকবে।

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন