পানিসম্পদ কৌশলের একজন গবেষক হিসেবে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পে আমার ব্যক্তিগত অবস্থান ছিল কিছুটা এ রকম : প্রাথমিক গবেষণার আলোকে এটি প্রতীয়মান হয়, টিপাইমুখ বাঁধের কারণে সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলে পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, পানিসম্পদ এবং মরফোলজিগত প্রভাব পড়বে। এ সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকগুলোকে সিদ্ধ করতে বাংলাদেশের প্রয়োজন এ প্রকল্পের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবেশগত প্রভাব যাচাই নিরূপণ, যা যৌথ সমীক্ষা আকারে হওয়া উচিত। বস্তুত এ সমীক্ষার পরই জানা যাবে এই বাঁধ হলে বাংলাদেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হবে। পরবর্তী বিবেচনায় আসবে বাঁধের কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে আনা আদৌ সম্ভব হবে কিনা। যদি বাঁধের ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য এর ডিজাইনে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা সম্ভব হয়, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আর যদি এ ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব না হয় তাহলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার প্রস্তাব ভারতের কাছে উত্থাপন করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য প্রভাব নির্ণয়ে যৌথ সমীক্ষার জন্য দশ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের নাম ঘোষণা করেছে। নিঃসন্দেহে এটি ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত। তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, 'ভারত সরকারের আশ্বাসে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা' মানসিকতা থেকে 'যৌথ সমীক্ষার আলোকে সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেয়ার' এ কূটনৈতিক পটপরিবর্তনের পেছনে এ ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ মহলের পদচারণা, গণমানুষের আন্দোলন কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। সেই সঙ্গে সাম্প্রতিককালে পানিসম্পদবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সুপারিশ এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে হয়তো। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে এটি কেবলই সূচনা, এখন লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এ সমীক্ষা সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন হয় এবং তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত না হয়। সেই আলোকেই আজকের আলোচনা।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক চূড়ান্তকৃত ১০ সদস্যের প্রস্তাবিত দলে ইন্দো-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেনের নেতৃত্বে এ দলের সদস্যরা কেউ আছেন পদাধিকার বলে আর কেউ আছেন স্ব স্ব বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতার জন্য। দলটিকে সাজালে এ রকম দাঁড়ায় : আহ্বায়ক মীর সাজ্জাদ হোসেন (জেআরসি সদস্য), কূটনীতিক-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, অর্থনীতিবিদ মোঃ শাহজাহান (পরিচালক, ওয়ারপো), হাইড্রোলজিস্ট প্রধান প্রকৌশলী, পানি বিজ্ঞান (পানি উন্নয়ন বোর্ড), পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এমএ কাশেম (সাবেক পরিচালক, ওয়ারপো), মরফোলজিস্ট মমিনুল হক সরকার (সিইজিআইএস), হাইড্রোলিক মডেলিং বিশেষজ্ঞ মোঃ সোহেল মাসুদ (ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং), মৃত্তিকা ও কৃষি বিশেষজ্ঞ অনিল চন্দ্র আইচ, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ (বুয়েট) এবং মৎস্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দেওয়ান আলী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। তবে এ দলে প্রকৌশল-ভূতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিদ, বাস্তুতন্ত্রবিদ, নৃবিজ্ঞানী ও আইনবিদের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। হয়তো দলটিকে দশ সদস্যের মধ্যে রাখার সীমাবদ্ধতা এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। দলটিতে মোঃ সোহেল মাসুদের অন্তর্ভুক্তি আমার কাছে একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং ২০০৫ সালে টিপাইমুখ প্রকল্পের ওপর 'হাইড্রোলজিকাল ইম্প্যাক্ট স্টাডি অব টিপাইমুখ ড্যাম প্রজেক্ট অব ইন্ডিয়া অন বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণা বা কেস স্টাডি সম্পন্ন করে, যা কিনা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংঘটিত দুটি গবেষণার মধ্যে একটি। এ প্রকল্পের ফলে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার জলাভূমি এবং হাওর অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য পানিসম্পদগত ও বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয় এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদী সিস্টেমের মরফোলজিগত পরিবর্তনের সম্ভাবনা উঠে আসে। উল্লেখ্য, মোঃ সোহেল মাসুদ ওই রিপোর্টটির তিনজন প্রণেতাকারীর একজন।
কী প্রত্যাশা থাকবে যৌথ সমীক্ষা দলের কাছে : আসলে যে কোন বাঁধের প্রভাব নিরূপণ করার জন্য প্রয়োজন একটি সামগ্রিক বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত গবেষণা। টিপাইমুখের ক্ষেত্রে যেসব গবেষণা প্রয়োজন তা হল- প্রথমত, টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজের জন্য বারাক-সুরমা-মেঘনা অববাহিকার একটি পূর্ণাঙ্গ ভৌত মডেল স্টাডি, যা আসলে পুরো প্রকল্প ও এর প্রভাব পড়ে এমন এলাকার একটি ল্যাবরেটরি সংস্করণ। আমার জানা মতে, বাংলাদেশের কাপ্তাই বাঁধের জন্যও এ রকম একটি মডেল বানানো হয়েছিল। এটি ভারত ও বাংলাদেশ- দু'দেশের জন্যই প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, গাণিতিক হাইড্রোলজিকাল মডেল স্টাডি, যা মূলত পানির পরিমাণ নিয়ে কাজ করবে এবং সমগ্র বারাক-সুরমা-মেঘনা অববাহিকার জন্য এ মডেল সেটআপ করে টিপাইমুখ বাঁধ হলে এর অববাহিকায় পানির পরিমাণের কী প্রভাব পড়বে তা নির্ণয় করতে হবে। তৃতীয়ত, গাণিতিক হাইড্রোলিক মডেল, যা মূলত উজানে পানির প্রবাহকে হিসাবে নিয়ে ভাটিতে মডেলের শেষ সীমা পর্যন্ত পানির উচ্চতা ও গতিবেগ প্রদান করে এবং এই দুই মৌলিক উপাত্তকে ব্যবহার করে আরও প্রয়োজনীয় উপাত্ত বের করে; টিপাইমুখের ক্ষেত্রে উজানের ইনপুট হিসেবে টিপাইমুখ বাঁধের প্রবাহ চিত্র (ডিসচার্জ কার্ভ) অর্থাৎ ভারত বছরের কোনদিন কী পরিমাণ পানি ছাড়বে তার একটি হাইড্রোগ্রাফ ব্যবহার করতে হবে আর এর সীমা হবে ন্যূনতম চাঁদপুর পর্যন্ত; এটি দিয়ে ড্যাম ব্রেক স্টাডিও করা যাবে। চতুর্থত, গাণিতিক মরফোলজিকাল মডেল, যা গাণিতিক হাইড্রোলিক মডেল থেকে প্রাপ্ত পানির গতিবেগ ও উচ্চতার সাহায্যে নদীর বুক থেকে কী পরিমাণ পলি অপসারিত বা জমা হবে, তা বের করবে। পঞ্চমত, গাণিতিক হ্যাবিটেট মডেল, যা গাণিতিক হাইড্রোলিক মডেল থেকে প্রাপ্ত পানির গতিবেগ আর উচ্চতাকে ইনপুট হিসেবে নিয়ে টিপাইমুখ বাঁধের প্রভাবে পরিবর্তিত প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে এর ভাটির নদী ও সংলগ্ন হাওর এলাকার মাছের হ্যাবিটেটের পরিবর্তন দেবে। উল্লেখ্য, নদীতে একেক গভীরতায় একেক মাছ পাওয়া যায়, কারণ তারা ওই স্তরের গতিবেগের সঙ্গে অভিযোজিত। ষষ্ঠত, রিজিওনাল ক্লাইমেট মডেল, যা মূলত জিসিএম বা জেনারেল সার্কুলেশন মডেল থেকে উপাত্ত নিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ ও এর প্রভাব পড়ে এমন এলাকার জন্য ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বৃষ্টিপাত এবং অন্য প্রয়োজনীয় উপাত্তের পরিবর্তনের সিমুলেশন করবে।
আসলে যৌথ সমীক্ষার জন্য ঠিক কী পরিমাণ সময় পাওয়া যাবে, কী কী উপাত্ত দুই দেশ আদান-প্রদান করবে তার ওপর নির্ভর করবে উপরোক্ত পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে কী কী বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। তবে ন্যূনতম যা প্রত্যাশা থাকবে এ দলের প্রতি তা হচ্ছে- এক. বাঁধ ও ব্যারাজের কারণে প্রবাহের কী পরিবর্তন হবে; দুই. এই প্রবাহ ও জলাধারে পলি হ্রাসের প্রভাবে বাঁধের ভাটিতে ব্যাপক নদী ক্ষয়ের কী প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে; তিন. প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলের হাওরগুলোর বাস্তুতন্ত্রে কী পরিবর্তন আসবে; চার. এই এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর তার কী প্রভাব পড়বে। সেই সঙ্গে কিছু বিশেষ অবস্থা পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে- এক. বর্ষাকালে প্রবাহ হ্রাসের ফলে বন্যার প্রকোপ হ্রাস কতটা যুক্তিযুক্ত ও ইতিবাচক, অর্থাৎ বন্যা এলে কমবে কিনা। আর যদি ধরেই নেয়া যায়, বাঁধের ফলে সিলেট আর মৌলভীবাজার এলাকা বন্যামুক্ত হবে, সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন আসবে এ তথাকথিত বন্যামুক্ত হওয়া কতটা ইতিবাচক; দুই. শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ বৃদ্ধি কতটা ইতিবাচক আর কতটা নেতিবাচক; তিন. অতি শুষ্ক মৌসুমে কী হবে; চার. অতি বর্ষা মৌসুমে কী হবে; পাঁচ. ভূমিকম্পে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু; ছয়. অপ্রাকৃতিক পরিস্থিতি যেমন যান্ত্রিক কারণে বাঁধের টারবাইনগুলো অকার্যকর হয়ে যাওয়া বা গ্রিডের কোন সমস্যার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করার পরস্থিতিতে স্পিলওয়ে দিয়ে বিকল্প পথে পানি প্রবাহ ইত্যাদি বিশ্লেষণ; সাত. ফুলেরতল ব্যারাজ হলে কী হবে; আট. ব্যারাজ না হলেই কি টিপাইমুখ বাঁধ ইতিবাচক হবে; এবং নয়. জলাধার ভরাট সময়কালে কী কী নেতিবাক প্রভাব পড়বে।
শুরুতেই বাংলাদেশ সরকারের ভারত সরকারের কাছে দুটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া উচিত- এক. যৌথ সমীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভারত টিপাইমুখ প্রকল্পের সব কার্যক্রম স্থগিত করবে এবং দুই. ভারত বাংলাদেশকে আমাদের বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শ অনুযায়ী জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উপাত্ত প্রদান করবে। এখানে উল্লেখ্য, সাম্প্রতিককালে টিপাইমুখ প্রকল্পে সমতাভিত্তিক অংশীদার হওয়া এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ নেয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। বলতে দ্বিধা নেই, যৌথ সমীক্ষার আগে এ প্রসঙ্গে ন্যূনতম আলোচনা বা ভারতের এ আমন্ত্রণ মেনে নেয়ার মানে হচ্ছে টিপাইমুখ প্রকল্পের কারণে যে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে, সেটি অস্বীকার করা। আমাদের আগে প্রয়োজন এই প্রকল্পের যৌথ সমীক্ষা থেকে জেনে নেয়া বাংলাদেশের কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে। তারপর বাঁধের কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে আনা আদৌ সম্ভব হবে কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। যদি বাঁধের ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য এর ডিজাইনে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা সম্ভব হয়, তবে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে বাংলাদেশী বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শ অনুযায়ী যদি বাঁধের ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়, যাতে করে এর ভাটিতে প্রভাব ন্যূনতম পর্যায়ে আসবে, তাহলে সেই পরবর্তিত ডিজাইন নিয়ে বিশেষজ্ঞ দল আরেক দফা গবেষণা করবে। এর পরই শুধু সমতাভিত্তিক অংশীদার হওয়া এবং সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ নেয়ার প্রসঙ্গ আসতে পারে। আর তা না হলে অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ দল যদি মনে করে এ ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব নয় তাহলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার প্রস্তাব ভারতের কাছে উত্থাপন করতে হবে।
জাহিদুল ইসলাম :সাবেক শিক্ষক, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, বুয়েট, বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, কানাডা
zahidripon@gmail.com
বিদ্রঃ লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে ৯ ফেব্রুয়ারী ( বাংলাদেশ সময়ে) প্রকাশিত হয়েছে। মূল লেখাটি বিজয়ে বলে এর ইউনিকোড সংস্করণ হিসেবে আমার ব্যাক্তিগত ব্লগে সংরক্ষণ করলাম।