মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১২

টিপাইমুখ বাঁধ: এই মূহুর্তে বাংলাদেশের করনীয়


টিপাইমুখ নিয়ে সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক আলোচনার নিমিত্তে ডঃ গওহর রিজভী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আরেক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান দিল্লী সফর করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি উল্লেখ করেন যে, বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখে বাঁধ হলেও তাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না এবং তিনি মনে করেন যে টিপাইমুখে বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে বলে যে কথাগুলো উঠেছে, তার সবই ভিত্তিহীন। পরবর্তীতে তিনি তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে টিপাইমুখ প্রকল্পের সমতাভিত্তিক অংশীদার হওয়া এবং সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ নেওয়ার আমন্ত্রণ পুনর্ব্যক্ত করেছেনএখানে বলে রাখা ভাল যে, ভারতের এই আমন্ত্রন মেনে নেয়া মানে হচ্ছে টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে সেটিকে অস্বীকার করা।


উল্লেখ্য যে, ২০১১ সালের নভেম্বরে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ভারতের রাষ্ট্রয়াত্ত্ব জলবিদ্যুৎ সংস্থা; ভারত সরকার ও হিমাচল প্রদেশের সমন্বয়ে গড়া এসজেভিএন লিমিটেড;  এবং মনীপুর সরকারের মধ্যে একটি যৌথ সংস্থা গঠনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরণের তথ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর এই প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ সরকার উদ্বেগ প্রকাশের সাথে সাথে যৌথ সমীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও জানিয়েছিল ভারত সরকারকে। বাংলাদেশ সরকারের সেই উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে দিল্লিতে স্বাগত জানিয়েছিল ভারত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনরূপ হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যাচ্ছেনা।

ইতিপূর্বে ২০০৯ সালেও বাংলাদেশ সরকার টিপাইমুখ বাঁধের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল। সেই  সফর শেষ করে সাংবাদিক সম্মেলনে সংসদীয় দল মত প্রকাশ করেছিল যে, ‘হেলিকপ্টারে খুব নিচু দিয়ে পরিভ্রমণকালে টিপাইমুখে কোনো অবকাঠামো তাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। সেই সাথে প্রকল্পের ভাটিতে কোনো ব্যারাজ বা অবকাঠামো নির্মাণের কোনো রকম প্রস্তুতিও পরিলক্ষিত হয়নি।’ তারা এই মর্মে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখনো কোনো প্রাথমিক ভৌত কার্যাদি শুরু হয়নি এবং তারা এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, ভারত বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছুই করবেনা এখানে উল্লেখ্য যে ঠিক কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ‘ভারত বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছুই করবেনা’ এই সিদ্ধান্তে এসেছিল সেটি আমাদের বোধগম্য হয়নি, তবে সেটি যে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি আশ্বাস ছিল  তা পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেখে মনে হয়েছে।

টিপাইমুখ বাঁধ একটি জাতীয় সমস্যা যার সাথে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক কিছু বিষয়আর যেহেতু এটি দুই দেশের মধ্যকার সমস্যা তাই আমাদেরকে খুবই সাবধানতা ও দক্ষতা আর সেই সাথে কুটনৈতিক ভাবে এগোতে হবে। এক্ষেত্রে যাদের একসাথে কাজ করতে হবে তারা হলোঃ সরকার, বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, গণ ও প্রচার মাধ্যম, প্রভাবিত এলাকার বিভিন্ন পেশার জনগণ, এবং দেশের সাধারণ জনগণ ভারত সাম্প্রতিক কালে যে বিষয়টা বার বার বলে যাচ্ছে তা হলো টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে কোন বিতর্কের সূচনা হলেই তারা ফুলেরতল ব্যারেজ না করার আশ্বাস দিচ্ছে কিন্তু তারা একটি বারও শুধু বাঁধের জন্য বাংলাদেশের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে কোন কিছু বলছেনা। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি  ভারত সরকারের নর্থ-ইষ্ট ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানি, নেপকোর টিপাইমুখ প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবের গবেষণায় বাংলাদেশ কিভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। ভারতের ভাটি অঞ্চল উপেক্ষা করার এই প্রবণতা নিঃসন্দেহে নেতিবাচক। এখানে উল্লেখ্য যে ২০০৯ সালে সংসদীয় টিম ভারত সফরের সময়কালে যৌথ নদী কমিশনের ভারতের সাবেক সদস্য বি জি ভার্গিস বলেছিলেন যে, টিপাইমুখ বাঁধের কারনে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের হাওড় এলাকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে এই মর্মে বাঁধের বিরোধিতা করতে হলে বাংলাদেশকে তা পর্যাপ্ত গবেষণা করে তুলে ধরতে হবেবলতে দ্বিধা নেই পর্যাপ্ত গবেষণা করে একথা অবশ্যই প্রমান করা সম্ভব যে টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের কতটা ক্ষতি করবে। বারাক-সুরমা অববাহিকার বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এখানে রয়েছে বিশাল জলাভুমি ও অসংখ্য হাওড়, এর একটি নিজস্ব বাস্তুসংস্থান রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এখানে বর্ষার সময় পানি বাড়বে, বন্যা হবে ও শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকা শুকিয়ে যাবে, এর উপর ভিত্তি করেই সেখানকার বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠেছে। প্রাথমিক গবেষনার আলোকে (‘হাইড্রোলজিকাল ইম্প্যাক্ট স্টাডি অফ টিপাইমুখ ড্যাম প্রজেক্ট অফ ইন্ডিয়া অন বাংলাদেশ, ‘ইন্সটিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং’, ২০০৫) জানা যায় টিপাইমুখ বাঁধের কারনে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার জলাভূমি ও হাওড় আগের থেকে গড়ে যথাক্রমে ২৬% ও ১১% কমে যাবে, কুশিয়ারা নদী তীরে অবস্থিত কুশিয়ারা-বর্দাল হাওড় গড় বর্ষার সময় পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে এবং কাওয়ারদিঘী হাওড় এর ২৬% প্লাবন এলাকা হারাবে, বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিমি দীর্ঘায়িত অংশে বিপুল নদীক্ষয়ের ফলে ক্ষয়িত পলি বাংলাদেশে বাহিত হবে যা কিনা বরাক নদীর নিচের অংশে যেখানে থেকে তা সুরমা আর কুশিয়ারা এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে সেখানে জমা হবে যা কুশিয়ারা নদীর বেশ কিছু শাখানদীর মুখ বন্ধ করে দিতে পারে। এই সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকগুলোকে সিদ্ধ করতে বাংলাদেশের প্রয়োজন এই প্রকল্পের একটি পূর্নাংগ পরিবেশগত প্রভাব যাচাই নিরূপন। সেই পথে এগুনোর জন্য  ঠিক এই মূহুর্তে বাংলাদেশের যা করা উচিৎ তা পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করছিঃ

প্রথমতঃ সংসদীয় দলের ২০০৯ সালে ভারত সফরের মধ্য দিয়ে একটি আলোচনার সুত্রপাত হয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের ভারত সফরের সময় সেই আলোচনাকে কূটনৈতিক ও কারিগরী ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সুতরাং সরকারের এই মূহুর্তে উচিৎ টিপাইমুখ নিয়ে একটি সমন্বিত বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা। এই বিশেষজ্ঞ দলে যেসব অনুষদ থেকে লোক থাকবেন তা হলোঃ পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশল-ভূতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদ, বাস্তুতন্ত্রবিদ(উদ্ভিজ ও প্রাণিজ), জীববিশেষজ্ঞ, কৃষিবিদ, নৃবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদআইনবিদ। 

দ্বিতীয়তঃ গঠিত বিশেষজ্ঞ দল সরকারের কাছে রিপোর্ট প্রদান করবে যে টিপাইমুখ বাঁধ বা ফুলেরতল ব্যারেজের ফলে বাংলাদেশে কি কি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা গবেষণার জন্য তাদের কি পরিমান তথ্য প্রয়োজন ?

তৃতীয়তঃ সমন্বিত বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে দু'টি বিষয়ে প্রস্তাব পাঠাবেঃ
  • বাংলাদেশের গবেষণা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভারত টিপাইমুখ প্রকলের কোন কাজ শুরু করতে পারবেনা।
  • ভারত বাংলাদেশকে আমাদের বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শ অনুযায়ী জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উপাত্ত প্রদান করবে।
চতুর্থতঃ তৃতীয় ধাপ সফল হলে বিশেষজ্ঞ দল সকল উপাত্ত নিয়ে টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করবেএই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য থাকবেঃ

o   বাঁধের ও ব্যারেজের কারনে প্রবাহের কি পরিবর্তন হবে ?
o   এই প্রবাহ হ্রাস ও জলাধারে পলিহ্রাসের প্রভাবে বাঁধের ভাটিতে ব্যাপক নদীক্ষয়ের কি প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে ?
o   প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলের হাওড় গুলির বাস্তুতন্ত্রে কি পরিবর্তন আসব ?
o   এই এলাকার সাথে মানুষের জীবন ও জীবিকার উপর তার কি প্রভাব পড়বে ?

বস্তুত এই সবকিছু নিয়ে সমীক্ষার পরই জানা যাবে এই বাঁধ হলে বাংলাদেশের কি পরিমান ক্ষতি হবে।

পঞ্চমতঃ এই পর্যায়ে বাঁধের কারনে বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষতি ন্যুনতম পর্যায়ে আনা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে যৌথ গবেষণার প্রস্তাব আসতে পারে।

ষষ্ঠতঃ এই সব রিপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে বা ভারতে সরকার পর্যায়ে বৈঠক করতে হবে যেখানে বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ দল তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। যদি বাঁধের ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য এর ডিজাইনে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন সম্ভব থাকে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞদলের পরামর্শ অনুযায়ী যদি বাঁধের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয় যাতে করে এর ভাটিতে প্রভাব ন্যুনতম পর্যায়ে আসবে তাহলে সেই পরবর্তিত ডিজাইন নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল আরেক দফা গবেষণা করবে।

আর তা না হলে, অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ দল যদি মনে করে এই ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব নয় তাহলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার প্রস্তাব ভারতের কাছে উত্থাপন করতে হবে।

সপ্তমতঃ প্রকল্প বন্ধ করার বাংলাদেশের প্রস্তাব কুটনৈতিক ভাবে ভারত প্রত্যাখ্যান করলে জাতিসংঘের মাধ্যমে আইনগতভাবে কিভাবে আমরা প্রচেষ্টা চালাতে পারি তারো খসড়া প্রনয়ন করতে হবে। বিশেষজ্ঞ দলের আইনবিদেরা এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন।

অষ্টমতঃ ভারতের সাথে আইনগত ভাবে এই সমস্যা মোকাবেলা করার সময় দেশের রাজনীতিবিদ, সংবাদ মাধ্যম, সাধারণ জনগণকে দেশের প্রেক্ষাপটে এক থাকতে হবে। জাতিগত ভাবে আমাদের সমস্যা আমরা অনেক সময়ই না বুঝে বা ভবিষ্যৎ আঁচ না করে সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়ে থাকি যা কখনই দেশের জন্য ভাল কিছু বয়ে আনেনা।

পরিশেষে, একজন নাগরিক হিসেবে চাইব বাংলাদেশ সরকার যেন টিপাইমুখ প্রকল্পের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভারত সরকারের মৌখিক আশ্বাসে আশ্বস্ত না হয়ে বরং যৌথ গবেষণা বা নিদেনপক্ষে নিজেদের অর্থায়নে হলেও এই প্রকল্পের সম্ভাব্য পরিবেশগত প্রভাব যাচাই করে তার পরে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে।

জাহিদুল ইসলামঃ   পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টা, কানাডা
প্রাক্তন শিক্ষক, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, বুয়েট
zahidripon@gmail.com


 বিদ্রঃ লেখাটি ১৭ জানুয়ারী ২০১২ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে সম্পাদকীয় কলামে প্রকাশিত হয়েছে।