বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০১৩

আমাদের আনন্দবাড়ি

দেশ ছাড়ার আগে এনটিভিতে একটি সিরিজ নাটক দেখতাম, আমাদের আনন্দবাড়ী। মন খারাপ করা একটা নাটক, তারপরেও দেখতাম। কিভাবে যৌথ পরিবার গুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে সেই নিয়ে গল্প। নাটকটির শেষ পর্ব আরো মন খারাপ করা। সবাই একেক দিকে চলে যায়, যৌথ বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলা হয় নতুন কোন উঁচু এপার্টমেন্ট গড়ার জন্য। রাস্তা দিয়ে সেই বাড়ির মেয়েটি একা একা হাঁটতে হাঁটতে একরকম দম বন্ধকরা কষ্টকর অনুভূতি নিয়ে নাটকটি শেষ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার আনন্দবাড়ী বলতে ছিল আমার হল, আমার ক্যাম্পাস। আমাদের আড্ডামুখর সেই সময়গুলি হারিয়ে গেছে, আমরা চলে গেছি একেক জন একেক দিকে। আমাদের আনন্দবাড়িটি অবশ্য ভেঙে ফেলা হয়নি, তবে সেখানে এসেছে নতুন মুখ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রেডের শেষ দিনগুলিতে সবসময় হাতে ছোট একটা মেরুণ রঙের বাধাই করা ডায়েরী নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। হাতের কাছে প্রিয় বন্ধু, বন্ধুপ্রতীম অনুজ বা অগ্রজ যাদেরকেই পেতাম ডায়েরীটা বাড়িয়ে দিতাম কিছু কথা লিখে দেবার জন্য। কেউ নিছক শুভকামনা লিখে দিত, আবার কেউ লিখত খুব আবেগ নিয়ে কিছু, কিংবা নস্টালজিক কোন স্মৃতিকথা। কেউ লিখত বাংলায়, কেউবা ইংরেজীতে। এই দশ বছরে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে কিন্তু হারায়নি সেই ডায়েরিটা। প্রিয় দেশ, প্রিয় ক্যাম্পাস থেকে অনেক অনেক দূরে থেকেও মাঝে মাঝেই নিয়ে সেই ডায়েরীটা নিয়ে বসি। মনটা খুব খারাপ থাকলে কখনো কখনো কিছু কিছু লেখা সেখান থেকে পড়ি। কখনো মন ভাল হয়, কখনো চোখ ছাপিয়ে কান্না আসে। তারপরেও সেটা সাথে রাখি। 


আমার বুয়েট জীবনের পুরো সময়টাই কেটেছে বয়লার খ্যাত নজরুল ইসলাম হলে। চার বছরের একাডেমিক জীবনের প্রথম দুই বছর ছিলাম চারতলায় ৪২৯ নামের রুমটাতে, এর পরের দুই বছর প্রমোশন পেয়ে দুতলার পূর্বপাশের শেষ রুম, ২০১/ক তে। আমাদের পাশের রুমে, মানে ২০১ তে থাকত আদিত্য নামের ’৯৮ ব্যাচের একজন। ওকে একদিন ডায়েরীটা দিয়ে বললাম, আদিত্য, তোমাদের সাথে অনেক স্মৃতি, তার কিছুটা এই ডায়েরীতে তুলে দিও। আদিত্য ডায়েরীটা নিয়ে গেল ওর সাথে। এর কিছুক্ষন পরে আমার রুমে এসে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা ভাইয়া আপনার রুমের পাশের ঐ গাছটার নাম কি? আমি বেশ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। তবে চেষ্টা করেও গাছের নামটা বলতে পারলামনা।পরের দিন আদিত্য ডায়েরীটা নিয়ে আসল। আমি পড়তে বসলাম, 

 ...আপনাকে ভীষণ মিছ করবে জানালার পাশের শিরিষ গাছটা, লম্বা করিডোরটা আর বোকা বোকা চেহারার পুরনো হলটা; আমি মিছ করব উঁচু গলার রবীন্দ্রনাথের গানগুলো আর ভয়ঙ্কর সুন্দর একজন প্রগতিশীল মানুষকে ...প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার বিকাশ ঘটুক পরিপূর্ণভাবে ... এই মঙ্গল কামনায় ...
আপনার উপস্থিতিতে গর্বিত আশীর্বাদপ্রার্থী ছোট ভাই  -আদিত্য

আমি লেখাটা বেশ কয়েকবার পড়লাম। তখন এমনিতেই র‍্যাগের সময়, কারনে অকারণে চোখ ভিজে আসে। সেই বিষন্ন বিকেলে আরেকবার চোখে পানি এল। আদিত্যের লেখাতেই নিজের বদভ্যেসটা আবার মনে পড়ল। সবসময় হলে সিড়ি দিয়ে উঠে করিডোরটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হেড়ে গলায় গান ধরতাম। এর জন্য বেশ কয়েকবার বড় ভাইয়াদের অল্প-বিস্তর বকা ঝকাও খেয়েছি, কিন্তু বদঅভ্যেস যায়নি। সেই মন খারাপ করা বিকেলটাতে আমি অনেকক্ষণ বোকা বোকা চেহারার হলটির এক কোণের স্যাঁতস্যাতে রুমটাতে বসে থাকলাম। আদিত্যর সাথে দেখা হয়নি দশ বছর, কোথায় আছে জানিনা। 

আমি সারাজীবন আড্ডাবাজ একজন মানুষ। বাবার বদঅভ্যেসটা নিজের মধ্যে দেখে মাঝে মাঝে গর্বে বুকের ছাতি ফুলে উঠত। বুয়েটে হলে উঠার পরেই যখন দেখলাম এক রুমে একই ব্যাচের তিনজন, তখন খুশিতে আটখানা। সারা হলে ব্যাচ ‘৯৬ এর তিনজনের এক রুম খুব বেশি ছিলনা, তাই বেশ কয়েক দিনের মধ্যেই আমাদের রুমটা হয়ে উঠল ব্যাচের আড্ডার আদর্শ একটা জায়গায়। যদিও এক ব্যাচের তিনজনের খুব বেশিদিন থাকা হলোনা। আমাদের আড্ডাতে অতিষ্ট হয়ে আমাদের রুমমেট সেলিম এক বা দুই টার্ম পরেই রুম পরিবর্তন করল, আমাদের নতুন রুমমেট হয়ে আসল সঞ্চয় নামে ব্যাচ ’৯৭ এক ছেলে। চিকন চাকন লম্বা গোছের ছেলেটিকে দেখে প্রথমে ভাবলাম কেমন হবে, আড্ডাবাজ না হলেতো সমস্যা। উঠার পরে দেখলাম আড্ডাবাজিতে ও আমাদের থেকে দুইধাপ এগিয়ে। আমাদের জমে গেল। সঞ্চয় গিটার নিয়ে টুংটাং বাজাতো আর আমাদের সাথে আড্ডা দিত। সঞ্চয়ের সাথে প্রায় এক বছর কাটিয়ে দিয়েছিলাম আমি, আর আমাদের আরেক বন্ধু ও রুমমেট তাবেদ। সঞ্চয় আমার ডায়েরিতে লিখেছিল, 

বলবনা বিদায়
দেখা হবেনা আবার
বলব কোন নিশ্চয়তার?

সঞ্চয়ের সাথেও দেখা হয়না দশ বছর। তবে হ্যাঁ, ভার্চুয়াল জগতে ‘ছেলের হাত ধরে অরণ্যের পথে হেঁটে চলেছে সঞ্চয়’- এই দৃশ্যটা দেখে ভাল লাগে। ঠিক যেমন এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন আমার ছেলেটাও আমার গায়ে হেলান দিয়ে পা দুলিয়ে দুলিয়ে টিভি দেখছে। 

সঞ্চয়ের মাধ্যমে ওদের ব্যাচের আরো অনেকের সাথে আড্ডা হতো। ওদের মধ্যে নোমান আমাদের রুমে প্রায়ই পিএল (প্রিপেয়ারেটরী লিভ) এর সময় আড্ডা আর পড়াশুনা করত রাত জেগে। মধ্যরাতে আমরা কখনো সবাই একসাথে রিকাশায় চেপে নিরবে বা পুরোন ঢাকার হোটেলগুলিতে খেতে যেতাম। কখনো বা অনেক বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতো। রাতভর পড়ে বা আড্ডা মেরে আমরা মাঝে মাঝে ভোর ছয়টার চানখারপুলের সোহাগে যেয়ে ভরপেট খিচুড়ী খেয়ে এসে জম্পেশ ঘুম দিতাম। বন্ধু না হয়েও আমাদের সম্পর্কগুলো ছিল বন্ধুত্ত্বের মত। নোমান আমার মেরুণ ডায়েরীটা হাতে পেয়ে লিখেছিল, 

PL এ রাতের আড্ডা আর হবেনা। সকাল ৬ টায় সোহাগে খিচুড়ী খেতে যাওয়া একসাথে হয়ত বা শেষ। কিন্তু শেষের পরেও আরও কিছু থেকে যায়। হয়তোবা শেষ থেকেই তার শুরু। সেটা আপনি যখন এই লেখাটা পড়তে শুরু করেছেন তখন থেকেই শুরু হয়েছে। শুভেচ্ছা”

নোমানের কথাগুলি মাঝে মাঝে ভাবি। শেষের পরে একটাই শুরু হয়েছে, সেটা দূরত্ব। ফেইসবুকে খুঁজে দেখলাম, নোমান এখন অস্ট্রেলিয়াতে। নোমানদের সাথেই আমাদের রুমে আড্ডা দিত পারভেজ। তখন আমার এক বিব্রতকর সময় শুরু হয়েছে। বিভাগে মেধাতালিকায় শুরুর দিকে থাকার কারনে বন্ধুরা, অনুজরা সবাই টিচার নামে ডাকা শুরু করেছে। এখন অবস্থা কি হয়েছে জানিনা, আমাদের সময়ে ক্যাম্পাসে দুইটা গোত্র ছিল এক ছাত্র, আর দুই শিক্ষক এবং এই দুই গোত্র যেন একে অপরের প্রতিপক্ষ, যার এক পক্ষ বাঁশ দেয়, আরেক পক্ষ বাঁশ খায়। এ যেন বাংলার সেই চিরায়ত বউ-শাশুড়ীর সম্পর্ক। ছাত্ররা সারাজীবন বাঁশ খেয়ে শিক্ষক হয়ে বাঁশ দিতে যায়। তার থেকেও অবাক বিষয় ছিল মাত্র এক মাস আগে যে বড়ভাইকে হলে আড্ডার ছলে পঁচানি দিতাম, ক্ষুদ্র সময়ের পরিক্রমার সেই হাস্যোজ্জ্বল ভাইয়াটিও ক্লাসে দেদারসে ঝাড়ি মারত। আমাদের জুনিয়র ব্যাচের ফয়সাল নামের এক ছেলে একদিন মুখ কালো করে এসে জানালো হলের এক বড় ভাই তাকে ভাইভাতে ব্যাপক ঝাড়ি মেরে বলেছে তোমারত বেসিকই ঠিক নাই! আমার মেরুন ডায়েরীর পাতাতেও তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই ‘টিচার’ বা ‘স্যার’ শব্দটি বেশ অনেক বারই এসেছে, কখনো অনুজদের কাছে থেকে, কখনো বা বন্ধুদের কাছ থেকে। কেউ মজা করেছে আবার কেউবা ফ্রি পেয়ে বেশ ভারী ভারী পরামর্শ দিয়েছে। পারভেজের মন্তব্যটা ছিল মজার, 

বেশি কিছু বলার নাই, কি লিখব, কি বলব, আমাদের সাথে থেকে গেলে পারতেন, পাস করায়ে দিতাম (সাথে হাসি)। টিচার হয়ে মনে রাখবেন আশা করি। মনে রেখেও  কাজ নেই, খুঁজে পাবেননা। 
পূনশ্চঃ খাওয়া বাকী রইল স্টার এ

আসলেই খুঁজে পাইনি তোমাদের কাউকে, স্টার এ আমাদের একসাথে খেতে যাওয়াও হয়নি আর কখনো। 
সঞ্চয়ের বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে মজার আর আলাদা ছিল রণ। কিছুটা পাগলাটে ধরনের বলে আমি বলতাম রণ পাগলা। রণর সাথে পরিচয়টাও বেশ মজার। পুরোনো স্মৃতি হাতড়ে যা মনে পড়ছে তাই বলি। ও হলে সিট পেয়েছিল সম্ভবত আমাদের পাশের এক রুমে। ও যেদিন হলে সব কিছু নিয়ে উঠতে এসেছে সেদিন সেই রুমে ছিল তালা। ও আমাদের রুমে এসে সাময়িক ভাবে ওর লাগেজগুলি রাখল। এক কথায় দুই কথায় আমাদের আড্ডা জমে উঠল। ওর স্কুল জীবন কেটেছিল রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে। সেখানে কিভাবে ছোটবেলায় ওদের আনন্দের, কষ্টের সময়গুলি কেটেছে তা নিয়ে গল্প করতে করতে সারারাত পার হয়ে গেল। সেই থেকে রণ আমাদের একজন। এখন ও এমেরিকাতে, মাঝে একদিন ফোনে কথাও হয়েছে। সেই আগের মতই আছে, পাগলাটে, ফেইসবুকে নাম রেখেছে ‘অস্থায়ী দর্শনার্থী’। রণ লিখেছিল, 

জাহিদ ভাই, আবার দেখা হবে। সাবধান থাইকেন !

আশা করি দেখা হবে কখনো, হয় টেক্সাসের উষ্ণ আবহাওয়ায়, কিংবা এই শ্বেতযবনের দেশে, কফির মগ হাতে নিয়ে। 

আমরা বুয়েটের একটি কালো অধ্যায়ে আমাদের আন্ডারগ্রেডের জীবন শেষ করছিলাম। আমাদের চতুর্থ বর্ষের দ্বিতীয় সেমিষ্টার শুরু হয়েছিল ২০০২ সালের এপ্রিলে আর শেষ হয়েছিল অক্টোবরে। শেষ বলতে বুঝাচ্ছি ক্লাস শেষ হওয়া। এর পরে পরীক্ষা, ফলাফল এবং হল ছাড়তে ছাড়তে ২০০৩ এর ফেব্রুয়ারী। ২০০২ সালের এপ্রিল আর অক্টোবরের মাঝে একটি দিন, ৮ জুন। দিনটি কখনই ভুলে যাবার নয় এই জীবদ্দশায়। সেদিন কি এক কারনে বুয়েটে ক্লাস হলোনা। আমরা বন্ধুরা মিলে রিকশা চেপে প্রথমে হাতিরপুলে বিগ বাইট ও পরে ইস্টার্ন প্লাজায় আড্ডা দিতে গিয়েছিলাম। ক্যাম্পাসে ফিরে এসে তিতুমীর হলে দোতালায় এক বন্ধুর রুমে টিভিকার্ড এর মাধ্যমে কম্পিউটারে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখছিলাম। হঠাৎ করে বেশ কয়েকটা কান ফাটানো শব্দ, আমাদের বুঝতে বাকী রইলনা ভয়াবহ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমার সাথে ছিল বন্ধু ওয়াসিম। আমরা দুইজন হামাগুড়ি দিয়ে রুম থেকে বারান্দায় চলে আসলাম। এসে দেখি পুরো বারান্দায় সবাই ফ্লোরে শুয়ে রয়েছে। চলতে লাগল প্রচন্ড গুলির শব্দ। আমরা আরো নিরাপদে সরে যাবার জন্য আস্তে আস্তে গড়াগড়ি দিয়ে সিড়ি বেয়ে চার চলায় উঠে গেলাম। গুলির শব্দ থেমে গেলে হলের নিচে নেমে আসলাম। বের হয়ে শুনি ’৯৯ ব্যাচের সনির গুলিতে আহত হবার কথা। আমরা বন্ধুরা সবাই চলে গেলাম ঢাকা মেডিকেলে। সনি খুব বেশিক্ষণ বেঁচে থাকেনি। এই অরাজকতার দেশটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ও চলে গিয়েছিল না ফেরার দেশে।

সনির হত্যাকান্ডের পর ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠল বুয়েট। দুই দুবার হল ভ্যাকেন্ট হলো। আমরা ব্যাচ ’৯৬ এর সবাই তাই র‍্যাগের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তারপরেও কেমন করে জানি সব কষ্ট, হতাশা ঝেড়ে সবাই র‍্যাগের উৎযাপন শুরু করল। হয়ত পৃথিবীর নিয়মটাই এরকম। আমরা র‍্যাগের জন্য টিশার্ট বানালাম, ঘোড়ার গাড়ির র‍্যালি সাজালাম, কনসার্ট আয়োজন করলাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করলাম। আমি যে সময়ের স্মৃতিচারন করছি তখন সবে বুয়েট আবার স্বাভাবিক হচ্ছে, আমাদের পরীক্ষা চলছে, বা শেষ হয়েছে এরকম। আমি আমার মেরুণ রঙের ডায়েরী নিয়ে আসলাম রিপন ভাইয়ের রুমে। ৪২৯ নাম্বার রুমে থাকার সময় পরিচয় হয়েছিল রিপন ভাইয়ের সাথে। রিপন ভাই আমাদের থেকে দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন। অসুস্থতা বা অন্য কোন কারনে উনার মাঝখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা হয়নি অনেকদিন। পরে আমাদের ব্যাচের সাথেই রিপন ভাই শেষ পর্যন্ত ছিলেন। আমার আগের রুমমেট সেলিমদের ডিপার্টমেন্টে ছিলেন বলেই আমাদের রুমে আড্ডা দিতেন, পড়তেন। রিপন ভাই ভাল কবিতা লিখতেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে রিপন ভাইয়ের লেখাগুলো ছিল তাই কাব্যের মত, 

কিংবা এইসব মিথ্যেই ভেবে দেখা,
আসলে দিনগুলি সব ক্ষণভঙ্গুর-একা!
কেউ এসে ডাক দিবে, কেউ চলে যাবে ভুলে!
দেখা হবে একদিন, হাতে-হাত আঙ্গুলে আঙ্গুলে ।।
জাহিদ, মনে রেখো।


মনে আছে রিপন ভাই আপনার সাথে আড্ডামুখর সেই সময়গুলো। হয়ত কোন একদিন ঢাকার পথে হাঁটতে হাঁটতে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে, হয়তোবা না, কে জানে!

কাব্যময় অনুভূতি ছিল শ্যামলেরও। ‘৯৯ ব্যাচের শ্যামল আমার হলের আর একই সাথে ডিপার্টমেন্টের জ্ঞাতি ভাই। পরবর্তীতে একসময় শ্যামল আমার ছাত্র হলেও ওর সাথে সম্পর্কটা সমসময়ই ছিল বেশ মজার। শ্যামল লিখেছিল,

সুন্দর স্বপ্নগুলো হোক নীলিমায় বিধৌত;
কখনো আকাশে তাকালে
যে আলোটুকু;
জোছনার দীপ্তিটুকু
তোমরা

আমার আর এক বন্ধু, তপু, খুলনার। আমাদের সাথে সিভিলে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু কেন জানি ওর ভাল লাগতনা পুরকৌশল। ক্লাস বাদ দিয়ে ও আমার নতুন করে এডমিশন টেষ্টের জন্য প্রস্তুতি শুরু করল। পরের বছর (’৯৭ ব্যাচ) ও ইলেক্ট্রিকালে চান্স পেয়ে আবার একই হলে ফিরে এসেছিল। দারুন আড্ডাবাজ একটা ছেলে। ওর ক্লাসিক পর্যায়ের জোকসগুলি ছিল বলতে গেলে আমাদের ব্যাচে আড্ডার মূল রসদ। একদিনের কথা মনে আছে। রাত ১২ টার সময় হঠাৎ করে তপুর মনে হল ক্রিকেট খেললে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা ক্রিকেট ব্যাট বল নিয়ে চলে গেলাম নজরুল ইসলাম হলের কাছে যে মসজিদ রয়েছে সেই মসজিদের সামনের রাস্তায়। রাস্তার দুপাশের ল্যাম্পপোষ্ট আমাদের ফ্লাড লাইটের কাজ করলো। খেলার ফরম্যাট হবে কিছুটা টেষ্ট ম্যাচ ধাচের। আউট হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন খেলতে পারবে। ব্যাটিং এর সময় বল উড়িয়ে মারা যাবেনা, বাউন্ডারীর বাইরে উড়ে গেলে আউট। আমরা দারুন জোশে ক্রিকেট খেলছি এরকম সময়ে মসজিদের মুয়াজ্জিন বা এরকম একজন আমাদের হট্টগোলে ঘুম ভেঙে বাইরে এসে হতভম্ব! আজ এতোবছর পরে চোখ বন্ধ করলেও সেই সময়টা মনে পড়ে। আমার ডায়েরীতে তপু লিখেছিল,

স্যার, সম্বোধনটা প্রথম ও শেষ বারের মত করলাম। শহীদ স্মৃতিতে যেয়ে আবার ভাব বাড়াবিনা। কি আর লিখবো। তবে হলে তোদের ছাড়া খুব একা একা লাগবে। আমারতো আরো এক বছর ...
ভাল থাকিস...

তপুর লেখাগুলি পড়তে যেয়ে মনে পড়ল, তখন সেই সময়ে এই কথাটা খুব চলত, ‘ভাব’। এক বড় ভাই হয়ত আকর্ষনীয় কোন বান্ধবী নিয়ে ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, পোলাপাইনের মনে হইলো ভাইয়া ভাব মারতাছে। কিংবা হলের বড় ভাই আগের মাসে মেস ম্যানেজার ছিল, পরের মাসে শীত পড়তে না পড়তে সন্ধ্যেবেলা নতুন বানানো স্যুট পড়ে যখন টিউশনিতে যেত, পোলাপাইনের মনে হত ভাইয়া ইচ্ছে করেই ভাব মারার জন্য তাদের সামনেই স্যুটের বোতাম ঠিক করছে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানানো হচ্ছে সেই সময় (হয়ত এখনো) নতুন যোগদান করা ব্যাচেলর শিক্ষকরা শহীদ স্মৃতি হলের এক ব্লকে ছোট একটি কামরা ভাড়া হিসেবে পেত। আরেক ব্লক ছিল স্নাকোত্তর শ্রেনীর ছাত্রদের জন্য। শহীদ স্মৃতি হল তাই আমাদের কাছে ছিল এক বিষ্ময়ের জায়গা যেখানে আমাদের কিছু ‘টিচার’ থাকে, যারা ঠিক রক্তমাংসের মানুষ হলেও মুখে অনেক খানি ভাব নিয়ে চলাফেরা করে। পরে অবশ্য আমার শহীদ স্মৃতি হলের সময়কালে সেটাকে হল নামের কলঙ্ক মনে হয়েছে যেখানে উঁচু ভলিউমে গান শুনলে সিনিয়র ভাইদের অহেতুক ঝাড়ি খেতে হয়, যেখানে নেই আড্ডা, নেই কোন বন্ধুত্ত্ব, যেখানে আমরা শুধুই একে অপরের সহকর্মী।  

আগেই বলেছিলাম আমি সেই সময়ে বিব্রতকর এক সময় কাটাচ্ছিলাম হবু শিক্ষকতা নিয়ে। শুভকামনার মোড়কে আমার বিভাগের এক বন্ধু, রানা, বেশ খানিকটা ভারিক্কি মার্কা তত্ত্বকথা শুনিয়ে দিল, 

বাঁশ দিয়ে জীবনটা শুরু করিসনা। ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবি। মানুষকে মানুষের মত ভালবাসতে শিখবি, ছোট, বড়, নিচু, উঁচু, সমাজের সর্বশ্রেনীর মানুষের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকার অভ্যাস মানুষকে বড় করে। শুধু লেখাপড়া শিখলেই মানুষ ভালো কিংবা মহৎ হয়ে যায়না। সর্বোপরি আধুনিক যোগাযোগের যুগে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করবি।

নাহ, বন্ধু রানার পরামর্শে নয়, নিজের আদর্শের কারনেই যতদিন শিক্ষকতা করেছি ছাত্রছাত্রীদের বন্ধুই ছিলাম। সেজন্যই হয়ত সত্যিকারের শিক্ষক হয়ে উঠা হয়নি আমার। তবে ভাবতে ভাল লাগে শিক্ষকতা ছেড়ে দেবার প্রায় সাত বছর পরে আজও আমার রয়েছে এক গাদা ভার্চুয়াল ছাত্র, যাদের অনেককেই কখনো সামনাসামনি দেখিনি, অথচ যাদের সাথে একসাথে কাজ করি, আড্ডা দেই, লেখালেখি করি, দেশ নিয়ে ভাবি। আমার সত্যিকারের শিক্ষক না হয়ে উঠার চেয়ে এটাই বা কম কিসের? 

প্রায় একই প্রসংগে ভাল লেগেছিল ’০০ ব্যাচের মৌরীর কথাগুলো, 

জাহিদ ভাই, আমাকে কিছু লিখতে বলে খুবই বিপদে ফেলে দিলেন। এই মাত্র পরীক্ষা শেষ করলাম। কাজেই সমস্ত চোথাগত বিদ্যা ওখানেই ঝেড়ে এসেছি। শুধু এইটুকুই বলতে চাই আজকে থেকে ২ বা ৩ মাস পর আমাদের সদা হাস্যোজ্জ্বল এই জাহিদ ভাইয়াকে জাহিদ স্যার না বলে জাহিদ ভাইয়া বলেই ডাকতে পারি।

আমরা কথা রেখেছিলাম, ওরা ক্লাসের বাইরে আমাকে ভাই বলেই ডাকতো। সেটা নিয়েও হয়েছিল এক কাহিনী। ’৯৯  (বা ’৯৮) ব্যাচের এক ছেলেতো ডিপার্টমেন্টের ফেয়ারওয়েলে পিন মেরে বলেই ফেলল, আমরা আমাদের সিনিয়র বড় ভাই, যারা শিক্ষক হয়েছেন তাদের ‘স্যার’ বলেই সম্মান করি, ভাইয়া বলে অসম্মান (?) করার মানসিকতা আমাদের নেই। কোনটা সম্মান আর কোনটা অসম্মান সেটা বোঝার বয়েস আমাদের অনেক আগেই হয়েছিল। সুতরাং উদারপন্থী শিক্ষক হলেও সমালোচনা, আবার কঠিন সম্মানপ্রার্থী শিক্ষক হলেও সমালোচনা! আমরা যে কি চাই সেটা নিজেরাও হয়ত জানিনা।

একই শুভকামনা ছিল বন্ধু নুপুরের, 

টিচার হয়ে ওজনে ভারী হয়ে যাস নে। ক্লাসে যেমনটা ছিলি তেমনি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত হাসি, আনন্দে কাটুক তোর দিনগুলি। আমার ঠিকানাতো নির্দীষ্ট। যোগাযোগ রাখিস। অনেক অ ...নে...ক, ম্যা...লা ভাল থাকি...স

আমার বিভাগের এক বন্ধু, ফুলকাম, পুরোনাম ফুলকাম বাদশাহ। ময়মনসিংহের ছেলে ফুলকাম শুরু থেকেই আমাদের আড্ডায় মজার একটি উপাদান। প্রথম দিকে ওর নাম নিয়ে আমরা সবাই একটু মজা করলেও পরে অবশ্য ফুলকামের আড্ডা জমানো গুনই আমাদের মুগ্ধ করতো। ফুলকামের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়েছিল যখন আমি, এহসান, শরীফ আর ফুলকাম মিলে আমাদের আরেক বন্ধু সোহেলের কবর জিয়ারত করতে দিনাজপুর যাচ্ছিলাম। সোহেল আমাদের ব্যাচের প্রথম হারিয়ে যাওয়া একজন। প্রথম বর্ষে প্রথম সেমিষ্টার শেষ করে ছুটিতে বাড়িতে গিয়েছিল, আর ফেরেনি। খবরটা আমাদের কানে আসে যখন আমরা সবাই প্রায় এক মাস ছুটি কাটিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসি ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষের সপ্তাহে। আমি সন্ধ্যার দিকে হল থেকে বের হয়ে আলমের দোকানে নাস্তা করে আহসানউল্লাহ হলের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, এরকম সময়েই আমাদের ব্যাচেরই এক ছেলের তৌহিদের কাছ থেকে দুঃসংবাদটা শুনলাম। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা যে আমাদের সোহেল নেই! আমাদের প্রিয় বুন্ধুটি আর কোনদিন আমাদের সাথে আড্ডা দিবেনা, আর কখনো এসে বলবেনা ‘চল বাইরে খেয়ে আসি, হলের খাবার অসহ্য লাগছে’। সোহেলের মাকে সান্তনা দিতে আমরা চারজন ঢাকা থেকে ট্রেনে করে রওনা দিলাম। তখনও যমুনা সেতু হয়নি, সুতরাং ট্রেন, ফেরী আবার ট্রেন ধরে আমরা সারা রাত জেগে সকালের দিকে পৌছলাম দিনাজপুর শহরে। আমার মনে আছে দিনটা ছিল শুক্রবার। প্রায় নিস্তব্ধ একটা বাড়িতে আমরা বাইরের দরজায় কড়া নারলাম। দরজা খুলে বের হয়ে আসলেন একজন মধ্যবয়সী মানুষ। পরিচয় হল, সোহেলের মামা। আমরা চারজন ওদের বাইরের ঘরে বসে আছি। মনে পড়ছে সোহেল একদিন বলেছিল পরের পরীক্ষার বন্ধে আমাদেরকে নিয়ে ওদের বাসায় যাবে। সোহেল, আজ আমরা তোর বাসায় এসেছি অথচ তুই নেই সেখানে। আমরা হাত মুখ ধুয়ে সোহেলের মাকে দেখতে গেলাম। শোকে প্রায় পাথর একজন মা, আমাদেরকে দেখে আর তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি সেদিন, সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। বার বার সোহেলের আগের দিনের কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন তিনি, সোহেল কিভাবে খেত, কিভাবে মায়ের কোলে শুয়ে থাকত,  কি খেতে পছন্দ করত।

সবসময়ের মজার চরিত্র ফুলকাম আমার ডায়েরীতে মজা করেই লিখেছিল, 

যেদিন বন্ধু চলে যাব...চলে যাব বহু দূরে
ক্ষমা করে দিও আমায়।।
আর মনে রেখ কেবল ফুলকাম ছিল
ভালবাসতো শুধুই তোমাদের

এই চলে যাওয়া টাইপ বিদায়ের বানী শুনে আসছি সেই স্কুল জীবন থেকে। বিদায়ী ব্যাচের ফেয়ারওয়েলের মানপত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘যেতে নাহি দিব’ থেকে তুলে আনা চারটি লাইন “এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে ...তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়” যতটা হাসিতামাশার মধ্যে দিয়ে শুনেছি, নিজেদের যাবার দিন ঠিক ততটাই ব্যাথিত হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মানপত্রের অবসান ঘটলেও চলে যাওয়া টাইপ বিদায় বানীর খুব একটা অবসান ঘটেনি। এই যেমন ধরা যাক ’৯৭ ব্যাচের রাসেলের কথা। চার চলায় থাকার সময়টাতে রাসেল থাকত আমাদের পাশের কাছাকাছি রুমে। রাসেল লিখেছিল, 

চলে যাওয়া মানেই বন্ধন ছিন্ন করা নয়। বরং আরও নতুন ভাবে পুরোনো বন্ধনকে শক্ত করে গড়ে তোনাই হোক জীবনের এই নতুন শুরু হতে যাওয়া অধ্যায়ের অন্যতম লক্ষ্য।
-বেশ বড় গল্প ঝেড়ে দিলাম চান্সে ! কি বলেন?

কবি সাহিত্যিকরা কি বলবেন জানিনা, আমার মতে এইটা ১০০ ভাগ ভুল কথা, চলে যাওয়া মানেই বন্ধন ছিন্ন। আমাদের সাথে ছিন্ন হয়েছে হলের বন্ধন, হলের সাথে লেগে থাকা মানুষগুলোর সাথে বন্ধন, প্রিয় ক্যাম্পাসের বন্ধন। আমরা নতুন করে বন্ধনে পড়েছি প্রিয়তমার, প্রিয় সন্তানের, নতুন শহরের।আজ যদি বর্তমান শহর ছেড়ে নতুন কোন শহরে চলে যাই আমি জানি এই তুষারে ঢাকা শহরটার জন্যও আমার মন কাঁদবে। দূরত্ব আর সময় আমাদের পুরোনো বন্ধনকে কখনো গাঢ় করেনা, বরং তা নিয়ে যায় নতুন নতুন বন্ধনের কাছে।