সোমবার, ১৫ জুন, ২০০৯

দিন বদলের আশাঃ ঢাকার নদী

প্রবাদে আছে ‘দাঁত থাকতে নাকি দাঁতের মর্যাদা বুঝতে হয়’ আর আমরা দাঁত চলে গেলেও দাঁতের মর্যাদা বুঝার চেষ্টা করিনা। নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা বন্ধের জন্য দেখলাম এখন ‘গানে গানে নদী বাঁচাও’ কর্মসূচী শুরু হয়েছে কিন্তু কতৃপক্ষের তাতে কিছু যাবে আসবে বলে মনে হয়না। বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন শুরু হয়েছে অনেক আগে, রাজপথে মিছিল হয়েছে, স্লোগান, ব্যানার, ফেস্টুনে ভরে গিয়েছে ঢাকা নগরী কিন্তু বুড়িগঙ্গার মরণ থামাতে যাদের এগিয়ে আসার কথা তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে, নিজেদের আখের গোছানোর কাজে মগ্ন গণতান্ত্রিক সরকার কিংবা বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণকারী সামরিক সরকার কেউই এই বিষয়ে কোন দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়নি কখনো। মানুষের দাবী রয়ে গেছে মানুষের মুখে মুখেই আর নতুন প্রজন্ম অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ নগরীর যেখানে নাগরিক ব্যস্ততা থেকে খানিকক্ষণের অবসরে যাবার কোন জায়গা নেই, নদীর নির্মল বাতাসত দূরে থাক সেখানে একদন্ড দাঁড়ানোও আজ দুঃস্বপ্নের মত।

মানুষের যেমন জন্ম মৃত্যু আছে ঠিক তেমনি নদীরও আছে। একটি নদীর মৃত্যু হয় দুই ভাবে, ভৌতগত ভাবে আর জীবগত ভাবে। যদি নদীর প্রবাহ বন্ধ বয়ে যায় কিংবা গতিপথ রোধ হয়ে যায় তাহলে ভৌতগত ভাবে নদীকে আর বাঁচিয়ে রাখা যায়না। আবার যদি নদীতে দূষণের মাত্রা এত বেড়ে যায় যে নদীর পানিতে জলজ জীবের বাঁচার মত প্রয়োজনীর অক্সিজেন থাকেনা তাতেও ধীরে ধীরে নদীর মৃত্যু ঘটে। আমাদের ঢাকার আশেপাশের নদীগুলো মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে দুইভাবেই। একদিকে অবৈধ স্থাপনা করে আমরা নদীর গতিপথকে সঙ্কুচিত করে ফেলছি আর অন্যদিকে ক্রমাগত দূষণ করে এর জলজ বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছি দিনে দিনে।
পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছে কোন না কোন নদী, উপকূল বা মরুদ্যানকে কেন্দ্র করে। এর মূল কারণ হচ্ছে খাবার পানি আর নৌচলাচল। আজ আমরা ঘুম থেকে উঠে পানির ট্যাপ ছাড়লেই বিশুদ্ধ পানি পাই আর চাইলেই বাহারী রকমের সৌখিন বাস আর ট্রেনে চড়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাই তাই নদী এখন আমাদের কাছে অপাংক্তেয়। কিন্তু একটু যদি চিন্তা করি তাহলে ভয়াবহ একটা চিত্র আমাদের সামনে আসবে। ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যেভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে আর গভীর নলকূপ দিয়ে পানি তোলা যাবেনা। এখনো ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ মূলত নলকূপ ভিত্তিক, বুড়িগঙ্গার পানি আজ বিশুদ্ধিকরণও অনেক ব্যয়সাপেক্ষ, মেঘনা থেকে পানি এনে যে সরবরাহ করবে তাও যথেষ্ট ঝক্কির ব্যপার।
ঐতিহ্যগত ভাবে ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর পরিধি বেড়েছে সেই সাথে ঢাকা পরিনত হয়েছে মেগা সিটিতে। ঢাকার চারদিকে ঘিরে রয়েছে নদীঃ পূর্বে বালি, উত্তরে ও পশ্চিমে তুরাগ আর দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। সেই সাথে এর অভ্যন্তর দিয়ে বয়ে চলত বেশ কিছু প্রশস্থ খাল (উদাহরণ সরূপ ধোলাইখাল, বেগুনবাড়ি খাল ইত্যাদি)। এই খালগুলি ঢাকার জলনিষ্কাশণ ব্যবস্থায় গুরুত্ত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করত। আমরা বাসস্থানের জন্য ধীরে ধীরে এই খালগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছি ধীরে ধীরে তাই আজ এক পশলা বৃষ্টি হলেই ঢাকার রাস্তায় পানি জমে যায়।আমাদের বর্জ্যের চাপে ঢাকার আশে পাশের নদীগুলো হারিয়েছে তার জীবন, অবৈধ স্থাপনার চাপে তারা হয়েছে সঙ্কুচিত।তাই নদীর জলে পা ভিজিয়ে বসে থেকে প্রেমালাপত দূরের কথা নদীর পানির দূর্গন্ধে তার আশে পাশে যাওয়াই আজ দুষ্কর। একসময় বুড়িগঙ্গায় নৌকাভ্রমণ ঢাকাবাসীদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল আজ তাও নিঃশেষ। অথচ ইউরোপে আমরা দেখেছি শহরগুলির মাঝ দিয়ে কৃত্রিম ভাবে ছোট ছোট খাল খনন করে নিষ্কাশনের ব্যাবস্থা করেছে আর সেই সাথে বিনোদনেরও আর আমাদের প্রাকৃতিক খালগুলিকে আমরা ভরে ফেলেছি অবহেলা ভরে।
আমরা খবরের কাগজ, টেলিভিশনের মাধ্যমে নদীর পানি দুষণের খবর দেখে বিচলিত হই কিন্তু এর ভয়াবহতা কিংবা আসলে দূষণের মাত্রাটা কিরকম তা খুব বেশি বোধ করিনা কারন ঢাকা শহরের খুব কম মানুষই আছে যারা চাক্ষুষ ভাবে নদীদূষণ লক্ষ্য করেছেন। আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা বলি, ‘ব্যবহারিক সার্ভেয়িং’ করাতে একবার বুয়েটের পানিসম্পদ কৌশলের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে গিয়েছ বালু নদীতে। ছোট একটা নদী, ছাত্রদের মূল কাজ হলো এর প্রস্থ আর গতি মেপে এর মোট প্রবাহ পরিমাপ করা। সমুদ্র থেকে যথেষ্ট দূরে থাকলেও এই নদীতে জোয়ার ভাটার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ভাল ভাবেই। আমরা সকালে গিয়েছি, তখন নদীর পানির যে গভীরতা ছিল কাজ করতে করতে যখন দুপূর গড়িয়েছে তখন পানির গভীরতা কমেছে আর সেই সাথে দুইপাড়ে জমে গিয়েছে কালো কালো সব বর্জ্য আর সেই সাথে দূর্গন্ধে সেখানে কাজ করাত দূরে থাক অবস্থান করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই যদি হয় একটি রাজধানীর আশে পাশের অবস্থা সেক্ষেত্রে সেই শহরের মানুষদের সুস্থতা আমরা কিভাবে আশা করতে পারি।
পৃথিবীর বুকে খুব কম দেশই আছে যেখানে রাজধানীর বুকে রয়েছে ট্যানারী। ঢাকার হাজারীবাগের ট্যানারীর বর্জ্য ফেলা হয় বুড়িগঙ্গার বুকে। বিষাক্ত এই বর্জ্য নদীর পানির সাথে মিশে এর জলজ প্রানীদের মৃত্যু ঘটায়। আমাদের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও আধুনিক নয়। আগে ঐতিহ্যগত ভাবে শহরের বাসিন্দারা তাদের নিজেদের বাসায় সেপটিক ট্যাঙ্ক নির্মান করত, সিটি কর্পোরেশনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য এখন কেউ তা আর করেনা। আমাদের পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনের সুযোগ আর সাধ্য দুটোই কম সেক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি, গোছলের পানি আর পয়ঃ একই পথ দিয়ে বের হয়ে সরাসরি গিয়ে নদীতে পড়ে আর নদী হারায় তার জীবন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাবার পানির জন্য হয়ত মেঘনা থেকে পান নিয়ে আসা হবে কিন্তু মানুষের সুস্থ বিনোদনের জন্য ট্রাকে ভর্তি করে মানুষকে তো আর মেঘনা পাড়ে নির্মল বাতাস খেতে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। আমাদের মনে আছে শুধু মাত্র শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে নদীর একটু নির্মল হাওয়া খাওয়ার জন্য মানুষ পাগলের মত ছুটে যেত আশুলিয়ায়, সে পথও একদিন বন্ধ হবে, বুড়িগঙ্গা গেছে এবার তুরাগও যাবে। শরীরের শিরা উপশিরা বন্ধ হলে মানুষ যেমন হৃদরোগে ভুগে তেমনি ঢাকার এই নদীগুলো শুকিয়ে একদিন শহরটাও রোগে ভুগবে তখন এর মূল্য দিতে হবে আমাদেরই।
আমাদের দেশের মন্ত্রীদের মুখে যখন কথার খই ফুটে তখন তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে কিনা আমার সন্দেহ আছে। একবার এক মন্ত্রীত আমাদের ম্যাগনেটিক ট্রেন এর স্বপ্ন দেখাল। সেদিন দেখলাম সংসদে পানিসম্পদ মন্ত্রী বলেছেন দেশের সব নদীগুলো ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা বাড়াবেন। উনার কিছু নদীপ্রকৌশলগত জ্ঞান থাকার প্রয়োজন অনুভব করছি। বাংলাদেশের নদনদীগুলোর পলি বহনের হার আর ড্রেজিং এর ব্যয় সম্পর্কে উনার ন্যুনতম ধারনা থাকলেও এই মন্তব্য করতে আরেকবার ভেবে দেখতেন। যাই হোক সে প্রসঙ্গে আরেকদিন আসব আমার কথা হল দেশের সব নদীর নাব্যতার আগে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় আপনি বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু এই গুলিকে দূষণের হাত থেকে বাঁচান, অবৈধ স্থাপনা দূর করুন, ঢাকার খাল গুলিকে আবার খনন করুন, নদীর ধার থেকে ট্যানারির মত শিল্প দূরে সরানোর ব্যবস্থা করুন তাহলে আমরা আমাদের প্রিয় শহরটাকে হয়ত আবার ফিরে পাবো। হয়ত সেদিন আমাদের সন্তানেরা বুড়িগঙ্গার বুকে নৌকায় করে ঘুরে বেড়াবে, নদীর শান্ত শীতল জলে পা ভেজাবে, প্রেয়সীর সাথে গল্প করতে করতে সুর্যাস্ত দেখবে। সেই দিনবদলের আশায় দিন গুণে যাচ্ছে ঢাকার এক কোটি মানুষ সেই সাথে সারা দেশ।

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন