রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১১

জলবায়ু পরিবর্তনঃ পর্ব-৩

গত পর্ব থেকে আমরা জলবায়ু বিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞানার্জনের পথে পা বাড়িয়েছিলাম। আমরা দেখেছিলাম কিভাবে গত ১৩০ বছর ধরে পৃথিবীর তাপমাত্রা একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে এবং এ তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে গ্রীন হাউস গ্যাস বিশেষত কার্বন ডাই অক্সাইড কিভাবে ভূমিকা রাখছে সেটি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল গত কয়েক দশক ধরে, বিশেষতঃ শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন বেড়ে যাওয়া এবং সেই আলোকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়া। শেষ করেছিলাম একটি জিজ্ঞাসা দিয়ে যে, 'বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের এই বৃদ্ধি সেটি কি কল্পকথা, নাকি আমরা সঠিক ভাবে মাপতে পারি এর পরিমান ?' আজ আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব, দেখব কোন কোন উৎস থেকে কতটুকু কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন হয়, সেই সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও আরো যেসব গ্রীন হাউস গ্যাস রয়েছে তাদের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।


 

কিলিং গ্রাফ (Keeling Curve)

পঞ্চাশ দশকে চার্লস ডেভিড কিলিং ( Charles David Keeling) নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানী বায়ুমন্ডলে সঠিক ভাবে কার্বন ডাই অক্সাইড এর পরিমান পরিমাপের জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি সন্দেহাতিত ভাবে প্রমান করতে পেরেছিলেন যে আসলেই বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বেড়ে যাচ্ছে।


keelingcurve
ছবিঃ ৫- পরিমাপকৃত উপাত্তের ভিত্তিতে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান [৫]


উপরের লেখচিত্রটিতে ডঃ কিলিং এর প্রাপ্ত ফলাফল দেখানো হয়েছে। উল্লেখ্য যে এই লেখচিত্রটি কিলিং কার্ভ(Keeling Curve) নামে পরিচিত। এখানে ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু করে ২০১০ সাল পর্যন্ত বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাপকৃত পরিমান পিপিএম ( ১ পিপিএম মানে হচ্ছে ১ মিলিয়ন লিটার বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান ১ লিটার) এককে দেখানো হয়েছে। উল্লেখ্য যে পরিমাপকৃত কার্বন ডাই অক্সাইডে স্থানীয় বায়ু দূষনের ন্যুনতম প্রভাব রাখার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপের বেশ উঁচুতে অবস্থিত মাওনা লোয়া (Mauna Loa) পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে এই পরিমাপ করা হয়েছে। লেখচিত্রটি আরো লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে প্রতি এক বছরের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান আবার পরিবর্তিত হচ্ছে। এটি মূলত হচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের সাথে উত্তর গোলার্ধে (এখানে উত্তর গোলার্ধের প্রসংগ আসছে কারন মাওনা লোয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত)কার্বন ডাই অক্সাইডের মানের তারতম্যের জন্য। উত্তর গোলার্ধে বসন্ত ও গ্রীষ্ম কাল হচ্ছে উদ্ভিদের বৃদ্ধিকাল, ফলে সেসময় অধিক পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড শোষিত হয়; পক্ষান্তরে হেমন্ত ও শীত কালে উল্লেখযোগ্য পরিমান উদ্ভিদের পাতা পড়ে যায় বা মরে যায় ফলে সেসময় বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বেড়ে যায় [৬]। 


ডঃ কিলিং যখন ১৯৫৮ সালে প্রথম এই পরিমাপ শুরু করেন তখন বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান ছিল ৩১৫ পিপিএম যা কিনা বর্তমানে (২০১০) এসে দাঁড়িয়েছে ৩৯০ পিপিএম এ। অর্থাৎ অর্ধ শতাব্দীতে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বেড়েছে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ। বলতে দ্বিধা নেই বায়ুমন্ডলে বর্ধিত এই কার্বন ডাই অক্সাইডের মূলে রয়েছি আমরা। বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন চলাচল, আমাদের অফিস-বাড়িঘর উত্তপ্তকরন, আর শিল্প কারখানা চালু রাখার জন্য আমরা অনবরত জীবাস্ম জ্বালানী পোড়াচ্ছি যা বায়ুমন্ডলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডের যোগান দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।


এবার চোখ ফেরানো যাক কিভাবে আমাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধিতে যোগান দিচ্ছে।

মানুষ্য সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইডের উৎসঃ

বায়ুমন্ডলে মানুষ্য সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমানকে যদি মোট পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয় তবে তার এক ভাগ আসছে সিমেন্ট, স্টীল সহ অন্যান্ন ভোগ্য সামগ্রী নির্মান শিল্প থেকে; দুই ভাগ আসছে আবাসিক ও বানিজ্যিক কাজে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে; অরণ্যবিনাশের (Defirestation) ফলে সৃষ্ট প্রভাব থেকে আসছে এক ভাগ (কারন আমাদের প্রয়োজনে বন ধ্বংসের ফলে প্রাকৃতিক ভাবে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষিত হতে পারছেনা); আর বাকী একভাগ আসছে পণ্য পরিবহন তথা যানবাহনের দহন থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে।

co2_source

চিত্রঃ ৬- মনুষ্য সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইডের উৎস।

কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য কি দায়ী শুধু মাত্র কার্বন ডাই অক্সাইড নাকি আরো ভিলেন আছে এক্ষেত্রে? আমরা অনেকেই বিষয়টি জানিনা যে অন্যান্ন গ্রীন হাউস গ্যাস যেমন জলীয় বাষ্প (H2O), ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন বা সিএসসি (CFC), মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডও এক্ষেত্রে গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে, এবারে বরং সেই আলোচনায় আসা যাক।

অন্যান্ন গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাবঃ

জলীয়বাষ্প আরেকটি গুরুত্ত্বপূর্ন গ্রীন হাউস গ্যাস। কার্বন ডাই অক্সাইডের মত এটিও অবলোহিত বিকিরন শোষন ও পূনঃবিকিরন করে। মজার তথ্য হচ্ছে গ্রীন হাউস উষ্ণয়নের এক চতুর্থাংশ যেখানে সংঘটিত হয় কার্বন ডাই অক্সাইড এর কারনে সেখানে দুই তৃতীয়াংশ উষ্ণায়নের জন্য দায়ী কিন্তু এই জলীয় বাষ্প। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে এই দুই গ্যাসের ভূমিকায় একটি গুরুত্ত্বপূর্ন পার্থক্য রয়েছে আর তা হচ্ছে বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমান বৃদ্ধির সাথে মানুষ ঠিক প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত নয়, বরং পরোক্ষ ভাবে সম্পর্কিত। অন্যভাবে বলতে গেলে বাতাসে জলীয় বাস্প বৃদ্ধির নিয়ন্ত্রক মানুষ নয় বরং বাতাসের তাপমাত্রা এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে থাকে। বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করা যাক এবার। পাঠক ইচ্ছে করলে জলীয় বাষ্পের প্রভাব নিয়ে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন।



আমরা জানি গরম বাতাস ঠান্ডা বাতাসের তুমলায় অধিক পরিমানে জলীয় বাষ্প ধারন করতে পারে। ঠিক সেই কারনেই বাতাসের তাপমাত্রা যখন কমে যায় তখন তার জলীয় বাষ্প ধারন ক্ষমতা কমে যায় এবং ধারন ক্ষমতার অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি বা তুষার আকারে ঝরে পড়ে। পূর্বের আলোচনার আলোকে বলা যায় যে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড যখন বৃদ্ধি পায় তখন তা অধিক পরিমানে অবলোহিত বিকিরন শোষন করে, ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক পরিমান তাপশক্তি আটকা পড়ে। এই অতিরিক্ত তাপশক্তি বাতাসের জলীয় বাষ্প ধারন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় ফলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমান বৃদ্ধি পায়। এই অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প আরো অধিক পরিমানে অবলোহিত বিকিরণ শোষন করে যা কিনা আরো তাপশক্তিকে আটকে রাখে বায়ুমন্ডলে এবং এই চক্র নিজে নিজেই চলতে থাকে। গুরুত্ত্বপূর্ন হচ্ছে একা কার্বন ডাই অক্সাইড যে পরিমান বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির যোগান দেয়, জলীয় বাষ্পের এই প্রক্রিয়া সেটাকে দ্বিগুন করে দিতে পারে। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে জলীয় বাষ্প পরিবর্ধক (Amplifier ) হিসেবে কাজ করে। পরিমাপকৃত উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা গিয়েছে বায়ুমন্ডলে ১৯৭০ সালে যে পরিমান জলীয় বাষ্প ছিল বর্তমানে তার চেয়ে শতকরা ৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই এই বর্ধিত জলীয় বাষ্প বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে তরান্বিত করছে।

আরেকটি গুরুত্ত্বপূর্ন গ্রীন হাউস গ্যাস হচ্ছে সিএফসি। সিএফসি (ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন) মূলত শীতলীকরক হিসেবে ফ্রীজ ও শীতাপন নিয়ন্ত্রক যন্ত্রে এবং এরোসলের বোতলে প্রোপেলেন্ট ( যে কারনে বডি স্প্রে বা কীটনাশক স্প্রে তীব্র বেগে বের হয়) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সিএফসি খুব কম পরিমানে বায়ুমন্ডলে অবস্থান করলেও এটি শক্তিশালী গ্রীন হাউস গ্যাস। এছাড়া যে ওজোন স্তর সূর্য্যের অতিবেগুনী রশ্মিকে শোষন করে এর ক্ষতিকর হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে থাকে, সিএফসি সেই ওজোনের সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে এই স্তর ক্ষয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আশির দশকে আবিষ্কৃত হয় যে বায়ুমন্ডলের ওজোণ স্তর আস্তে আস্তে ক্ষয় হচ্ছে, ফলে আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে সিএফসির ব্যবহার রোধ করা হয়। 



cfc

চিত্রঃ ৮- বায়ুমন্ডলে সিএফিসি’র পরিমান বৃদ্ধি [৭]

উপরের লেখচিত্রে দেখানো হয়েছে কিভাবে বায়ুমন্ডলে সিএফসির পরিমান বেড়ে চলেছে। লেখচিত্রটিতে ১৯৭৭ সাল থেকে পরিমাপকৃত উপাত্তের ভিত্তিতে উত্তর গোলার্থে ( নীল লাইন), দক্ষিন গোলার্থে (লাল লাইন)ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ( কালো লাইন) বায়ুমন্ডলে সিএফসির পরিমানকে প্রদর্শন করা হয়েছে। লেখচিত্র থেকে এটি প্রতীয়মান যে আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে সিএফসির ব্যবহার রোধ করার পর থেকে বায়ুমন্ডলে এর পরিমান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।

আরো একটি গ্রীন হাউস গ্যাস হচ্ছে মিথেন। মূলত অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে জৈবিক পদার্থের পচন সংঘটিত হলে সেখান থেকে মিথেন গ্যাস সৃষ্টি হয়। উল্লেখযোগ্য উদাহরন হচ্ছে উচ্চ ফলনশীল ধানের ক্ষেতে (যেক্ষেত্রে পানি জমিয়ে ধান চাষ করা হয়) এবং গবাদিপশুর ( গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি) অন্ত্রে সৃষ্ট গ্যাস। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধের উজানে যে বিশাল জলাধার সৃষ্টি করা হয় সেখানকার গাছপালার পচন থেকেও এই গ্যাস নির্গমন হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে ধান উৎপাদন ও গবাদিপশু পালন, ফলশ্রুতিতে অধিক পরিমান মিথেন গ্যাস বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে। নিচের ভিডিওতে দেখানো হয়েছে কিভাবে মিথেন বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে তরান্বিত করছে।


এছাড়া রয়েছে গুরুত্ত্বপূর্ন গ্রীন হাউস গ্যাস নাইট্রাস অক্সাইড। উল্লেখযোগ্য পরিমান নাইট্রাস অক্সাইড মূলত কৃষিজমিতে কৃত্রিমভাবে যোগকৃত নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার থেকে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। গত কয়েক দশক ধরে এই গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমান বেড়ে চলেছে। 


no2

চিত্রঃ ৭- বায়ুমন্ডলে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমান বৃদ্ধি [৮]

উপরের লেখচিত্রে দেখানো হয়েছে কিভাবে বায়ুমন্ডলে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমান বেড়ে চলেছে। লেখচিত্রটিতে ১৯৭৭ সাল থেকে পরিমাপকৃত উপাত্তের ভিত্তিতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ( কালো লাইন) বায়ুমন্ডলে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমানকে প্রদর্শন করা হয়েছে।

কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে মনুষ্যসৃষ্ট এই গ্রীন হাউস গ্যাসসমুহের মধ্যে কোনটিত প্রভাব সর্বাধিক? আগামী পর্বে নাহয় সে উত্তর জানা যাবে। তার আগে বরং একটু চা খেয়ে আসা যাক।

আগের পর্বগুলোর লিঙ্কঃপর্ব-১পর্ব-২

(চলবে)

তথ্যসুত্রঃ

বিদ্রঃ


১) এই সিরিজের লেখাগুলো মূলত কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ভিক্টোরিয়ার Pacific Institute for Climate Solutions (PICS) কতৃক প্রনীত অনলাইন কোর্স Climate Insights 101 এর উপর ভিত্তি করে তৈরী। আগ্রহী পাঠক এই সিরিজ পড়াকালীন সময়ে কোর্সটিও ঘুরে আসতে পারেন অনলাইনে।