শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১১

টিপাইমুখ বাঁধঃ সাম্প্রতিক পরিস্থিতি

প্রায় ২ বছরের শীতনিদ্রার পর আবারো আলোচনার টেবিলে টিপাইমুখ বাঁধ। ২০০৯ সাল ছিল টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আলোচনার বছর। সেই সময়ের সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি, ভিডিও, আর প্রতিবেদনের ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন। ১৯৫৪ সালে যে পরিকল্পনার শুরু, ১৯৭৪ সালে তার বাস্তবায়নের স্থান নির্ধারণ, আর ২০০৯-এর দিকে এসে তার নির্মাণ কাজ শুরুর কথা ছিল। আমাদের সংসদীয় কমিটি ভারত সফরে থেকে ফিরে এসে সে সময় মন্তব্য করেছিলেন,
হেলিকপ্টারে খুব নিচু দিয়ে পরিভ্রমণকালে টিপাইমুখে কোনো অবকাঠামো প্রতিনিধি দলের দৃষ্টিগোচর হয়নি। প্রকল্পের ভাটিতে কোনো ব্যারাজ বা অবকাঠামো নির্মাণের কোনো রকম প্রস্তুতিও পরিলক্ষিত হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখনো কোনো প্রাথমিক ভৌত কার্যাদি শুরু হয়নি [১]।
সুতরাং আর কি, নিশ্চিন্ত থাক। তা ছাড়া ভারত সরকার তো বলেছিলই, তারা এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। ঠিক একই রকম আশ্বাস আমরা পরবর্তীতেও পেয়েছি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর কিংবা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময়।এখানে উল্লেখ্য যে ঠিক একই রকম আশ্বাস ফারাক্কা ব্যারাজের সময়ও তারা দিয়েছিল। সুতরাং 'নো চিন্তা ডু ফুর্তি'। আমরা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম টিপাইমুখের কথা। গতবছর (২০১০ সালে) একটি লেখাতে আমি উল্লেখ করেছিলাম,

আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি টিপাইমুখ বাঁধ বাস্তবায়িত হচ্ছে আর সেইসঙ্গে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য গিয়ে পড়ছে টিপাইমুখের বাঁধ রুল কার্ভের ওপর। আমরা আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করব যখন বাঁধ আমাদের ওপর খড়গ হয়ে পুরো বাস্তবায়ন হয়ে যাবে। এ কথা সত্য যে এত বড় পরিকল্পনা করে ভারত টিপাইমুখের বাস্তবায়ন আজ বা কাল করবেই। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের স্বার্থও যাতে রক্ষিত হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই। কিন্তু আমরা কি আদৌ সেই বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছি নাকি 'বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে না' এই জাতীয় অবৈজ্ঞানিক আশ্বাসে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি, সেটা এই মুহূর্তে জনমানসে পরিষ্কার নয় [২]।
এই আশঙ্কা সত্যি হোক সেটা কখনো চাইনি কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সেটিই বাস্তবিক। গুরুত্ত্বপূর্ন কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের ( বিবিসি, দি হিন্দু, হাইড্রোওয়ার্ল্ড.কম, প্রথম আলো, দি ডেইলী ষ্টার) ভিত্তিতে আমরা জানতে পারছি যে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ভারতের রাষ্ট্রয়াত্ত্ব জলবিদ্যুৎ সংস্থা ( NHPC Limited); ভারত সরকার ও হিমাচল প্রদেশের সমন্বয়ে গড়া Satluj Jal Vidyut Nigam Limited (SJVN Ltd ); ও মনীপুর সরকারের মধ্যে একটি যৌথ সংস্থা গঠনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যাতে NHPC, SJVN Limited ও মনীপুর সরকারের যথাক্রমে শতকরা ৬৯ ভাগ, ২৬ ভাগ ও ৫ ভাগ অংশীদ্বারত্ত্ব থাকবে। NHPC এর ওয়েবসাইটেই এই চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে [৩]।
সংবাদ মাধ্যমগুলোর ভিত্তিতে এই প্রসংগে মণিপুর সরকারের মুখপাত্র ও রাজ্যের সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী এন বীরেন সিং এর উক্তি উল্লেখযোগ্যঃ

সরকারের নীতি খুবই পরিস্কার, টিপাইমুখ প্রকল্প হবেই। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায়, বিশেষত উত্তরপূর্ব ভারত উন্নয়ন দপ্তর এর জন্য টাকা দেবে।
অর্থাৎ ধরেই নেয়া যায় যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের অশনি সংকেত শুনতে পাচ্ছি আমরা। কিন্তু আসলে কি আছে এই প্রকল্পে?

বারাক নদী থেকে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারনা আসে মূলত বন্যা নিয়ন্ত্রনের চাহিদা থেকেই। বাঁধ তৈরীর জন্য মাইনাধর, ভুবনধর ও নারাইনধর নামক আরো তিনটি প্রস্তাবিত স্থান প্রকৌশলগত কারনে বাতিল হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৪ সালে টিপাইমুখ বাঁধের চুড়ান্ত স্থান হিসেবে নির্ধারিত যা কিনা তুইভাই নদী ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থল থেকে ৫০০ মিটার ভাটিতে এবং বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ২০০ কিমি উজানে। নির্মিতব্য ১৬২.৮ মিটার উচত এই বাঁধটি একটি রকফিল ড্যাম অর্থ্যাৎ নদীর প্রবাহকে গ্রানুলার (দানাদার) মাটি দিয়ে ভরাট করা হবে এবং পানির প্রবাহকে এক বা একাধিক পানি অভেদ্য স্তর ( যেমন স্টীল পাইল বা কনক্রীট, বা প্লাস্টিক পর্দা) দিয়ে রোধ করা হবে।এতে নুন্যতম বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪৩৪ মেগাওয়াট তবে সর্বোচ্চ ১৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদনের ব্যবস্থা রাখা হবে।উল্লেখ্য যে বাঁধের কারনে সৃষ্ট জলাধারের ফলে প্লাবিত এলাকা প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার যার প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগই মনিপূর রাজ্যের আর বাকী ৫ ভাগ মিজোরাম রাজ্যের।ভারত সরকারের তথ্য মতে এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানুষদের উন্নয়নের পথে নিয়ে আসা যাবে, এটি বন্যা নিয়ন্ত্রন করবে যা বাৎসরিক ৪৫ কোটি রুপির ক্ষয়ক্ষতি রোধ করবে, এই প্রকল্প থেকে ৯৫ কিলোমিটার ভাটিতে ফুলেরতল ব্যারেজ নির্মানের প্রস্তাব রয়েছে যা পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ছেড়ে দেয়া পানিকে কাজে লাগিয়ে প্রায় ১,২০,৩৩৭ হেক্টর জমিকে সেচের আওতায় নিয়ে আসবে, প্রকল্পের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম হ্রদে মৎস্য চাষের মাধ্যেমে বার্ষিক আয় হবে ১৪ কোটি রুপি, প্রকল্প এলাকা একটি উৎকৃষ্ট পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে, সৃষ্ট হ্রদ উজানের এলাকার মানুষদের নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করবে সেই সাথে প্রকল্পের ফলে বছরের বিভিন্ন সময় নদীর পানির গভীরতার উঠা নামা কমে যাওয়ায় কলকাতা বন্দর থেকে বাংলাদেশ হয়ে শীলচর পর্যন্ত পন্য পরিবহণের সম্ভাব্যতা দেখা যাবে।


এই প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে সেটি নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা হয়েছে [৪]। তার ভিত্তিতে বলা যায়ঃ
  • এই প্রকল্পের ফলে বর্ষাকালে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে প্রবাহ ১০% থেকে ৩০% হ্রাস পাবে।
  • বাঁধের কারনে এর উজানে জলাধারে সব পলি সঞ্চিত হবে ফলে পলিমুক্ত পানি বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিমি ব্যাপী ব্যাপক নদী ক্ষয়ের সৃষ্টি করবে।বাংলাদেশ বাঁধের ২০০ কিমি ভাটিতে থাকায় এই বিপুল পরিমান পলি বরাক নদী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। কিন্তু পানির প্রবাহ তুলনামূলক ভাবে কমে যাওয়ায় পলি বহন করার ক্ষমতা কমে যাবে, এবং তা সুরমা ও কুশিয়ারার বুকে জমা হবে। এতে নদীর নাব্যতা ও গভীরতা হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে আগে যেটা স্বাভাবিক বর্ষাকালীন প্রবাহ ছিল প্রকারান্তরে তা বন্যা আকারে আসতে পারে এই এলাকায়।
  • বাঁধের কারনে বন্যার সময় পানি না আসায় বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের হাওড়গুলি একসময় ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে সেই সাথে বিলুপ্ত হবে বেশ কিছু প্রজাতি। এই এলাকার মানুষদের তখন বর্ষা মৌসুমে জীবিকার জন্য অন্য কোন পথ বেছে নিয়ে হবে।
  • বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ শতকরা ৬০ ভাগ থেকে ১১০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে । এই বর্ধিত প্রবাহের ফলে নৌচলাচল, সেচ ও মৎস্য চাষ বৃদ্ধি ঘটবে কিন্তু কিছু কিছু এলাকা থেকে পানি নিষ্কাশন ব্যহত হবে।তবে যে বিষয়টি খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ তা হলো বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের হাওড়গুলি শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় তখন কৃষকরা সেখানে বোরো ধান বপন করে যা এই অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে উঠে যা এই লোক গুলির বছরের একমাত্র শর্করার যোগান দেয়।বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এই এলাকার চাষাবাদ ব্যহত হবার আশঙ্কা আছে।
  • কখনো কখনো পর্যায়ক্রমে কিছু বছর থাকে যেখানে যেসময় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক গড় প্রবাহ থেকে অনেক কমে যায়।প্রাপ্ত তথ্য মতে বরাক অববাহিকায় ১৯৭৯-১৯৮১ পর্যন্ত এরকম একটি পর্যায় গিয়েছে যেখানে শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমে পানির অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম ছিল। টিপাইমুখ বাঁধ হবার পরে এরকম একটি সময় আবার যদি আসে সেক্ষেত্রে বাঁধের উজানে জলাধারের পানির স্তর কমে যাবে। এই পরিস্থিতিতে শুষ্ক মৌসুমে বাঁধের টারবাইন থেকে যে পরিমান পানি ভাটিতে প্রবাহিত হবে তা বাঁধ পূর্ব পরিস্থিতির সাথে তুলনা করলে অনেক অনেক কম। এই অতি শুষ্ক মৌসুমের কারনে জলাধারের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পরবর্তী বর্ষা মৌসুমে লক্ষ্য থাকবে বেশী পরিমান পানি সঞ্চয় করার যা প্রকারান্তরে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাবে এবং সেই সাথে বর্ষা মৌসুমে ভাটিতে পানির প্রবাহ আরো কমে যাবে। এই পরিস্থিতি তিন চার মৌসুম ধরে চললে তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসবে বাংলাদেশে।
  • প্রত্যেক জলাধারের একটা ধারন ক্ষমতা থাকে, সেই ধারন ক্ষমতার চেয়ে বেশী পানি জলাধারে জমা হলে তা স্পিলওয়ে বা বিকল্প পথ দিয়ে ভাটিতে প্রবাহিত করা হয়। বরাক অববাহিকায় যদি পর পর কিছু অতি বর্ষা মৌসুম আসে সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্রা আগের মতই থাকলে এই অতিরিক্ত পানি বিকল্প পথে বের করে দিতে হবে।বাঁধ হবার পর ভাটিতে মানুষের জীবন যাত্রা পরিবর্তিত হবে অর্থাৎ মানুষ স্বাভবতই তাদের ঘরবাড়ি আগের মত উঁচু করে বানাবেনা, বন্যার প্রকোপ কমে যাওয়ায় অববাহিকার অধিক মানুষ বসবাস করবে। সেক্ষেত্রে এই জাতীয় অতি বর্ষা মৌসুমে বাঁধের নিরাপত্তার জন্য অধিক পানি ছেড়ে দিলে তা ভাটিতে অকষ্মাত বন্যার আশঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে।
  • ভারতীয় ও বার্মা প্লেটের মিথস্ক্রিয়ার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।ভূতাত্ত্বিকভাবে টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল আসলে অসংখ্য 'ফোল্ড ও ফল্ট' বিশিষ্ট এবং এই অঞ্চলে গত ১৫০ বছরে রিক্টার স্কেলে ৭ এর অধিক মাত্রার দু'টি ভূমিকম্প হয়েছে যার মধ্যে শেষটি ছিল ১৯৫৭ সালে যা কিনা টিপাইমুখ প্রকল্প থেকে পূর্ব-উত্তরপূর্ব দিকে মাত্র ৭৫ কিমি দূরে। এছাড়া "জলাধার আবেশিত ভূমিকম্প"এর আশঙ্কা আছে।
  • যদি কোন যান্ত্রিক কারনে বাঁধের টারবাইনগুলো অকার্যকর হয় অথবা গ্রীডের কোন সমস্যার কারনে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয় তখন টারবাইন ছাড়া অন্য কোন পথ দিয়ে সেই সময়ে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা থাকবে কিনা বা থাকলেও তা কত লেভেলে ( সমুদ্র সমতল থেকে ) থাকবে সেটিও বিবেচ্য বিষয়।
  • টিপাইমুখ প্রকল্পে বাঁধ থেকে ১০০ কিমি ভাটিতে একটি সেচ প্রকল্পের প্রস্তাব আছে। আপাতত বলা হচ্ছে এক লক্ষ বিশ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা রাখে হবে। যদি এই প্রকল্পের জন্য পানি অপসারন আর অতিশুষ্ক মৌসুম এর প্রভাব একসাথে হয় সেক্ষেত্রে বরাক নদীর প্রবাহ আশঙ্কাজনক ভাবে কমে যেতে পারে বাংলাদেশে যার প্রভাব হবে আরেকটা ফারাক্কার মত।


প্রিয় পাঠক এখন উপরের আলোচনার আলোকে এটি কি প্রতীয়মান হয়না যে টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য বিপুল পরিমান সমস্যার সৃষ্টি করবে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী সময়কালে।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের আপত্তির মুখেও ভারত সরকার এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে, যদিও একই সাথে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবেই বলে যাচ্ছে যে এই প্রকল্পে বাংলাদেশের ক্ষতি যেন না হয় সেদিকটা তারা দেখবে, সেক্ষেত্রে এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার কি নিশ্চিত হয়েছে (!) যে এতে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবেনা? সেটি কিসের ভিত্তিতে? সেটির সাথে বাংলাদেশ কি সংশ্লিষ্ট ?

এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্ত্বপূর্ন আর তাহচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সংসদীয় কমিটির ভারত সফরের পরে পানিসম্পদ মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন,

টিপাইমুখ বাঁধটি যদি সেচ প্রকল্প হয় তাহলে তা অবশ্যই ক্ষতিকর হবে, এর বিরোধিতা জাতীয়ভাবে করা উচিৎ। কিন্তু বিদ্যুৎ প্রকল্প হলে আরো সমীক্ষা চালিয়ে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।

অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের এমন একটি ধারনা হয়েছে যে সেচ প্রকল্প না হলে সেটি বাংলাদেশের জন্য কম ক্ষতিকর হবে। কিন্তু আদতে তা সত্য নয় যা উপরের আলোচনা থেকে প্রয়ীয়মান। আমাদের সংসদীয় কমিটি কি সেই পথেই হাঁটছে না যে পথে ভারত হাঁটাতে চাইছে।


এই পরিস্থিতিতে আমরা চাইঃ
  • কূটনৈতিক ভাবে বাংলাদেশ সরকার জরুরী ভিত্তিতে "কিভাবে ভারত সরকার কি নিশ্চিত হয়েছে যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান হলে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবেনা" এই প্রশ্নের উত্তর বা ব্যাখ্যা চাক ভারতের কাছে।
  • সেই সাথে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত অগ্রসর হলে কিভাবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে আলোচনা বা আইনের আশ্রয় নিতে পারে সেটি নিয়েও আগ্রসর হবার সময় এসেছে।

উল্লেখ্য যে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসের সংবিধির ৩৮ ধারা অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক যেকোন চুক্তি আনর্জাতিক আইনের উৎস। এই বিচারে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতে সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তি একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের চুক্তি ( Vienna Convention on the Law of Treaties 1969) এবং এই দুই দেশের জন্য আন্তর্জাতিক আইন যা কিনা ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেনে চলতে দুই দেশই বাধ্য। গঙ্গাচুক্তির অনুচ্ছেদ ৯ তে স্পষ্ট বলা আছেঃ
পক্ষপাত বিহীন ও সাম্যতা প্রসুত এবং কোন পক্ষেরই ক্ষতি না করে দুই সরকারই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহমান অন্যান্য আন্তসীমান্ত নদীসমুহের চুক্তির ব্যাপারে একক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার ব্যাপারে একমত
অর্থাৎ এই চুক্তি অনুযায়ী আমরা গঙ্গা ছাড়াও অন্য আন্তঃসীমান্ত নদী যেমন বরাক নদীর ক্ষেত্রে "সাম্যতা" ও " কোন পক্ষেরই ক্ষতি" এই দু'টি পয়েন্টের ভিত্তিতে আইনের আশ্রয় নিতে পারি। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ দল যদি প্রমান করতে পারে টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে ও সাম্যতা বিনষ্ট হচ্ছে তাহলে তার পরেও টিপাইমুখ বাঁধ করতে গেলে তা গঙ্গাচুক্তি ভঙ্গের কারন হবে।

অর্থাৎ এই চুক্তি অনুযায়ী আমরা গঙ্গা ছাড়াও অন্য আন্তঃসীমান্ত নদী যেমন বরাক নদীর ক্ষেত্রে "সাম্যতা" ও " কোন পক্ষেরই ক্ষতি" এই দু'টি পয়েন্টের ভিত্তিতে আইনের আশ্রয় নিতে পারি। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ দল যদি প্রমান করতে পারে টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে ও সাম্যতা বিনষ্ট হচ্ছে তাহলে তার পরেও টিপাইমুখ বাঁধ করতে গেলে তা গঙ্গাচুক্তি ভঙ্গের কারন হবে।



সর্বশেষ সংযোজনঃ 

১) বিবিসির তথ্য মতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহি:প্রচার অনুবিভাগের মহাপরিচালক শামীম আহসান বলেছেন,
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রশ্নে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছে। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পুনরায় নিশ্চিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকারক কিছু ভারত হবে না। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে তারা বিষয়টি নিয়ে ভারতের জাতীয় জলবিদ্যুৎ করপোরেশনের সাথে যোগাযোগ রাখছেন এবং সোমবার নাগাদ এবিষয়ে তারা আরো তথ্য জানাতে পারবেন।
২) প্রথম আলোর সংবাদ মতে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারেক এ করিম বলেছেন,
টিপাইমুখ প্রকল্পের ব্যাপারে আমরা ভারতের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছি।
৩) প্রথম আলোর সংবাদ মতে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সংসদীয় কমিটির সফরকারী দলের অন্যতম সদস্য সাংসদ আবদুর রহমান বলেছেন,
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সম্পর্কে আমাদের অবহিত করা হয়েছিল এবং আমরা সেটি সরেজমিনে দেখেছিলামও। সেই অবধি কোনো স্থাপনা সেখানে নির্মিত হয়নি। আরও সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করে তারা তাদের এ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। প্রতিনিধিদলে আমাদের কারিগরি কমিটি ছিল, তারাও সে জিনিসটি তাদের কাছ থেকে বুঝেছে যে ওখানে বাঁধ বা ড্যাম নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশ বরং উপকৃত হবে। কারণ বর্ষা মৌসুমে যখন পানি থাকবে, তখন বাংলাদেশ প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পাবে এবং যখন শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকবে না, তখন বাংলাদেশ পানি সেখান থেকে পাবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ বরং সংরক্ষিতই হবে।
এই বক্তব্যে কারিগরী কমিটির সম্পর্কে যে উক্তিটি করা হয়েছে তা ভয়াবহ মনে হচ্ছে। আমার জানামতে কারিগরী কমিটিতে ছিলেন অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন।ডঃ হোসেন ব্যাক্তিগত জীবনে আমার শিক্ষক, প্রাক্তন সহকর্মী এবং আমার স্নাতকোত্তর গবেষণা (এম আস সি) সুপারভাইজার। ইতিপূর্বে একটি লেখায় আমি উল্লেখ করেছিলাম যে এখন পর্যন্ত এই সফর সংক্রান্ত বিষয়ে মনোয়ার সারের কোন বিবৃতি দেখিনি । তবে এই সফরের পূর্বে ১২ জুন ২০০৯ সাপ্তাহিক ২০০০ এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি কয়েকটি মন্তব্য করেছিলেন,


" যেহেতু জলাধারে পানি সংরক্ষণ করা হবে তাই এর কিছু প্রভাব ভাটিতে পড়বে। তবে সেই প্রভাব টিপাইমুখ পানি বিদ্যু্ৎ প্রকল্পের সারপ্লাস বিদ্যুৎ বাংলাদেশ ব্যবহারের মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে" ( ভিন্নচিন্তা, সামহোয়ার ইন ব্লগ, ২০ জুলাই)
উল্লেখ্য যে সারপ্লাস বিদ্যুতের প্রসংগে বা তা বাংলাদেশে বিতরনের বা ব্যবহারের প্রসংগের ভারতের কোন বিবৃতি বা প্রস্তাব কখনো চোখে পড়েনি, সেক্ষেত্রে এই ধরনের বক্তব্য এই প্রকল্পের প্রসংগে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিতর্কিত করতে পারে।সাংসদ আবদুর রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্য সেই আশঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে আমার ব্যাক্তিগত অভিমত।


৪) বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান মন্তব্য করেন যে,

‘টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান ভারতের অভ্যন্তরীন বিষয় (ইটিভি, ২০ নভেম্বর, ২০১১; ডয়েচ ভেল, ২১ নভেম্বর ২০১১)’। 

তিনি তুলনা করে বলেন যে,

‘গড়াই নদীর খনন যেমন আমাদের (বাংলাদেশের) নিজস্ব ব্যাপার তেমনি টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীন ব্যাপার।’

কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী আসলেই কি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান ভারতের অভ্যন্তরীন বিষয়? আবেগ নয় বরং যুক্তি দিয়েই আপনার মন্তব্যের উত্তর দেইঃ


নৌচলাচল ব্যাতিরেকে আন্তর্জাতিক নদী সমূহের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের কনভেনশন [৭] মতে, ‘আন্তর্জাতিক নদী বলতে বোঝায় সেই সকল নদী যা একাধিক রাষ্টের মধ্যে দিয়ে প্রবাহমান’ (ধারা ২বি)। সেই বিচারে বারাক নদী একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদীতে বাঁধ নির্মান হলে তার প্রভাব ভাটিতে অর্থাৎ বাংলাদেশে পড়বে। জাতিসংঘের কনভেনশনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ‘আন্তর্জাতিক নদী সমুহের অংশীদার রাষ্ট্রসমূহ ঐ নদীসমুহের ব্যবহারে এই মর্মে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবে যেন তা অন্য দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমানে ক্ষতির কারন না হয়’ (ধারা ৭ এর ১)। উল্লেখ্য যে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসের সংবিধির ৩৮ ধারা অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক যেকোন চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের উৎস। এই বিচারে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতে সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গা চুক্তি একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের চুক্তি এবং এই দুই দেশের জন্য আন্তর্জাতিক আইন । যেহেতু গঙ্গাচুক্তির অনুচ্ছেদ ৯ তে স্পষ্ট বলা আছে যে, ‘পক্ষপাত বিহীন ও সাম্যতা প্রসুত এবং কোন পক্ষেরই ক্ষতি না করে দুই সরকারই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহমান অন্যান্য আন্তসীমান্ত নদীসমুহের চুক্তির ব্যাপারে একক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার ব্যাপারে একমত’ এবং যেহেতু টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে ও সাম্যতা বিনষ্ট হচ্ছে সেহেতু তা গঙ্গাচুক্তি ভঙ্গের কারন হবে এবং প্রকারান্তরে তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হবে।সুতরাং একথা প্রতীয়মান হয় যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান কোন মতেই ভারতের অভ্যান্তরীন বিষয় নয় বরং তা ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং বংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পরিমান ক্ষতি সাধন করে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।


৫) টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগ প্রকাশের প্রতিউত্তরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে যে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না। সেই সম্মেলনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রকল্পটিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকবে, কিন্তু সেচকাজের জন্য নদীর গতিপথ পাল্টে দেওয়া হবে না [৮]।

এখানে কয়েকটি বিষয় গুরুত্ত্বপূর্নঃ

প্রথমতঃ কিসের ভিত্তিতে ভারত জানাচ্ছে যে এই প্রকল্পে বাংলাদেশের ক্ষতি হবেনা? এই প্রকল্পের জন্য ভাটিতে বিশেষত বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক, পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক কি পরিবর্তন হবে সেই বিষয়ক কোন গবেষণা বা নিদেনপক্ষে কোন কেইস স্টাডিও হয়নি ভারতের পক্ষ থেকে। সুতরাং শুধু প্রযুক্তিগত কোন তথ্য ব্যাতিরেকে ঢালাও ভাবে এই প্রকল্পে বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবেনা সেটা মেনে নেয়া অবাস্তব এবং অবান্তর। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ এখনই এই প্রতিবাদ জানানো।


দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশ সরকার শুধু উদ্বেগ প্রকাশ না করে এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রভাব কেন চোখে আঙ্গল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেনা।


তৃতীয়তঃ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে এমনটি মনে হচ্ছে যে তারা মনে করেন যে এই প্রকল্পে সেচের জন্য ব্যারেজ নির্মান না করে শুধু বাঁধ হলে তা তেমন ক্ষতি হবেনা। সেই একই সুর পাওয়া যাচ্ছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনারনালয়ের মুখপাত্রের কথায়। কিন্তু এটি একটি ভ্রান্ত ও অযৌক্তিক মতামত। এই লেখাতে বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধের প্রভাব পরিচ্ছেদটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সেখানে এই বাঁধের বাংলাদেশে প্রভাবের যে নয়টি পয়েন্ট আলোচনা করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ফুলেলতল ব্যারেজ সম্পর্কিত, বাকী আটটিই হচ্ছে বাঁধ সম্পর্কিত। সুতরাং এই যুক্তি অসাড় ও বিভ্রান্তিমূলক।


৬) টিপাইমুখের প্রকল্প নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সংবাদ সম্মেলনে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ( সর্বশেষ সংযোজন ৫ দ্রষ্টব্য) আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরকারের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। আমি বিজ্ঞপ্তিটির [৯] গুরুত্ত্বপূর্ন অংশ নিচে দিচ্ছিঃ

... Dhaka has also noted the Press Briefing issued by the Ministry External Affairs of India today which clarified that the proposed project is designed to be "a hydro-electric project with provision to control floods". As such, this project would not involve any diversion of water e.g. for irrigation purposes.

...In keeping with the letter and spirit of the assurances at the highest level, Bangladesh, as a co-riparian country, would like to underscore the need for prior consultation before initiating any intervention on common rivers like the Barak.
 Given the most cordial relations existing between the two countries, Bangladesh would hope that the Government of India would share all relevant details of the proposed Project in full transparency and also about any further step that it may take in connection with the project. This would be critical in avoiding any gap in understanding or allay concerns in Bangladesh. 

অর্থাৎ বাংলাদেশ মনে করে যে টিপাইমুখের প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে কোনো ধরনের উদ্বেগ ও ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে ভারতের উচিৎ ছিল স্বচ্ছতার সঙ্গে বাংলাদেশকে তথ্য দেয়া। আর ভাটির দেশ হিসেবে বরাকসহ যেকোনো নদীতে কোনো অবকাঠামো তৈরির আগে বাংলাদেশকে আগে জানানোটা জরুরি।সেই সাথে বাংলাদেশ এটাও মনে করে যে এই প্রকল্পের বিষয়ে পরবর্তী কোন পদক্ষেপে বাংলাদেশকে অবহিত করার প্রয়োজন রয়েছে।


উল্লেখ্য যে এই প্রেস রিলিজেও বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে এই প্রকল্পে বাংলাদেশের প্রভাব বা ক্ষতিকর দিক নিয়ে কোন বক্তব্য দেয়নি বা আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতকে তা খতিয়ে দেখার বা এই বিষয়ে যৌথ গবেষনার কোন প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেনি। সরকারের এই অবস্থান দুঃখজজনক।


৭) বাংলাদেশের পরররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি সম্প্রতি সাংবাদিক সম্মেলনে [১০] টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। তার উক্তি সেই সাথে তার যুক্তি খন্ডন নিচে করছিঃ

“When we talk with Nepal and Bhutan about a dam twice the size of the Tipaimukh (dam), nobody objects to it, but criticism arises in the cases of Tipaimukh”

মাননীয় মন্ত্রী আপনি সঠিক, মানুষ প্রতিবাদ করেনি বরং আমাদের বিশেষজ্ঞরা সেটাই চেয়েছিল। সেই সাথে এটাও সবার জানা উচিত যে বাংলাদেশের সেই প্রস্তাব কিন্তু ভারত সমর্থন করেনি। করলে গঙ্গাচুক্তি হতো ১৯৭৪/৭৫ সালেই। আপনার জ্ঞাতার্থে এই নিয়ে আরো দু'কলম লিখিঃ


গঙ্গা চুক্তির আপস আলোচনার দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৯৭৪-১৯৭৬) যেহেতু গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ের সমস্যার উৎপত্তি হয় তাই এই পর্যায়ে ‘গঙ্গায় পানি বৃদ্ধির’ বিষয়টি সামনে আনা হয়। বাংলাদেশ প্রস্থাব করে যে ভারত বর্ষা মৌসুমের বিপুল পরিমান পানিকে উজানের জলাধারে (ভারতে না নেপালে) সঞ্চিত করে তা শুস্ক মৌসুমে ব্যাবহার করতে পারে, অন্যদিকে ভারত একটি সংযোগ খালের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র (বাংলাদেশে যমুনার উজানে মূল নদীটির নাম ব্রহ্মপুত্র) থেকে বিপুল পরিমান পানি গঙ্গায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করে।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন বিশেষজ্ঞরা বাঁধ করতে চেয়েছিল উজানে? কারন তারা চেয়েছিল যেন তাতে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গায় পানি বৃদ্ধি পায় এবং সেই বর্ধিত পানি ভারত প্রত্যাহার করতে পারে ফলে বাংলাদেশকে আর পানিবিহীন থাকতে হয়না শীতকালে। আর তাছাড়া এখানে একটি জিনিস বলে নেয়া ভাল যে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ আর জলবিদ্যুৎ বাঁধ এক জিনিস নয়। বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ দিয়ে দুই ভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রন করা যায়, প্রথমতঃ বাঁধের নিচে একটা সুড়ংগ (স্লুইস ওয়ে) থাকবে যার ধারন ক্ষমতা হবে ভাটির নদীর সর্বোচ্চ পরিবহন ক্ষমতার সমান। ফলে স্বাভাবিক ভাবে বাঁধের উজানে ততটুকু পানিই জমবে যতটুকু পানি ভাটির নদীর পরিবহন ক্ষমতার থেকে বেশী। এক্ষেত্রে মোটামুটি ভাটির নদীর স্বাভাবিক হাইডোগ্রাফ একই রকম থাকে শুধু মাত্র পিক প্রবাহ বন্যার সময় সেটি ধ্রুবক হয়ে যায়, আরে দ্বিতীয়তঃ বাঁধের সাথে গেইটেড স্পিলওয়ে/স্লুইস গেইট থাকবে যা দিয়ে ভাটিতে কতটুকু পানি যাবে তা নির্ধারণ করা যায়। এক্ষেত্রে বর্ষা মৌসুমে পানি সঞ্চয় করা হবে এবং তা দিয়ে সারাবছর একটি মোটামুটি গড় প্রবাহ সরবরাহ করা হয়। প্রথম প্রকারের বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হবে কারন এক্ষেত্রে পানির প্রবাহ আসলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আসলে ভাটির অঞ্চলের পরিবহন ক্ষমতার দ্বারা কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে তা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ আসলে উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমানের দ্বারা কারন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন নিরবিচ্ছিন বা ধ্রুব প্রবাহ।দ্বিতীয় প্রকারের বাঁধের ক্ষেত্র আসলে বিদুৎ উৎপাদনের জন্য আদর্শ। বাংলাদেশ চেয়েছিল প্রথমটি। আর টিপাইমুখ প্রকল্প হচ্ছে দ্বিতীয়টি।


“The criticism is not correct at all, it is completely motivated. Those who make such criticism turn a blind eye to reality. ...

Bangladesh trusts in the assurance given by the India’s highest leadership about the Tipaimukh dam project. ”

মাননীয় মন্ত্রী আমি যদি বলি, 'কোন কিছু স্টাডি না করে টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের কো্ন ক্ষতি করবেনা' এই আশ্বাসে আশ্বস্ত থাকা বরং অধিক অবাস্তবিক বা আপনার ভাষায় অন্ধবিশ্বাস। উদাহরনসরূপ বলি, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সাথে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মতৈক্যের ( আপনার ভাষায় সর্বোচ্চ আশ্বাস এতে বাংলাদেশের ক্ষতি হবেনা) ভিত্তিতেই ব্যারেজের কার্যক্রম শুরু হয়।মতৈক্যটি কিছুটা এরকমঃ ভারত বিকল্প খাল দিয়ে ১১,০০০ থেকে ১৬,০০০ কিউসেক ( ১ কিউসেক=প্রতি সেকেন্ডে ১ ঘনফুট পানির প্রবাহ) পানি গঙ্গা থেকে অপসারন করবে আর বাকী প্রবাহ বাংলাদেশে চলে যাবে। এখানে উল্লেখ্য যে ফারাক্কা ব্যারেজ করার উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা করা। এর জন্য গঙ্গা থেকে সংযোগ খাল দিয়ে পানি হুগলী নদীতে স্থানান্তর করা হয় যার নকশাকৃত ধারন ক্ষমতা ৪০,০০০ কিউসেক। এর কম যেকোন প্রবাহ ভারতের প্রয়োজনের তুলনায় কম। সুতরাং ভারত আমাদেরকে সর্বোচ্চ আশ্বস্ত করে পরীক্ষামূলক ভাবে মাত্র মাত্র ১১০০০ থেকে ১৬০০০ কিউসেক ভাইভার্ট করাকে রাজী করিয়ে নিল। আপনার জ্ঞাথার্থে বলছি, এই পরীক্ষামুলক পানিবন্টন মাত্র ৪১ দিন স্থায়ী হয়।১৯৭৬ সালে আগের মতৈক্যের নবায়ন না করে ভারত একতরফা ভাবে গঙ্গার পানি অপসারন করে যার ভয়াবহ প্রভাব পড়ে পদ্মানদী কেন্দ্রিক বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপর এবং একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৭৭ সালে। বাংলাদেশ বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করে এবং সাধারন পরিষদ এক্ষেত্রে একটি মতৈক্যের বিবৃতি দেয় যার ফলশ্রুতিতে বিষয়টির একটি সুষ্ঠূ সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত ঢাকাতে মন্ত্রীপরিষদ পর্যায়ের বৈঠকের ব্যাপারে একমত হয়।



যুক্তি খন্ডনঃ টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশের উপকৃত হবে
 সরকারের কারিগরী কমিটির মতে টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশের উপকার হবে দুই ক্ষেত্রে, একঃ বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমবে, দুইঃ শুষ্ক মৌসুমে অধিক পানি পাবে। আমি এই দুই যুক্তিরই খন্ডন [৪] করছি নিচেঃ

প্রথমতঃ বন্যা আসলে কি কমবে ?


বরাক নদীর ভাটির দিকের অঞ্চল সিলেটের হাওড় এলাকায় বর্ষার শুরুতে আগাম বন্যা হয় আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি কমে আসে।টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের পর বর্ষার শুরুতে রিজার্ভারে পানি ধরে রাখার প্রয়োজন পড়বে আবার বর্ষার শেষের দিকে পানি ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। এর ফলে বর্ষার শুরুতে বন্যা কমে আসতে পারে আবার বর্ষার শেষে বন্যার প্রকোপ বাড়তে পারে।এর প্রভাব বাংলাদেশের উপরেও পড়বে [৫]। অর্থাৎ বন্যা মুক্ত হবার যে কথা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি সঠিক নয়, যেটি হতে পারে তা হলো বন্যার স্বাভাবিক সময় পরিবর্তিত হতে পারে।


এছাড়া এই লেখাতেই উল্লেখ করেছি যে বাঁধের কারনে এর উজানে জলাধারে সব পলি সঞ্চিত হবে, ফলে যে পানি ভাটিতে আসবে তাকে এক কথায় বলা যায় "রাক্ষুসী পানি"। এই পানি পলিমুক্ত বলে এর পলিধারন ক্ষমতা অনেক বেশী আর তাই এটি বাঁধের ভাটিতে ১০০ থেকে ১৫০ কিমি ব্যাপী ব্যাপক নদী ক্ষয়ের সৃষ্টি করবে।বাংলাদেশ বাঁধের ২০০ কিমি ভাটিতে থাকায় এই বিপুল পরিমান পলি বরাক নদী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। কিন্তু পানির প্রবাহ তুলনামূলক ভাবে কমে যাওয়ায় পলি বহন করার ক্ষমতা কমে যাবে, এবং তা সুরমা ও কুশিয়ারার বুকে জমা হবে। এতে নদীর নাব্যতা ও গভীরতা হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে আগে যেটা স্বাভাবিক বর্ষাকালীন প্রবাহ ছিল প্রকারান্তরে তা বন্যা আকারে আসতে পারে এই এলাকায়।


আর যদি ধরেই নেই যে বাঁধের ফলে সিলেট আর মৌলভীবাজার এলাকা বন্যামুক্ত হবে সেখানেও প্রশ্ন আসে, এই তথাকথিত বন্যামুক্ত হওয়া কতটা ইতিবাচক? এ প্রসংগে বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞ ডঃ জহির উদ্দীন চৌধুরীর বলেছিলেন[৬],


সাধারণভাবে আমরা ধরে নেই যে বন্যার সময় যদি পানি কমানো যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে যখন পানির পরিমান কম থাকে তখন পানির সরবরাহ বাড়ানো যায় তা খুবই ভাল একটি বিষয়। সে বিবেচনা থেকেই ভারত টিপাইমুখ বাঁধের পেছনে তাদের যুক্তি হিসেবে এই বিষয়টি তুলে ধরেছে।কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি অনন্য বৌশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে রয়েছে বিশাল জলাভুমি ও অসংখ্য হাওড়। এর একটি নিজস্ব ইকোসিস্টেম রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এখানে বর্ষার সময় পানি বাড়বে, বন্যা হবে ও শুষ্ক মৌসুমে অনেক এলাকা শুকিয়ে যাবে, এর উপর ভিত্তি করেই সেখানকার ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। ফলে বন্যার পানি কমা বা শুষ্ক মৌসুমে পানি বেশী পাওয়ার যে আশ্বাস ভারত দিচ্ছে তা এই এলাকার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ শুষ্ক মৌসুমে অধিক পানি কি ইতিবাচক


এ প্রসংগে এই লেখাতেই উল্লেখ করেছি যে, বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের এই হাওড়গুলি শুষ্ক মৌসুমে যখন শুকিয়ে যায় তখন কৃষকরা সেখানে বোরো ধান বপন করে যা এই অঞ্চলের একমাত্র ফসল। এই ধান বর্ষা আসার আগেই ঘরে উঠে যা এই লোক গুলির বছরের একমাত্র শর্করার যোগান দেয়।বাঁধের কারনে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এই এলাকার চাষাবাদ ব্যহত হবার আশঙ্কা আছে। আর যদি ধরেও নেই যে এই বর্ধিত প্রবাহ চাষাবাদের জমিকে খুব বেশী প্লাবিত করবেনা সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়। এই জমিগুলো বন্যার সময় প্লাবিত হওয়ায় বিপুল পরিমান পলি জমে। এখন বর্ষা মৌসুমে পানি কমে যাওয়ায় তা আগের মত আর প্লাবিত হবেনা ফলে জমিগুলো তাদের উর্বরতা হারাবে।


বিদ্রঃ টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশের এর প্রভাব নিয়ে সচলায়তন থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে “টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট” ই-বুক। এই ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য এই ইবুকটি ছড়িয়ে দেবার আহবান জানাচ্ছি সবাইকে। এই লিঙ্ক থেকে বইটি ডাওনলোড করা যাবে।

তথ্যসুত্রঃ

[১] প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর ২০০৯
[২] মহামানবের অপেক্ষায় আমাদের দিনযাপন, দৈনিক কালের কন্ঠ, ৪ অগাষ্ট, ২০১০।
[৩] NHPC signs Promoter’s Agreement with SJVNL and Govt. of Manipur for implementation of 1500 MW Tipaimukh H.E (Multipurpose) Project in Manipur
[৪] টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট, জাহিদুল ইসলাম, সচলায়তন প্রকাশনা।
[৫] ডঃ আইনুন নিশাত, ২৮ জুন ২০০৯, ‘দুই দেশেই টিপাইমুখ বাঁধের পরিবেশগত প্রভাবের জরিপ চালাতে হবে’, প্রথম আলোকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকার।
[৬] ডঃ জ়হির উদ্দিন চৌধুরী, ১২ জুলাই ২০০৯, ‘বরাক নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করা হলে তা হবে বিপদ জনক’, প্রথম আলোকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকার।
[৭] UN Convention on the Law of the Non-navigational Uses of International Watercourses
[৮] টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না: ভারত
[৯] বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রেস রিলিজ
[১০] Dipu Moni slams Tipai critics