রবিবার, ২৭ মে, ২০১২

কেমন হল পানি আইন-২০১২


 ১)

পানি একটি সীমিত সম্পদ, আর যেহেতু বাংলাদেশের জীবনধারা গড়ে উঠেছে পানিকে কেন্দ্র করে তাই পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য গুরুত্ত্বপূর্ন একটি বিষয়। মূলত মানুষের জীবনধারন, আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ব্যাপক, সমন্বিত ও সুষম ভিত্তিতে দেশের পানিসম্পদ ব্যাবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে জাতীয় পানি নীতি ঘোষিত হয়। জাতীয় পানি নীতি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত কাঠামো প্রনয়নের লক্ষ্যেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রস্তাবিত বাংলাদেশ পানি আইন ২০১২ প্রকাশ করেছেনয়টি অধ্যায়ে মোট ও ৩৯ টি ধারার মাধ্যমে প্রকাশিত এই প্রস্তাবিত আইনটি মূলত জাতীয় পানি নীতির আলোকেই প্রণিত হয়েছে যা অবিলম্বে কার্যকর করা হবে। প্রস্তাবিত আইনটির প্রথম অধ্যায়টিতে আইনে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয়ের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে এবং বাকী আটটি অধ্যায়ে আইনের মূল বিষয়বস্তু আলোচনা করা হয়েছে। এই নিবন্ধে এই প্রস্তাবিত পানি আইন ২০১২ এর একটি সার্বিক পর্যালোচনা থাকবে। প্রথমে প্রস্তাবিত পানি আইনের ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়ে পর্যালোচনা থাকবে, এর পরবর্তীতে এই আইনের কিছু অসংগতি বিশ্লেষণ করা হবে, এবং পরিশেষে এই আইনে একটি গুরুত্ত্বপূর্ন বিষয় অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আলোচনা থাকবে।
 
২)
প্রথমেই আসি প্রস্তাবিত পানি আইনে সরকারের গৃহীত ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো নিয়ে। যেসব বিষয়ে সরকার ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হচ্ছেঃ এক, একটি পানি সম্পদ পরিষদ গঠন করার প্রসংগ যা রাষ্ট্রের পানিসম্পদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ হিসেবে কাজ করবে; দুই, নদী অববাহিকা ভিত্তিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা, খরা ও পানি দূষণের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে তথ্য বিনিময় ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ; তিন, পানি ব্যবহারের জন্য অনুমতিপত্র প্রদান ও পানি সম্পর্কিত ট্রাইব্যুনাল স্থাপন, এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ব্যতিরেকে পানি সম্পদের বণ্টন, ব্যবহার, আহরণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ, সুরক্ষা ও প্রবহমান পানির উপর অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ রহিত করন; চার, পানীয় জল এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও পয় নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় পানিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা; পাঁচ, সেচ ও নগরে পানি সরবরাহ পরিকল্পনায় ভূপরিস্থ, ভূগর্ভস্থ ও বৃষ্টির পানির সমন্বিত ব্যবহার বিবেচনায় আনার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা; ছয়, যেসব জলাশয় অভিবাসী পাখির চারণভূমি হিসেবে চিহ্নিত সেগুলোতে কোন রকম নিষ্কাশন প্রকল্প পরিহার করা; সাত, প্রাকৃতিক নিষ্কাশনকে বিবেচনায় না এনে যেকোন ধরনের পানিসম্পদ বিষয়ক প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন রহিত করন; আট, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় অনুমতি ব্যতিরেকে নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তিত হয় বা হতে পারে এমন স্থাপনা নির্মাণ রহিত করন; নয়, অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত পানি ব্যবস্থাপনা সংগঠন গঠন এবং তার নিয়মাবলী নির্ধারণের উদ্যোগ; এবং দশ, পানি আইনের আওতায় দণ্ড যোগ্য অপরাধসমূহ চিহ্নিত করণ ও এর কারণে শাস্তি ও জরিমানা নির্ধারণ।

কয়েকটি ইতিবাচক পদক্ষেপ বিশদ আলোচনার দাবী রাখে। প্রথমেই আসে অংশগ্রহণমূলক পানি ব্যবস্থাপনার প্রসংগটি। সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে স্টেকহোল্ডার বা যাদের জন্য প্রকল্প করা হবে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। পানিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পে স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ। তবে এই বিধি, গঠন প্রকৃতি ও কার্যাবলী এমন ভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে তাতে সত্যিকার অর্থেই সাধারণ জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে অপরিকল্পিত ভাবে বা স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় না করে গৃহীত প্রকল্প পরিশেষে ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণ সরূপ বলা যেতে পারে সাম্প্রতিক কালে পঞ্চগড় সদর উপজেলায় করুম নদের ওপর পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করা স্লুইসগেট বা পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামোর কথা যার লক্ষ্য ছিল পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধা। ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো এক বছরেই পরিত্যক্ত হয়েছে কারণ এর কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে প্রায় ৬০০ একর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। প্রকল্পটি করার আগে স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে কোনরূপ মতামত বা পরামর্শ নেওয়া হয়নি এবং স্থানীয় কৃষকদের দাবির মুখে সেই বাঁধ কেটে দিতে হয়েছে স্থানীয় প্রশাসনকে (দৈনিক প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১২) এছাড়া, পানির মূল্য নির্ধারণে পানি সরবরাহের প্রকৃত খরচ, পরিবেশ সংরক্ষণের খরচ, জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থান (দরিদ্র-অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য মূল্য কম), পানির ব্যবহারের ধরণ (মৌলিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূল্য কম, শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যবহারে মূল্য বেশী), ইত্যাদি নিয়ামকে বিবেচনায় আনা ইতিবাচক।

৩)

বিপরীতক্রমে, বাংলাদেশ পানি আইন ২০১২ পর্যালোচনা করলে কিছু কিছু বিষয়ে অসংগতি লক্ষ্য করা যায়ঃ এক, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে অভিন্ন নদী অববাহিকা নিয়ে চলমান বা আসন্ন সংকট নিরসন নিয়ে কোন দিক নির্দেশনা বা নীতি এখানে উল্লেখ করা হয় নাই যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম; দুই, রাষ্ট্রের সকল পানিসম্পদের মালিকানা সরকারের এবং কোন ব্যক্তিকে শুধুমাত্র গৃহস্থালি কাজে ও সাধারণ কৃষিকাজে প্রাকৃতিক জলাধার বা জলাশয়ের পানি সীমিত ব্যবহারের অধিকার দেয়া তবে এই সীমিত ব্যবহারের সংজ্ঞাপন করা হয়নি; তিন, যদিও ভূপরিস্থ, ভূগর্ভস্থ ও বৃষ্টির পানির সমন্বিত ব্যবহার বিবেচনায় আনার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে তবে এ বিষয়ে বিশদ দিক নির্দেশনার বিষয়টি এখানে উহ্য রয়ে গিয়েছে; চার, প্রাকৃতিক নিষ্কাশনকে বিবেচনায় না এনে যেকোন ধরনের পানিসম্পদ বিষয়ক প্রকল্প গ্রহণ বা বাস্তবায়ন রহিত করন করা হলেও অন্যান্য প্রকল্পের (সরকারী বা বেসরকারি আবাসন প্রকল্প)ক্ষেত্রে কোন দিক নির্দেশনা আসেনি; পাঁচ, অপরিকল্পিত ড্রেজিং বা শাখানদীর গতিপথ বন্ধের ক্ষেত্রে যথাযথ পরিবেশগত প্রভাব যাচাই (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট বা ‘ই আই এ’)এর প্রয়োজনীয়তা এই আইনে উল্লেখ করা হয়নাই; ছয়, বন্যা ব্যবস্থাপনার জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের বৈধতা দেয়া হলেও তা নির্মাণের আগে পরিবেশগত প্রভাব যাচাই বা অকাঠামোগত বন্যা ব্যবস্থাপনা বা ‘লিভিং উইথ ফ্লাড’ এর দিকে অধিক নজর দেয়া এরকম কোন আলোচনা বা নীতিমালা এখানে আসেনি; সাত, দুইটি ধারাতে আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রয়েছেঃ ধারা ৩০ (১) এর ‘চ’ তে উল্লেখ আছে যে, ‘গৃহস্থালি ও সাধারণ কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানির মূল্য-অব্যাহতি থাকবে,’ অন্যদিকে একই ধারার ‘জ’ তে উল্লেখ আছে, ‘পানির মৌলিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম মূল্য ও বাণিজ্যিক ও শিল্প ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশী মূল্য ধারণ করা হবে।’ একই ধারার একদিকে মূল্য-অব্যাহতি প্রদান করার পর পুনরায় তুলনামূলক কম মূল্য নির্ধারণ এর বিষয়টি ঠিক স্পষ্ট নয়; এবং আট, শুল্ক ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা কি সরকার কর্তৃক গঠিত কোন কমিটি বা সংস্থার উপর ন্যস্ত হবে নাকি সেটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপরও ন্যস্ত হতে পারে সেই বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি। 

তবে এই আইনের সবচেয়ে আলোচিত বা বিতর্কিত অন্তর্ভুক্তি সম্ভবত ধারা ৩৯ (সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত কার্য) যাতে উল্লেখ আছে, এই আইনের আওতায় সরল বিশ্বাসে সম্পাদিত কার্যের ফলে কোন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান অথবা গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হইলে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে তজ্জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়/ পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা/ কোন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা/ কর্তৃপক্ষ/ সরকারের কোন কর্মকর্তা অথবা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন আইনগত কার্যক্রম (Any Legal Proceedings) গ্রহণ করা যাইবে না  সত্যিকার অর্থে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এর অধীনে গৃহীত পানিসম্পদ বিষয়ক কোন উন্নয়ন কার্যক্রম এর ফলে স্টেকহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেক্ষেত্রে সেই প্রকল্পের পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করার অধিকার সত্যিকার অর্থে পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষগুলোর জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে নাকচ করে দেয়।
৪)

জাতীয় পানি নীতিতে নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতি ছিল দীর্ঘমেয়াদী যৌথ পরিকল্পনা প্রণয়নে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ক্ষেত্রে পানিসম্পদ উন্নয়নে অববাহিকাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং এর ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই প্রস্তাবিত পানি আইনেও নদী অববাহিকা ভিত্তিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা, খরা ও পানি দূষণের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে তথ্য বিনিময় ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেবার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে যেটি আসেনি সেটি হচ্ছে এক অববাহিকা থেকে অন্য অববাহিকায় পানি স্থানান্তরের বিষয়টি। আন্তঃঅববাহিকা পানি স্থানান্তর রহিতকরন বর্তমান বিশ্বের একটি গুরুত্ত্বপূর্ন আলোচিত বিষয়। উদাহরন সরূপ বলা যেতে পারতে কানাডার কথা। এখানে আলবার্টা অংগরাজ্যে ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য পানিসংকটের কারনে আন্তঃঅববাহিকা পানি স্থানান্তর রহিত করণ করা হয়েছে। বর্তমান কালে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যা মূলত একট আন্তঃঅববাহিকা পানি স্থানান্তর প্রকল্পের বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশদ আলোচনাএছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদীর চীনের অংশ ইয়ারলুং সাংপুর পানি দক্ষিণ চীন থেকে উত্তর চীনে স্তানান্তরও পরিকল্পনাধীন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিজস্ব পানি আইনে এই আন্তঃঅববাহিকা পানি স্থানান্তর রহিত করণ করা হলে ভারত ও চীনের ঐসব প্রকল্পের বিপরীতে বাংলাদেশের একটি শক্ত অবস্থান তৈরী হতো বলে আমার বিশ্বাস। 

বিদ্রঃ লেখাটি গত ২৭ মে তারিখে দৈনিক যুগান্তর প্রকাশিত হয়েছে। 
লিঙ্কঃ এইখানে।