'পানি ও খাদ্যের নিশ্চয়তা', এ স্লোগানকে সামনে রেখে এ বছরের ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। মূলত খাদ্যের নিশ্চয়তার সঙ্গে পানি যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সবার সামনে নিয়ে আসাই এবারের বিশ্ব পানি দিবসের উদ্দেশ্য। ১৯৯২ সালে রিওডি জেনেরিওতে জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক অধিবেশনে একটি বিশেষ দিনকে স্বাদু পানি দিবস হিসেবে পালন করার সুপারিশ করা হয়। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চকে প্রথম আন্তর্জাতিক পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর স্বাদু পানির ওপর একেকটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক পানি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সুস্থ জীবনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুষম খাদ্যের নিশ্চয়তা এবং সেটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে থেকে বিশ্বের সব মানুষের কাছে সব সময়ের জন্য। আর খাদ্য উৎপাদনের একটি প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে পানি। প্রতিদিন আমরা খাদ্য হিসেবে ভাত বা রুটি, পাউরুটি, মাংস, ডিম ইত্যাদি গ্রহণ করি; পানীয় হিসেবে কাপের পর কাপ চা বা কফি পান করি। কিন্তু আমরা কি জানি, এসব কিছুর জন্যই পানির প্রয়োজন, কম কিংবা বেশি, যাকে ওয়াটার ফুটপ্রিন্ট বা জলপদাঙ্ক দিয়ে প্রকাশ করা যেতে পারে।
একটি পণ্যের জলপদাঙ্ক হচ্ছে ওই পণ্যটির একক পরিমাণ, উৎপাদনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে পরিমাণ পানি লাগে তার পরিমাণ। ধরা যাক, এক কেজি ধান উৎপাদনে যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১৬৭০ লিটার পানি লাগে তাহলে ধানের জলপদাঙ্ক হচ্ছে ১৬৭০। খাবার হিসেবে আমরা ধান খাইনা, খাই ভাত। ১ কেজি ধান থেকে গড়ে ০.৬৭ কেজি ভাত হয়, যা হিসাবে আনলে ভাতের জলপদাঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ২৫০০। কারখানায় উদ্ভূত পণ্যের ক্ষেত্রে আদতে তার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল হিসেবে উৎপাদিত পণ্যের জলপদাঙ্ক বিবেচনায় আনতে হয়। ধরা যাক, আমরা একটি চকলেট বারের জলপদাঙ্ক বের করব। ব্যাখ্যার প্রয়োজনে আমরা ধরে নিচ্ছি চকলেটে ৪০ শতাংশ থাকে কোকা পেস্ট, ২০ শতাংশ থাকে কোকা বাটার আর ৪০ শতাংশ থাকে চিনি। কোকা পেস্ট, কোকা বাটার ও চিনির জলপদাঙ্ক যথাক্রমে ২৪০০০ লিটার/কেজি, ৩৪০০০০ লিটার/কেজি ও ১৮০০ লিটার/কেজি হলে চকলেটের জলপদাঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ১৭০০০ লিটার/কেজি। তাহলে ১০০ গ্রামের একটি চকলেট বারের জলপদাঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ১৭০০ লিটার।
এবার কিছু খাদ্যদ্রব্যের জলপদাঙ্ক দেখা যাক। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাদ্যশস্য উৎপাদনে পাউন্ডপ্রতি প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ হচ্ছে- বার্লি-৭৫০ লিটার, গম-৫০০ লিটার, মিলেট-২৫০০ লিটার, ধান-১৭০০ লিটার, আলু-৪৫০ লিটার, ভুট্টা-৪০৯ লিটার, সয়াবিন-৮১৬ লিটার। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হচ্ছে ধান ও গম। দেখা যাচ্ছে প্রতি পাউন্ড ধান উৎপাদনে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন তা দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন পাউন্ড গম উৎপাদন সম্ভব। প্রাণিজ আমিষ জাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে সর্বাধিক পরিমাণ পানির প্রয়োজন গরুর মাংস উৎপাদনে। এক পাউন্ড গরুর মাংস উৎপাদনে যতটুকু পানির প্রয়োজন (৬৮০০ লিটার), তা দিয়ে ১৪ পাউন্ড খাসির মাংস আর প্রায় ৪ পাউন্ড মুরগির মাংস উৎপাদন সম্ভব। গবাদি পশু থেকে উৎপাদিত পণ্যের জলপদাঙ্ক আবাদকৃত ফসলের থেকে বেশি। কারণ গবাদি পশু প্রচুর কৃষিজ পণ্য, পানি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে আর এদের প্রতিপালনেও প্রচুর পানি প্রয়োজন।
এবার আসি পানীয়র ক্ষেত্রে। সারাবিশ্বে জনপ্রিয় কিছু পানীয় এবং তা উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এক লিটার দুধ, ওয়াইন ও বিয়ার উৎপাদনে প্রায় কাছাকাছি পরিমাণ পানি প্রয়োজন (৯০০-১১০০ লিটার)। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, এক লিটার কফি উৎপাদনে যতটুকু পানি প্রয়োজন (৯০০ লিটার), তা দিয়ে প্রায় ৭ লিটার চা উৎপাদন সম্ভব। ফলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ১টি আম উৎপাদনে যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন, তা একটি কলা উৎপাদনের দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ হচ্ছে- একটি ডিম-২০০ লিটার, এক পাউন্ড পনির-২২৭৩ লিটার, এক পাউন্ড চকলেট-১২০০০ লিটার, এক স্লাইস পাউরুটি-৪০ লিটার, এক পাউন্ড চিনি ৭৫০-লিটার, একটি বার্গার-২৫০০ লিটার ইত্যাদি।
এবার জাতীয় প্রেক্ষাপটে জলপদাঙ্ক ব্যাখ্যা করা যাক। একটি দেশের জনগণ যে পরিমাণ কৃষিজ ও শিল্পজ পণ্য ব্যবহার করে তাদের উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও গৃহস্থালির কাজে প্রয়োজনীয় পানি- এ দুইয়ের সামষ্টিক জলপদাঙ্ককে বলা হয় ওই দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগের জলপদাঙ্ক। একটি দেশে যে পরিমাণ কৃষিজ ও শিল্পজ পণ্য উৎপাদিত হয় তার একটি অংশ আবার রফতানি করা হয়। রফতানিকৃত পণ্যের জলপদাঙ্কের সঙ্গে ওই অভ্যন্তরীণ ভোগের জলপদাঙ্ককে যদি একত্রিত করা হতো, সেটিই হচ্ছে একটি দেশের উৎপাদনের জলপদাঙ্ক। আবার একটি দেশ অন্য দেশ থেকেও কৃষিজ ও শিল্পজ পণ্য আমদানি করে থাকে। এ আমদানিকৃত পণ্যের জলপদাঙ্কের সঙ্গে যদি অভ্যন্তরীণ ভোগের জলপদাঙ্ককে একত্রিত করা হতো, সেটিই হচ্ছে ওই দেশের মোট জাতীয় ভোগের জলপদাঙ্ক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ উৎপাদন ও ভোগের জলপদাঙ্কের মান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য বা ভোগকৃত পণ্যের মধ্যে পানির চাহিদার ক্ষেত্রে সিংহভাগজুড়ে (৯৫%-৯৬%) রয়েছে কৃষিজ পণ্য, যা পরোক্ষভাবে খাদ্য উৎপাদন বা ভোগের সঙ্গে পানির নিবিড় সম্পর্ক আমাদের সামনে উপস্থাপন করে।
এবার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা যাক। কৃষিজ, শিল্পজ ও গৃহস্থালি- এ তিনটি ক্ষেত্রে বিশ্বের সব দেশের জলপদাঙ্কের সমষ্টিই ওই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বৈশ্বিক জলপদাঙ্কের সংখ্যা নির্দেশ করে। সমগ্র বিশ্বের প্রেক্ষাপটে উৎপাদন ও ভোগের জলপদাঙ্ক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পৃথিবীতে উৎপাদিত বা ভোগকৃত পণ্যের মধ্যে পানির চাহিদার ক্ষেত্রে সিংহভাগজুড়ে (৯১%-৯২%) রয়েছে কৃষিজ পণ্য। অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন বা ভোগের সঙ্গে পানির চাহিদার যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, সেটির স্বরূপ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও প্রায় একই রকম। বিশ্বের প্রধান ১৪টি কৃষিজ পণ্যের টনপ্রতি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ (ঘনমিটার) হচ্ছে- চিনি-১৯৭, পশুখাদ্য-২৫৩, শাকসবজি-৩২২, মূল ও কাণ্ডজাতীয় ফসল-৩৮৭, ফল-৯৬৭, খাদ্যশস্য-১৬৪৪, তেলবীজ-২৩৬৪, তামাক-২৯২৫, আঁশ বা তন্তুজাতীয় ফসল-৩৮৩৭, ডাল-৪০৫৫, ছোলা-৭০৪৮, বাদাম-৯০৬৩, রাবার-১৩৭৪৮ ও মাদকদ্রব্য-১৪৪৪৩। আমরা যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকাই, সেক্ষেত্রেও দেখা যায় একটি দেশের সর্বাধিক পানির চাহিদা কৃষি ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক উপাত্তের আলোকে বিশ্বে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রতিবছর প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ ৬৩৯০ গিগা ঘনমিটার। এই বিপুল পরিমাণ পানির ২১ শতাংশই প্রয়োজন ধান উৎপাদনে, যার পরেই রয়েছে গমের (১২%) অবস্থান। বিশ্বে দেশভিত্তিক পানির ব্যবহার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চীনের জলপদাঙ্ক সর্বাধিক, যা বিশ্বের মোট জলপদাঙ্কের শতকরা ১৬ ভাগ। এর পরেই রয়েছে ভারত (১৩%), যুক্তরাষ্ট্র (১০%) ও ব্রাজিল (৪%)। যেসব দেশ পানির জন্য বাইরের দেশের ওপর নির্ভরশীল অর্থাৎ যেসব দেশের জন্য আমদানিকৃত পণ্যের জলপদাঙ্ক উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে এগিয়ে আছে কুয়েত, জর্ডান, ইসরাইল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন।
ওপরের আলোচনায় একথা প্রতীয়মান হয় যে খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে পানির সম্পর্ক নিবিড়। গত শতাব্দীর মাঝভাগে পৃথিবীতে একাধারে খাদ্যের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে, সেই সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনপ্রতি খাদ্য গ্রহণের হার ৩০ ভাগ বেড়েছে। এ বর্ধিত চাষাবাদের জন্য বিশ্বে পানির চাহিদা যে বিপুল হারে বেড়েছে, সেটা সহজেই প্রণিধানযোগ্য। একটি পরিসংখ্যান এক্ষেত্রে গুরুত্ত্বপূর্ণ; আর তা হচ্ছে বিশ্বের স্বাদু পানির ব্যবহারের শতকরা ৭০ ভাগই হচ্ছে সেচের জন্য। সুতরাং ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর জন্য প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। পক্ষান্তরে দিন দিন বিশ্বে বিশুদ্ধ স্বাদু পানির জোগান কমছে। চাহিদা আর জোগানের এই চিরায়ত দ্বৈরথ আগামী দিনগুলোতে কতটা প্রকট হবে সেটাই এখন প্রশ্ন। আর এ দ্বৈরথকে সীমার মধ্যে রাখতে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কতটা সচেষ্ট হয় সেটাই দেখার বিষয়।
জাহিদুল ইসলাম : সাবেক শিক্ষক, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, বুয়েট; বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, কানাডা
zahidripon@gmail.com
বিদ্রঃ লেখাটি দৈনিক যুগান্তরে ২২ মার্চ ( বাংলাদেশ সময়ে) প্রকাশিত হয়েছে। মূল লেখাটি বিজয়ে বলে এর ইউনিকোড সংস্করণ হিসেবে আমার ব্যাক্তিগত ব্লগে সংরক্ষণ করলাম।