বৃহস্পতিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

তবুও আশা ……

জীবন এখানে অনেক যান্ত্রিক, একঘেয়ে, বিরক্তিকর| নিজের কোমল অনুভুতিগুলো কখন যে ভোঁতা হয়ে গেছে তা নিজেও জানিনা| যে সোনার হরিণের খোঁজে নিজের সংস্কৃতি ছেড়ে চলে এসেছি অনেক দূরে সেট চলছে সানন্দে| দিন রাত ধরে গবেষণা করে এ জাতির উন্নতি করছি আমরা সবাই, বিনিময়ে পাচ্ছি আমাদের উচ্চ শিক্ষার সনদপত্র, উন্নত আর ঝামেলাবিহীন জীবনের নিশ্চয়তা| মাঝে মাঝে মনে হয় এই ঝামেলাবিহীন জীবনই সকল সমস্যার উৎস| একসময় হাঁপিয়ে উঠি, যান্ত্রিকতার নিষ্পেষনে নিজেকে অসহায় মনে হয়| মনে পড়ে যায় বুয়েটের সেই দিনগুলির কথাঃ সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে ক্লাসে যাওয়া, ক্লাসের ফাঁকে ক্যাফেটিরিয়াতে সকালের নাস্তা করা, ক্যাফের সামনে লাল ইটের পিচে ক্রিকেট খেলা, ‘নিরবে’ খেতে যাওয়া, দুপূরের সেশনাল ক্লাসে একটা কফির গ্লাস নিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে ঢোকা, বিকেলের সোনালী রোদে ক্যাম্পাসে আড্ডা দেওয়া, আরও কত কি ! 


মনে আছে আমরা যখন প্রথম বর্ষে পড়ি তখন ঝাঁকে ঝাঁকে সবাই একসঙ্গে ঢুকে পড়লাম ডিবেটিং ক্লাবে| চারিদিকে অচেনা অনেক মুখ| আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল বন্ধুত্বের বৃত্তের পরিধি| কখন যে আস্তে আস্তে জড়িয়ে পরলাম আরও অনেক সংগঠন গুলিতে (বুয়েট ড্রামা সোসাইটি, মূর্ছনা, কন্ঠ বুয়েট, বুয়েট সেফ্‌টি মুভমেন্ট)মনে নেই| শুধু জানি, নিজের সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষন অনেক গুন বেড়ে গিয়েছিল বুয়েটে এসে এই সব সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে যুক্ত হয়ে| তাই দেশ ছেড়ে এসেও ভুলতে পারিনি সেই দিনগুলোকে| তীর্থের কাকের মত বসে থাকি, কখন এই তুষারে ঢাকা শহরটাতে একটু বাঙালি সংস্কৃতির ছোঁয়া পড়ে|
গত বছর ২০০৭ এ আমাদের এডমন্টনে একটা বাঙলা উৎসব হলো| এখানে বাঙালি মানে আমরা বাংলাদেশিরা, আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা| ঢাক ঢোল পিটিয়ে টানা দুই দিন ধরে নজরুল রবীন্দ্রচর্চা হলো| সবার মুখে তখন একটাই কথা রবীন্দ্র নজরুল ছাড়া বাঙালি সংস্কৃতি হয় নাকি| সেদিন গর্বিত হয়েছিলাম নিজেকে বাঙালি মনে করে| ভাবলাম শেষের দিন অনেক রাত অবধি থাকব| হায়রে ভাগ্য আমার, সেই রাত অবধি থাকাটাই কাল হয়ে দাঁডালো| মধ্যরাতের কিছু আগে মঞ্চে উঠলেন জনৈক পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী যিনি সম্প্রতি খুব নাম ডাক করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা করে| ব্যাস, শুরু হল হিন্দি গানের মাতম আর সেই সাথে আমাদের আমাদের আধুনিক বাঙালিদের আধুনিক নৃত্য| এই না হলে আর সংস্কৃতি চর্চা| তবুও ভাল লাগে অন্তত দূটো দিনতো পেলাম নিজের ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য| 

মাঝে মাঝে বিদেশে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মদের কথা ভেবে আঁৎকে উঠি| এখানে বড় হওয়া বাংলাদেশি প্রজন্মকে দেখলে মাঝে মাঝে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়| মনে আছে একবার ‘ইত্যাদি’ তে হানিফ সংকেট ঈদের অনুষ্ঠানে বিদেশের অনেক তারকাকাদেরকে দিয়ে দর্শকদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিল| ‘ঈদ মোবারক’ কথাটি ইংরেজিতে বানান করে লিখে তাদের পড়তে দেয়া হত আর আমরা আনন্দিত হতাম প্রিয় তারকাদের মুখে বাংলা ভাষা শুনে| আর আজ যখন একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে এই উত্তর মেরুর নিকটবর্তী কোন শহরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করি, তখন আমাদের সন্তানদেরকে “ কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটি ……” কবিতাটি, কিংবা “ আমি বাংলায় গান গাই …” গানটি ইংরেজি বানানে লিখে দিতে হয়| তারপর তারা মঞ্চে যেয়ে বিদেশী তারকাদের মত বিদেশী ঢং এ আমাদের কবিতা পড়ে, গান গেয়ে শোনায়| আমরা পুলকিত হই, গর্বিত হয়ে হাততালি দেই| তারপর অনুষ্ঠান শেষ হয়, সেই সাথে শেষ হয়ে যায় একুশ, বাংলা ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি| 

মাঝে মাঝে খুঁড়িয়ে চলা এই সংস্কৃতিকে দেখে বড় মায়া হয়, কষ্ট লাগে, কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়ে যায় বিপরীত একটা চিত্র| আজকাল যখন এখানে বসে দেশের অনুষ্ঠানগুলো দেখি, অবাক হয়ে লক্ষ্য করি ওরা কি সুন্দর ইংরেজী ঢং এ বাংলা বলছে| পৃথিবীর দুই প্রান্তে কি সুন্দর সদৃশ্যতা| তাহলে কাদেরকে দোষ দেব, ওদেরকে যারা বাংলাদেশে বসে বসে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করছে, নাকি যারা এদেশে বেড়ে উঠে ইংরেজী বানানে বাংলা কবিতা পড়ছে? আমি সমাধান খুঁজে পাইনা, হারিয়ে যাই নিজের প্রশ্নের মাঝে|
আমি জানি আমার প্রশগুলোর উত্তর আমার জানা নেই, হয়ত কারোরই জানা নেই| তবুও আশা বেঁধে রাখি, স্বপ্ন দেখি সেই দিনগুলোর যেদিন আমাদের প্রবাসি পরবর্তী প্রজন্মকে আর কখনো নজরুল রবীন্দ্র বা জীবনান্দের কবিতা বা গানগুলো ইংরেজী বানানে লিখে দিতে হবেনা, বাঙলা উৎসবের করূণ পরিনতি ঘটবেনা হিন্দি গানের মধ্য দিয়ে| বাঙালি জাতি তার স্বকীয়তা নিয়ে জয় করে নেবে অন্য সংস্কৃতির আগ্রাসনকে|