মঙ্গলবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

এডমন্টনে প্রথম বাংলা নাটকঃ একটি স্বপ্নপূরন

এডমনটনে আমি আসলাম ২০০৭ এর জানুয়ারীতে| প্রায় তুষারে ঢাকা এই শহরটাতে এসে মনটা প্রথমে অসম্ভব খারাপ হয়ে গিয়েছিল| যে শহরটাকে ট্রাফিক জ্যামের শহর বলে গালি দিতাম, কেন জানি সেই শহরটাকে বড্ড বেশি মনে পড়া শুরু করল| আস্তে আস্তে সময় গড়াল, একটু একটু করে এখানকার বাঙালী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি| গত ২০০৮ এর ফেব্রুয়ারী মাসের কথা| আমরা একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম| এমনি এক আড্ডাতে একদিন রাফাত ভাইএর সাথে পরিচয়| রাফাত ভাইএর পুরো নাম ডঃ রাফাত আলাম| সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রতি প্রায় নেশাচ্ছন্য এই মানূষটির পুরো পরিবার সম্পৃক্ত ছিল ঐ অনুষ্ঠানে| আড্ডার ফাঁকে শোনা হল তিনি একসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যদলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন| শুনে আমি বেশ পুলকিত হলাম কারন এককালে বুয়েট ড্রামা সোসাইটির সদস্য হবার কারনে নিয়মিত নাটক করতাম যদিও পরবর্তীতে পড়াশুনার চাপ বেড়ে যাওয়ায় আর সময় দেয়া সম্ভব হয়নি| প্রায় মজা করেই সেদিন বলেছিলাম ভাইয়া এখানে নাটক করা যাবে কিনা? 
শুনে রাফাত ভাইও বেশ আগ্রহ বোধ করলেন| সেইখানে স্বপ্নের সূচনা| এর কিছুদিন পরে তখনকার এডমনটনের বাংলাদেশ কানাডা সংঘের সভাপতি রাসেল ভাইয়ের কাছে শুনতে পেলাম আসলেই একটা নাটক মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং সম্ভাব্য মঞ্চায়নের তারিখ নভেম্বরের ১৫| শুরু হল নাটক বাছাইএর কাজ| ব্যাপারটি বেশ জটিল কারন এমন একটি পান্ডুলিপি জোগাড় করতে হবে যেটি দিয়ে মানুষকে বিনোদনও দেয়া যাবে আবার একটি সুস্থ বক্তব্যেরও প্রকাশ ঘটবে|সিদ্ধান্ত হলো শৈলেন গুহের “ফাঁস” নাটকটি করা হবে| 
নাটকের গল্পটি শুরু হয় একটি গোয়েন্দা অফিসকে কেন্দ্র করে|গোয়েন্দাদের প্রধান ডি.এস.পি. ঘরে স্ত্রীর শাসনে আর অফিসে অধস্তনদের বোকামী কর্মকান্ডে অস্থির|নিজের ছেলেও পড়াশুনা বাদ দিয়ে বিপথে যাবার উপক্রম|ঠিক সেই মুহূর্তে এস.পি.র কাছ থেকে নির্দেশ আসে দুটি গুরুত্বপূর্ন কেস তদন্ত করার জন্য|একটি হলো চিত্রনায়ক নবীন কুমারের বাসা থেকে কালো টাকা উদ্ধার করা আর অপরটি সোনালী রায় নামের এক মহিলা চোরাকারবারীরকে আটক করা|এবারও যথারীতি গোয়েন্দারা বোকামীর পরিচয় দিতে থাকে |একদিকে কেসের দূরাবস্থা, অন্যদিকে ছেলের লাপাত্যা হওয়া এবং তা নিয়ে স্ত্রীর সাথে বাকবিতন্ডাতে বিপর্যস্ত ডি.এস.পি. নিজের ডিমোশন ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনা| শেষ পর্যন্ত নানা ঘটনার আবর্তে গোয়েন্দারা দুজনকেই ধরে আনতে সক্ষম হয়| কিন্তু নায়কের ফ্যানদের কর্মকান্ড, নিজের স্ত্রীর ছেলেমানুষী, মহিলা চোরাকারবারীর সাথে এক গোয়েন্দার ব্যাক্তিগত সম্পর্ক, এবং নিজের ছেলের আসামী হিসেবে ধরা পড়ার ঘটনায় ডি.এস.পি. নিজের গলাতেই ফাঁস অনুভব করেন|

যাই হোক জুলাই মাস থেকে শুরু হল নাটকের অনুশীলন| যারা বাংলাদেশে নাটক করেন বা এখনো করছেন তারা নিশ্চয় জানেন যে একটি নাটক মঞ্চায়নের পিছনে অনুশীলন কতটা জরুরী| বুয়েটে আমরা যখন নাটক করতাম তখন সপ্তাহে নিদনপক্ষে তিন থেকে চার দিন অনুশীলন করতাম এবং মঞ্চায়নের ঠিক আগে তা বেড়ে দাঁড়ত পাঁচ কিংবা আরো বেশী| আমার মনে আছে আমরা একবার পাভেল ভাই ( অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম) এর নির্দেশনায় কিছু পরীক্ষামুলক নাটক করেছিলাম যা ছিল মূলত তার পরিচালিত বুয়েট ড্রামা সোসাইটির একটি নাট্য কর্মশালার সমাপনি অনুষ্ঠান| ভাবতে অবাক লাগে মঞ্চায়নের ঠিক আগে পাভেল ভাই আমাদের সপ্তাহের প্রতিটি দিন অনুশীলন করাতেন| যাই হোক মূল প্রসঙ্গে আসি, এখানে নাটক করতে এসে প্রথমেই যে বাঁধার সম্মুখীন হলাম তা হচ্ছে অনুশীলনের অপর্যাপ্ত সময়| পশ্চিমা সংস্কৃতি সম্মন্ধে যাদের কিঞ্চিৎ ধারনাও আছে তাদের জানা উচিৎ এখানে মানুষ সপ্তাহের কাজের দিন গুলিতে কি পরিমান ব্যস্ত থাকে, এবং আমাদের মত যারা এই দেশে এসেও বাঙালী কায়দায় রসনা বিলাস চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের সপ্তাহের দুটি বন্ধের দিনের একটি যায় বাজার করা এবং রন্ধন চর্চায়| তার উপরে আছে বাঙালী সমাজে দাওয়াত| সুতরাং তার পরে যতটুকু সময় পায় মানুষ চেষ্টা করে তার পুরোটাই পরিবারে সাথে কাটাতে আর ব্যাচেলারদের একমাত্র উপায় হলো কার্ড পিটানো কিংবা রাত জেগে আড্ডা দেয়া| সুতরাং বলাই বাহুল্য এখানে নাট্যচর্চার পর্যাপ্ত সময় খূঁজে বের করা যথেষ্ট ঝক্কির এবং সেটি পুরো দায়ভার বর্তালো রাফাত ভাই এর উপর সেই সাথে নাটকের নির্দেশনা|

যাই হোক রাফাত ভাই এর নির্দেশনায় নাটকের প্রথম অনুশীলন শুরু হল রাসেল ভাইএর বাসায়| পুরো সাড়ে তিন মাস অনুশীলনের পর আমরা নাটকটি মঞ্চায়নের খুব কাছাকাছি চলে আসলাম| এই সময়টাতে আমরা কখনো জাফর ভাইএর বাসায় কখনো নকীব ভাইএর বাসায় আবার কখনো রুম ভাড়া করে অনুশীলন করেছি|আমাদের সাথে অনুশীলন সময়ের অসম্ভব সুন্দর সেই স্মৃতিগুলো এখনো হৃদয়ে গাঁথা আছে| মনে আছে শেষের দিকে আমরা আসলে একটি পরিবারে মত হয়ে গিয়েছিলাম|আর ভাল একটি মঞ্চায়ন আমাদের কাছে একপ্রকার চ্যালেঞ্জের মত হয়ে দাঁড়িয়েছিল কারন এখানকার অধিকাংশ বাঙালীদের ধারনা ছিল আমরা আসলে তেমন কিছু করতে পারবনা|কেন জানি আমাদের সবার একটা জেদ চেপে গিয়েছিল সেই সাথে একটা শিহরনও কাজ করছিল কারন সেটাই ছিল এডমনটনে বাংলাদেশীদের করা প্রথম বাংলা নাটক|

আস্তে আস্তে আসল সেই ১৫ নভেম্বর| আমরা এডমনটন সাধারন গ্রন্থাগারের “স্ট্যানলি মিলনার” মিলনায়তনে প্রায় আড়াইশ দর্শকের উপস্থিতিতে মঞ্চস্থ করলাম ‘ফাঁস’| পাঁচ অঙ্কের এই নাটকটির প্রতিটি অংশ দর্শক গ্রহন করলো অসংখ্য করতালির মধ্য দিয়ে| শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্যের পরে দর্শকদের উদ্দেশ্য রাফাত ভাইএর সেই কথা গুলি আমি কখনই ভুলবনাঃ “আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার নিজের এবং অন্য সব অভিনেতা অভিনেত্রীদের পরিবার পরিজনদের যারা তাঁদের মুল্যবান পারিবারিক সময় বিসর্জন দিয়েছেন বলেই আমরা আজ নাটকটি মঞ্চস্থ করতে পেরেছি|”

মঞ্চ ছেড়ে আসলাম গ্রীন রমে ততক্ষনে গ্রীন রুমে চলে এসেছে রাজিব, আনন্দ, শাহিব, হামিদ ভাই, তাজুল এবং আরো অনেকে এই সাফল্যকে উদযাপন করতে, আমরা পুরো দল ততক্ষনে ইতিহাসের সাক্ষী, আমার চোখে তখন আনন্দাশ্রু, একটি সফল স্বপ্নপূরন, এই পশ্চিমা বিশ্বে বাঙালী সংস্কৃতির প্রসারের একটি ধাপ| ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসলাম গ্রীন রুম থেকে|আমাকে অবাক করে দিয়ে একটি ছোট্ট শিশু যার জন্ম হয়েছে এই দেশে, যে বেড়ে উঠছে এই সমাজে, সে হাতে একটি রোজনামচার খাতা নিয়ে এগিয়ে আসল এবং বাড়িয়ে দিল আমার হাতে তাতে| আমি দেখলাম তাতে লেখা একটি লাইন “My Diary, today I saw a Bengali drama and enjoyed a lot.” আমাদের সবচাইতে বড় উপহার ছিল এই লাইনটি কারন আমরা আমাদের এখানে বেড়ে উঠা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাঙালী সংস্কৃতির কিছুটা হলেও নিদর্শন রেখে যেতে পেরেছি|



পুনঃশ্চঃ উপরের ছবিতে স্বপ্নপূরনের সাক্ষী পুরো দলঃ (বা দিক থেকে দাঁড়ানো) সুভাশীষ দা, ফয়সাল, ববি, কুয়াশা, অলিদ, সাজ্জাদ ভাই, পারভীন ভাবী, খসরু ভাই, আইরীন ভাবী, রোজী ভাবী, সানজিদা ভাবী, (বা দিক থেকে বসা)ফারহান, আমি এবং রাফাত ভাই।