মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০১৩

জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচক ও বাংলাদেশ

২০১৩ সালের এপ্রিলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের অর্থায়নে এশীয় পানি উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি  (Asian Water Development Outlook) প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রকাশনায় বাংলাদেশ সহ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পানিসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ কিছু চিত্র উঠে এসেছে। পানিসম্পদ উন্নয়নের জাতীয় পর্যায়ের এই রূপ আসলে জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচক বা National Water Sequirity Index (NWSI) এর মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে। পুরো রিপোর্টটি এই লিঙ্ক থেকে পড়া যাবে। আমি এই লেখায় চেষ্টা করেছি এই রিপোর্টের আলোকে বাংলাদেশের জাতীয় পানি নিরাপত্তার একটি রূপ তুলে ধরতে। লেখাটি দুটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচকের মৌলিক তথ্য ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা নির্ণয়ের সার্বিক ব্যবচ্ছেদ থাকবে। দ্বিতীয় পর্বে  কি কি পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ তার জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচকের উন্নয়ন ঘটাতে পারবে তা বিশ্লেষণের চেষ্টা থাকবে।



জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচকঃ

একটি দেশের সার্বিক জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচক  আসলে পাঁচটি আলাদা আলাদা সূচকের সমন্বয়ে নির্ণীত হয়। এই আলাদা আলাদা সূচক গুলির মান ১ থেকে ৫ পর্যন্ত এবং এদের গড়ই আসলে ঐ দেশের জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচক নির্দেশ করবে। এখন দেখা যাক সেই মাপকাঠিগুলো কি কি এবং কিভাবে আলাদা করে এই মাপকাঠিগুলোর মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে।

ক) গৃহস্থালির পানির নিরাপত্তা:

এই নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হবে যখন সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিত করা হবে। সেই সাথে স্বাস্থসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও এই মাপকাঠির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

গৃহস্থালির পানির নিরাপত্তা সূচক নির্ভর করে তিনটি সাব-সূচকের উপর: গৃহে পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের সুবিধা,  স্বাস্থ্যকর ও উন্নত পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা, এবং ডিসএবিলিটি এডজাস্টেড লাইফ ইনডেক্স বা DALY এর উপর। যদি একটি দেশে শতকরা ৯০ ভাগ বা ততোর্ধ মানুষের গৃহে পাইপের মাধ্যমে পানির সুবিধা থাকে সেক্ষেত্রে প্রথম সাব-সূচকের মান হবে ৫, অন্যদিকে যদি শতকরা ৬০ ভাগ এর কম মানুষের গৃহে এই সুবিধা না থাকে তবে এই প্রথম সাব-সূচকের মান হবে মাত্র ১। একই ভাবে, যদি একটি দেশে শতকরা ৯০ ভাগ বা ততোর্ধ মানুষের গৃহে স্বাস্থ্যকর ও উন্নত পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা থাকে সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় সাব-সূচকের মান হবে ৫, অন্যদিকে যদি শতকরা ৬০ ভাগ এর মানুষের কম গৃহে এই সুবিধা না থাকে তবে এই দ্বিতীয় সাব-সূচকের মান হবে মাত্র ১। তৃতীয় সাব-সূচকটি আসলে পানি বাহিত রোগ যেমন ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যু বা অকর্মক্ষমতার কারণে প্রতি ১০০,০০০ মানুষের গড় আয়ু থেকে কত বছর নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তার একটি হিসেবের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। এর মান যত বেশি হবে সাব-সূচকের মান তত কম হবে। পরোক্ষ ভাবে বলা যায় পানি বাহিত রোগের কারণে যত বেশি মানুষ মারা যাবে বা অকর্মক্ষম হবে বাকী জীবন কাটাবে এই সাব-সূচকের মান তত কম হবে।

খ) অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তা: 


একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির তিনটি স্তম্ভকে হচ্ছে: খাদ্য উৎপাদন, শিল্প পণ্য উৎপাদন, এবং শক্তি উৎপাদন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই তিনটির সাথেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে পানি। পানি ছাড়া খাদ্য ও শিল্প পণ্য উৎপাদন অসম্ভব। সেই সাথে শক্তি উৎপাদন প্ল্যান্টের শীতলীকরণের জন্য পানি আবশ্যক একটি উপাদান। টেকসই উন্নয়নের জন্য পানির গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি কাজে পানির ব্যবহারের কতটা সমন্বয় ঘটছে সেটি জাতীয় পানি নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তা সূচক তাই তিনটি সাব-সূচকের উপর নির্ভর করে: খাদ্য উৎপাদনে পানির নিরাপত্তা, শিল্প পণ্য উৎপাদনে পানির নিরাপত্তা এবং শক্তি উৎপাদনে পানির নিরাপত্তা। এই তিনটি আলাদা সাব-সূচকের মান ১ ও ১০ যথাক্রমে স্ব স্ব ক্ষেত্রে পানির অনিশ্চিত ও নিশ্চিত যোগান নির্দেশ করে।

গ) শহরাঞ্চলের পানির নিরাপত্তা: 

দ্রুত ও ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে শহরাঞ্চলে মানুষের জীবন ও জীবিকার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনে দিনে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ জাতীয় পানি নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি।

শহরাঞ্চলের জন্য পানির নিরাপত্তা সূচক আসলে তিনটি সাব-সূচক এর উপর ভিত্তি করে হিসেব করা হয়। তিনটি সাব-সূচক হচ্ছে: শহরের শতকরা কত ভাগ মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ রয়েছে, শতকরা কত ভাগ মানুষের জন্য বর্জ্য জলের (Waste Water) পরিশোধনের সুব্যবস্থা আছে এবং শহরের অধিবাসীদের মাথাপিছু বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত। প্রথম দুটির ক্ষেত্রে যদি একটি শহরাঞ্চলের অধিবাসীদের শতকরা ৯০ ভাগ বা ততোর্ধদের কাছে নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকে বা বর্জ্য জলের (Waste Water)  পরিশোধনের সুব্যবস্থা থাকে তবে ঐ সাব-সূচকের মান হবে ৫, অন্যদিকে যদি শতকরা ৬০ ভাগ এর কম অধিবাসীদের কাছে এই সুবিধা না থাকে তবে তাদের মান হবে মাত্র ১। তৃতীয়টির ক্ষেত্রে বন্যার ফলে সৃষ্ট মাথাপিছু খরচ যত বেশি সূচকের মান তত কম।

ঘ) পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তা:


অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশের ভারসাম্য কিছুটা বিপরীতে অবস্থান করে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবেশের, বিশেষত পানিসম্পদের বিপর্যয় ঘটায়। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে তা কতটা বাস্ততান্ত্রিক ভারসাম্য বজায় রাখছে বা নদী ও জলাশয়ের পানির গুনগত মান কতটা সংরক্ষিত হচ্ছে তা এই মাপকাঠির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।

মূলত দুইটি বিষয় দ্বারা এই সূচক নিয়ন্ত্রিত হয়: অববাহিকায় মানুষের কার্যক্রম ও দূষণের ফলে নদী কতটা  হুমকির সম্মুখীন, এবং নদী অববাহিকায় মানুষের নির্মিত বিভিন্ন উন্নয়ন অবকাঠামোর ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রবাহ কতটা বিঘ্নিত হচ্ছে। আসলে একটি নদী অববাহিকার জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম বা GIS বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই সূচক নির্নয় করা হয়।

ঙ) পানি সম্পর্কিত দুর্যোগের সাথে অভিযোজনের ক্ষমতা:


শিল্পায়নের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই সাথে জলবায়ুর পরিবর্তন সামনের দিনগুলোতে পানি সম্পর্কিত দুর্যোগ যেমন: বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন ইত্যাদির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেই সাথে এই ঝুঁকির সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। একটি দেশ সেই পথে কতদূর অগ্রসর হল তাই এই মাপকাঠি নিয়ে নির্ণয় করা হয়।

মূলত পানি সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন: বন্যা, ঘূর্নিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ও উপকূলীয় বন্যা ইত্যাদির সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য একটি দেশের অধিবাসীরা কতটা প্রস্তুত তার হিসেব করা হয় বেশ কয়েকটি সাব-সূচকের মাধ্যমে। এই সূচক গুলি হচ্ছে: জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বৃদ্ধির হার, দারিদ্রের হার,  দেশের মানুষের টেলিযোগাযোগের হার ও শিক্ষিতের হার।

জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচক আসলে কি নির্দেশ করে:


জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচকের সর্বোচ্চ মান হচ্ছে ৫, যা কিনা “মডেল” বা “আদর্শ পানি নিরাপত্তা সূচক” নামে অভিহিত। কোন দেশের পানি নিরাপত্তা সূচক ৫ মানে হচ্ছে সেই দেশে রয়েছে টেকসই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এবং সেবা; রয়েছে পরিবেশ ও পানিসম্পদের সুরক্ষা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত ও টেকসই বিনিয়োগ; রয়েছে জনসাধারণের পানির ব্যবহারের টেকসই মাত্রা; রয়েছে উন্নত কারিগরি ব্যবস্থা, উন্নয়ন ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পানিসম্পদ পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক প্রণীত আদর্শ মডেল।

এর বিপরীতে জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচকের সর্বনিম্ন মান হচ্ছে ১, যা কিনা “ঝুঁকিপূর্ণ” বা “অনিশ্চিত পানি নিরাপত্তা সূচক” নামে অভিহিত।  একটি দেশের পানি নিরাপত্তা সূচক তখনই অনিশ্চিত বা ঝুঁকিপূর্ণ যখন সেদেশে পানি ও পরিবেশ নিয়ে নীতি ও আইন থাকলেও তার বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। সেই সাথে এটি পরিবেশ ও পানিসম্পদের সুরক্ষা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য বিনিয়োগের দীনতাকেও নির্দেশ করে।

জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচকের মান ২ মানে হচ্ছে পানি ও পরিবেশ নিয়ে নীতি ও আইন কিছুটা হলেও সক্ষমতা অর্জন করছে, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কিছুটা উন্নয়নের পথে, এবং পরিবেশ ও পানিসম্পদের সুরক্ষা ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ কিছুটা হলেও বেড়েছে তবে তা পর্যাপ্ত নয়।

জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচকের মান ৩ নির্দেশ করে দেশে পরিবেশ ও পানিসম্পদ নিয়ে নীতি ও আইনের বাস্তবায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে, পানিসম্পদ উন্নয়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে, পরিবেশ ও পানিসম্পদের সুরক্ষা ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সর্বোপরি স্থানীয় ভাবে কারিগরিগত ও আর্থিক উন্নয়ন ঘটেছে।

জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচকের মান ৪ কে বলা যেতে পারে “কার্যকরী” বা “ফলপ্রসূ পানি নিরাপত্তা সূচক”। একটি দেশের পানি নিরাপত্তা সূচককে কার্যকরী তখনই বলা যাবে যখন জাতীয় ও স্থানীয় উন্নয়ন (নগর ও গ্রামে) পরিকল্পনায় পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, জাতীয় পরিকল্পনায় পানিসম্পদ এর প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে, পরিবেশ ও পানিসম্পদের সুরক্ষা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সর্বোপরি পরিবেশ ও পানিসম্পদ নিয়ে নীতি ও আইনের উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ ঘটেছে।

বাংলাদেশের জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচক:


এবার দেখা যাক উপরের আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা সূচক কত। প্রথমেই আসা যাক গৃহস্থালির ক্ষেত্রে পানির নিরাপত্তা সূচকের প্রশ্নে। ইতিমধ্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে গৃহস্থালির পানির নিরাপত্তা সূচক নির্ভর করে তিনটি সাব-সূচকের উপর: পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের সুবিধা,  স্বাস্থ্যকর ও উন্নত পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা, এবং ডিসএবিলিটি এডজাস্টেড লাইফ ইনডেক্স বা DALY এর উপর। বাংলাদেশে মাত্র শতকরা ৬ ভাগ মানুষের পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের সুবিধা রয়েছে, ফলে প্রথম সাব-সূচকের মান ১ । যদিও শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের স্বাস্থ্যকর ও উন্নত পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা রয়েছে কিন্তু তা ৬০ ভাগের নিচে বলে দ্বিতীয় সাব-সূচকের মানও মাত্র ১। বিপরীত ক্রমে বাংলাদেশের ডিসএবিলিটি এডজাস্টেড লাইফ ইনডেক্স বা DALY এর মান ১,২১৭ যা কিনা বেশ উঁচু, ফলে তৃতীয় সাব-সূচকের মানও মাত্র ১। অর্থাৎ বাংলাদেশে গৃহস্থালির ক্ষেত্রে পানির নিরাপত্তা সূচক ১ থেকে ৫ এর স্কেলে আসলে মাত্র ১।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তা সূচক যে তিনটি সাব-সূচকের উপর নির্ভর করে তার মধ্যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদনে পানির নিরাপত্তা সূচকের মান ৪.৮৯ ( ১০ এর মধ্যে), শিল্প পণ্য উৎপাদনে পানির নিরাপত্তা সূচকের মান ৫.৫৬ এবং শক্তি উৎপাদনে পানির নিরাপত্তা সূচকের মান ৩.৭৮। অর্থাৎ মোট ৩০ এর মধ্যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় স্কোর হচ্ছে ১৪.২২। ১ থেকে ৫ এর স্কেলে তাই বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তা সূচক এর মান ৩।

আসা যাক শহরাঞ্চলের জন্য পানির নিরাপত্তা সূচক নির্ণয়ে। এই সূচক তিনটি সাব-সূচক এর উপর নির্ভরশীল: মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ, বর্জ্য জলের পরিশোধনের সুব্যবস্থা এবং মাথাপিছু বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত। বাংলাদেশের শহরগুলিতে শতকরা মাত্র ২০ ভাগ মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধাপ্রাপ্ত, ফলে ১ থেকে ৫ এর স্কেলে এই সাব-সূচকের মান মাত্র ১। সেই সাথে শতকরা ১৭ ভাগ মানুষের জন্য বর্জ্য জলের পরিশোধনের সুব্যবস্থা আছে যা কিনা দ্বিতীয় সাব-সূচকের মান নির্নয় করে মাত্র ১। অন্যদিকে বাংলাদেশে শহরের অধিবাসীদের মাথাপিছু বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২৭ মার্কিন ডলার ফলে তৃতীয় সাব-সূচকের মান ৪। এই তিন সাব-সূচকের  সমন্বিত মান ৬ যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের জন্য পানির নিরাপত্তা সূচক দাঁড়ায় মাত্র ১ এ।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মানুষের কার্যক্রম ও দূষণের ফলে নদী কতটা  হুমকির সম্মুখীন এবং নদী অববাহিকায় মানুষের নির্মিত বিভিন্ন উন্নয়ন অবকাঠামোর ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রবাহ কতটা বিঘ্নিত হচ্ছে তার ভিত্তিতে পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তা সূচক এর মান মাত্র ১। সেই সাথে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বৃদ্ধির হার, দারিদ্রের হার,  দেশের মানুষের টেলিযোগাযোগের হার ও শিক্ষিতের হার এর ভিত্তিতে বাংলাদেশের পানি সম্পর্কিত দুর্যোগের সাথে অভিযোজনের ক্ষমতা সূচকও মাত্র ১।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচক নির্ণয়ের যে পাঁচটি ভিত্তি রয়েছে তার মধ্যে একমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পানির নিরাপত্তা সূচক ( মান ৩) বাদে বাকী সবগুলোই ১ থেকে ৫ এর স্কেলে ন্যুনতম মান অর্থাৎ ১ নির্দেশ করে। ফলে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা সূচকের মান দাঁড়ায়= (১+৩+১+১+১)/৫ =১.৪, বা ১ থেকে ৫ এর স্কেলে এর মান ১ ও ২ এর মধ্যে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পানির নিরাপত্তা সূচক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে কিছুটা উন্নীত হবার চেষ্টা করছে।

পরবর্তী লেখাতে চেষ্টা থাকবে আসলে কি কি পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ তার জাতীয় পানি নিরাপত্তা সূচকের উন্নয়ন ঘটাতে পারবে তার ব্যবচ্ছেদ করার। এর ফাঁকে পাঠক এই ভিডিও প্রেজেন্টেশনটা দেখে নিতে পারেন।