মঙ্গলবার, ১১ মে, ২০১০

জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশঃ সিইজিআইএস এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট ও মিডিয়া

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভুত জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে যেসব দেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ বলে ধারণা করা হয় বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের বড় বড় জিসিএম ( General Circulation Model বা Global Climate Model) গুলো আগামী শতকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর কোন কোন স্থানগুলো সমুদ্রতলে বিলীন হয়ে যাবে তার একটা ধারণা দিচ্ছে যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। তবে যেকথা সত্য তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যেকোন ভবিষ্যৎবাণীই অমেঘ সত্য নয়, বরং বিজ্ঞাণ ও প্রযুক্তিকে ভিত্তি করে সেটা একটা সম্ভাবনা মাত্র। আরো ভাল করে বলতে গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যপট আসলে ভবিষ্যতের জলবায়ুর বাস্তব রূপায়ণ নয় বরং তা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন বা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্ন নিয়ামক একটি নির্দীষ্ট হারে বাড়লে তার কি কি প্রভাব জলবায়ুর উপর পড়বে সেই জাতীয় একটি ধারণা মাত্র।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে নদীপ্রবাহের কিরূপ সম্পর্ক তা নিয়ে আগের একটি লেখায় কিছু সহজ ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম।খুব সহজে বললে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাধারণ প্রভাব নিম্নরূপঃ
  1. বিপুল জলরাশির তাপমাত্রার ফলে প্রসারণ ( ছোটবেলায় পড়েছি সবাই যে তাপমাত্রা বাড়লে আয়তন বাড়ে) আর সেই সাথে মেরু অঞ্চলের বরফের একটা বিশেষ অংশ গলে গিয়ে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধি।
  2. তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অধিক পানি স্বতঃবাষ্পীভুত হবে ফলে বৃষ্টিপাত বাড়বে ফলশ্রুতিতে বর্ষা মৌসুমে নদীতে প্রবাহ বাড়বে।
  3. যেহেতু অধিক হারে পানি স্বতঃবাষ্পীভুত হবে তাই শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে পানির পরিমান কমে যাবে এবং খরা দেখা দিবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ ডুববে নাকি ডুববে না? সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী আগামী শতকের শেষে ( ২১০০ সালে ) সমুদ্র সমতলের উচ্চতা ০.৬ মিটার বাড়বে আর মৌসুমী বৃষ্টিপাত ২৬% বাড়বে সুতরাং বাংলাদেশের মত একটি ব-দ্বীপের পক্ষে এই উপাত্তের ভিত্তিতে বেঁচে থাকা খুব কষ্টকর।
এই যখন প্রেক্ষাপট ঠিক সেই সময় গত ২৩ এপ্রিল ২০১০ দেশের সংবাদ মাধ্যমের (প্রথম আলো , ডেইলী ষ্টার) বরাতে আমরা একটি আশার বাণী শুনতে পেলাম,
উদ্ধৃতি
বাংলাদেশের ডুবে যাবার সম্ভাবনা নেই বরং নতুন কিছু এলাকা বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কয়েকদিনের মধ্যে সেই আশা বিস্ফোরিত হলো সাংবাদিকের কলামে, ব্লগারের হাত ধরে ব্লগে, চায়ের টেবিলে কিংবা ড্রয়িং রুমের আড্ডা থেকে ফেইসবুকের পাতায় পাতায়। বলতে দ্বিধা নেই পানিসম্পদ প্রকৌশল নিয়ে দুপাতা পড়া থাকায় বোধহয় মিডিয়ার সংবাদে খুব বেশি আশান্বিত হতে পারিনি। চেষ্টা ছিল যে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণাটি করেছে তাদের মূল রিপোর্টটি হাতে পাবার। সেটি অবশ্য হাতে মিলল তবে বিস্তারিত রিপোর্ট নয় বরং তার একটি সংক্ষেপিত রূপ। ইতিমধ্যে অবশ্য ঐ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের প্রতিক্রিয়ায় তাদের ব্যাখ্যা প্রদান করে ২৬ এপ্রিল ২০১০ এ ( প্রথম আলো ) যার মূল বক্তব্য ছিল,
উদ্ধৃতি
'বাংলাদেশ ডুববে না শিরোনামটি আমরা যা বলিনি এবং গবেষণা থেকে পাইনি এমন একটি বার্তা দিতে পারে।'
একথা অমেঘ সত্যি যে রিপোর্টে যা ছিল তাকে সংবাদপত্র ভুল ভাবে উপস্থাপন করেছে কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে উক্ত প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় এমন কি ছিল যা কিনা দেশের প্রধান সংবাদ মাধ্যমের কাছে ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করতে হবে? সেই প্রশ্নের উত্তর পাবার আগে চলুন ঐ রিপোর্টের ছোট খাট একটি ব্যবচ্ছেদ করা যাক। চেষ্টা করেছি সহজভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জিনিসগুলোকে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে তুলতে তার পরেও কোন কিছু বুঝতে না পারলে লেখক হিসেবে মন্তব্যে তা ব্যখ্যা করার আশ্বাস দিয়ে রাখছি শুরুতেই।
কি আছে সিইজিআইএস এর রিপোর্টেঃ
'‌Brief note on the findings of Field Based Research on the Impact of Climate Change on Bangladesh Rivers' শিরোনামে সিইজিআইএস এর ঐ রিপোর্টে মূলত করেকটি জিনিস তুলে ধরা হয়েছে,
  1. ১০০ বছর পরে অর্থাৎ ২১০০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভুত মৌসুমী বৃষ্টিপাত ২৬ ভাগ বেড়ে যাওয়া আর সমুদ্র সমতল ০.৬ মিটার উপরে উঠার সাথে বাংলাদেশের নদীগুলোর অভিযোজন।
  2. বর্ধিত মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর বর্ষাকালীন পানি প্রবাহ সমানুপাতে বেড়ে যাওয়া এবং তার ফলে নদীর গভীরতা ও প্রস্থ পরিবর্তিত হওয়া।
  3. বর্ধিত প্রবাহের কারনে নদীর পাড় ভাঙ্গার পরিমান ও তলদেশ থেকে মাটি সরে যাবার ( Scour) পরিমান নির্নয় করা।
  4. সর্বোপরি বর্ধিত পানি প্রবাহের সাথে বর্ধিত পলি প্রবাহ উপরের প্রক্রিয়াগুলোর উপর কতটুকু ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা বের করা।
পুরো রিপোর্টিতে মূলত অতীতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় প্রকাশিত বেশ কিছু গবেষণা কাজের ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। যে বিষয়টি বার বার এসেছে তা হচ্ছে অভিযোজন। রিপোর্টের উপসংহারে যাবার পূর্বে তাই অভিযোজন বিষয়টা একটু ব্যাখা করা প্রয়োজন।
ধরে নেয়া যাক মেঘনা নদীর প্রবাহ যা আছে তাই থাকল কিন্তু হঠাৎ করে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেল। এই বর্ধিত সমুদ্রতলের ফলে নদীর পানি সাগরে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হবে, ফলে তার বেগ কমে যাবে। পানি প্রবাহের বেগ কমে গেলে এর সাথে আসা পলি নিচে পড়ে যাবে ফলে নদীর তলদেশ উচু হবে। নদীর তলদেশে উঁচু হলে নদীর পানির উপরিতলও উঁচু হবে।
এবারে একটু জটিলে যাই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেঘনা নদীর বর্ষাকালীন প্রবাহ আগের মত থাকবেনা, বাড়বে, আর সেই সাথে বেড়ে যাবে পলির পরিমান। বর্ধিত পানি প্রবাহ নদীর গভীরতাকে বাড়াবে আর অন্যদিকে সমুদ্রতলের বৃদ্ধি ও বর্ধিত পলি মিলে নদীর গভীরতাকে কমাতে চেষ্টা করবে। এই প্রক্রিয়াগুলো মিলে যদি নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যায় তাহলে নতুন এলাকা ডুবে যাবে আর যদি না বেড়ে যায় তাহলে নতুন এলাকা ডুববেনা। ধরে নেই নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে, এখন নদীর পাড়ের উচ্চতাও যদি বাড়িয়ে দেই তাহলে বেড়ে যাওয়া নদীর পানি কিন্তু আটকে থাকবে, বাইরে যেতে পারবেনা।
ঠিক এই সম্ভাবনাগুলিই বিশ্লেষণ করা হয়েছে ঐ রিপোর্টে, কারন জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বর্ধিত বৃষ্টিপাত অববাহিকা থেকে অধিক পলিকে নদীতে নিয়ে আসবে, সেই পলি বর্ষাতে উপচে পড়বে নদীর পাড়ে। সুতরাং সিইজিআইএস এর গবেষণায় ধরে নেয়া হয়েছে সবকিছু মিলিয়ে নদীর তলদেশ যতটুকু উপরে উঠবে নদীর পাড় ঠিক ততটুকুই উপরে উঠবে ফলে বর্ধিত পানি নদী থেকে বাইরে আসবেনা এবং বাংলাদেশের ডুবে যাবার সম্ভাবনা কম এর ফলে। এই যে বর্ধিত সমুদ্র সমতল আর পানি ও পলি প্রবাহের নিজেদের মধ্যে মধ্যস্থতা একেই বলা যায় 'অভিযোজন' যা নিচের উপসংহারে বার বার চলে এসেছে।
এবারে সিইজিআইএস এর গবেষণার উপসংহার দেখা যাক,
  1. বাংলাদেশের নদীসমুহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বর্ধিত সমুদ্র সমতলের উচ্চতা আর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত পানি ও পলিপ্রবাহের সাথে দ্রুত অভিযোজিত হবে।
  2. দীর্ঘমেয়াদী বর্ধিত পানি প্রবাহের ফলে নদী তার প্রস্থ ও গভীরতা পরিবর্তন করবে বা অভিযোজিত হবে সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপুল এলাকা ডুবে যাবার সম্ভাবনা যে আশঙ্কা এখন করা হচ্ছে তা ততটা আশঙ্কাজনক হবেনা।
  3. আগামী ১০০ বছরে সমুদ্রসমতলের উচ্চতা বৃদ্ধি যদি ৬০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটারের মধ্যে থাকে তাহলে মেঘনা মোহনায় এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সমুদ্রতলের সাথে নদীর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত পানি ও পলির অভিযোজন দ্রুত হবে।
  4. ইতিপূর্বে বিভিন্ন গবেষণায় জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বর্ধিত জোয়ারের ফলে লবনাক্ততা বৃদ্ধির যে আশঙ্কা করা হয়েছে তা কম হবে।
সিইজিআইএস এর রিপোর্টের দূর্বল দিকগুলোঃ
আমার বিচারে এই গবেষণার দূর্বল দিকগুলো নিম্নরূপঃ
  1. যেকোন বৈজ্ঞানিক গবেষণাই বেশ কিছু ধারনার উপরে ভিত্তি করে শুরু করতে হয় যাকে আমরা Assumption বলে থাকি। আমার বিচারে এই গবেষণার সবচেয়ে দূর্বল দিক হচ্ছে নদীর তলদেশ যতটকু বাড়বে নদীর পাড় ঠিক ততটুকু বাড়বে এই এসাম্পশনটা।
  2. এই গবেষণায় শুধু বর্ষা মৌসুমে বর্ধিত পানির ফলে লবনাক্ততা বাড়বেনা বলে নিয়ে উপসংহার টানা হয়েছে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ আগের থেকে কমবে, ফলে তখন অধিক লবনাক্ত পানি উপকূলীয় নদীগুলোর ভেতরে মোহনায় ঢুকবে। এই বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে আসা উচিৎ।
  3. যেকোন জলবায়ু পরিবর্তনের গবেষনাতেই যেসব গানিতিক মডেল ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে একটি বেইজ পিরিয়ড ( অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৯৬১-১৯৯০) সালের প্রাপ্ত উপাত্ত দিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হয়। অর্থাৎ আগেই জানা উপাত্ত দিয়ে পরীক্ষা করে নেয়া যে ঐ গানিতিক সুত্র সঠিক ফলাফল দিচ্ছে কিনা। আমি এই রিপোর্টে সেরকম কোন সিদ্ধকরণের নমুনা পাইনি।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও মিডিয়াঃ
একজন গবেষক হিসেবে আমি সিইজিআইএস এই গবেষনার সাধুবাদ জানাই এই জন্য যে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবর্তিত নদী প্রবাহের সাথে পলি কতটা গুরুত্ত্বপূর্ণ সেই বিষয়টি তারা সামনে নিয়ে এসেছে। বিশেষত বাংলাদেশের মত পললভূমির ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অতীব গুরুত্ত্বপূর্ন। কিন্তু তাদের গবেষনার এই রিপোর্ট আসলে একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান, ভাল করে বললে এই বিষয়টি নিয়ে যে গবেষণা প্রয়োজন তা অনুধাবনের একটি নির্নায়ক। সুতরাং কোন মতেই তা আশা বা নিরাশা কোনটারই দাবী রাখেনা। সেই বিচারে এই গবেষণার ফলাফল নিয়ে জাতীয় গনমাধ্যমে বিশাল প্রচারের কোন যৌক্তিকতা অন্ততপক্ষে আমার বোধগম্য নয়। সংবাদিকরা প্রযুক্তিবিদ বা গবেষক নয়, তাদের দায়িত্ত্ব গবেষকদের গবেষনা লব্ধ ফলাফলের সারমর্ম মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। সুতরাং দেশের প্রধান দুটি সংবাদপত্রে 'বাংলাদেশ ডুববেনা' বা 'বাংলাদেশ নতুন ভূমি পাচ্ছে' জাতীয় সংবাদ, আর তা দেখে পনের কোটি মানুষের আশায় বুক বাধা, এবং পরে গবেষণা সংস্থার ব্যাখ্যায় পুনরায় নিরাশ হওয়া, এই কোন কিছুই হতোনা যদিনা পরিপূর্ন গবেষণা শেষ করে তার ফলাফল মিডিয়ায় প্রকাশ করা হতো।
আরো যে জিনিসটি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে শেষ হয়ে যাওয়া ২০০৯ কোপেনহেগেন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে আগামী সময়গুলোতে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে কি কি পদক্ষেপ নিবে সেই বিষয়ে নির্দীষ্ট প্রকল্প জাতিসংঘের কাছে পেশ করতে বলা হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দীষ্ট গবেষণা না শেষ করে তার যাত্রাপথে বা মাঝপথেই মিডিয়ায় ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাংলাদেশে ডুববেনা, আমাদের কিছু হবেনা জাতীয় খবর প্রকাশ করাটা কতটা কূটনৈতিকভাবে সিদ্ধ সেই প্রশ্নও রয়ে যায়।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
রাজিব কামাল
স্বাধীন
হাসান জোবায়ের

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন