মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০১০

হরিণ চিতা চিল

মমতাজউদ্দীন আহমদের লেখা নাটকগুলির একটি বিশেষত্ত্ব হচ্ছে নাটকের চরিত্রগুলোর নামগুলির ভীরে কঠিন একটি বা দু'টি চরিত্রের নাম চোখে পড়া। উদাহরণ সরূপ বলা যেতে পারে তার লেখা নাটক 'হরিণ চিতা চিল' এর কথা। হাকিম, হাক্কানী, ভুইঁঞা দের ভীরে হঠাৎ করে 'সবুক্তিগীণ' নামটি পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগায় বৈকি। এমন নয় যে এই চরিত্রটি কোন অভিজাত শ্রেনীর মানুষকে নির্দেশ করে, এটি সাধারণ গ্রামের একজন মাঝবয়সী শিক্ষিকার সন্তান। ক্ষুধার জ্বালায় অন্নের খোঁজে যে মাকে নিয়ে ঢাকা শহরে এসেছে। একটু গভীরে গেলে বোঝা যায় সবুক্তিগীণ আসলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চরিত্রকে ধারণ করছে সেজন্যই এই নামটি এত কঠিন, যেন নাটকটি যে একবার পড়বে তার মনে গেঁথে যাবে নামটি।


পটভূমিঃ
মমতাজউদ্দীনের নাট্য সংকলন থেকে জানা যায় 'হরিণ চিতা চিল' এর রচনাকাল ১৯৭৩ অর্থাৎ এটি ১৯৭৪ এর দূর্ভিক্ষের ঠিক আগে রচিত। এটি মূলত একটি  সামাজিক ও রাজনৈতিক স্যাটায়ার ভিত্তিক নাটক। নাটকটি ব্যবচ্ছেদ করলে যা বেরিয়ে আসে তা কিছুটা এরকমঃ

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে স্থান করে নিল লাল সবুজের একটি মানচিত্র, রক্তের অক্ষরে লেখা হলো একটি নাম, বাংলাদেশ। কিন্তু ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার পরিপূর্ণ সুখ অনুধাবন করার আগেই নবজন্ম নেয়া এই দেশটিকে আঘাত করে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ। শত শত বছর ধরে ভীনদেশী শকুনীদের ছিঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে আঁস্তাকুড়ে ফেলে যাওয়া এই দেশটিকে নতুন করে গঠনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সুবিধাবাদীদের লোভ, লালসা, ক্ষমতার তৃষ্ণা, স্বেচ্ছচারিতা, আর স্বার্থপরতার বেড়াজাল।সেই বেড়াজালে আটকা পড়ে এদেশের লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ। দুবেলা দুমুঠো অন্নের অধিকারের বিনিময়ে দিনশেষে তাদের প্রাপ্তি হয় লঙ্গরখানার লাঠিয়ালের হাতে মৃত্যু। আর সারি সারি লাশের সিড়ি বেয়ে তথাকথিত সমাজসেবিরা উঠে যায় নিজেদের সাফল্যের চূড়াতে।

প্লটঃ
নাটকে বর্নিত 'হরিণ চিতা চিল' আসলে একটি স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন যারা সমাজের উন্নয়নে কাজ করে থাকে। এই সংগঠনের কর্নধার হরিণ খ্যাত হাজেরা একজন সুযোগসন্ধানী সমাজকর্মী মহিলা, আর তার সহযোগী দুই যুবক হাকিম আর ভুইঞা (চিতা আর চিল)। হাজেরা এই দুই যুবককে মায়ার জালে আচ্ছন্ন করে রাখে কাজ হাসিলের জন্য, সুতরাং বলাই বাহুল্য এই দুই যুবক হাজেরার প্রতি দূর্বল। 'দেশের গরুরা ঠিকমতন দুধ দিচ্ছেনা' এই অন্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে তারা সভা ডেকেছে। সভাপতি হিসেবে নিয়ে এসেছেন মুখোশধারী একজন সমাজপতি হাক্কানীকে। সভাতে বক্তব্য রাখছেন নারীনেত্রী, কবি, বিশেষজ্ঞ, নেতা ইত্যাদি নানা রকমের মানুষ। মজার বিষয় হচ্ছে বক্তারা কেউ আসল সমস্যা নিয়ে কথা বলছেননা, সবাই যার যার স্বার্থ আর নিজস্ব ধ্যান-ধারণা নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি সভাপতি হাক্কানীও ঘুরে ফিরে হাজেরার প্রতি তার দূর্বলতা প্রকাশ করছেন আর হাজেরাও তাতে সায় দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কারন সাফল্যের অনেক উপরে উঠতে হাজেরার প্রয়োজন একটি সিড়ি।

হাক্কানীর দেয়া একটি গাই গরুর দুধ থেকে ছানা ফাটিয়ে শুরু হয় হরিণ চিতা চিলের রসগোল্লার ব্যবসা। হাকিম আর ভুইঞা পার্কে বসে রসগোল্লা বিক্রি শুরু করে। সাধারণ মানুষ যেখানে খেতে পারছেনা, ক্ষুধার জ্বালায় ঢাকার রাস্তায় সবুক্তিগীন আর তার মা হন্নে হয়ে খুঁজছে লঙ্গরখানা সেখানে হরিণ চিতা চিলের সখের দোকান ১৯৭৩ এর সময়কালীন রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে নাট্যকারের নিরব বিদ্রোহকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন রকমের মানুষের রসগোল্লার দোকান দেখে আর তাদের কথা বার্তায় '৭৩ সালের নানা রকম অসংগতিগুলো চোখে পড়ে। দেশের উন্নয়নের নামে যে ব্যবসা সেখানে ক্ষুধার জ্বালায় কাতর ছোট্ট একটি ছেলে সবুক্তিগীন  বার বার চেয়েও একটি রসগোল্লা পায়না, খাদ্যের সন্ধানে সবুক্তিগীন একসময় হারিয়ে যায় মানুষের ভীরে, কে জানে হয়ত সে লাঠিয়ালের হাতে মার খেতে হারিয়ে যায় চিরতরে, কিংবা না খেতে পেরে একসময় শিয়াল ককুরের মুখের গ্রাস হয়। একদিকে ক্ষুধার জ্বালা আর অন্যদিকে পুত্রকে হারানোর শোক বুকে নিয়ে পাগলের মত ঘুরে বেড়ানো সবুক্তিগীনের মার ভাগ্যেও যুটে যায় লঙ্গরখানার লাঠিয়ালের হাতের মার আর হাকিমদের গলাধাক্কা। উদ্ভ্রান্তের মত ঘুড়ে বেড়ানো মানুষের বিবেকরূপী পাগলের কথায় চোখ খুলে যায় ভুইঁঞার, সে বিপ্লবী হয়ে উঠে, বিদ্রোহ ঘোষনা করে এই সমাজ আর মুখোশ পড়া হাজেরা হাক্কানী আর হাকিমদের বিরুদ্ধে। হাজেরা সব বুঝতে পারে কিন্তু ততক্ষনে ভুইঞাদের দিয়ে তার স্বার্থ হাসিল শেষ, ততক্ষণে  সে হাক্কানীকে পেয়ে গেছে সমাজের উঁচু তলার পৌছানোর বাহন হিসেবে।
এভাবেই উপড়ে উঠে যায় স্বার্থপরেরা। হাজেরা হরিণ প্রজাপতির ডানা মেলে, পেছনে পড়ে থাকে সবুক্তিগীনের লাশ অন্ধকারে শেয়াল কুকুরের মুখের গ্রাস হয়ে। শোষিত আর ক্ষুধিতের আর্তনাদ বাতাসে ভর করে হাক্কানী হাজেরা আর হাকিমদের উচুতলায় পৌঁছায়না কখনো তবে সবুক্তিগীনের মৃত্যুক্ষুধা মাঝে মাঝে ভুইঞাদের মনে জন্ম দেয় বিল্পবের।

নির্মান কথনঃ
অভিনয়ে হাতেখড়ি অনেক আগে হলেও এই নাটকটির মধ্য দিয়ে আমার নির্দেশনার হাতেখড়ি। আর তাই নাটকটি নিয়ে আমার উচ্ছ্বাস, ভাললাগা, দুশ্চিন্তা, আবেগ সবই কাজ করেছে তীব্রভাবে। আমার সাথে যৌথভাবে নির্দেশনায় ছিলেন রাফাত ভাই। নাটকটির জন্য সময় পেয়েছি দুই থেকে আড়াই মাস তবে সম্পাহান্তে একদিন মাত্র রিহার্সেল করার সুযোগ পেয়েছি। এত কম রিহার্সেল করে মঞ্চে উঠার সাহস পেয়েছি মূলত কিছু নাট্যপ্রেমী মানুষের জন্য। এদের একটি অংশ মঞ্চে অভিনয় করেছেন, কেউ কেউ মঞ্চের পেছনে বসে কাজ করেছেন আর কেউ কেউ অভিভাবকের মত পরামর্শ আর অন্তরালে থেকেই কাজ করে গেছেন। এই দুই মাসে রয়েছে অসংখ্য মধুর স্মৃতি যা হয়ত পরে রোমন্থন করব তবে তার দুই একটি পাঠকের সাথে শেয়ার করিঃ
নাটকের প্রথম দৃশ্যের জন্য আমি মনে মনে একটি ব্যানার ভেবে রেখেছিলাম, যেহেতু একটি সভা হচ্ছে সেটি ভেবে। ঢাকা হলে এটি এক ঘন্টার কাজ কিন্তু এই এডমন্টনে কাপড় আর রংতুলি দিয়ে বাংলা ব্যানার বানানো বলতে গেলে অসম্ভব। মঞ্চসজ্জার দ্বায়িত্ত্ব থাকা রিগ্যান সেটিকে সম্ভব করে তুলল। টানা তিন দিন তিন চার ঘন্টা সময় দিয়ে সে সত্যি সত্যি একটি ব্যানার দাড় করিয়ে ফেলল। 

ছবিঃ নাটকের প্রথম দৃশ্যের সেট
নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্য আসলে একটি পার্কের সেট। কিছু কৃত্রিম গাছ জোগাড় করেছিলাম, কিন্তু কেন জানি পার্ক পার্ক ভাবটা আসছিলনা। নাটকের দিন জাফর ভাই আর পারভীন ভাবি তাদের বাসার পাশ থেকে থেকে একগাদা গাছের ডাল কেটে নিয়ে এলো। সেগুলো সাজিয়ে সত্যিকারের পার্কের রূপ চলে আসল সেটে।

IMG_2699
ছবিঃ নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যের সেট

নাটকের শুরুতে আর শেষ কিছু কথা যোগ করা হয়েছে সেগুলো আমার লেখা। কিন্তু তার পরও কেন জানি সমাপ্তিটি ভাল লাগছিলনা। হঠাৎ মনে হলো রফিক আজাদের 'ভাত দে হারামজাদা' কবিতাটির থেকে ভাল কোন সমাপ্তি আর হতে পারেনা। আবারো যথারীতি সচলের নজরুল ইসলামের সহযোগীতা। নজু কবিতাটি সংগ্রহ করে পাঠালো আর আমি তার সাথে একটি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়ে কবিতাটি যুক্ত করে দিলাম। ধন্যবাদ রইল নজুর প্রতি।
নাটকের ছবিঃ
IMG_2948
নাটকের পুরো দলের ছবিঃ বা দিক থেকে  সাজ্জাদ ভাই ( কবি চরিত্রে, ফ্রেমে অনুপস্থিত) রিগ্যান (রূপসজ্জা ও মঞ্চসজ্জা), কাকলী ভাবী ( নারীনেত্রী), আইরীন ভাবী(হাজেরা), রুমি ( আবহ সংগীত) ,আদনান ( হাকিম ও নেপথ্য কন্ঠ), খসরু ভাই( হাক্কানী), রাসেল ভাই( ডঃ বাপ্পী), ববি ( নেতা  "সচলের মুক্তবিহঙ্গ"), জাহিদ ( পাগল), পৃথুল ( সবুক্তিগীন) , রাফাত ভাই ( ভুইঞা), পারভীন ভাবী( সবুক্তিগীনের মা), ফয়সাল (যুবক) , মিতু ( ছাত্রী "সচলের রিফাত জাহান মিতু" )ও  শান্তা ( মঞ্চ ব্যব্যস্থাপনা)

পিকাসাতে আপলোড করা এলবামের একটি স্লাইডশো নিচে এমবেডেড করে দিলাম। ছবিগুলোর জন্য ধন্যবাদ রইল বিপুর প্রতি।

নাটকের ভিডিওঃ
ইউটিউবে নাটকের ভিডিওটি ছয়টি খন্ডে দেয়া হয়েছে। নিচে এমবেডেড করে দিলাম। ভিডিওর জন্য কৃতজ্ঞতা রইল অমিতের প্রতি।
১/৬)


২/৬)

৩/৬)

৪/৬)

৫/৬)

৬/৬)


১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের পটভুমিতে লেখা এই নাটকটিতে যে রাজনৈতিক আর সামাজিক অসংগতির আলোকপাত করা হয়েছে আজ ছত্রিশ বছর পরও তা বিরাজমান। রাজা যায় রাজা আসে, কিন্তু এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়না। না শোষকের না শোষিতের।

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন
দ্বিতীয় প্রকাশঃ বকলম