জাহিদুল ইসলাম ও ডঃ মোঃ খালেকুজ্জামান
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৭ টি আন্তঃসীমান্ত নদী প্রবাহমান থাকলেও ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তিই এই দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে আন্তঃ-নদীর পানিবন্টনের একমাত্র উদাহরন। সঙ্গত কারণেই, এই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন দুই দেশের জন্যই গুরুত্ত্বপূর্ন।গঙ্গার পানি প্রবাহ আর এর অববাহিকা বিধৌত পলি যেমন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত চার কোটি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় তেমনি তা এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের সার্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশগত ভারসাম্যের জন্যও গুরুত্ত্বপূর্ন। বিশেষত, সুন্দরবনের মত একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের টিকে থাকা নির্ভর করছে গঙ্গা এবং তার শাখা নদী সমূহের যথাযথ প্রবাহের উপর। গঙ্গা অববাহিকা নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে বিস্তৃত। আর তাই সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপটে এই অববাহিকার সকল অংশীদারদের পরিকল্পনা হওয়া উচিৎ পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রকে সমুন্নত রেখে গঙ্গার পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে এইযে আন্তঃ-নদীর ক্ষেত্রে এখনো অববাহিকা ভিত্তিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার সেরকম কোন দৃষ্টান্ত দক্ষিণ এশিয়ায় নেই।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (জে আর সি)চুক্তি স্বাক্ষরের পর গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তির সাফল্য ও ব্যর্থতা পর্যালোচনা করার জন্য দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর পরিমাপকৃত প্রবাহের উপর ভিত্তি করে গঙ্গা চুক্তির সার্বিক বিশ্লেষন, পর্যালোচনা ও প্রকাশ করার বিধান রয়েছে। যদিও এরি মধ্যে চুক্তি সংঘটনের ১৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে তার পরেও যৌথ নদী কমিশনের পক্ষ থেকে গঙ্গা চুক্তির সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে সার্বিক কোন বিশ্লেষন প্রকাশিত হয়নি বা জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন কোন পর্যালোচনা সংঘটিত না হলে এই চুক্তি ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকবে এবং মেয়াদ শেষ হবার পর দুই পক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে নবায়ন হবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো গঙ্গা চুক্তির সাফল্য ও ব্যার্থতা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসেছে। বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে বিগত পনের বছরের মধ্যে ১২ বছরই বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যয্য হিস্যা পায়নি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংবাদ মাধ্যমের এইসব তথ্য বা প্রতিবেদন দীর্ঘ মেয়াদী উপাত্ত বিশ্লেষনের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়না। যেহেতু গঙ্গা চুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুতুত্ত্বপূর্ন, সেহেতু সঠিক উপাত্তের উপর নির্ভর করে গঙ্গা চুক্তির সাফল্য ও ব্যর্থতা নিরূপন করা উচিৎ।
মুল আলোচনায় যাবার আগে গঙ্গা চুক্তির পানিবন্টন সমীকরণ একটু জেনে নেয়া যাক। এই পানিবন্টন চুক্তি প্রতি বছর ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ মে পর্যন্ত কার্যকর থাকে এবং পানিবন্টন হয় ১০ দিন ভিত্তিক, অর্থাৎ একটি মাসকে তিনটি ভাগে ভাগ করে ১০ দিনের গড় প্রবাহ অনুযায়ী চুক্তি অবলোকন করতে হয়। চুক্তি অনুযায়ীঃ প্রবাহ যদি ৭৫,০০০ কিউসেকের বেশি হয় তাহলে ভারত পাবে ৪০,০০০ কিউসেক আর বাদবাকী পানি পাবে বাংলাদেশ; প্রবাহ যদি ৭০,০০০ থেকে ৭৫,০০০ এর মধ্যে হয় তাহলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫,০০০ কিউসেক আর বাদবাকী পানি পাবে ভারত; প্রবাহ যদি ৭০,০০০ এর কম হয় সেক্ষেত্রে দুই দেশ সমভাবে পানি ভাগ করে নিবে। তবে যেহেতু শুষ্ক মৌসুমে দুই দেশেই পানির প্রয়োজন বেশি তাই প্রবাহ ৭০,০০০ এর চেয়ে কমে গেলেও ১১-২০ মার্চ, ১-১০ এপ্রিল, ও ২১-৩০ এপ্রিল এই তিনটি সময়ে বাংলাদেশ ৩৫,০০০ কিউসেক পানি গ্যারান্টি সহকারে পাবে; পক্ষান্তরে ২১-৩০ মার্চ, ১১-২০ এপ্রিল ও ১-১০ মে এই তিন সময়ে ভারত ৩৫,০০০ কিউসেক পানি গ্যারান্টি সহকারে পাবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। গঙ্গা চুক্তির এই পানিবন্টন সমীকরণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ফারাক্কায় গঙ্গার ঐতিহাসিক প্রবাহের উপর ভিত্তি করে। এই ৪০ বছরের উপাত্তের ১০ দিন ভিত্তিক গড় প্রবাহ আসলে গঙ্গা চুক্তির সমীকরণ প্রনয়ণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তাই এই চুক্তির বিশ্লেষণে এর গুরুত্ত্ব অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত এবং মূল চুক্তির সংযুক্তি-২ হিসেবে এই উপাত্ত চুক্তির একটি অংশও।
আমরা যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত গত চার বছরে(২০০৮-২০১১) দুইটি স্থানের (পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা পয়েন্ট ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্ট)পরিমাপকৃত গঙ্গার প্রবাহ এই বিশ্লেষনে ব্যবহার করেছি। গঙ্গা চুক্তির কার্যকরকাল, অর্থাৎ ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়কে মোট ১৫ টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। এই নিবন্ধে গঙ্গার প্রবাহ বিশ্লেষনের সময় মূলতঃ দুটি দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছেঃ প্রথমতঃ, প্রতিবছর এই ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে কতটি পর্যায়ে ১৯৯৬ এর চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পেয়েছে, এবং দ্বিতীয়তঃ, ফারাক্কায় গঙ্গার ঐতিহাসিক প্রবাহ (১৯৪৯-১৯৮৮) থেকে চুক্তির সমীকরণ অনুযায়ী বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রাপ্য পানির প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর এই ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে কতটি পর্যায়ে বাংলাদেশ সঠিক ভাবে পানি পেয়েছে। বাংলাদেশ গঙ্গার পানির প্রাপ্ত হিস্যা হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে যাচাই করে নেয়। এখানে উল্লেখ্য যে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ফারাক্কা ব্যারেজের ভাটিতে অবস্থিত এবং এই দুই পয়েন্টের মাঝখানে কোন শাখানদী নেই যা এই অংশ থেকে পানি সরিয়ে নিতে পারে। উপরন্তু, এই দুই পয়েন্টের মধ্যে রয়েছে মহানন্দা উপনদী, যা কিনা এই অংশে গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধি করছে। ফলশ্রুতিতে, গঙ্গার প্রবাহ হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে অবশ্যই ফারাক্কা পয়েন্টে বাংলাদেশের জন্য ছেড়ে দেয়া পানির চেয়ে অধিক হবে। এছাড়া গঙ্গা চুক্তির ধারা-৩ অনুযায়ী ফারাক্কা পয়েন্টে ছেড়ে দেয়া পানি থেকে ভারত সর্বোচ্চ ২০০ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে। তাই যুক্তিসংগত ভাবে আমাদের বিশ্লেষনে আমরা ধরে নিয়েছি যে, হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহ ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহের চেয়ে অধিক হবে। ঐতিহাসিক প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে আমাদের এই ধারনা আরো পাকাপোক্ত হয়।
২০০৮, ২০০৯ ও ২০১১ সালের গঙ্গার প্রবাহের উপাত্ত বিশ্লেষন করে দেখা যায় যে প্রতিবছর ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে ১২ টি পর্যায়ে বাংলাদেশ গঙ্গার ন্যায্য হিস্যা পেয়েছে। অর্থাৎ, ঐ তিন বছরে শতকরা ২০ ভাগ সময়ে বাংলাদেশ হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কম পানি পেয়েছে। ২০১০ সালে পরিস্থিতি আরো নাজুক ছিল কারন ঐ বছর ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে মাত্র ৯ টি পর্যায়ে বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যা পেয়েছে, যা কিনা নিশ্চিত ভাবেই শতকরা ৪০ ভাগ সময়ে গঙ্গা চুক্তির লংঘন নির্দেশ করে। সার্বিক ভাবে এই চার বছরের উপাত্ত বিশ্লেষন করে একথা প্রমানিত হয় যে, গত চার বছরে গড়ে শতকরা ২৫ ভাগ সময়ে বাংলাদেশ হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কাতে ছেড়ে দেয়া পানির চেয়ে কম পানি পেয়েছে।
অন্যদিকে, ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ বিবেচনা করলে দেখা যায় ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে মাত্র ২ টি পর্যায়ে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহ ’৯৬ এর চুক্তিতে উল্লেখিত ঐতিহাসিক প্রবাহের সমান বা বেশি ছিল। ২০১০ সালে ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে কোন পর্যায়েই হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহ উল্লেখিত ঐ ঐতিহাসিক প্রবাহের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি এবং ২০১১ সালে ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে মাত্র পাঁচটি পর্যায়ে ’৯৬ এর চুক্তিতে উল্লেখিত ঐতিহাসিক প্রবাহ অনুযায়ী বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পেয়েছে। সার্বিক ভাবে বলা যায়, ২০০৮-২০১১ এই সময়ের মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ সময়ে ফারাক্কাতে গঙ্গার প্রবাহ ১৯৪৮-১৯৮৮ সালের গড় প্রবাহের চেয়ে কম ছিল। এই বিশ্লেষন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, গত চার বছরে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গায় প্রবাহ ঐতিহাসিক প্রবাহের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে যা কিনা প্রকারান্তরে গঙ্গা চুক্তির লংঘন বলে বিবেচনা করা যায়, কারন চুক্তির পানিবন্টন সমীকরন আদতে এই ঐতিহাসিক প্রবাহের ভিত্তিতেই নির্নীত হয়েছে।
গঙ্গাচুক্তি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার অন্তর্ভূক্ত দেশসমুহের মধ্যে পানিবন্টনের ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে পারে। গঙ্গাচুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন তাই বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ। এছাড়া এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং নদী অববাহিকার বাস্তুসংস্থানের যথাযথ পরিবেশ নির্ভর করছে এই চুক্তির সফল বাস্তবায়নের উপর।সাম্প্রতিক সময়ে এই চুক্তির বাস্তবায়ন সত্যিকার অর্থে যেভাবে হবার কথা ছিল সেরকম ভাবে হচ্ছেনা। সফল বাস্তবায়ন তো দূরের কথা উপরন্তু গত চার বছরে শতকরা ২৫ ভাগ সময়ে বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী কম পানি পেয়েছে। এছাড়া, গঙ্গা চুক্তি নির্নীত হয়েছে ফারাক্কাতে গঙ্গার ঐতিহাসিক গড় প্রবাহের উপর ভিত্তি করে, যদিও ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে আজ পর্যন্ত ফারাক্কাতে গঙ্গার প্রবাহ উল্লেখিত ঐ ঐতিহাসিক প্রবাহের কাছাকাছি পৌঁছেছে খুব কম সময়েই; এর আংশিক কারন হতে পারে ফারাক্কার উজানে গঙ্গা বা এর উপনদী গুলোর পানির অধিক প্রত্যাহার। আমরা আশা করি যেসব উপাদানগুলি ফারাক্কাতে গঙ্গার পানি হ্রাস পাওয়াতে ভুমিকা রাখছে এবং প্রকারান্তরে তা গঙ্গা চুক্তির বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে ভারত সরকার সেদিকে দৃষ্টিপাত করবে, এবং সেই সাথে চুক্তির সফল বাস্তবায়নের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে যাতে করে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার নতূন দীগন্ত উন্মোচিত হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৭ টি আন্তঃসীমান্ত নদী প্রবাহমান থাকলেও ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তিই এই দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যে আন্তঃ-নদীর পানিবন্টনের একমাত্র উদাহরন। সঙ্গত কারণেই, এই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন দুই দেশের জন্যই গুরুত্ত্বপূর্ন।গঙ্গার পানি প্রবাহ আর এর অববাহিকা বিধৌত পলি যেমন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত চার কোটি মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় তেমনি তা এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের সার্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশগত ভারসাম্যের জন্যও গুরুত্ত্বপূর্ন। বিশেষত, সুন্দরবনের মত একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের টিকে থাকা নির্ভর করছে গঙ্গা এবং তার শাখা নদী সমূহের যথাযথ প্রবাহের উপর। গঙ্গা অববাহিকা নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে বিস্তৃত। আর তাই সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপটে এই অববাহিকার সকল অংশীদারদের পরিকল্পনা হওয়া উচিৎ পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রকে সমুন্নত রেখে গঙ্গার পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে এইযে আন্তঃ-নদীর ক্ষেত্রে এখনো অববাহিকা ভিত্তিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার সেরকম কোন দৃষ্টান্ত দক্ষিণ এশিয়ায় নেই।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (জে আর সি)চুক্তি স্বাক্ষরের পর গঙ্গা পানিবন্টন চুক্তির সাফল্য ও ব্যর্থতা পর্যালোচনা করার জন্য দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর পরিমাপকৃত প্রবাহের উপর ভিত্তি করে গঙ্গা চুক্তির সার্বিক বিশ্লেষন, পর্যালোচনা ও প্রকাশ করার বিধান রয়েছে। যদিও এরি মধ্যে চুক্তি সংঘটনের ১৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে তার পরেও যৌথ নদী কমিশনের পক্ষ থেকে গঙ্গা চুক্তির সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে সার্বিক কোন বিশ্লেষন প্রকাশিত হয়নি বা জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন কোন পর্যালোচনা সংঘটিত না হলে এই চুক্তি ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকবে এবং মেয়াদ শেষ হবার পর দুই পক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে নবায়ন হবে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো গঙ্গা চুক্তির সাফল্য ও ব্যার্থতা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসেছে। বিভিন্ন সময় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে বিগত পনের বছরের মধ্যে ১২ বছরই বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যয্য হিস্যা পায়নি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংবাদ মাধ্যমের এইসব তথ্য বা প্রতিবেদন দীর্ঘ মেয়াদী উপাত্ত বিশ্লেষনের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়না। যেহেতু গঙ্গা চুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুতুত্ত্বপূর্ন, সেহেতু সঠিক উপাত্তের উপর নির্ভর করে গঙ্গা চুক্তির সাফল্য ও ব্যর্থতা নিরূপন করা উচিৎ।
মুল আলোচনায় যাবার আগে গঙ্গা চুক্তির পানিবন্টন সমীকরণ একটু জেনে নেয়া যাক। এই পানিবন্টন চুক্তি প্রতি বছর ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ মে পর্যন্ত কার্যকর থাকে এবং পানিবন্টন হয় ১০ দিন ভিত্তিক, অর্থাৎ একটি মাসকে তিনটি ভাগে ভাগ করে ১০ দিনের গড় প্রবাহ অনুযায়ী চুক্তি অবলোকন করতে হয়। চুক্তি অনুযায়ীঃ প্রবাহ যদি ৭৫,০০০ কিউসেকের বেশি হয় তাহলে ভারত পাবে ৪০,০০০ কিউসেক আর বাদবাকী পানি পাবে বাংলাদেশ; প্রবাহ যদি ৭০,০০০ থেকে ৭৫,০০০ এর মধ্যে হয় তাহলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫,০০০ কিউসেক আর বাদবাকী পানি পাবে ভারত; প্রবাহ যদি ৭০,০০০ এর কম হয় সেক্ষেত্রে দুই দেশ সমভাবে পানি ভাগ করে নিবে। তবে যেহেতু শুষ্ক মৌসুমে দুই দেশেই পানির প্রয়োজন বেশি তাই প্রবাহ ৭০,০০০ এর চেয়ে কমে গেলেও ১১-২০ মার্চ, ১-১০ এপ্রিল, ও ২১-৩০ এপ্রিল এই তিনটি সময়ে বাংলাদেশ ৩৫,০০০ কিউসেক পানি গ্যারান্টি সহকারে পাবে; পক্ষান্তরে ২১-৩০ মার্চ, ১১-২০ এপ্রিল ও ১-১০ মে এই তিন সময়ে ভারত ৩৫,০০০ কিউসেক পানি গ্যারান্টি সহকারে পাবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। গঙ্গা চুক্তির এই পানিবন্টন সমীকরণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ফারাক্কায় গঙ্গার ঐতিহাসিক প্রবাহের উপর ভিত্তি করে। এই ৪০ বছরের উপাত্তের ১০ দিন ভিত্তিক গড় প্রবাহ আসলে গঙ্গা চুক্তির সমীকরণ প্রনয়ণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তাই এই চুক্তির বিশ্লেষণে এর গুরুত্ত্ব অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত এবং মূল চুক্তির সংযুক্তি-২ হিসেবে এই উপাত্ত চুক্তির একটি অংশও।
আমরা যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত গত চার বছরে(২০০৮-২০১১) দুইটি স্থানের (পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা পয়েন্ট ও বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্ট)পরিমাপকৃত গঙ্গার প্রবাহ এই বিশ্লেষনে ব্যবহার করেছি। গঙ্গা চুক্তির কার্যকরকাল, অর্থাৎ ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়কে মোট ১৫ টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। এই নিবন্ধে গঙ্গার প্রবাহ বিশ্লেষনের সময় মূলতঃ দুটি দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছেঃ প্রথমতঃ, প্রতিবছর এই ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে কতটি পর্যায়ে ১৯৯৬ এর চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পানি পেয়েছে, এবং দ্বিতীয়তঃ, ফারাক্কায় গঙ্গার ঐতিহাসিক প্রবাহ (১৯৪৯-১৯৮৮) থেকে চুক্তির সমীকরণ অনুযায়ী বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রাপ্য পানির প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর এই ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে কতটি পর্যায়ে বাংলাদেশ সঠিক ভাবে পানি পেয়েছে। বাংলাদেশ গঙ্গার পানির প্রাপ্ত হিস্যা হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে যাচাই করে নেয়। এখানে উল্লেখ্য যে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ফারাক্কা ব্যারেজের ভাটিতে অবস্থিত এবং এই দুই পয়েন্টের মাঝখানে কোন শাখানদী নেই যা এই অংশ থেকে পানি সরিয়ে নিতে পারে। উপরন্তু, এই দুই পয়েন্টের মধ্যে রয়েছে মহানন্দা উপনদী, যা কিনা এই অংশে গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধি করছে। ফলশ্রুতিতে, গঙ্গার প্রবাহ হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে অবশ্যই ফারাক্কা পয়েন্টে বাংলাদেশের জন্য ছেড়ে দেয়া পানির চেয়ে অধিক হবে। এছাড়া গঙ্গা চুক্তির ধারা-৩ অনুযায়ী ফারাক্কা পয়েন্টে ছেড়ে দেয়া পানি থেকে ভারত সর্বোচ্চ ২০০ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে। তাই যুক্তিসংগত ভাবে আমাদের বিশ্লেষনে আমরা ধরে নিয়েছি যে, হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহ ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহের চেয়ে অধিক হবে। ঐতিহাসিক প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে আমাদের এই ধারনা আরো পাকাপোক্ত হয়।
২০০৮, ২০০৯ ও ২০১১ সালের গঙ্গার প্রবাহের উপাত্ত বিশ্লেষন করে দেখা যায় যে প্রতিবছর ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে ১২ টি পর্যায়ে বাংলাদেশ গঙ্গার ন্যায্য হিস্যা পেয়েছে। অর্থাৎ, ঐ তিন বছরে শতকরা ২০ ভাগ সময়ে বাংলাদেশ হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কম পানি পেয়েছে। ২০১০ সালে পরিস্থিতি আরো নাজুক ছিল কারন ঐ বছর ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে মাত্র ৯ টি পর্যায়ে বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যা পেয়েছে, যা কিনা নিশ্চিত ভাবেই শতকরা ৪০ ভাগ সময়ে গঙ্গা চুক্তির লংঘন নির্দেশ করে। সার্বিক ভাবে এই চার বছরের উপাত্ত বিশ্লেষন করে একথা প্রমানিত হয় যে, গত চার বছরে গড়ে শতকরা ২৫ ভাগ সময়ে বাংলাদেশ হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কাতে ছেড়ে দেয়া পানির চেয়ে কম পানি পেয়েছে।
অন্যদিকে, ঐতিহাসিক গড় প্রবাহ বিবেচনা করলে দেখা যায় ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে মাত্র ২ টি পর্যায়ে হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহ ’৯৬ এর চুক্তিতে উল্লেখিত ঐতিহাসিক প্রবাহের সমান বা বেশি ছিল। ২০১০ সালে ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে কোন পর্যায়েই হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পয়েন্টে গঙ্গার প্রবাহ উল্লেখিত ঐ ঐতিহাসিক প্রবাহের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি এবং ২০১১ সালে ১৫ টি পর্যায়ের মধ্যে মাত্র পাঁচটি পর্যায়ে ’৯৬ এর চুক্তিতে উল্লেখিত ঐতিহাসিক প্রবাহ অনুযায়ী বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা পেয়েছে। সার্বিক ভাবে বলা যায়, ২০০৮-২০১১ এই সময়ের মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ সময়ে ফারাক্কাতে গঙ্গার প্রবাহ ১৯৪৮-১৯৮৮ সালের গড় প্রবাহের চেয়ে কম ছিল। এই বিশ্লেষন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, গত চার বছরে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গায় প্রবাহ ঐতিহাসিক প্রবাহের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে যা কিনা প্রকারান্তরে গঙ্গা চুক্তির লংঘন বলে বিবেচনা করা যায়, কারন চুক্তির পানিবন্টন সমীকরন আদতে এই ঐতিহাসিক প্রবাহের ভিত্তিতেই নির্নীত হয়েছে।
গঙ্গাচুক্তি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার অন্তর্ভূক্ত দেশসমুহের মধ্যে পানিবন্টনের ক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে পারে। গঙ্গাচুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন তাই বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ। এছাড়া এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং নদী অববাহিকার বাস্তুসংস্থানের যথাযথ পরিবেশ নির্ভর করছে এই চুক্তির সফল বাস্তবায়নের উপর।সাম্প্রতিক সময়ে এই চুক্তির বাস্তবায়ন সত্যিকার অর্থে যেভাবে হবার কথা ছিল সেরকম ভাবে হচ্ছেনা। সফল বাস্তবায়ন তো দূরের কথা উপরন্তু গত চার বছরে শতকরা ২৫ ভাগ সময়ে বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী কম পানি পেয়েছে। এছাড়া, গঙ্গা চুক্তি নির্নীত হয়েছে ফারাক্কাতে গঙ্গার ঐতিহাসিক গড় প্রবাহের উপর ভিত্তি করে, যদিও ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে আজ পর্যন্ত ফারাক্কাতে গঙ্গার প্রবাহ উল্লেখিত ঐ ঐতিহাসিক প্রবাহের কাছাকাছি পৌঁছেছে খুব কম সময়েই; এর আংশিক কারন হতে পারে ফারাক্কার উজানে গঙ্গা বা এর উপনদী গুলোর পানির অধিক প্রত্যাহার। আমরা আশা করি যেসব উপাদানগুলি ফারাক্কাতে গঙ্গার পানি হ্রাস পাওয়াতে ভুমিকা রাখছে এবং প্রকারান্তরে তা গঙ্গা চুক্তির বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে ভারত সরকার সেদিকে দৃষ্টিপাত করবে, এবং সেই সাথে চুক্তির সফল বাস্তবায়নের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে যাতে করে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার নতূন দীগন্ত উন্মোচিত হয়।
লেখক পরিচিতিঃ
জাহিদুল ইসলামঃ পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টা, কানাডা।
বিদ্রঃ লেখাটি ১০ জুলাই ২০১২ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে।
লিঙ্কঃ এইখানে