বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১০

ভয়াবহ পানিসংকটের দোরগোড়ায় ঢাকা

সভ্যতার সাথে পানির সম্পর্ক অকৃত্রিম এবং অপরিহার্য। সেকারনেই পৃথিবীর অধিকাংশ সভ্যতার সূচনা ঘটেছে কোন না কোন নদীকে কেন্দ্র করে। সেসময় জীবন ধারনের জন্য পানির অপরিহার্যতার পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যব্যস্থাও ছিল আসলে নদী নির্ভর। বর্তমান কালে স্থল ও আকাশ পথে যোগাযোগ ব্যব্যস্থায় অভূত উন্নতি সাধন নৌযোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা হয়ত কমিয়ে দিয়েছে কিন্তু এখনো জীবন ধারন এবং নগর জীবনের প্রাত্যাহিক কাজের জন্য পানির কোন বিকল্প নেই।

নদীভিত্তিক পানি সরবরাহঃ
শুরুতেই একটি গতানুগতিক নদী ভিত্তিক নগরের কথা বিবেচনা করা যাক। নিচের ছবিটি তার একটি সহজ ধারণা দিবে আশা রাখিঃ
 
ছবিঃ একটি নদীভিত্তিক পানি সরবরাহ ব্যব্যস্থা।
সাধারনত একটি শহর যে নদীকে ভিত্তি করে গড়ে উঠে তার উজান থেকে পানি সংগ্রহ করে তাকে পরিশোধন করে নগরের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করা হয় যেমন গৃহস্থালী, বানিজ্যিক ভবন, কল কারখানা ইত্যাদি। এসব থেকে নিষ্কাশিত পানি আবার দূষিত পানি পরিশোধন কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়। সেখান থেকে পরিশোধিত পানি আবার নদীর ভাটিতে ফেলে দেয়া হয়।
এই ব্যবস্থা কাজ করবে যদি ঐ শহরে প্রবাহমান নদীর পানির গুনগত মান একটি নির্দীষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। এই সব মান সাধারণতঃ পানিতে ভাসমান কঠিন পদার্থের পরিমান, পানিতে দ্রবীভূত বিভিন্ন লবণ ও ভারী ধাতুর পরিমান, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমান, পানির পি এইচ, ইত্যাদি। একটি নির্দীষ্ট সীমান মধ্যে থাকা বলতে বুঝাতে চাইছি এর বেশি হলে নদীর পানিকে পরিশোধন করা অর্থনৈতিক ভাবে সিদ্ধ হবেনা। এছাড়া গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পানি পরিশোধন করার মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা শহরে থাকতে হবে। এই জাতীয় পরিশোধন কেন্দ্রের প্রাথমিক খরচ অনেক। সুতরাং নদীভিত্তিক পানি সরবরাহ করতে হলে একটি শহরকে সেই খরচ বহন করতে হবে।  
ধরা যাক একটি শহর যার নদী ভিত্তিক পানি সরবরাহ করার মত পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই বা যা আছে তা দিয়ে পুরো শহরে পানি সরবরাহ করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানি গভীর নলকূপের মাধ্যমে তুলে তা সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে একটি সুবিধা হচ্ছে যেহেতু ভুগর্ভস্থ পানির গুনগত মান নদীর পানির চেয়ে ভাল সুতরাং অনেক ক্ষেত্রেই পানির পরিশোধন আর করতে হয়না।
ভূগর্ভস্থ পানিঃ
এবারে ভূগর্ভস্থ পানির কিছুটা ব্যবচ্ছেদ করা যাক। সাধারনত মাটির নিচে একটি নির্দীষ্ট গভীরতার পরে মাটির কণার ফাঁকে পানির পরিমান বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে শতভাগ ফাঁকা জায়গা পানি দ্বারা পূর্ণ থাকে। যদি সেই পানি সহজে পরিবহণ যোগ্য হয় ( সাধারণত সেখানে বালি মাটি থাকে সেখানে পানি সহজে পরিবাহিত হয়) তাহলে তাকে এক্যুইফার বলে। এই এক্যুইফার সাধারণত দুই ধরনের একঃ আন-কনফাইন্ড এক্যুইফার যা কিনা মাটির উপরের দিকে থাকে আর কনফাইন্ড এক্যুইফার যা আসলে মাটির অনেক নিচে দুটি অপরিবহনযোগ্য স্তরের মাঝামাঝি অবস্থান করে (নিচের ছবিটি দেখুন)। আন-কনফাইন্ড এক্যুইফার সাধারণত ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ বর্ষা কালে যেহেতু বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করে তাই সেসময় এই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উপরে উঠে আর শুষ্ক মৌসুমে তা আবার নিচে নামে। অন্যদিকে কনফাইন্ড এক্যুইফারে এই উঠানামা অনেক ধীর গতির। 
ছবিঃ এক্যুইফার ( উৎসঃ উইকিমিডিয়া কমন্স, Hans Hillewaert
এবারে আসি এই এক্যুইফারে পানির বাজেট নিয়ে। এক্যুইফারে পানি আসে মূলত দুই উৎস থেকে। একঃ বৃষ্টির পানি যা কিনা উলম্ব ভাবে মাটির উপর থেকে , দুইঃ আশে পাশের নদী বা জলাভূমি থেকে পানি যা মাটির কণার ফাঁক দিয়ে প্রবাহিত হয়। এখন এই এক্যুইফারের পানির ব্যবহার হচ্ছে নগরের জন্য প্রয়োজনের পানির যোগান। এবারে একটি সহজ সমীকরণ দেখা যাকঃ
এক্যুইফারের পানির স্তরের পরিবর্তন= পানির ইনপুট –পানির আউটপুট
এক্ষেত্রে ইনপুট যদি আউটপুট থেকে বেশি হয় তাহলে পানির স্তর উপরে উঠবে আর ইনপুট যদি আউটপুট থেকে কম হয় সেক্ষেত্রে পানির স্তর নিচে নামবে।  
ঢাকার পানি সরবরাহ ব্যব্যস্থাঃ
ঢাকা শহরে পানি সরবরাহের একমাত্র বৈধ প্রতিষ্ঠাণ ঢাকা ওয়াসা। ওয়াসার ২০০৩ এর রিপোর্ট অনুসারে ঢাকা শহরের ৮৪% ভাগ পানি সরবরাহ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে আর বাকী ১৬% হচ্ছে নদী থেকে। তবে ২০০২ এ সায়েদাবাদ পানি পরিশোধন কেন্দ্র চালুর আগে এই পরিসংখ্যান ছিল ৯৫% ভূগর্ভস্থ থেকে আর বাকী ৫% নদী থেকে [১] অর্থাৎ ঢাকা শহরের এক্যুইফার থেকে আমরা অনবরত পানি উত্তোলন করে চলেছি। ২০০৩ সালের হিসেবমতে ঢাকা ওয়াসা দিনে ১১৬০ মিলিয়ন লিটার পানি উত্তলন করে থাকে এর ৩৮৯ টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে।
ঢাকার ক্রমহ্রাসমান এক্যুইফারঃ
উপরে যে পানির চাহিদার হিসাব দিলাম এগুলো সবই ঢাকার নিচে অবস্থিরত ‘ডুপিটিলা’ এক্যুইফারের পানির আউটপুট। এখন দেখি ইনপুটের কি অবস্থা। ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকা হয় পীচ নয় সিমেন্টের অচ্ছাদনে ঢাকা। কিছু যৎসামান্য পার্ক বা মাঠ আছে যেখানে মাটির অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়। সুতরাং বলাই বাহুল্য ঢাকার বৃষ্টির পানির অধিকাংশই যায় খালে বা নালআর সেখান থেকে গড়িয়ে নদীতে। সুতরাং বৃষ্টির পানি থেকে এক্যুইফারে ইনপুট অনেক কম। এবারে আসি ঢাকার আশেপাশের নিম্নাঞ্চল প্রসংগে। বর্ষাকালে নিম্নাচলে পানি জমে থেকে তার একটি বিশেষ অংশ এক্যুইফারে প্রবেশ করে। কিন্তু এই নিম্নাঞ্চল ভরাট করে নগরায়ন করা হচ্ছে ফলে তার পরিমান দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। সুতরাং সামষ্টিক ভাবে ঢাকায় এক্যুইফারে পানির ইনপুট যৎসামান্য।
উপরে সহজ সমীকরনে দেখানো হয়েছে কিভাবে এক্যুইফারে পানির স্তর উঠানামা করে। এখন যেহেতু ঢাকার এক্যুইফারে ইনপুট আউটপুট থেকে অনেক অনেক কম সেজন্য ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। কিন্তু এই নেমে যাওয়ার হার আশঙ্কাজনক। এক গবেষণা প্রবন্ধে [১] ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে পানির স্তর কিভাবে দ্রুত নেমে যাচ্ছে তার একটি নমুনা দেয়া হয়েছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ওয়াসার পর্বেক্ষণ নলকূপের উপাত্তের ভিত্তিতে এই ফলাফল বেরিয়ে এসেছে। নিচের গ্রাফটি লক্ষ্য করুন,বছরে প্রায় ৩ মিটার করে নেমে যাচ্ছে ঢাকা শহরের পানির স্তর।
 
চিত্রঃ ঢাকার ক্রম হ্রাসমান এক্যুইফার[১]
  
একই ধরনের ফলাফল দেখা গিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার গবেষনায়ও [২]। নিচে ছবিতে সেটি স্পষ্টঃ

ছবিঃ ঢাকার ক্রম হ্রাসমান এক্যুইফার[২]

সার্বিক পরিস্থিতি ও সমাধানঃ
উপরের আলোচনায় একথা প্রমানিত যে ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমে নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০০৩ সালেও ঢাকা ওয়াসার ৮৪% পানি সরবরাহ যেহেতু এই ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল এখনই ব্যবস্থা না নিলে এই স্তর আরো নিচে নেমে যাবে এবং ঢাকা শহর ভয়াবহ পানিসংকটে পড়বে।  এক্ষেত্রে করণীয়ঃ
প্রথমতঃ ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমানো। কিন্তু এটি সহজসাধ্য নয়। আগেই ব্যাখ্যা করেছি নদী ভিত্তিক পানি সরবরাহের কথা। ঢাকাতে পানি সরবরাহ নদী ভিত্তিক করতে গেলে তা হতে হবে বুড়িগঙ্গা ভিত্তিক কিন্তু ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গার পানির গুনগত মান এতটাই নিচে নেমেছে যে তা পরিশোধনের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে হয়ত মেঘনা থেকে পানি নিয়ে আসতে হবে। সেটি অর্থনৈতিক ভাবে কতটা সিদ্ধ তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
দ্বিতীয়তঃ ভূগর্ভস্থ পানির আয়তন বাড়ানো। আগেই ব্যাখ্যা করেছি যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উপরে তুলতে গেলে এক্যুইফারে পানির ইনপুট বাড়াতে হবে। সেটি করা যাবে দুইভাবে।
          একঃ প্রাকৃতিক ভাবে নিম্নাঞ্চল বা জলাভুমিকে সংরক্ষণ করে।
          দুইঃ কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করিয়ে যাকে বলা হয় ‘রেইন ওয়াটার হারভেষ্টিং’। রেইন ওয়াটার হারভেষ্টিং এর মাধ্যমে ঢাকা শহরের বিভিন্ন আচ্ছাদিত স্থান ( পীচ বা সিমেন্টের নিচে আচ্ছাদিত এলাকা) ও বিল্ডিং এর ছাদ থেকে সংগ্রহীত পানি পাইপ দিয়ে প্রবাহিত করে শহরের উন্মুক্ত মাঠ বা পার্কে কূপ খনন করে তা ভূওভ্যন্তরে প্রবেশ করানো হবে। বছর পাঁচেক আগে ওয়াসার ব্যব্যস্থাপনা পরিচালক আনম আখতার হোসেন কে একটি কর্মশালায় জিজ্ঞেস করেছিলাম ঢাকা ওয়াসার ‘রেইন ওয়াটার হারভেষ্টিং’ এর কোন প্রকল্প আছে কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন তাদের পরিকল্পনায় আছে। ঠিক জানিনা পরবর্তীতে এই বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা।
সার্বিক ভাবে ঢাকা শহরের আসন্ন পানিসংকট নিয়ে শীঘ্রই কোন উদ্যোগ না নিলে তা আস্তে আস্তে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কথায় আছে দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে আমরা সচেতন হইনা। আমার ধারণা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও ইদানিং আমরা সচেতন হইনা, ঢাকার পানিসমস্যার সাথে সরকারের পদক্ষেপ দেখে কিন্তু তারই প্রামাণ মেলে।  

তথ্যসুত্রঃ

প্রথম প্রকাশঃ সচলায়তন