গত পর্বে আমরা দেখেছিলাম যে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই
অক্সাইডের বৃদ্ধি আদতে কল্পকথা নয় বরং পরিমাপকৃত উপাত্তের ভিত্তিতেই সেটি
প্রমানিত। সেই সাথে এও জেনেছিলাম যে কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও বৈশ্বিক
উষ্ণায়নে জলীয় বাষ্প, মিথেন, সিএফসি ও নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্রীন হাউস
গ্যাসেরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।আলোচনা শেষ করেছিলাম একটি প্রশ্ন রেখে
যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে মনুষ্যসৃষ্ট এই গ্রীন হাউস গ্যাসসমুহের
মধ্যে কোনটির প্রভাব সর্বাধিক? আজ সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাবে আর সেই
সাথে গত শতাব্দী ধরে গ্রীন হাউস গ্যাসসুমহের বর্ধিত পরিমান আমাদের
বায়ুমন্ডলের প্রাকৃতিক ভাবে সংঘটিত বিভিন্ন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার উপর কতটুকু
কোন প্রভাব ফেলছে সেটি নিয়েও আলোচনা করা হবে।
মনুষ্যসৃষ্ট গ্রীন হাউস গ্যাসসমুহের তুলনামূলক প্রভাবঃ
এবারে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের উপর মনুষ্যসৃষ্ট গ্রীন হাউস গ্যাসসমুহের
তুলনামূলক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাক। নিচের চার্টটিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের
জন্য দায়ী গ্রীন হাউস গ্যাসগুলোর এই প্রক্রিয়ায় কতটুকু অবদান আছে তা শতকরা
হিসেবে দেখানো হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে কার্বন ডাই অক্সাইড
এক্ষেত্রে শতকরা ৬০ ভাগের চেয়ে বেশি দায়ী। অন্যান্ন গ্রীন হাউস গ্যাসের
মধ্যে মিথেন শতকরা প্রায় ২০ ভাগ, কৃত্রিম গ্যাস ( যেমন সিএফসি) প্রায় শতকরা
১৫ ভাগ ও নাইট্রাস অক্সাইড শতকরা প্রায় ৫ ভাগ দায়ী। এই চার্টটিতে
জলীয়বাষ্পকে হিসেবে আনা হয়নি কারন সেটি সরাসরি মানুষের কার্যক্রম দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত নয়।
গত শতাব্দী ধরেই বায়ুমন্ডলে এই গ্রীন হাউস গ্যাসসুমহ উল্লেখযোগ্য
পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আসলেই কি এই গ্যাস সমূহের বর্ধিত পরিমান
আমাদের বায়ুমন্ডলের প্রাকৃতিক ভাবে সংঘটিত বিভিন্ন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার উপর
গুরুত্ত্বপূর্ন কোন প্রভাব ফেলছে? যেমন উদাহরন সরূপ বলা প্রশ্ন করা যেতে
পারে যে, যতটুকু পরিমানে কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডলে বৃদ্ধি পাচ্ছে বা
পেয়েছে তা কি আদতেই বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রাকৃতিক চক্রের
তুলনায় খুব বেশি গুরুত্ত্বপূর্ন কিছু ? সেই সাথে এই পরিবর্তন কি আসলেই
পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য কোন প্রভাব ফেলছে ? সেই উত্তর জানতে আগে কার্বন চক্র
সম্পর্কে একটি মৌলিক ধারনা নেয়া যাক।
কার্বন চক্রঃ
আমরা জানি কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলে গ্যাস আকারে ও জলে দ্রবীভূত
অবস্থায় অবস্থান করে। উদ্ভিদ উৎপাদক হিসেবে সালোক সংশ্লেষনের জন্য এই
কার্বন গ্রহণ করে। খাদ্যস্তর অনুযায়ী বিভিন্ন খাদক খাদ্য হিসেবে এই কার্বন
গ্রহণ করে। গৃহীত কার্বনের অধিকাংশ জীবের শ্বাস-প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই
অক্সাইড হয়ে প্রকৃতিতে ফিরে যায়। এছাড়া মৃত জীবের পচন, বিভিন্ন দহন ও শিল্প
প্রক্রিয়াতে তৈরী কার্বন ডাই-অক্সাইড আবার বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে। এভাবে
চক্রাকারে কার্বনের আদান প্রদান বা কার্বন চক্র প্রকৃতিতে চলতে থাকে।উপরের
চিত্রটিতে এই কার্বন চক্র দেখানো হয়েছে।
অনেকেই ধারণা পোষন করে থাকে যে মানুষের বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে
বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাস, বিশেষত কার্বন ডাই অক্সাইডের যে পরিবর্তন
ঘটছে সেটি আসলে খুব বেশি গুরুত্ত্বপূর্ন নয়। এই ধারনার পেছনে তাদের যুক্তি
হচ্ছে মনুষ্য সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড আসলে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভাবে
বিভিন্ন উৎসের মধ্যে চক্রাকারে আদান-প্রদানকৃত কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায়
অতি নগন্য যা আসলে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তেমন গুরুত্ত্বপূর্ন কোন প্রভাব
ফেলবেনা। কিন্তু আসলেই কি তাই ?
উপরের চিত্রটিতে খুব সহজ করে কার্বন চক্র দেখানো হয়েছে। প্রতিবছর প্রায়
৩৩৮ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডল থেকে সমুদ্রের জলরাশিতে
দ্রবীভূত হয় যার মধ্যে থেকে ৩৩২ বিলিয়ন টন আবার বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে। মূলত
ঠান্ডা পানি যখন সমুদ্রতলে এসে উত্তপ্ত হয় তখন তা দ্রবীভূত কার্বন ডাই
অক্সাইড বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়, যদিও এটি নির্ভর করে ঋতু পরিবর্তন,
সমুদ্রস্রোত, পানির তাপমাত্রা জলীয় উদ্ভিদের বৃদ্ধির উপর। একই সময়ে বছরে
প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডল থেকে গাছপালা ও মাটিতে
প্রবেশ করে যার মধ্যে প্রায় ৪৩৯ বিলিয়ন টন আমার বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে মূলত
জীবদেহের পচনের মাধ্যমে।অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় ৮০০ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই
অক্সাইড প্রাকৃতিক ভাবেই চক্রের মাধ্যমেই পৃথিবীতে বিভিন্ন উৎসের মধ্যে
(বায়ুমন্ডল, সমুদ্র, মাটি, জীব) আদান-প্রদান হয়ে থাকে। অন্যদিকে প্রতিবছর
প্রায় ২৯ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড মানুষের বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে
বায়ুমন্ডলে নিঃসরিত হয় যার অধিকাংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানী দহন এবং
অরণ্যবিনাশের মাধ্যমে।
আপাতদৃষ্টিতে প্রাকৃতিক ভাবে চক্রাকারে আবর্তিত ৮০০ বিলিয়ন টনের সাথে
তুলনা করলে মানুষের কার্যক্রমের ফলে সৃষ্ট ২৯ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই
অক্সাইডকে নগন্য মনে হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে গুরুত্ত্বপূর্ন হচ্ছে এই
নগন্য পরিমান অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড কিন্তু প্রাকৃতিক সাম্যাবস্থাকে
বিনষ্ট করছে। কিভাবে এটি ঘটছে তা বোঝার জন্য নিচের এনিমেশন দুটি (পাঠক
ইচ্ছে করলে পুরো এনিমেশনটি অডিওসহ এই লিঙ্ক থেকে দেখতে পারেন)বিশ্লেষণ করা যাকঃ
উপরের এনিমেশনটিতে দেখানো হয়েছে যে একটি বাথটাবে ট্যাপের মাধ্যমে পানি
আসছে এবং একই সাথে নিচে অবস্থিত একটি পাইপ দিয়ে বাথটাব থেকে পানি চলে
যাচ্ছে। ট্যাপের প্রবাহ এবং নির্গমন পাইপের প্রবাহ এমন ভাবে নিয়ন্ত্রন করা
হয়েছে যেন যে পরিমান পানি প্রবেশ করে ঠিক তার সমপরিমান পানিই যেন চলে যায়।
এর ফলে বাথটাবের পানির পরিমানের আদতে কিন্তু কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা। এই
নমুনাটিকে তুলনা করা যেতে পারে শিল্প বিপ্লবের আগে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভাবে
সংঘটির কার্বন চক্রের সাথে। অর্থাৎ যে পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড
বায়ুমন্ডল থেকে গাছাপলা, মাটি ও সমুদ্রে শোষিত হচ্ছে ঠিক সেই পরিমানই আবার
বায়ুমন্ডলে ফিরে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সবসময় একটি সাম্যাবস্থা বিরাজ করছে।
এখন ধরা যাক কেউ একজন এসে ট্যাপের প্রবাহ সামান্য পরিমানে বাড়িয়ে দিল
যেমন করে আমরা শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়িয়ে এবং
অরণ্যবিনাশের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের আগমন একটু করে
বাড়িয়ে দিয়েছি। এবারে নিচের এনিমেশনটি লক্ষ্য করুন। যেহেতু নির্গমন পাইপের
প্রবাহ আগের মতই রাখা হয়েছে তাই ট্যাপের সামান্য বর্ধিত প্রবাহ আসলে একটু
একটু করে সঞ্চিত হয়ে বাথটাবের পানির স্তর একটু একটু করে বাড়িয়ে দিচ্ছে, ঠিক
যেমন করে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। যতক্ষন
পর্যন্ত এই ট্যাপ দিয়ে বাড়তি পানি বাথটাবে আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত পানির স্তর
বাড়তেই থাকবে। ঠিক তেমনি যতক্ষন আমরা অধিক জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়িয়ে কার্বন
ডাই অক্সাইড উৎপাদন করব ঠক ততদিন ধরেই বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের এই
বর্ধন প্রক্রিয়া চলতে থাকবে যা প্রাকৃতিক সাম্যাবস্থাকে করবে বিনষ্ট।
সুতরাং, ‘মনুষ্য সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ভাবে
বিভিন্ন উৎসের মধ্যে চক্রাকারে আদান-প্রদানকৃত কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায়
অতি নগন্য’ - এই যুক্তিতে যারা বিশ্বাস বা দাবী করে যে আসলে মানুষের
বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে বায়ুমন্ডলে গ্রীন হাউস গ্যাসের যতটুকু পরিবর্তন
ঘটছে সেটি আসলে খুব বেশি গুরুত্ত্বপূর্ন নয়, বা জলবায়ু পরিবর্তবের জন্য
দায়ী নয়, তাদের সেই বিশ্বাস বা দাবী আসলে ভ্রান্ত এবং ভিত্তিহীন। মানুষের
কার্যক্রম পৃথিবীতে হাজার বছর ধরে বিরাজমান প্রকৃতিক সামাবস্থা বিনষ্ট
করেছে এবং এর ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান বেড়েই চলেছে।
জলবায়ু বিজ্ঞান নিয়ে প্রাথমিক আলোচনার পর দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং আজকের
পর্বে (চতুর্থ পর্ব) আমরা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এর উপর মূলত গ্রীন হাউস গ্যাসের
প্রভাব নিয়য়েই আলোচনা করেছি। কিন্তু পৃথিবীতে আরো অনেক প্রাকৃতিক কারন
রয়েছে যারা জলবায়ুকে উল্লেখযোগ্য পরিমানে পরিবর্তন করে থাকে। উদাহরন সরূপ
বলা যেতে পারে, আগ্নেয়গিরির উদগীরন, সময়ের সাথে সূর্য্যের বিকিরনের
পরিবর্তন এবং গুরুত্ত্বপূর্ন দুটি জলবায়ু ব্যাত্যয় (Climate Anomaly)- এল
নিনু (El Nino) আর লা নিনা (La Nina)। আগামী পর্ব থেকে ধারাবাহিক ভাবে আমরা
এগুলো সম্পর্কে বিশদ জানার চেষ্টা করব।
(চলবে)
তথ্যসুত্রঃ
[৯] IPCC Fourth Assessment Report, 2007
[১০] Carbon Cycle, NOAA
[১১] Climate Change 2007: The Physical Science Basis, IPCC fourth assessment report (Working Group I)
বিদ্রঃ
এই সিরিজের লেখাগুলো মূলত কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ভিক্টোরিয়ার Pacific Institute for Climate Solutions (PICS) কতৃক প্রনীত অনলাইন কোর্স Climate Insights 101 এর উপর ভিত্তি করে তৈরী। আগ্রহী পাঠক এই সিরিজ পড়াকালীন সময়ে কোর্সটিও ঘুরে আসতে পারেন অনলাইনে।