বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১১

প্রতিক্রিয়াঃ "টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি করা কেন জরুরি"

মহিউদ্দিন আহমদ ২৯ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে “টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি করা কেন জরুরি” শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। বলতে দ্বিধা নেই তথ্যগত ও ভাষাগত বিচারে নিবন্ধটিকে আমার অত্যন্ত একপেশে মনে হয়েছে। আমি এই নিবন্ধে তার বক্তব্যের অযৌক্তিক দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব।

তিনি উল্লেখ করেছেন যে তার নিবন্ধে উল্লেখকৃত তথ্য কানাডীয় উন্নয়ন সংস্থার (সিডা) অর্থায়নে বাংলাদেশ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নব্বইয়ের দশকে সম্পাদিত একটি বিশেষ সমীক্ষার অংশবিশেষ। যদিও তিনি ঐ সমীক্ষার নাম উল্লেখ করেননি তবে ধারনা করা যায় উল্লেখ্য গবেষনাটি বাংলাদেশের ‘উত্তর-পূর্ব আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাঃ ফ্লাড একশন প্ল্যান-৬ (NERP-FAP 6)’ এর অধীনে ‘ইনিশিয়াল এনভায়রন্মেন্টাল ইভ্যাল্যুয়েশন’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় [১]। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে টিপাইমুখ প্রকল্পে এটিই একমাত্র একমাত্র উল্লেখ্যযোগ্য গবেষণা যা মূলত কিছু ধারনা বা এসাম্পশনের উপর ভিত্তি করে সংগঠিত হয়েছিল। তিনি উল্লেখ করেছেন যে এর চেয়ে মানসম্মত তথ্য ও উপাত্ত যদি আর কারও কাছে থেকে থাকে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অথচ ঐ রিপোর্টেই উল্লেখ আছে যে,

‘যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে এই প্রকল্পের একটি ন্যুনতম ধারনা পাওয়া যায় যা কিনা ঐ প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রাথমিক প্রভাব যাচাইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে।...ভারত কতটুকু পানি এই প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করবে সে সম্পর্কে কোন তথ্য জানা নেই। এই গবেষনার জন্য ধরে নেয়া হয়েছে যে সেচের জন্য ১ মিটার সমপরিমান পানি অপসারন করা হবে পানি অপসারন ক্রমাগত ভাবে শুষ্ক মৌসুম (নভেম্বর থেকে এপ্রিল)পর্যন্ত চলবে।’

উক্ত গবেষনায় উল্লেখ আছে যে, 

  • জলাধার পূরণের সময়কালে অনেক সময় প্রকল্পের সুবিধা তাড়াতাড়ি পাবার জন্য অতিদ্রুত ভাবে জলাধার পূর্ণ করা হয় যা বাংলাদেশের মত ভাটির অঞ্চলে ভয়াবহ পরিবেশ বিশেষ করে বাস্তুসংস্থান বিপর্যয় ঘটাবে।
  • বর্ষা মৌসুমে অমলসিদে বারাক নদীর ‘সর্বোচ্চ প্রবাহ’ ২৫ শতাংশ হ্রাস পাবে এবং পানির পরিমান শতকরা ২০ ভাগ কমে যাবে ফলে পানির উচ্চতা ১.৬ মিটার কমে যাবে।
  • শুষ্ক মৌসুমে অমলসিদে পানির সর্বোচ্চ প্রবাহ শতকরা ১০০ ভাগ থেকে ২০০ ভাগ বাড়বে এবং পানির পরিমান শতকরা ৬০ ভাগ বেড়ে যাবে ফলে পানির উচ্চতা ১.৭ মিটার বেড়ে যাবে।
  • বাঁধ ভেঙ্গে গেলে উৎপন্ন ঢেউ ঘন্টায় ১০ থেকে ৩০ কিলোমিটার বেগে ভাটির দিকে ধাবিত হবে এবং বাংলাদেশে প্রবেশ করতে এর সময় লাগবে ২৪ ঘন্টা। বাংলাদেশে প্রবেশের সময় এই ঢেউয়ের উচ্চতা হবে ৫ মিটার। টিপাইমুখ বাঁধের জলাধারের ধারন ক্ষমতা ১৫,০০০ মিলিয়ন ঘনমিটার, ফলে এই বিপুল প্রবাহ ১০ দিন ধরে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং সমস্ত বন্যার্ত এলাকা থেকে পানি সরে যেতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে।

এছাড়া সেপ্টেম্বর ২০০৫ এ কেনিয়ার নাইরবি তে ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভায়রনমেন্টাল প্রোগ্রাম’ কতৃক আয়োজিত ‘ড্যামস এন্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ শীর্ষক কর্মশালায় মোঃ গোলাম কিববিয়ার একটি উপস্থাপিত প্রবন্ধের [২] তথ্যসুত্র অনুযায়ী ‘ইন্সটিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং’ এর পক্ষ থেকে টিপাইমুখ এর উপর একটি অপ্রকাশিত স্টাডির খবর জানা যায় যাতে । উক্ত গবেষনা অনুযায়ী টিপাইমুখ বাঁধ পূর্ন ভাবে এর কার্যক্রম শুরু করলে, 

  • অমলসিদে বরাক নদীতে বর্ষা মৌসুমে গড় প্রবাহ জুন, জুলাই, আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে যথাক্রেমে ১০%, ২৩%, ১৬% ও ১৫% কমে যাবে।
  • সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার জলাভূমি ও হাওড় আগের থেকে গড়ে যথাক্রমে ২৬% ও ১১% কমে যাবে।
  • কুশিয়ারা নদী তীরে অবস্থিত কুশিয়ারা-বর্দাল হাওড় গড় বর্ষার সময় পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে এবং কাওয়ারদিঘী হাওড় এর ২৬% প্লাবন এলাকা হারাবে।
  • বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিমি দীর্ঘায়িত অংশে বিপুল নদীক্ষয়ের ফলে ক্ষয়িত পলি বাংলাদেশে বাহিত হবে যা কিনা বরাক নদীর নিচের অংশে যেখানে থেকে তা সুরমা আর কুশিয়ারা এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে সেখানে জমা হবে। বর্ষার শেষের দিকে এই পলি সঞ্চয়ের হার আরো বেড়ে যাবে। এই বেড়ে যাওয়া পলি কুশিয়ারা নদীর বেশ কিছু শাখানদীর মুখ বন্ধ করে দিতে পারে।

বর্ষা মৌসুমে পানিপ্রবাহ হ্রাসের কথা উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেছেন যে এই হ্রাসকৃত প্রবাহ বন্যা নিয়ন্ত্রনে ভূমিকা রাখবে। সেই সাথে শুকনো মৌসুমে বর্ধিত প্রবাহও ইতিবাচক।কিন্তু এই তথাকথিত বন্যামুক্ত হওয়া কতটা ইতিবাচক। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি অনন্য বৌশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রয়েছে বিশাল জলাভুমি ও অসংখ্য হাওড়। এর একটি নিজস্ব বাস্তুসংস্থান রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এখানে বর্ষার সময় পানি বাড়বে, বন্যা হবে ও শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকা শুকিয়ে যাবে, এর উপর ভিত্তি করেই সেখানকার বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠেছে। ফলে বন্যার পানি কমা বা শুষ্ক মৌসুমে পানি বেশী পাওয়ার যে আশ্বাস ভারত দিচ্ছে তা এই এলাকার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

হাওড় এলাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, বর্ষাকালে হাওড়গুলি জলে টইটুম্বর থাকে কোনো ফসল হয় না, কিন্তু তিনি বিস্তীর্ন এই হাওড় এলাকার মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্রের কথা এড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি ভুলে গিয়েছেন বর্তমান সময়ে সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার মূলনীতির কথা। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, হাওড় অঞ্চলের সমস্যা দু’টিঃ এক, আগাম বন্যা, যার ফলে ফেব্রুয়ারি-মার্চে উঠতি ফসল মাঠেই তলিয়ে যায়, এবং দুই, দেরিতে পানি নিষ্কাশন, যার ফলে বোরো ধান রোপণ করতে দেরি হয়ে যায় এবং তা আগাম বন্যার ঝুঁকিতে পড়ে। তিনি মন্তব্য করেছেন যে বর্ষাকালে বরাক দিয়ে পানিপ্রবাহ হ্রাস পেলে এই দুটো সমস্যাই কমে যাবে। কিন্তু এখানে লক্ষ্যনীয় যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের পর বর্ষার শুরুতে রিজার্ভারে পানি ধরে রাখার প্রয়োজন পড়বে আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। এর ফলে বর্ষার শুরুতে বন্যা কমে আসতে পারে আবার বর্ষার শেষে বন্যার প্রকোপ বাড়তে পারে।এর প্রভাব এই অঞ্চলের বোরো ধান আবাদের উপর পড়তে পারে।

এখানে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের হাওড়গুলি শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় তখন কৃষকরা সেখানে বোরো ধান বপন করে যা এই অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে উঠে যা এই লোক গুলির বছরের একমাত্র শর্করার যোগান দেয়। শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং তার ফলে সেচের জন্য সুফল বয়ে আনা প্রসংগে জনাব আহমদের মন্তব্যের প্রতি উত্তরে বলতে চাই, প্রাথমিক গবেষনা অনুযায়ী টিপাইমুখ প্রকল্পের কারনে শুষ্ক মৌসুমে অমলসিদের আরো ভাটিতে সুরমা কুশিয়ারা অববাহিকায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলে প্রবাহ শতকরা ৮০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে যা কিনা পানির উচ্চতা ২ মিটার পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে। সেক্ষেত্রে সেচের সুবিধা নয় বরং এই বিস্তীর্ন অঞ্চলের ফসল পানিতেই নিমজ্জিত হবে। তাই বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এই এলাকার চাষাবাদ ব্যহত হবার আশঙ্কা আছে।

নদীর উজানে বাঁধ তৈরি ও জলাধার নির্মাণ করে শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেছেন যে ‘এ ধরনের জলাধার নেপাল কিংবা ভুটানে হলে আপত্তি নেই কিন্তু ভারতে হলেই অনেকের আপত্তি।’ এখানে বলে রাখা ভাল যে বাংলাদেশের বিশেষোজ্ঞদের সেই প্রস্তাব ভারত সমর্থন করলে হয়ত গঙ্গাচুক্তি ১৯৭৪/৭৫ সালেই সংগঠিত হতো। গঙ্গা চুক্তির আপস আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৯৭৪-১৯৭৬) যেহেতু শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ের সমস্যার উৎপত্তি হয় তাই এই পর্যায়ে ‘গঙ্গায় পানি বৃদ্ধির’ বিষয়টি সামনে আনা হয়। বাংলাদেশ প্রস্তাব করে যে ভারত বর্ষা মৌসুমের বিপুল পরিমান পানিকে উজানের জলাধারে (ভারতে না নেপালে) সঞ্চিত করে তা শুস্ক মৌসুমে ব্যাবহার করতে পারে, অন্যদিকে ভারত একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র থেকে বিপুল পরিমান পানি গঙ্গায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করে।বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা উজানে বাঁধ করতে প্রস্তাব করেছিল কারন তারা চেয়েছিল যেন তাতে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গায় পানি বৃদ্ধি পায় এবং সেই বর্ধিত পানি ভারত প্রত্যাহার করতে পারে ফলে বাংলাদেশকে আর পানিবিহীন থাকতে হয়না শীতকালে। 

তিনি উল্লেখ করেছেন যে অনেকেই আছেন সরাসরি বাঁধের বিরুদ্ধে বলেলেও ভূমিকম্পের জুজুর ভয় দেখান। কিন্তু আসলেই কি এটি জুজুর ভয়? এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ভারতীয় ও বার্মা প্লেটের মিথস্ক্রিয়ার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।ভূতাত্ত্বিকভাবে টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল আসলে অসংখ্য 'ফোল্ড ও ফল্ট' বিশিষ্ট এবং এই অঞ্চলে গত ১৫০ বছরে রিক্টার স্কেলে ৭ এর অধিক মাত্রার দু'টি ভূমিকম্প হয়েছে যার মধ্যে শেষটি ছিল ১৯৫৭ সালে যা কিনা টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে পূর্ব-উত্তরপূর্ব দিকে মাত্র ৭৫ কিমি দূরে। 

তিনি মন্তব্য করেছেন ‘এ বাঁধ শুধু ভারতের তৈরি করাই উচিত নয়, বাংলাদেশের উচিত ভারতকে চাপ দেওয়া, যাতে বাঁধটি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়।’ আবেগ বর্জিত হয়েই তার উক্তির প্রতিউত্তরে বলছি আমাদের আগে প্রয়োজন এই প্রকল্পের নিজস্ব বা যৌথ সমীক্ষা করে জেনে নেয়া বাংলাদেশের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে। যদি বাঁধের ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য এর ডিজাইনে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন সম্ভব থাকে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।আর যদি এই ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার প্রস্তাব ভারতের কাছে উত্থাপন করতে হবে।