বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১১

প্রতিক্রিয়া- "টিপাইমুখ: যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনার অনুরোধ"

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ডঃ গওহর রিজভী সম্প্রতি The Daily Star এ "Tipaimukh: A plea for rational and scientific discussion" শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। তার এই নিবন্ধ দৈনিক প্রথম আলোতে "টিপাইমুখঃ যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনার অনুরোধ" শিরোনামে বাংলায় অনূদিত হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ডঃ রিজভীর এই নিবন্ধ তার সম্প্রতি ভারত সফরের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা।উল্লেখ্য যে, টিপাইমুখ নিয়ে সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক আলোচনার নিমিত্তে ডঃ গওহর রিজভী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আরেক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান দিল্লী সফর করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি উল্লেখ করেন যে, বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখে বাঁধ হলেও তাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না এবং তিনি মনে করেন যে টিপাইমুখে বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে বলে যে কথাগুলো উঠেছে, তার সবই ভিত্তিহীন। বলতে দ্বিধা নেই ডঃ রিজভীর এই নিবন্ধ সেই সাংবাদিক সম্মেলনে তার মতামতেরই আনুষ্ঠানিক রূপ। এখানে বলে নেয়া ভাল যে তার এই নিবন্ধের অনেক অংশেই আমার দ্বিমত রয়েছে। শুধু তাই নয় তিনি এই নিবন্ধে পানিসম্পদ কৌশলগত দিক থেকে কিছু ভুল তথ্য দিয়েছেন। আমার এই নিবন্ধে তার লেখার কিছু অসংগতি এবং যেসব বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী মতামত রয়েছে তার ব্যবচ্ছেদ থাকবে।

নিবন্ধের শুরুতে তিনি কিছু বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে নিয়েছেনঃ 

১) তিনি টিপাইমুখ বাঁধ প্রসংগে যথেষ্ট সচেতন এবং জাতীয় স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলে দাবী করেন।

২) টিপাইমুখ বাঁধে যাতে বাংলাদেশের পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক কোন ক্ষতি না হয়, বর্ষায় যাতে বন্যা না বাড়ে, এবং বরাক নদ থেকে যেন পানি প্রত্যাহার না হয় এসব বিষয়ে তিনি আপসহীন কারন এগুলো জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন।

৩) তিনি মনে করছেন যে সাম্প্রতিক কালে টিপাইমুখ নিয়ে গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের চেয়ে রাজনীতিবিদরা অধিক সক্রিয় যারা মূলত অন্তঃসারশূন্য আলোচনা দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করছেন।

৪) দিল্লি যাওয়ার আগে টিপাইমুখ প্রকল্পের প্রভাব বিষয়ে তিনি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিজ্ঞানী, নীতিপ্রণেতা এবং ভিন্ন মত ও দলের রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সমস্যাগুলো বুঝে নিয়েছেন এবং কোন কোন বিষয়ে ভারতের কাছ থেকে কূটনৈতিকগত ব্যাখ্যা ও নিশ্চয়তা পাওয়া প্রয়োজন সেটি জেনে নিয়েছেন।

৫) তিনি তার দিল্লী সফরে ভারতের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তপ্রণেতা মুখ্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের উদ্বেগের দিকগুলো উল্লেখ করেছেন।

তার নিবন্ধের প্রাথমিক অংশের এই পাঁচটি পয়েন্টের মধ্যে চারটিতেই (১, ২, ৪, ৫) তার অবস্থানের সাথে সহমত জ্ঞাপণ করছি, আশা করছি পাঠকও এই ক্ষেত্রে একমত হবেন। অর্থাৎ ডঃ রিজভীত মত আমরাও টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সচেতন; বাংলাদেশে পরিবেশ ও পানিসম্পদগত বিষয়ে আপসহীন। একজন কূটনৈতিক দূত হিসেবে ভারত সফরের আগে টিপাইমুখ ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সাথে কথা বলে সমস্যা ও উদ্বেগ জেনে নিয়ে ভারত সরকারের কাছে সেই আলোকে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরাকেও আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু টিপাইমুখ নিয়ে গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের নিশ্চুপ থাকার বিষয়টির (৩ নং পয়েন্ট) সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে আলোচনা শুরু হবার সময় থেকেই বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা এই প্রকল্পে বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে অধ্যাপক জহির উদ্দীন চৌধুরী [১], অধ্যাপক আইনুন নিশাত [২, ১২], জনাব এম এ কাসেম [৩], ডঃ আসিফ নজরুল [৪, ১৪], ডঃ আকবর আলি খান [৫ (ক,খ,গ)], ডঃ সিরাজুল ইসলাম [৬], ম. ইনামুক হক [১৩] প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গের লেখা বা সাক্ষাৎকার সমূহ। পানিসম্পদ কৌশল নিয়ে বিগত এক যুগের অধিক সময় ধরে পড়াশুনা ও গবেষনার আলোকে টিপাইমুখ বাঁধের বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আমার নিজেরও বেশ কিছু লেখালেখি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে [৭,৮,৯,১০, ১১]। সুতরাং ঢালাও ভাবে 'টিপাইমুখ ইস্যুতে শুধুমাত্র রাজনীতিবিদরাই মাঠ গরম করছে' বা 'বাংলাদেশের প্রভাব সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় বিশেষজ্ঞদের মতামতের মেরুকরণ হচ্ছে' এই জাতীয় মন্তব্য বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে টেকেনা।

প্রাথমিক আলোচনার পর ডঃ রিজভী টিপাইমুখ প্রকল্প সম্পর্কে সবচেয়ে ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক একটি তথ্য দিলেন তার লেখাতে। তিনি উল্লেখ করলেন যে, বিজ্ঞানী ও পানিবিশারদদের মতে, টিপাইমুখ প্রকল্প একটি গতিশীল জলপ্রবাহ (run-of-the-river) জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। এক্ষেত্রে পাঠকদের সুবিধার্থে আমি গতানুগতিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আর গতিশীল জলপ্রবাহ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কে একটি মৌলিক ধারনা দেবার চেষ্টা করছি।

গতানুগতিক পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পঃ এই প্রকল্পের মূল স্থাপনা হলো একটি বাঁধ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কাপ্তাই বাঁধকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। সাধারনত একটি খরোস্রোতা নদীর প্রবাহকে একটি বাঁধ দিয়ে আটকে এর উজানে জলাধার তৈরী করে পানির উচ্চতা বাড়ানো হয়। আমরা যারা সাধারন বিজ্ঞান পড়েছি তারা জানি এতে পানির স্থিতিশক্তি বেড়ে যাবে যা কিনা উচ্চতার সমানুপাতিক। পানিকে শুধু আটকে রাখলেই হবেনা, একটি নির্দীষ্ট উচ্চতায় যাবার পড়ে জলাধারের নিম্ন দিয়ে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে এই পানিকে প্রবাহিত করতে হবে, হলে স্থিতিশক্তি গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হবে এবং প্রচন্ড বেগে পানি প্রবাহিত হবে। পানির সেই বেগকে কাজে লাগিয়ে আমরা টারবাইন ঘোরালে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। সুতরাং বিদ্যুৎ উৎপাদন যত বাড়ানো হবে তত জলাধার থেকে ছেড়ে দেয়া পানির পরিমান তত বাড়বে। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পনির প্রবাহ বাড়লে তা জলাধারে আটকে রাখা হবে সুতরাং বাঁধের পরে ভাটি অঞ্চলে পানির প্রবাহ কমে যাবে, আরো ভাল করে বললে ঠিক তততুকুই পানি যাবে যা টারবাইনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হবে। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে উজান থেকে পানি কম আসলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করার তাগিদে জলাধার থেকে নিয়মিত ভাবে পানি ছাড়তে হবে ফলে বাঁধের ভাটিতে পানির প্রবাহ আগের থেকে বাড়বে। বাঁধের ভাটিতে পানির এই বাড়া বা কমার পরিমান নির্ভর করবে মূলত উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমানের উপর।

এই জাতীয় প্রকল্পের সুবিধে হচ্ছে উজানে বিশাল জলাধার থাকায় সারা বছর একটি মোটামুটি স্থির মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সবচাইতে দুর্বল দিক হচ্ছে উজানের জলাধার নির্মাণের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় আর ভাটি অঞ্চলের নদীতে বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রবাহের কোন তারতম্য না হওয়া যা কিনা নদীর ঐ অংশের জলজ বাস্তুসংস্থান নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।সেই সাথে ভাটিতে নদী ক্ষয় এবং সেই ক্ষয়িত পলির আরো ভাটিতে পরিবাহিত হওয়াও এর মধ্যে পড়ে।

গতিশীল জলপ্রবাহ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পঃ এই পদ্ধতিতেও নদীতে আড়াআড়ি বরাবর বাঁধ দেয়া হয় তবে এক্ষেত্রে উজানে কোন জলাধার নির্মান করা হয়না অথবা খুব ছোট আকারের জলাধার থাকে। বাঁধ দেবার পর নদীর প্রায় সম্পূর্ন প্রবাহকে (অধিকাংশ ক্ষেতে শতকরা ৯৫ ভাগ প্রবাহ) ঢালু টানেলে (Penstock) করে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়া হয় তার পর সেই ঢালু টানেলের উচ্চতার ব্যবধানকে কাজে লাগিয়ে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

এই পদ্ধতির সুবিধে হিসেবে বলা হয়ে থাকে উজানে পানি ধরে রাখার দরকার নেই ফলে এটি অধিক পরিবেশবান্ধব। আর যেহেতু ভাটিতে নদীর প্রবাহের উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন হয়না তাই এর পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক প্রভাব গতানুগতিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের চেয়ে অনেকাংশেই কম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে প্রাকৃতিক প্রবাহের কারণে তাই উৎপাদনে হার পরিবর্তনশীল এবং অপেক্ষাকৃত কম।

আবারে আসি টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে। টিপাইমুখ প্রকল্পে নদীর প্রবাহকে প্রায় ১৬৩ মিটার উঁচু গ্রানুলার (দানাদার) মাটি দিয়ে ভরাট করা হবে এবং পানির প্রবাহকে এক বা একাধিক পানি অভেদ্য স্তর দিয়ে রোধ করা হবে এবং বাঁধের কারনে সৃষ্ট জলাধারের ফলে প্লাবিত এলাকা প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার যাত প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগই মনিপূর রাজ্যের আর বাকী ৫ ভাগ মিজোরাম রাজ্যের। সুতরাং একথা বলার অপেক্ষ রাখেনা যে টিপাইমুখ প্রকল্প একটি 'গতানুগতিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প', 'গতিশীল জলপ্রবাহ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প' নয়।

এর পরে তিনি উল্লেখ করলেন যে টিপাইমুখ প্রকল্প শুধুমাত্র তখনই ভাটি অঞ্চলে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে যখন সেখান থেকে সেচ ও অন্যান্য প্রয়োজনে পানি প্রত্যাহার করা হবে এবং যেহেতু ভারত সরকার বলছে যে তারা এই প্রকল্পে কোন ব্যারেজ নির্মান করবেনা সেক্ষাত্রে বাংলাদেশে বরাক নদের দুটি শাখা সুরমা ও কুশিয়ারার পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা নয় বরং শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ বাড়বে আর আর বর্ষায় পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করবে।

এখানে উল্লেখ্য যে ডঃ রিজভী সহ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে এমনটি মনে হচ্ছে যে তারা মনে করেন যে এই প্রকল্পে সেচের জন্য ব্যারেজ নির্মান না করে শুধু বাঁধ হলে তা তেমন ক্ষতি হবেনা বরং তা ইতিবাচক হবে বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্ত ও অযৌক্তিক মতামত। সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার না করলেও এই বাঁধ বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক হবে। বরাক নদীর ভাটির দিকের অঞ্চল সিলেটের হাওড় এলাকায় বর্ষার শুরুতে আগাম বন্যা হয় আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি কমে আসে।টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের পর বর্ষার শুরুতে রিজার্ভারে পানি ধরে রাখার প্রয়োজন পড়বে আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। এর ফলে বর্ষার শুরুতে বন্যা কমে আসতে পারে আবার বর্ষার শেষে বন্যার প্রকোপ বাড়তে পারে।এর প্রভাব বাংলাদেশের উপরেও পড়বে । অর্থাৎ বন্যা মুক্ত হবার যে কথা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়, যেটি হতে পারে তা হলো বন্যার স্বাভাবিক সময় পরিবর্তিত হতে পারে। এছাড়া বাঁধের কারনে এর উজানে জলাধারে সব পলি সঞ্চিত হবে, ফলে যে পানি ভাটিতে আসবে তাকে এক কথায় বলা যায় "রাক্ষুসী পানি"। এই পানি পলিমুক্ত বলে এর পলিধারন ক্ষমতা অনেক বেশী আর তাই এটি বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিমি ব্যাপী ব্যাপক নদী ক্ষয়ের সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ বাঁধের ২০০ কিমি ভাটিতে থাকায় এই বিপুল পরিমান পলি বরাক নদী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। কিন্তু পানির প্রবাহ তুলনামূলক ভাবে কমে যাওয়ায় পলি বহন করার ক্ষমতা কমে যাবে, এবং তা সুরমা ও কুশিয়ারার বুকে জমা হবে। এতে নদীর নাব্যতা ও গভীরতা হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে আগে যেটা স্বাভাবিক বর্ষাকালীন প্রবাহ ছিল প্রকারান্তরে তা বন্যা আকারে আসতে পারে এই এলাকায়।

আর যদি ধরেই নেই যে বাঁধের ফলে সিলেট আর মৌলভীবাজার এলাকা বন্যামুক্ত হবে সেখানেও প্রশ্ন আসে, এই তথাকথিত বন্যামুক্ত হওয়া কতটা ইতিবাচক। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি অনন্য বৌশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রয়েছে বিশাল জলাভুমি ও অসংখ্য হাওড়। এর একটি নিজস্ব বাস্তুসংস্থান রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এখানে বর্ষার সময় পানি বাড়বে, বন্যা হবে ও শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকা শুকিয়ে যাবে, এর উপর ভিত্তি করেই সেখানকার বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠেছে। ফলে বন্যার পানি কমা বা শুষ্ক মৌসুমে পানি বেশী পাওয়ার যে আশ্বাস ভারত দিচ্ছে তা এই এলাকার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের হাওড়গুলি শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় তখন কৃষকরা সেখানে বোরো ধান বপন করে যা এই অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে উঠে যা এই লোক গুলির বছরের একমাত্র শর্করার যোগান দেয়।বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এই এলাকার চাষাবাদ ব্যহত হবার আশঙ্কা আছে। আর যদি ধরেও নেই যে এই বর্ধিত প্রবাহ চাষাবাদের জমিকে খুব বেশী প্লাবিত করবেনা সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়। এই জমিগুলো বন্যার সময় প্লাবিত হওয়ায় বিপুল পরিমান পলি জমে। এখন বর্ষা মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় তা আগের মত আর প্লাবিত হবেনা ফলে জমিগুলো তাদের উর্বরতা হারাবে। সুতরাং ফুলেরতল ব্যারেজ না হলেই টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক এই যুক্তি অসাড় ও বিভ্রান্তিমূলক।

পরবর্তীতে তিনি টিপাইমুখ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভাটির রাজ্য আসাম ও নাগাল্যান্ড এর আপত্তি না থাকার কথা উল্লেখ করে এই প্রকল্পে বাংলাদেশেরো আপত্তি থাকা উচিৎ নয় এরকম একটি ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে বারাক নদী থেকে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারনা আসে মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রনের চাহিদা থেকেই। অনেক আগে সেই ১৯৩০ সালের দিকে যখন আসামের কাছাড় উপত্যকায় এক ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয় তার পর থেকেই মূলত একটি দীর্ঘমেয়াদী বন্যা নিয়ন্ত্রন পরিকল্পনা করা হয় যার অংশ হিসেবে ১৯৫৪ সালে ভারতের Central Water Commission (CWC) একটি বহুমুখী জলাধারের জন্য সমীক্ষার কাজ হাতে নেয়। একথা সত্য যে এই প্রকল্পের ঠিক ভাটির রাজ্য আসাম এক্ষেত্রে বন্যার প্রকোপ কমে যাবার সুবিধে পাবে যেমনটা পাচ্ছে কাপ্তাই বাঁধ হবার পর চট্রগ্রামের অধিবাসীরা। কিন্তু টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ২০০ কিমি দূরে। বাঁধের ঠিক ভাটিতে নদী ক্ষয় হয় যেহেতু পলি সব উজানে জমে থাকে। সেই পলি আরো ভাটিতে এসে নদীতে জমে। ধারনা করা হয় টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রে প্রথম ১৫০ কিমি (এটি নির্ভর করে বাঁধের উচ্চতা, নদীর মাটির প্রকৃতি সহ আরো বিভিন্ন ফ্যাক্টরের উপর) পর্যন্ত নদী ক্ষয় হবে আর তার পরে সেই পলি সঞ্চিত হবে ভাটিতে।এছাড়া বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের যে বিস্তীর্ন হাওড় অঞ্চলের বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্র আছে সেটি পরিপূর্ন ভাবে বিনষ্ট হবে এই বাঁধের জন্য । সুতরাং এই প্রকল্পে আসামের আপত্তি থাকার কোন কারন নেই। ফলে আসামের উদাহরন টেনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই বাঁধের ইতিবাচকতা টেনে আনা অযৌক্তিক।

তিনি আরো উল্লেখ করলেন যে ভারত সরকার তাদের আন্তরাজ্য সম্পর্কের বিষয়টি বোঝে এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। কিন্তু কৌশলে তিনি মনিপুর রাজ্যের কথা এড়িয়ে গেলেন। এই বাঁধের কারনে সৃষ্ট জলাধারের ফলে প্লাবিত এলাকা প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার যাত প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগই মনিপূর রাজ্যের আর বাকী ৫ ভাগ মিজোরাম রাজ্যের। ঠিক এ কারনেই এই বাঁধ নিয়ে মনিপুর রাজ্যের সাধারন মানুষ ও পরিবেশবাদীদের আন্দোলন চলছে। ভারত সত্যিই তাদের আন্তরাজ্য সম্পর্কের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলে এই জলাধারের ফলে মনিপুর রাজ্যে পরিবেশগত যে বিরূপ প্রভাব পড়বে সেটি মাথায় রাখত।

এর পর তিনি উল্লেখ করলেন যে টিপাইমুখ প্রকল্পটি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৪০ মাইল দূরে এবং এর ফলে সকল পরিবেশগত প্রভাব ঘটলে তা ঘটবে প্রধানত ভারতের ভূখণ্ডের মধ্যে এবং এ ক্ষেত্রে দূরত্বের কারণে বাংলাদেশের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তিনি এখানেও ভুল তথ্য দিলেন। এই প্রকল্পের ভারতের পরিবেশগত প্রভাব যাচাই রিপোর্ট অনুসারেই টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তাবিত স্থানটি বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ২০০ কিমি উজানে। আর দূরত্বের কারনে বাংলাদেশে পরিবেশগত প্রভাব কম হবার যে হাইপোথিসিস তিনি দিলেন সেটি সম্ভবত তার মস্তিষ্কজাত বা আরোপিত। এই লেখাতেই এই নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে কিভাবে টিপাইমুখ প্রকল্প বাংলাদেশে পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

এই প্রকল্পের ভূমিকম্পের ঝুকির কথা উল্লেখ করে তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন ভারতের সরকার পর্যাপ্ত অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনা ছাড়া মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও আসামে তাদের নিজেদের নাগরিকদের জীবন ও বসতিকে বিপন্ন করে ঝুঁকি নিতে চাইবেনা। আর যেহেতু বাংলাদেশ টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে অনেক দূরে সেক্ষেত্রে আমাদের ঝুঁকি অনেক কম। এটি হাস্যকর যুক্তি। ভূমিকম্পের কারনে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার জলাধারের পানি সুরমা কুশিয়ারা দিয়েই বঙ্গোপসাগরে যাবে, বিকল্প কোন পথ এক্ষেত্রে নেই। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের FAP 6 রিপোর্ট মতে টিপাইমুখ প্রকল্পে বাঁধ ভাঙ্গার কারনে বাঁধের স্থলে যে ঢেউ উৎপন্ন হবে তা সাধারনত ঘন্টায় ১০ থেকে ৩০ কিলোমিটার বেগে ভাটির দিকে ধাবিত হবে, যদিও এই বেগ দূরত্ত্বের সাথে হ্রাস পাবে। বাঁধ স্থল থেকে অমলসিদের ( বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে ) দূরত্ত্বকে ২০০ কিলোমিটার ধরলে এই ঢেউ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সময় লাগবে ২৪ ঘন্টা। বাংলাদেশে প্রবেশের সময় এই ঢেউয়ের উচ্চতা হবে ৫ মিটার। টিপাইমুখ বাঁধের জলাধারের ধারন ক্ষমতা ১৫,০০০ মিলিয়ন ঘনমিটার। এই বিপুল প্রবাহ ১০ দিন ধরে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং সমস্ত বন্যার্ত এলাকা থেকে পানি সরে যেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। সুতরাং বাংলাদেশে কম ক্ষতিগ্রস্থ হবার যুক্তি অসাড়।

তিনি উল্লেখ করেছেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন যে টিপাইমুখ প্রকল্পে ভারত এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না যাতে বাংলাদেশের স্বার্থের ক্ষতি হয় এবং এই আশ্বাসকে নির্ভরযোগ্য করতে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস সেই রাষ্ট্রের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার পাওয়ার শামিল এবং একে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। কিন্তু আমরা সম্প্রতি লক্ষ্য করেছি যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে নীতিগত সবকিছু চুড়ান্ত হবার পরও শুধু পশ্চিমবংগ রাজ্য সরকারের আপত্তির কারনে তা বাস্তবায়িত হয়নি। ভবিষ্যতেও যে টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোন পদক্ষেপ মনিপুর রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত হবেনা সেটি তাই এক্ষেত্রে হলফ করে বলা যাবেনা। আর যেখানে বর্তমান প্রস্তাবিত প্রকল্পই বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী সেখানে এই জাতীয় আশ্বাসের কোন ভিত্তি নেই।

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব পর্যালোচনা, প্রকল্পের নকশা ও অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশকে তথ্য প্রদানের অঙ্গীকার করেছেন এবং বাংলাদেশ ভবিষ্যতে যেকোনো প্রতিনিধিদল কিংবা সমীক্ষাদল পাঠালে তিনি তাদেরও স্বাগত জানাবেন। এখানে উল্লেখ্য যে টিপাইমুখ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব পর্যালোচনা রিপোর্ট সেই ২০০৯ সাল থেকেই অনলাইনে নেপকোর (NEEPCO) ওয়েবসাইটে রয়েছে (যদিও বর্তমানে লিঙ্ক কাজ করছেনা)। তবে প্রকল্পের নকশা ও বাংলাদেশের সমীক্ষাদলকে স্বাগতমের অঙ্গীকার নিঃসন্দেহে ইতিবাচক সাড়া। তিনি মন্তব্য করেছেন যে, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও বিজ্ঞানীদের উচিত এই আমন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে গভীর সমীক্ষা চালানো, যাতে আমরা নিজস্ব একটা সিদ্ধান্ত বা উপসংহারে পৌঁছাতে পারি। তার এই মন্তব্যের সাথে আমি সহমত জ্ঞাপণ করছি তবে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকেই নিতে হবে এবং তা করার আগে এই প্রকল্পের কি কি তথ্যাবলী ও উপাত্ত লাগবে সেটি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে হবে।

তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্পের সমতাভিত্তিক অংশীদার হওয়া এবং সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ নেওয়ার আমন্ত্রণ পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন যে, এর ফলে প্রকল্পটির সকল পর্যায়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ থাকবে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্থান করে নেওয়া নিশ্চিত হবে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, ভারতের এই আমন্ত্রন মেনে নেয়া মানে হচ্ছে টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে সেটিকে অস্বীকার করা। আমাদের আগে প্রয়োজন এই প্রকল্পের নিজস্ব বা যৌথ সমীক্ষা করে জেনে নেয়া বাংলাদেশের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে। তার পর এই প্রকল্পে বাঁধের কারনে বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষতি ন্যুনতম পর্যায়ে আনা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। যদি বাঁধের ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য এর ডিজাইনে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন সম্ভব থাকে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞদলের পরামর্শ অনুযায়ী যদি বাঁধের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয় যাতে করে এর ভাটিতে প্রভাব ন্যুনতম পর্যায়ে আসবে তাহলে সেই পরবর্তিত ডিজাইন নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল আরেক দফা গবেষণা করবে।এর পরেই শুধুমাত্র সমতাভিত্তিক অংশীদার হওয়া এবং সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ নেওয়ার প্রসংগ আসতে পারে। আর তা না হলে, অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ দল যদি মনে করে এই ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব নয় তাহলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার প্রস্তাব ভারতের কাছে উত্থাপন করতে হবে।

তিনি উল্লেখ করেছেন যে সংগৃহীত তথ্য এবং ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া আশ্বাসের ভিত্তিতে আমাদের উচিত টিপাইমুখ প্রকল্পকে আবেগ ও রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে বিযুক্ত করে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিশীলতার আলোকে বিবেচনা করা। তার এই মন্তব্যের সাথেও আমি একমত তবে শুধুমাত্র ভারত সরকারের মৌখিক আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে নিশ্চয়তার ঢেকুর তোলার পক্ষপাতি নই। টিপাইমুখ বাঁধ একটি জাতীয় সমস্যা যার সাথে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক কিছু বিষয়। আর যেহেতু এটি দুই দেশের মধ্যকার সমস্যা তাই আমাদেরকে খুবই সাবধানতা ও দক্ষতা আর সেই সাথে কুটনৈতিক ভাবে এগোতে হবে। আমি বিশ্বাস করি যে এই ইস্যুটি নিয়ে আমাদের মধ্যে আবেগ কাজ করবে কিন্তু সমস্যাটি সমাধান করতে আবেগের চেয়ে তথ্য ও যুক্তির প্রয়োগ বেশী প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে যাদের একসাথে কাজ করতে হবে তারা হলোঃ সরকার, বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, গণ ও প্রচার মাধ্যম, প্রভাবিত এলাকার বিভিন্ন পেশার জনগণ, এবং দেশের সাধারণ জনগণ। এই বিষয়টি যেহেতু দু'টি দেশের মধ্যে বিদ্যমান তাই যেকোন যোগাযোগ রক্ষার কাজটি সরকারের কূটনৈতিক পর্যায় থেকে হতে হবে। কিন্তু যেহেতু বিষয়টা পুরোপুরি কারিগরী তাই কুটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা কি হবে সেটি ঠিক করে দেবে আমাদের বিশেষজ্ঞরা। সরকার এই কাজটি সঠিকমত করছে কিনা তার গঠনমূলক তদারকি করবে রাজনীতিবিদেরা । জনগণকে এই বিষয়ে সাম্যক জ্ঞান দিয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে গণ আর প্রচার মাধ্যমগুলো আর সচেতন জনগণ দেশের প্রয়োজনে যেকোন প্রকার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করবে।

তিনি আলোচনা শেষ করেছেন এই প্রকল্প নিয়ে নিজস্ব বৈজ্ঞানিক সমীক্ষাও চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে। আমারও বক্তব্য সেটাই। তবে এক্ষেত্রে ঠিক এই মূহুর্তে বাংলাদেশের যা করা উচিৎ তা পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করছিঃ

প্রথমতঃ সংসদীয় দলের ২০০৯ সালে ভারত সফরের মধ্য দিয়ে একটি আলোচনার সুত্রপাত হয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের ভারত সফরের সময় সেই আলোচনাকে কূটনৈতিক ও কারিগরী ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সুতরাং সরকারের এই মূহুর্তেই উচিৎ টিপাইমুখ নিয়ে একটি সমন্বিত বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দলে যেসব অনুষদ থেকে লোক থাকবেন তা হলোঃ পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশল-ভূতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদ, বাস্তুতন্ত্রবিদ(উদ্ভিজ ও প্রাণিজ), জীববিশেষজ্ঞ, কৃষিবিদ, নৃবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও আইনবিদ। কারা এই দলে থাকবে সেটি নির্ণয়ের দায়িত্ত্ব সরকারের তবে অনুরোধ থাকবে বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাদেরকেই রাখতে যাদের তাদের স্ব স্ব বিষয়ে বিস্তর গবেষণা ও কাজের অভিজ্ঞতা আছে, সেই সাথে এই জাতীয় ইস্যু নিয়ে অতীতে যারা কাজ করেছেন তাদের অভিজ্ঞতার মূল্য দেওয়াটাকেও বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।

দ্বিতীয়তঃ গঠিত বিশেষজ্ঞ দল সরকারের কাছে রিপোর্ট প্রদান করবে যে টিপাইমুখ বাঁধ বা ফুলেরতল ব্যারেজের ফলে বাংলাদেশে কি কি নেতিবাচিক প্রভাব পড়বে তা গবেষণার জন্য তাদের কি পরিমান তথ্য প্রয়োজন ?

তৃতীয়তঃ সমন্বিত বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে দু'টি বিষয়ে প্রস্তাব পাঠাবেঃ
  • বাংলাদেশের গবেষণা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভারত টিপাইমুখ প্রকলের কোন কাজ শুরু করতে পারবেনা।
  • ভারত বাংলাদেশকে আমাদের বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শ অনুযায়ী জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উপাত্ত প্রদান করবে।
চতুর্থতঃ তৃতীয় ধাপ সফল হলে বিশেষজ্ঞ দল সকল উপাত্ত নিয়ে টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করবে। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য থাকবেঃ
  • বাঁধের ও ব্যারেজের কারনে প্রবাহের কি পরিবর্তন হবে ?
  • এই প্রবাহ হ্রাস ও জলাধারে পলিহ্রাসের প্রভাবে বাঁধের ভাটিতে ব্যাপক নদীক্ষয়ের কি প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে ?
  • প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলের হাওড় গুলির বাস্তুতন্ত্রে কি পরিবর্তন আসব ?
  • এই এলাকার সাথে মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর তার কি প্রভাব পড়বে ?
বস্তুত এই সবকিছু নিয়ে সমীক্ষার পরই জানা যাবে এই বাঁধ হলে বাংলাদেশের কি পরিমান ক্ষতি হবে।

পঞ্চমতঃ এই পর্যায়ে বাঁধের কারনে বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষতি ন্যুনতম পর্যায়ে আনা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে যৌথ গবেষণার প্রস্তাব আসতে পারে।

ষষ্ঠতঃ এই সব রিপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে বা ভারতে সরকার পর্যায়ে বৈঠক করতে হবে যেখানে বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ দল তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। যদি বাঁধের ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য এর ডিজাইনে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন সম্ভব থাকে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞদলের পরামর্শ অনুযায়ী যদি বাঁধের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয় যাতে করে এর ভাটিতে প্রভাব ন্যুনতম পর্যায়ে আসবে তাহলে সেই পরবর্তিত ডিজাইন নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল আরেক দফা গবেষণা করবে।
আর তা না হলে, অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ দল যদি মনে করে এই ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব নয় তাহলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার প্রস্তাব ভারতের কাছে উত্থাপন করতে হবে।

সপ্তমতঃ প্রকল্প বন্ধ করার বাংলাদেশের প্রস্তাব কুটনৈতিক ভাবে ভারত প্রত্যাখ্যান করলে জাতিসংঘের মাধ্যমে আইনগতভাবে কিভাবে আমরা প্রচেষ্টা চালাতে পারি তারো খসড়া প্রনয়ন করতে হবে। বিশেষজ্ঞ দলের আইনবিদেরা এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন।

অষ্টমতঃ ভারতের সাথে আইনগত ভাবে এই সমস্যা মোকাবেলা করার সময় দেশের রাজনীতিবিদ, সংবাদ মাধ্যম, সাধারণ জনগণকে দেশের প্রেক্ষাপটে এক থাকতে হবে। জাতিগত ভাবে আমাদের সমস্যা আমরা অনেক সময়ই না বুঝে বা ভবিষ্যৎ আঁচ না করে সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়ে থাকি যা কখনই দেশের জন্য ভাল কিছু বয়ে আনেনা।

পরিশেষে, একজন নাগরিক হিসেবে চাইব বাংলাদেশ সরকার যেন ভারত সরকারের এই আমন্ত্রনে সাড়া দিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়, সেই সাথে যৌথ গবেষণা বা নিদেনপক্ষে নিজের অর্থায়নে হলেও এই প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে তার পরে এই প্রকল্পের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে।

তথ্যসুত্র

[১] ডঃ জ়হির উদ্দিন চৌধুরী, ১২ জুলাই ২০০৯, ‘বরাক নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করা হলে তা হবে বিপদ জনক’, প্রথম আলোকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকার।
[২] ডঃ আইনুন নিশাত, ২৮ জুন ২০০৯, ‘দুই দেশেই টিপাইমুখ বাঁধের পরিবেশগত প্রভাবের জরিপ চালাতে হবে’, প্রথম আলোকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকার।
[৩] এম এ কাসেম,৬ জুলাই ২০০৯, ‘টিপাইমুখঃ যে কথা কেউ বলছেনা’প্রথম আলো।
[৪] ডঃ আসিফ নজরুল, ৫ জুলাই ২০০৯, ‘পিনাক রঞ্জনের ছোট ভুল, আমাদের বড় ভুল’ প্রথম আলো।
[৫ ক] প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধঃভারত ও বাংলাদেশের শাশ্বত ও চিরস্থায়ী জাতীয় স্বার্থের অন্বেষণ, ডঃ আকবর আলী খান। দৈনিক প্রথম আলো, ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৯।
[৫ খ] প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধঃ ভারতে সরকার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের স্বার্থ , ডঃ আকবর আলী খান। দৈনিক প্রথম আলো, ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯।
[৫ গ] প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধঃ টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশের স্বার্থ, , ডঃ আকবর আলী খান। দৈনিক প্রথম আলো, ৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯।
[৬] ডঃ মোঃ সিরাজুল ইসলাম, ‘টিপাইমুখ বাঁধঃ কিছু শর্ত মানলে কম ক্ষতিকর হতে পারে’ প্রথম আলো।
[৭] 'টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট', জাহিদুল ইসলাম। সচলায়তন প্রকাশনা।
[৮] টিপাইমুখ বাঁধঃ বাংলাদেশের জন্য বিবেচ্য বিষয়গুলি, জাহিদুল ইসলাম। প্রথম আলো, ২১ আগষ্ট ২০০৯।
[৯] টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ, জাহিদুল ইসলাম। বিডিনিউজ২৪ ডট কম, ২৪ নভেম্বর ২০১১।
[১০] বিপর্যয়ের আভাস, জাহিদুল ইসলাম। দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৭ নভেম্বর, ২০১১।
[১১] টিপাইমুখ বাঁধ কোনোভাবেই বাংলাদেশের উপকারে আসবে না, জাহিদুল ইসলাম। দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৯ নভেম্বর ২০১১।
[১২] টিপাইমুখ নিয়ে অন্ধকারে সরকার, ডঃ আইনুন নিশাত। দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৯ নভেম্বর ২০১১
[১৩] টিপাইমুখ বাঁধ দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির নজির, ম ইনামুল হক। দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৯ নভেম্বর ২০১১
[১৪] একতরফাভাবে টিপাইমুখের মতো প্রকল্প গ্রহণের অধিকার ভারতের নেই, ডঃ আসিফ নজরুল। দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৯ নভেম্বর ২০১১