বুধবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

সোহেল তোকে ভুলবনা বন্ধু, কখনো ভুলতে পারবনা

আজ ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০০৯। আজ থেকে ১১ বছর পূর্বে এই দিনে আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের প্রিয় বন্ধু সোহেলকে। বুয়েট ’৯৬ এর পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের ছাত্র ছিল সোহেল। ওর স্মরণেই আজকে আমার এই লেখা

দিনটা ১৯৯৭ সালের ৩১ শে অগাস্ট, আমাদের বুয়েটে জীবনের প্রথম ক্লাশ।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাশ নিয়ে আমার হাজারটা স্বপ্ন ছিল তার কোনটারই বাস্তবায়ন না হয়ে নিরস পদার্থবিদ্যার জনৈক অধ্যাপিকার কাটখোট্টা লেকচার গিলছিলাম এবং মনে মনে ৫০ মিনিটের ক্লাশ কখন শেষ হবে তাই ভাবছিলাম।অবশেষে ক্লাস শেষ হল, আমরা ১০ মিনিট সময় পেলাম নিজেদের মধ্যে পরিচিত হতে। প্রাথমিক পরিচয়টা যেমন হয় গতানুগতিক নাম ধাম আর কলেজের পরিচয় দিয়েই আলোচনা শুরু হয়। সারা ক্লাসে আমার পূর্ব পরিচিত মাত্র একজন এহসান, কারন দুজনেই নটরডেম কলেজে ছিলাম।যাই হোক প্রথম দিনের ক্লাসে ফাঁকে ফাঁকে এবং সব ক্লাস শেষে মোটামুটি অনেকের সাথেই পরিচয় হল, কিছুটা আড্ডাও জমল ক্যাফেটেরিয়াতে। এরকমই কোন এক আড্ডার ফাঁকে পরিচয় সোহেলের সাথে। বেশ দীর্ঘাকায় দেখতে ছেলেটি, খুবি সাধাসিধে এবং মিশুক।অল্প কয়েকদিনেই আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ত হয়ে গেল। আমি তখনো হলে সিট পাইনি, থাকি আহসানউল্লাহ হলে আমার এক বড় ভাই এর রুমে। হঠাৎ একদিন আমার সেই ভাইএর রুমে এসে হাজির সোহেল, শারিফ, সুমন আর ফুলকাম। ততদিনে আমাদের মধ্যে সম্মোধন তুমির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে তুই এ এসে পৌঁছেছে। সোহেল বলল ‘হলের জঘন্য খাবার খেতে খেতে বিরক্ত। চল আজ বাইরে কোথাও খেয়ে আসি’। সত্যি কথা বলতে ততদিনে আমরা আসলেই হাঁপিয়ে উঠেছি হলের একঘেয়েমি খাবার দাবারে। চারজন মিলে গেলাম মিরপুরের দিকে এক চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে, সেখানে খাওয়া দাওয়া আর জম্পেশ আড্ডা। এভাবেই আস্তে আস্তে বন্ধু হিসেবে সোহেল আমাদের কাছে কিছুদিনেই বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছিল। ওর সারল্য, অল্পতেই আড্ডা জমিয়ে দেয়া কিংবা পড়াশুনাতে সহযোগীতা আমাদেরকে মুগ্ধ করত। আমার মনে আছে 'পূর কৌশল ড্রয়িং' নিয়ে আমরা রীতিমত সপ্তাহের বন্ধের দিনগুলি রশিদ হলে কাটিয়ে দিলাম সোহেলের রুমে। ধীরে ধীরে কেটে গেল ১৪ টি সপ্তাহ এবং ঘনিয়ে আসল টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা। আমার মনে আছে সময়টা জানুয়ারী, প্রচন্ড ঠান্ডা পরেছিল সেইবার। যাইহোক টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে আমরা সবাই গিয়েছ যার যার বাড়িতে। প্রায় এক মাস ছুটি কাটিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসলাম ফেব্রুয়ারীর শেষের সপ্তাহে সম্ভবত ২০ তারিখের দিকে। ততদিনে আমি আমার নিজের হল নজরুল ইসলাম হল ওরফে ‘বয়লার’ এ উঠে গিয়েছি। লোক মুখে শূনা যাচ্ছে তার পরের দিন আমাদের ফলাফল বেরূবে। সন্ধ্যার দিকে বের হয়েছি, আলমের দোকানে নাস্তা করে আহসানউল্লাহ হলের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, গন্তব্য তিতুমীর হল কিংবা রশিদ হল। হঠাৎ আমাদের ব্যাচেরই এক ছেলের সাথে দেখা। যতদূর মনে পড়ে তৌহিদ, তড়িৎ কৌশলের।

‘কিরে খবর শুনেছিস?’

আমি নির্বিকার ভাবে উত্তর দেই কি ফলাফলের কথা জিজ্ঞেস করছিস? পোলাপান বলা বলি করছে কালকে দিবে।

‘না সেহেলের খবর জানিস?’

সোহেল, হ্যা ওর ত আজকে আসার কথা, আমিত খোঁজ নিতে যাচ্ছি ওইদিকেই ।

‘ও আর কোনদিনই আসবেনা’

আমি বলি তার মানে ?

‘জাহিদ সোহেল আর নেই, আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক দূরে’


আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা,আমাদের সোহেল নেই ! আমাদের প্রিয় বুন্ধুটি আর কোনদিন আমাদের সাথে আড্ডা দিবেনা, আর কখনো এসে বলবেনা ‘চল বাইরে খেয়ে আসি, হলের খাবার অসহ্য লাগছে’। আমি নিজে কে সামলে নেবের চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা। ততক্ষনে ব্যাচের যারা হলে থাকে প্রায় সবাই জেনে গেছে। আমি আস্তে আস্তে তিতুমীর হলের দিকে যাই। সেখানে দেখা হয় এহসান, ফুলকাম, খালিদ, শরীফ আরও অনেকের সাথে। সবার চোখ সিক্ত, প্রিয় বন্ধুকে হারানোর বেদনায় সবাই আমরা আবেগে আপ্লুত। তৌহিদ আস্তে আস্তে আমাদেরকে সব কিছু জানায়। কিছুদিন আগে সোহেলের জন্ডিস হয়েছিল। বিলুরুবিন এর মাত্রাটা খানিকটা বেশিই ছিল।ওর পরিবারের ভাস্য মতে ডাক্তারদের অসতর্কতা আর খানিকটা ভুল চিকিৎসার খেসারত দিয়ে হয় সোহেলকে তার জীবন দিয়ে। আমার তখনও সব কিছু বিশ্বাস হচ্ছেনা, বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে আগের স্মৃতি গুলো, কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা ওর মৃত্যুকে। মাত্র চার মাসের পরিচয় ছিল সোহেলের সাথে আমাদের কিন্তু এই চার মাসেই সোহেল আমাদের কাছে হয়ে উঠেছিল অনেক কাছের একজন মানুষ। আমার মনে আছে সোহেল আমাকে একদিন বলছিল ওর পছন্দের একজন মানুষের কথা, যাকে সোহেল ভালবাসত কিন্তু কখনো বলতে পারেনি। আমাকে বলেছিল এইবার বাড়িতে যেয়ে মেয়েটিকে জানাবে তার পছন্দের কথা। সোহেল কি পেরেছিল তাকে জানাতে?


আমাদের ক্লাস শুরু হল কয়েকদিন পরে। আমরা কয়েকজন মিলে ভাবলাম একবার ঘুরে আসি সোহেলদের বাড়ি থেকে। ওর মার হয়ত আমাদেরকে দেখে তার ছেলের কথা মনে পড়বে। আমি, এহসান, শরীফ আর ফুলকাম মিলে রওনা হলাম দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে। তখন যমুনা সেতু হয়নি সুতরাং ট্রেন, ফেরী আবার ট্রেন ধরে আমরা সারা রাত জেগে সকালের দিকে পৌছলাম দিনাজপুর শহরে। আমার মনে আছে দিনটা ছিল শুক্রবার। প্রায় নিস্তব্ধ একটা বাড়িতে আমরা বাইরের দরজায় কড়া নারলাম। দরজা খুলে বের হয়ে আসলেন একজন মধ্যবয়সী মানুষ। পরিচয় হল, সোহেলের মামা। আসলে সোহেল ছোট বেলায় ওর বাবাকে হারিয়েছে। ওর মা ওদের দুই ভাইকে নিয়ে ওদের মামার বাসায় থাকত। আমরা চারজন ওদের বাইরের ঘরে বসে আছি। মনে পড়ছে সোহেল একদিন বলেছিল পরের পরীক্ষার বন্ধে আমাদেরকে নিয়ে ওদের বাসায় যাবে। সোহেল, আজ আমরা তোর বাসায় এসেছি অথচ তুই নেই সেখানে। আমরা হাত মুখ ধুয়ে সোহেলের মাকে দেখতে গেলাম। শোকে প্রায় পাথর একজন মা, আমাদেরকে দেখে আর তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি সেদিন, সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। বার বার সোহেলের আগের দিনের কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন তিনি, সোহেল কিভাবে খেত, কিভাবে মায়ের কোলে শুয়ে থাকত , কি খেতে পছন্দ করত। আমরাও নিজেদেরকে সামলাতে পারলামনা কিছুতেই।


শুক্রবারের নামাজ পড়ে আমরা চারজন আর সোহেলের দুই মামা গেলাম সেখানে, যেখানে সোহেলকে রেখে আসা হয়েছে চিরজীবনের জন্য। আস্তে আস্তে ওর কররের পাশে দাঁড়ালাম, আমার চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, আমি থামাতে পারছিনা। আমার চোখের সামনে ভেসে আসছে আগের দিনের স্মৃতিগুলো, জীবন এত ছোট ! ওর কবরের ধারে বসে পড়ে ফিসফিস করে বললাম ‘সোহেল তোকে ভুলবনা বন্ধু, কখনো ভুলতে পারবনা’। আসলেই আমরা সোহেলকে ভুলতে পারিনি আজো এই ১২ বছর পরেও আজো তোকে মনে পড়ে, অন্তত এই দিনটাতে। সোহেলের স্মৃতি কে অমর করে রাখার জন্য বুয়েট ’৯৬ ব্যাচের স্যুভেনীর প্রকাশনা উৎসর্গ করা হয়েছিল সোহেলের নামে।