রবিবার, ১৫ মার্চ, ২০১৫

একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের আকুতি

একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের আকুতি
রচনাঃ নকিব আহমেদ

আবৃত্তিঃ জাহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশ কানাডা এসোশিয়েশন এডমন্টন একুশ ও স্বাধীনতা অনুষ্ঠান, মার্চ ১৪, ২০১৫


বড় দুঃখ ভরা মন নিয়া আজ আপনাগো সামনে আইসা দাড়াইছি।হৃদয় আমার গভীর শোকে ভরা, কষ্ট আর বেদনায় জর্জরিত। অনেক কথা বলতে চাই, কিন্তু শোনার কেউ নাই। লোকে বলে আমার মাথার স্ক্রু নাকি ঢিলা, আমি নাকি আউলা ঝাউলা কথা বলি... হা হা হা ...

হ, কথা সত্য, আমিত পাগল কিসিমের লোক, আবোল তাবোল কথা বলি। কখন, কি যে বলি, সব মনেও থাকেনা। আমারে পাগল ভাইবা আপনারা তামাশা দেখেন, ঠাট্টা মশকরা করেন। আর ভাল মানুষের মুখোশ পইড়া যারা আপনাগো সামনে বইসা আছে তাগোর বিরুদ্ধে আপনারা টু শব্দও করেননা। 

অথচ দেখেন, ক্ষমতার লোভ, অবরোধ, আর হরতালের নামে নিরীহ জনগন নিয়া আমাগো নেতারা কেমন ছিনিমিনি খেলতাছে। ঐ যে দেখেন, নিরীহ মানুষগুলান পেট্রোল বোমার আগুনে ঝইলসা যাইতাছে, ক্রস ফায়ারের নামে অন্যায় ভাবে মানুষ মারা হইতাছে, ধর্মের নামে রাজপথে পশুর মত মানুষ কুপাইয়া মারতাছে। 

আপনারাত সুধীজন, সুশীল সমাজ, ভদ্দর লোক। আপনারা মাইপা কথা কন। আপনাদের প্রতিবাদের কথা, বিপ্লবের ডাক, ঐ টেলিভিশনের টক শো আর ফেইসবুকের মধ্যেই পইড়া থাকে। সত্যিকারের প্রতিবাদ কেমনে করতে হয় সেইটা আপনারা জানেনওনা, করতেও চাননা। আর, আমাগো মতন মানুষ, যাগো নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তারা হইলাম গিয়া জনগণ। এই জনগণ এখন হইয়া গেছে আলুর দম। হা হা হা ...।জনগনের কথা চিন্তা করার সময় আপনাগো নাই।
একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে আমি নিজেরে ধিক্কার দেই। ক্যান আমার বাবা নিজের পরিবারের মায়া ছাইড়া দেশের টানে যুদ্ধে ঝাপাইয়া পড়ল! মাইষের কাছে শুনছি আমার বাবা খুব সাহসী মানুষ ছিল, সিনা টান কইরা সবার সামনে যুদ্ধ করছে। যখন যুদ্ধ শেষ হইল, অনেকে ফিরা আইল। আমার মা অনেক আশায় বুক বাইধা রইল, কিন্তু বাবা ফিরা আইলনা। বাবার লাশটাও আমরা পাই নাই। পরে শুনছি, হানাদার বাহিনী নাকি প্রতিশোধের জন্য বাবাদের লাশ আগুন দিয়া পুড়াইয়া দিছিল। কি যে ভীষন কষ্ট আমার বুকে, এ জীবনে বাবার আদর, ভালবাসা, কিছুই পাইলামনা। আমার এই কষ্ট, এই যন্ত্রণা, আপনারা কখনো বুঝবেননা।
অথচ ২৬ মার্চ আর ১৬ ই ডিসেম্বর আইলে নেতাদের আহাজারি শুরু হয়, মুখে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ফোটে। কিন্তু কি পাইছি আমরা? খুব ঘটা করে আমার মার হাতে একটা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট তুইলা দেয়া হইল। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই, আর কোনদিন কেউ কোন খবর নেয় নাই। আমার বিধবা মা মাইনষের দুয়ারে দুয়ারে ধর্না দিল, এই হতভাগ্য ছেলের জন্য একটু আশ্রয় চাইল, কিন্তু ফলাফল, যা হবার তাই হইল, শুন্য ... হা হা হা ...
আমার জীবন হইয়া গেল একটা বিরাট শুন্য। আমার মা রোগে শোকে ধুকতে ধুকতে অভিমানে একদিন আমারে ছাইড়া পরপারে চইলা গেল। আর আমি, বানের জলে ভাসতে ভাসতে একদিন হইয়া গেলাম রাস্তার মানুষদের একজন। আপনাগো ভাষায় পথকলি। হা হা হা ...
জীবনের এই চাওয়া পাওয়ার যুদ্ধে আমি পরাজিত একজন মানুষ, আমার আর কিছু পাওয়ার নাই। আমার জীবন বড় কষ্টের। ভালাবাসা দিবসে কেউ আমারে একটু ভালবাসার কথা কয়না, বসন্ত উৎসবে কেউ রঙ্গীন মালা নিয়া আমার পাশে আইসা বসেনা, ২১ শে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীতে কেউ ফুল নিয়া আমার হাত ধইরা আইসা দাড়ায়না। আমিত আস্তে আস্তে হারাইয়া গেছি আপনাগো বর্নময় সুন্দর জীবন থিকা।
আমার কথা বাদ দেন, আমিত পাগল ছাগল মানুষ, দেশের কথা ভাবারইত সময় কারোর নাই। অসুস্থ রাজনীতিতে আজ আক্রান্ত সারা দেশ। আমাগো মায়াবতী-কোমলমতি নেত্রীগো ক্ষমতার কামড়া-কামড়ি, আর একজনের প্রতি আরেকজনের খিস্তি খেউরি দিন দিন বাইড়াই যাইতাছে।


আমি আপনাগো কাছে করজোড়ে মিনতি করি, আমাগো দুই দন্ড শান্তিতে থাকবার সুযোগ দেন। এ দেশতো খালি আপনাগো না, এদেশ আমাগোও। আপনারা দেশে একটু শান্তি আনেন, তাইলে অন্তত আমার বাবার মত মুক্তিযোদ্ধারা শান্তিতে এই বাংলার মাটিতে ঘুমাইতে পারব। ত্রিশ লাখ রক্তের দামে কেনা আমাগো এই দেশে আপনারা আর কোন মায়ের বুক অকারণে খালি হইতে দিয়েননা। অন্তত এই শান্তিটুকু আমগো দেন। আমরা আর কিছু চাইনা। আমরা আর কিছু চাইনা।