এবারের বিশ্ব পানি দিবসের স্লোগান
হচ্ছে ‘খাদ্যের নিশ্চয়তা ও পানি’। ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতি বছর স্বাদু পানির
উপর এক একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ২২ শে মার্চ আন্তর্জাতিক পানি দিবস
হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। খাদ্যের নিশ্চয়তার সাথে পানি যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত
সেই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সবার সামনে নিয়ে আসাই এবারের বিশ্ব
পানি দিবসের উদ্দেশ্য।সুস্থ জীবনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুষম খাদ্যের নিশ্চয়তা
এবং সেটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের উর্দ্ধে থেকে বিশ্বের সকল মানুষের
কাছে সব সময়ের জন্য। আর খাদ্যের উৎপাদনের একটি প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে
পানি। প্রতিদিন আমরা নিজেদের খাদ্য হিসেবে ভাত বা রুটি, পাউরুটি, মাংস, ডিম
ইত্যাদি গ্রহন করি; পানীয় হিসেবে কাপের পর কাপ চা বা কফি পান করি। কিন্তু
আমরা কি জানি এই সব কিছুর জন্যই পানির প্রয়োজন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে,
যাকে ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট (Water Footprint) বা জলপদাঙ্ক দিয়ে প্রকাশ করা
যেতে পারে। বিশ্ব পানি দিবসকে সামনে রেখে আমার আজকের আলোচনা এই জলপদাঙ্ক
নিয়ে। পুরো নিবন্ধটি কয়েকটি অংশে বিভক্তঃ প্রথমে থাকবে জলপদাঙ্কের মৌলিক
জ্ঞান, বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যের জলপদাঙ্কের তুলনামূলক চিত্র এবং জাতীয়
প্রেক্ষাপটে (বাংলাদেশ) জলপদাঙ্কের চিত্র। পরবর্তীতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ও
নদী অববাহিকার প্রেক্ষাপটে জলপদাঙ্কের চিত্র ও গুরুত্ত্ব আলোচনা করা হবে।
ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট (Water Footprint) বা জলপদাঙ্ক
একটি পণ্যের ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট (Water Footprint) বা জলপদাঙ্ক হচ্ছে ঐ
পণ্যটির একক পরিমান উৎপাদনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে পরিমান পানি লাগে
তার পরিমান [৪]। ধরা যাক এক কেজি ধান উৎপাদনে যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে
১৬৭০ লিটার পানি লাগে তাহলে ধানের জলপদাঙ্ক হচ্ছে ১৬৭০। বিষয়টা একটু বিশদ
ব্যাখ্যা করছি। একটি পণ্যের জলপদাঙ্ক মূলত তিনটি উৎস থেকে নির্নয় করা হয়ঃ
সবুজ পানি (Green Water), নীল পানি (Blue Water) ও ধুসর পানি (Grey Water)।
ধান উৎপাদনের সময়কালে তা বৃষ্টির পানি গ্রহণ করে, যাকে বলা যেতে পারে সবুজ
পানি; উৎপাদনের পর্যায়ে এটি সেচ হিসেবে বা প্রাকৃতিক ভাবে সরাসরি ভূপরিস্থ
বা ভূগর্ভস্থ পানি গ্রহণ করে, যাকে বলা যেতে পারে নীল পানি; আর ধুসর পানি
হচ্ছে উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে পানিদূষন জড়িত সেই দূষিত পানির
অভ্যন্তরস্থ দুষণকে স্বাভাবিক মাত্রায় আনতে যে পরিমান পানির প্রয়োজন সেই
পরিমানকে[৪]। উপরে উল্লেখিত ধানের জলপদাঙ্ক মূলত এই তিনটি উৎস থেকে পাওয়া
পানির পরিমান যা মোটা দাগেঃ সবুজ পানি-১১১৩ লিটার, নীল পানি-৩৭১ লিটার আর
ধুসর পানি- ১৮৬ লিটার। খাবার হিসেবে আমরা ধান খাইনা, খাই ভাত। ১ কেজি ধান
থেকে গড়ে ০.৬৭ কেজি ভাত হয় যা হিসেবে আনলে ভাতের জলপদাঙ্ক দাঁড়ায় প্রায়
২৫০০ লিটার।
কিন্তু এতো গেলো প্রাথমিক পণ্যের ক্ষেত্রে, এবারে একটি জটিলে যাই।
কারখানায় উদ্ভুত পণ্যের ক্ষেত্রে আদতে তার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাচামাল
হিসেবে উৎপাদিত পণ্যের জলপদাঙ্ক বিবেচনায় আনতে হয়।ধরা যাক আমরা একটি চকলেটে
বারের জলপদাঙ্ক বের করব। ব্যাখ্যার প্রয়োজনে আমরা ধরে নিচ্ছি চকলেটে ৪০
শতাংশ থাকে কোকা পেষ্ট, ২০ শতাংশ থাকে কোকা বাটার আর ৪০ শতাংশ থাকে চিনি।
এখন মাঠে উৎপাদিত কোকা বীজের জলপদাঙ্ক ধরা যাক ২০০০০ লিটার/কেজি। ১ কেজি
কোকা বীজ থেকে ৮০০ গ্রাম কোকা পেষ্ট হলে কোকা পেষ্টের জলপদাঙ্ক দাঁড়ায়
২৪০০০ লিটার/কেজি। কোকা পেষ্ট থেকে দুটি পণ্য উৎপাদিত হয়ঃ কোকা বাটার আর
কোকা গুড়া। কোকা পেষ্টের জলপদাঙ্ক কোকা বাটার আর কোকা গুড়ার মধ্যে ২:১
অনুপাতে বন্টন করে দেয়া হলে, আর ১ কেজি কোকা পেষ্ট থেকে যদি ০.৪৭ কেজি কোকা
বাটার হয়, তাহলে কোকা বাটারের জলপদাঙ্ক হয় প্রায় ৩৪০০০০ লিটার/কেজি। চিনির
জলপদাঙ্ক হচ্ছে ১৮০০ লিটার/ কেজি। এখন সহজ ঐকিক নিয়ম কষলে চকলেটের
জলপদাঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ১৭০০০ লিটার/কেজি। তাহলে ১০০ গ্রামের একটি চকলেট বারের
জলপদাঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ১৭০০ লিটার [২]।
খাদ্যদ্রব্যের জলপদাঙ্ক
এবারে কিছু খাদ্যদ্রব্যের জলপদাঙ্ক দেখা যাক।চিত্র-১ এ বিশ্বের
গুরুত্ত্বপূর্ন কয়েকটি খাদ্যশস্য উৎপাদনে পাউন্ডপ্রতি কি পরিমান পানি
প্রয়োজন তার একটি তুলনা দেয়া হয়েছে [১,২]। বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রধান
খাদ্যশস্য হচ্ছে ধান ও গম। দেখা যাচ্ছে প্রতি পাউন্ড ধান উৎপাদনে প্রয়োজন
১৭০০ লিটার পানি অন্যদিকে প্রতি পাউন্ড গম উৎপাদনে প্রয়োজন ৫০০ লিটার।
এবারে লক্ষ্য করা যাক প্রাণীজ আমিষ জাতীয় খাবারের দিকে। দেখা যাচ্ছে
(চিত্র-২) সর্বাধিক পরিমান পানির প্রয়োজন গরুর মাংস উৎপাদনে[১,২]। এক
পাউন্ড গরুর মাংস উৎপাদনে যতটুকু পানির প্রয়োজন তা দিয়ে ১৪ পাউন্ড খাসির
মাংস আর প্রায় ৪ পাউন্ড মুরগীর মাংস উৎপাদন সম্ভব। গবাদি পশু থেকে উৎপাদিত
পণ্যের জলপদাঙ্ক আবাদকৃত ফসলের থেকে বেশি কারন গবাদি পশু প্রচুর কৃষিজ
পন্য, পানি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, আর এদের প্রতিপালনেও প্রচুর পানি
প্রয়োজন।
এবারে আসি পানীয়র ক্ষেত্রে। নিচের চিত্র-৩ এ সারাবিশ্বে জনপ্রিয় কিছু
পানীয় এবং তা উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির পরিমান দেখানো হয়েছে [১,২]। এক লিটার
দুধ, ওয়াইন ও বিয়ার উৎপাদনে প্রায় কাছাকাছি পরিমান পানি প্রয়োজন। তবে মজার
বিষয় হচ্ছে এক লিটার কফি উৎপাদনে যতটুকু পানি প্রয়োজন তা দিয়ে প্রায় ৭
লিটার চা উৎপাদন সম্ভব।
চিত্র-৪ এ কয়েকটি ফলের জলপদাঙ্কের একটি তুলনা করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে আম
উৎপাদনে যে পরিমান পানির প্রয়োজন তা একটি কলা উৎপাদনের দ্বিগুনেরও
বেশি[১,২]।
এছাড়া আরো গুরুত্বপূর্ন কিছু খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির
পরিমান হচ্ছেঃ একটি ডিম-২০০ লিটার, এক পাউন্ড পনির-২২৭৩ লিটার, এক পাউন্ড
চকলেট-১২০০০ লিটার, এক স্লাইস পাউরুটি-৪০ লিটার, এক পাউন্ড চিনি ৭৫০-লিটার,
একটি বার্গার-২৫০০ লিটার ইত্যাদি[১,২]।
জাতীয় প্রেক্ষাপটে জলপদাঙ্ক
এবারে জাতীয় প্রেক্ষাপটে জলপদাঙ্ক ব্যাখ্যা করা যাক। একটি দেশের জনগণ যে
পরিমান কৃষিজ ও শিল্পজ পণ্য ব্যবহার করে তাদের উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয়
পানি ও গৃহস্থালীর কাজে প্রয়োজনীয় পানি এই দুইয়ের সামষ্টিক জলপদাঙ্ককে বলা
হয় ঐ দেশের আভ্যন্তরীন ভোগের জলপদাঙ্ক। এখন একটি দেশে যে পরিমান কৃষিজ ও
শিল্পজ পণ্য উৎপাদিত হয় তার একটি অংশ আবার রপ্তানী করা হয়। রপ্তানীকৃত
পণ্যের জলপদাঙ্কের সাথে ঐ আভ্যন্তরীন ভোগের জলপদাঙ্ককে যদি একত্রিত করা হত
সেটিই হচ্ছে একটি দেশের উৎপাদনের জলপদাঙ্ক। আবার একটি দেশ অন্য দেশ থেকেও
কৃষিজ ও শিল্পজ পণ্য আমদানী করে থাকে। এই আমদানীকৃত পণ্যের জলপদাঙ্কের সাথে
যদি আভ্যন্তরীন ভোগের জলপদাঙ্ককে যদি একত্রিত করা হত সেটিই হচ্ছে ঐ দেশের
মোট জাতীয় ভোগের জলপদাঙ্ক। এবারে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই দুই ধরনের
জলপদাঙ্কের একটি চিত্র দেখা যাক [৩]।
উপরের চিত্রে (চিত্র-৫) বাংলাদেশের তিনটি ক্ষেত্রে উৎপাদন ও ভোগের
জলপদাঙ্কের একটি আনুপাতিক রূপ দেখানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে কৃষিজ
জলপদাঙ্ক বলতে বলতে চাষাবাদ, গবাদি পশু চারণ ও পালন এই সবকটি ক্ষেত্রে
প্রয়োজনীয় পানির সমষ্টিকে বোঝানো হয়েছে। উপরের দুইটি পাই-লেখ দেখে আমরা
অনুধাবন করতে পারি বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যে বা ভোগকৃত পণ্যের মধ্যে পানির
চাহিদার ক্ষেত্রে সিংহভাগ(৯৫%-৯৬%) জুড়ে রয়েছেই কৃষিজ পণ্য, যা পরোক্ষ ভাবে
খাদ্য উৎপাদন বা ভোগের সাথে পানির নিবিড় সম্পর্ক আমাদের সামনে উপস্থাপন
করে।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জলপদাঙ্ক
এবারে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা যাক। কৃষিজ, শিল্পজ ও গৃহস্থালী
এই তিনটি ক্ষেত্রে বিশ্বের সব দেশের জলপদাঙ্কের সমষ্টিই ঐ স্ব স্ব ক্ষেত্রে
বৈশ্বিক জলপদাঙ্কের সংখ্যা নির্দেশ করে। নিচের চিত্রে এই তিনটি ক্ষেত্রে
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উৎপাদন ও ভোগের জলপদাঙ্কের একটি আনুপাতিক রূপ দেখানো
হয়েছে[৩]। নিচের দুইটি পাই-লেখ দেখে আমরা অনুধাবন করতে পারি পৃথিবীতে
উৎপাদিত পণ্যে বা ভোগকৃত পণ্যের মধ্যে পানির চাহিদার ক্ষেত্রে সিংহভাগ
(৯১%-৯২%) জুড়ে রয়েছেই কৃষিজ পণ্য। অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন বা ভোগের সাথে
পানির চাহিদার যে নিবিড় সম্পর্কে রয়েছে সেটির সরূপ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও
প্রায় একই রকম।
আমরা যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকাই সেক্ষেত্রেও দেখা যায় একটি
দেশের সর্বাধিক পানির চাহিদা কৃষি ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক উপাত্তের আলোকে[৩]
বিশ্বে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রতিবছর প্রয়োজনীয় পানির পরিমান ৬৩৯০ গিগা
ঘনমিটার। এই বিপুল পরিমান পানির ২১ শতাংশই প্রয়োজন ধান উৎপাদনে, যার পরেই
রয়েছে গম (১২%) এর অবস্থান।
এবারে বিশ্বের প্রধান ১৪ টি কৃষিজ পণ্যের বৈশ্বিক গড় জলপদাঙ্ক দেখা যাক
(চিত্র-৭)।লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কৃষিজ পণ্যের মধ্যে রাবার বা মাদকদ্রব্যের
গড় জলপদাঙ্ক অধিক হলেও তাদের উৎপাদন খাদ্যশস্যের তুলনায় অনেক কম বলে
প্রয়োজনীয় পানির পরিমান কম। অন্যদিকে খাদ্যশস্যের তুলনায় শাকসবজি, মূল ও
কান্ড জাতীয় ফসল ও ফলের জলপদাঙ্ক তুলনামূলক ভাবে কম।
বিশ্বে দেশ ভিত্তিক পানির ব্যবহার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় [৩], চীনের
জলপদাঙ্ক সর্বাধিক যা বিশ্বের মোট জলপদাঙ্কের শতকরা ১৬ ভাগ। এর পরেই রয়েছে
ভারত (১৩%), যুক্তরাষ্ট্র(১০%) ও ব্রাজিল (৪%)। যেসব দেশ পানির জন্য বাইরের
দেশের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ যে সব দেশের জন্য আমদানীকৃত পন্যের জলপদাঙ্ক
উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে বেশি তাদের মধ্যে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো
(কুয়েত, জর্ডান, ইসরাইল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, ইত্যাদি)।
নদী অববাহিকার প্রেক্ষাপটে জলপদাঙ্ক
একটি নদী অববাহিকা কোন রাজনৈতিক সীমারেখা মেনে চলেনা বরং সে প্রাকৃতিক
ভাবেই সৃষ্ট তার নিজস্ব গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে। তাই অববাহিকা ভিত্তিক
পানি ব্যবস্থাপনার প্রসংগে আসলেই গুরুত্ত্বপূর্ন নদী অববাহিকা সমুহের
জলপদাঙ্ক, পানির উৎস এবং পানির প্রাপ্যতা এই বিষয়সমুহ সামনে চলে আসে। একটি
দেশের ক্ষেত্রে যেমন ভোগের জলপদাঙ্ক নির্নয় করা যায় ঠিক তেমনি একটি নদী
অববাহিকায় মোট পানির ব্যবহার থেকে সেই অববাহিকার জলপদাঙ্ক বের করা যায়।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় গুরুত্ত্বপূর্ন তা হচ্ছে, জলপদাঙ্কের যে অংশ ভূপরিস্থ
বা ভূগর্ভস্থ পানি থেকে আসে তা হচ্ছে নীল পানি বা ‘ব্লু ওয়াটার’ আর তাই যখন
অববাহিকার জলপদাঙ্ক আলোচনায় আসবে সেটা মূলত এই নীল জলপদাঙ্ক নিয়ে
আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
এই নিবন্ধে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ন দুটি নদী অববাহিকার জলপদাঙ্ক এবং
তার গুরুত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে। প্রথমেই আসা যাক গঙ্গা অববাহিকার
প্রসংগে। নিচের চিত্রে (চিত্র-৮) গঙ্গা অববাহিকার মাসভিত্তিক প্রাকৃতিক
প্রবাহ, পানির প্রাপ্যতা এবং পানির ব্যবহার বা নীল জলপদাঙ্ক দেখানো হয়েছে
[৫]। নীল শেড দেয়া অংশটি আদতে এই অববাহিকায় বছরের বিভিন্ন মাসে গড়ে কি
পরিমান পানি প্রবাহ (Natural Runoff) আসে সেটা নির্দেশ করে। এই পানির
সবটুকুই মানুষের ব্যবহারে কাজে লাগানো যাবেনা সেক্ষেত্রে নদীর
বাস্তুসংস্থান বিঘ্নিত হবে। মূলত লাল লাইন দিয়ে আবদ্ধ সবুজ রঙের অংশটি এই
অববাহিকায় পানির প্রাপ্যতা( Available Water) নির্দেশ করে। এই অববাহিকায়
বছরের বিভিন্ন সময়ে কতটুকু পানির চাহিদা যা কিনা মূলত নীল জলপদাঙ্ক (Blue
Water) সেটি কালো লাইন দিয়ে বোঝানো হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে শুষ্ক
মৌসুমে গঙ্গা অববাহিকায় পানির প্রাপ্যতার চেয়ে পানির চাহিদা বেশি যা কিনা
আদতে এই অববাহিকার ঐ সময়ে পানির অভাব বা আকাল নির্দেশ করে।
এবারে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। নিচের চিত্রে
(চিত্র-৯) ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মাসভিত্তিক প্রাকৃতিক প্রবাহ, পানির
প্রাপ্যতা এবং পানির ব্যবহার বা নীল জলপদাঙ্ক দেখানো হয়েছে[৫]।
গঙ্গা অববাহিকার সাথে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়
পানির আদতে কোন অভাব বা আকাল আপাতত নেই। অন্যভাবে চিন্তা করলে ব্রহ্মপুত্র
অববাহিকায় পানির চাহিদা বা নীল জলপদাঙ্ক গঙ্গা অববাহিকার চাইতে অনেক কম।
নিচের তুলনামূলক চিত্রটি (চিত্র-১০) এক্ষেত্রে আরো পরিষ্কার ভাবে এই বিষয়টি
আমাদের সামনে নিয়ে আসে[৫]।
পরিশেষে
বিভিন্ন পন্যের উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির পরিমান আর সেই সাথে জাতীয়,
বৈশ্বিক ও অববাহিকার প্রেক্ষাপটে জলপদাঙ্কের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল
খাদ্য উৎপাদনের সাথে পানির যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে সেটা তথ্য উপাত্ত আর
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আরো একবার চেখিয়ে দেয়া।গত শতাব্দীর মাঝভাগে
পৃথিবীতে একাধারে খাদ্যের উৎপাদন দিগুন হয়েছে আর সেই সাথে উন্নয়নশীল
দেশগুলোতে জনপ্রতি খাদ্যগ্রহনের হার ৩০ ভাগ বেড়েছে। এই বর্ধিত চাষাবাদের
জন্য বিশ্বে পানির চাহিদা যে বিপুল হারে বেড়েছে সেটা তাই সহজেই
প্রনিধানযোগ্য। একটি পরিসংখ্যান এক্ষেত্রে গুরুত্ত্বপূর্ন আর তা হচ্ছে
বিশ্বের স্বাদু পানির ব্যবহারের শতকরা ৭০ ভাগই হচ্ছে সেচের জন্য। সুতরাং
ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে তার জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা
বৃদ্ধি পাবে। পক্ষান্তরে দিনে দিনে বিশ্বে বিশুদ্ধ স্বাদু পানির যোগান
কমছে। চাহিদা আর যোগানের এই চিরায়ত দ্বৈরথ আগামী দিনগুলোতে কতটা প্রকট হবে
সেটাই এখন প্রশ্ন আর এই দ্বৈরথকে সীমার মধ্যে রাখতে আমাদের নীতিনির্ধারকরা
কতটা সচেষ্ট হয় সেটাই দেখার বিষয়।
তথ্যসুত্র
[৩] Mekonnen, M.M. and Hoekstra, A.Y. (2011). ‘National Water
Footprint Accounts: The Green, Blue and Grey Water Footprint of
Production and Consumption’. Volume 1 & 2, Value of Water Research
Report Series No. 50.
[৪] Mekonnen, M.M. and Hoekstra, A.Y. (2011).’The green, blue and
grey water footprint of crops and derived crop products’. Hydrological
Earth Syst. Sci., 15, 1577–1600.
[৫]Hoekstra, A.Y. and Mekonnen, M.M. (2011) Global water scarcity:
monthly blue water footprint compared to blue water availability for the
world’s major river basins, Value of Water Research Report Series No.
53, UNESCO-IHE, Delft, the Netherlands.