মঙ্গলবার, ১০ মার্চ, ২০০৯

বাংলা গানের রিমিক্সঃ এখনি প্রতিরোধ প্রয়োজন

‘সংস্কৃতি বহমান নদীর মত’ এ কথাটি প্রায়শঃ আমরা শুনে থাকি। নদী তার উৎস থেকে উৎপন্ন হয়ে সময়ের আবর্তে একেকটা দেশ-মহাদেশ পেরিয়ে পরিশেষে সমুদ্রে পতিত হয়। চলার পথে সে বিভিন্ন জায়গার জল, কাদা, মাটি নিয়ে বয়ে চলে। কখনো কখনো নানান দেশের ছোট বড় নদী এসে মিশে যায় তার সাথে আবার কখনো সে নতুন ধারা তৈরী করে তা বিলিয়ে দেয় নতুন এক দিগন্তে।প্রবাহের তীব্রতা থাকলে সেই নতুন ধারা হয়ত একই ভাবে বয়ে চলে আবার আরেকটা দেশ-মহাদেশ পেরিয়ে। কখনো কখনো নানাদেশের বর্জ্য এসে মিশে যায় মূল ধারাটিতে, কলুসিত হয় তার জল। নদীতে স্রোত থাকলে এই দূষন দূর হয়ে যায় নিমিশেই, খুব বেশী ক্ষতি হয়না নদীর, আবার কখনো দূষণের মাত্রা এততাই তীব্র হয় যে মূল ধারাটিই বিনষ্ট হয়ে যায়। বিপরীতে কখনো কখনো বিশুদ্ধ পানির ধারা এসে মিশে যায় মূল ধারার সঙ্গে, তাকে সমৃদ্ধ করে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় নদীর প্রবাহ। এইভাবে একেবেঁকে বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পার হয়ে নদী পতিত হয় সাগর আর মহাসাগরে।

ঐতিহ্যগত ভাবে আমাদের বাংলা গানের ভান্ডার সমৃদ্ধ। এই বাংলায় জন্ম নিয়েছে রবিঠাকুর, নজরুল, হাসন, লালন সহ আরো অনেকে যারা সৃষ্টি করেছে এক একটা সংগীতের ধারা।আজো বাংলার বৈশাখ, বর্ষা, বসন্ত, কিংবা পৌষপার্বন উৎসব শুরু হয় রবীঠাকুরের গান দিয়ে। রমনার বটমূল কিংবা চারুকলার বকুলতলার সেই বৈশাখী কিংবা বসন্ত উৎসবের আসর আমাদের বাঙালী সংস্কৃতির পরিচায়ক। আর আমাদের জাতীয় সংগীত যা আমাদের অহংকার তাওত রবীঠাকুরেরই অনবদ্য সৃষ্টি। নজরুলের ‘ রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটি না শুনলে যেমন ঈদের আমেজই যেন পাইনা, তেমনি ‘সখি সে হরী কেমন বল, নাম শুনে যার এত প্রেম জাগে চোখে আসে এত জল’ কিংবা ‘এমন কেন হয় মা শ্যামা, তোর কথা পরলে মনে আর সবারে যাই ভুলে মা’ গানগুলি শুনলে আমরা ভক্তিতে নিজেদেরকে উজার করে দেই পুজা অর্চনায়।সমরে আমাদেরকে উজ্জীবিত করে রাখে ‘চল চল চল উর্দ্ধগননে বাজে মাদল’ গানটি, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি আমাদেরকে বার বার মনে করিয়ে দেয় বাঙালীর সংগ্রামের বলিষ্ঠ ইতিহাসকে।। শুধু তাই নয়, বাংলার লোকগীতি আর আধুনিক গানের ধারাও আমাদের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির প্রতীক। লালনের সেই ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’ কিংবা ‘তিন পাগলে হল মেলা নদে এসে’ গানগুলি আমাদের অসাম্প্রদায়ীক মানসিকতারই পরিচয় বহন করে। আবার ‘খাঁচার ভেতর অচীন পাখি’, ‘লোকে বলে বলে রে ঘর বাড়ি বালা না আমার’, কিংবা ‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’ গানগুলি আমাদেরকে আধ্যাত্মিকতার দিকে নিয়ে যায়। এছাড়া জারি, সারী, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, মুর্শীদি, মারফতী, কীর্ত্তন, গম্ভীরা আমাদের লোক মানুষের মুখে মুখে সৃষ্টি হয়ে পেয়েছে এক একটি নতুন ধারা।আব্বাসউদ্দিন, আব্দুল আলিম, শাহ্‌ আব্দুল করিম, আমীরউদ্দিন, রাধারমনের মত গুনী সংগীতজ্ঞরা বাংলার লোকগীতির এই ধারাকে করেছেন আরো সমৃদ্ধ।একটু চিন্তা করে দেখুনত ‘ওহো কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে’ গানটিতে গ্রাম বাংলার নারীদের যে প্রেমের আবেগ প্রকাশ পেয়েছে, কিংবা ‘সর্বনাশা পদ্মা নদীরে’ গানটিতে নদীপাড়ের মানুষদের যে জীবন সংগ্রামের কথা উচ্চকিত হয়েছে তা কি আমাদের চিরন্তন বাঙালী সংস্কৃতির পরিচায়ক নয়? বাংলার লোক মানুষের উৎসব নৌকা বাইচ আজো বেঁচে আছে ‘নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে ছল ছলাইয়া চলুকরে নাও মাঝ দইরা দিয়া’ গানটির মধ্যে। উত্তরবঙ্গের ‘ হে নানা ...’ রবের সেই গম্ভীরা আজো ব্যবহৃত হয় সচেতনতামুলক যেকোন কাজে। 
 

বাংলা চলচিত্রের স্বর্নালীদিনের সেই আধুনিক গানগুলির কথা একটু মনে করে দেখুনত, কি আবেগ ছিল সেই কথা আর সুরগুলিতে।।‘তুমি যে আমার কবিতা’ কিংবা ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার মৌনতার সূতায় বুনা একটি রঙীন চাদর’ গানগুলিতে শাশ্বত প্রেমের যে ছোঁয়া বা, ‘ও রে নীল দরিয়া’ গানটিতে বিদেশ বিভুঁই থেকে প্রিয়ার কাছে ফেরার যে ব্যাকুলতা পাওয়া যায় তা কি আমাদেরকে সমৃদ্ধ অতীদের দিনগুলিয়ে নিয়ে যায়না? পশ্চিম বাংলার চলচিত্রে হেমন্ত, মান্না দে, সন্ধ্যা, কিংবা কিশোর কুমারের সেই গানগুলি আজো গুন গুন করে গাই সারাক্ষন। মান্না দের ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটি আমাদের অতীতস্মৃতিবিধুরক মনকে নিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলিতে, হেমন্তের ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে কই তাহার মত তুমি আমার কথা শুনে হাসনাতো’ গানটি যেন তারুন্যের সেই শাশ্বত প্রেমের দিনগুলির কথা মনে করিয়ে দেয়। ভুপেনের ‘মানুষ মানূষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’, কিংবা ‘দোলা হে দোলা’ গানটিগুলিতে মানবতাবাদের যে ভাব প্রকাশ পেয়েছে তাকি সমস্ত মানব সম্প্রদায়ের জন্য নয়? আজো ‘বিস্তীর্ন দু’পারে অসংখ্য মানুষের হাকার শুনে নিস্তব্ধে নিরিবে ও গঙ্গা তুমি গঙ্গা বইছ কেন’ গানটিতে আমাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ পায়।


আমরা কি ভুলতে পারি আমাদের বাংলাদেশের ভাষা আর স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই ইতিহাসকে? বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত বাংলার সমৃদ্ধ দেশাত্মবোধক গানগুলিকি আমাদের আন্দোলনকে বেগবান করেনি? আমি কি করে ভুলে যাই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি, যা শুনে বা গেয়ে আজো আমার দেহের লোমগুলি দাড়িয়ে যায়, চোখে ভিজে যায় জলে।একাত্তরের সে উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীন বাংলা বেতের কেন্দ্রের ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য্য উঠেছে’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানগুলি কি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উজ্জীবিত করেনি কিংবা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘সব কটা জানালা খুলে দাওনা’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য্য আনলে যারা’ গানগুলি যুদ্ধে আমাদের স্বজন হারানো ব্যাথাকে ভুলিয়ে দেয়নি?


আমি আগেই ব্যাখ্যা করেছি নদীর মত সংগীতের ধারাও পরিবর্তীত হয় যুগে যুগে। আশির দশকে বাংলা গানে পাশ্চাত্য ধারার যে সংমিশ্রন শুরু হয় এদেশের তরুন সমাজ তা গ্রহন করেছিল তাদের উচ্ছলতা দিয়ে। বলতে দ্বিধা নেই, এটির বিপক্ষে অনেক যুক্তি ছিল কিন্তু নিজের ধারাকে ঠিক রেখে অন্য একটি বিশুদ্ধ ধারার ভাল অংশটুকু গ্রহন করায় বাংলা সংগীত পেল সম্পূর্ন নতুন একটি মাত্রা। ফিরোজ সাঁই, আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকীর আলমগীর কিংবা লাকী আখন্দরা সেই প্রজন্মেরই ধারক ও বাহক। তাদের ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা’, ‘এই নীল মনিহার’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘মামনি আয়’, কিংবা ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা’ গানগুলিতে প্রকাশ পেয়েছে আমাদের সংগীতের সাথে পাশ্চাত্যের ধারার সংমিশ্রণ, কিন্তু তাতে আমাদের নিজস্ব সংগীত হয়েছে সমৃদ্ধ। নব্বইএর দশক পর্যন্তও এই নতুন ধারাটি থেকে আমরা পেয়েছে অসংখ্য ভাল গান যা আজো আমাদের মুখে মুখে। সংগীতের এই ধারাটি কলুষিত হওয়া শুরু করেছে যখন আমরা নিজেদের শেকড়কে বাদ বিয়ে বা ন্যুনতম প্রাধান্য দিয়ে পাশ্চাত্যের সংগীতের প্রতি ঝুকে পড়েছি এবং হিন্দি গানের মাতম আমাদেরকে উদ্বেলিত করেছে। পার্শবর্তী দেশের আমদানী বলে বাঙালীদের মধ্যে হিন্দী গানের জনপ্রিয়তা কখনই একেবারে শুন্যের কোঠায় ছিলনা কিন্তু তা কখনো আমাদের নিজস্ব গানের ধারাটিকে আবৃত করেনি যা এখন করছে।


তবে বাংলা গানের ভয়ংকর ব্যাপারটি শুরু হয়েছে বিগত দশ বছর ধরে, যার অপর নাম ‘রিমিক্স’। তথাকথিত রিমিক্সকারদের বিষয়ে আমার ইতিবাচক বক্তব্য হচ্ছে তারা অন্তত পক্ষে আমাদের মুলধারার কিছু গানকে এই প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পেরেছে । উদাহরন হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে আব্দুল করিম শাহ এর অনেক গানই এই প্রজন্মের শিল্পী হাবিব আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। আমি বলছিনা সেই তুলে ধরাটা সঠিক ভাবে হয়েছে কিংবা হয়নি কিন্তু আমরা অন্তত গানগুলি পেয়েছি। আর তাদের বিষয়ে আমার নেতিবাচক মন্তব্য হচ্ছে তারা প্রকৃত সুরকারের সুরকে অনেকাংশে বিকৃত করে গানগুলিকে আমাদের সামনে তুলে ধরছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে তা হলো আমরা গানটার আসল আবেদনটাকে হারাচ্ছি। সেদিন আমি ইউটিউবে ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ গানটা শুনছিলাম। গানের প্রকারভেদে এটি একটি বিঃচ্ছেদি গান এবং সেটি বিচারে রেখেই রাধারমন দত্তের এই গানটি সুর করা হয়েছে। আশ্চর্য্যের ব্যাপার হলো সেই গানটির আবেদন সম্পূর্ন রূপে নষ্ট করে দিয়ে জনৈক শিল্পী সেটি রিমিক্স করেছেন’। আরো উদাহরন দেয়া যেতে পারেঃ লোকগীতির উপরে অনুষ্ঠান করব বলে হাসন রাজার একটা গান ‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে’ খুঁজছিলাম ইউটিউবে।হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম এই গানটির একটি ‘রিমিক্স’। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলামনা, গানটির সম্পূর্ন আবেদন ধ্বংস করে দিয়ে নতুনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। একটি দেশীয় আধ্যাত্মিক গানকে কোন রকম চিন্তাভাবনা না করে পাশ্চাত্য ঢঙে ‘ড্রামের বিট’ আর ‘রোবটিক’ স্বর দিয়ে পুনঃনির্মান করাটাকে অন্ততপক্ষে বিশুদ্ধ সংগীতপ্রেমিক মানুষের পক্ষে গ্রহন করা সম্ভব নয়।হাসন রাজা বেঁচে থাকলে নির্ঘাৎ আত্মহত্যা করতেন!খুঁজলে এরকম শত শত উদাহরন আমরা পেয়ে যাব একটি মাউসের ক্লিকে। তবে এই রিমিক্সের সর্বশেষ শিকার বোধকরি রবীন্দ্রনাথ। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোন এক বিতর্কে প্রতিপক্ষ শুনিয়েছিল আজকের দিনে রবীন্দ্রনাথ জন্মালে তাকেও পণ্যায়িত হতে হত, আদতে তাই হলো। কপিরাইট উঠে যাবার কয়েক বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে আধুনিক সস্তা নাচ আর ‘চেক ইট আউট’ টাইপের কথাবার্তা দিয়ে বাজারে আসল ‘রক উইথ রবীন্দ্রনাথ’।


এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আজকে আমাদের এই সাংস্কৃতিক দৈন্যতার জন্য অনেকাংশে দায়ী আমাদের অনুকরন প্রবনতা। এই নিবন্ধের শুরুতে বলেছিলাম সংস্কৃতি আসলে বহমান নদীর মত, সুতরাং সে পরিবর্তিত হবেই এবং আমি মনে প্রানে পরিবর্তনের পক্ষে। কিন্তু পরিবর্তনের নামে এখন যা হচ্ছে তাকে আর সংস্কৃতি না বলে অপসংস্কৃতি বলাটাই কি শ্রেয় নয়? আমরা যদি এখনই সোচ্চার না হই তাহলে আমাদের বাংলা গানের মুল ধারাটির দূষনের হার দিন দিন বেড়ে গিয়ে এমন একটি স্থানে পৌঁছবে যে তার থেকে আমরা আর আমাদের নিজস্ব ধারাকে আলাদা করতে পারবনা। যেমন করে বছরের পর বছরের অবহেলা আর দূষনে অপমৃত্যু ঘটেছে ঢাকার ঐতিহ্য অভিমানী বুড়িগঙ্গার, তেমনি করে একদিন অপমৃত্যু ঘটবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাংলা সঙ্গীতের। কিন্তু আমরা কি পারিনা এটাকে রোধ করতে? ঔপনিবেশিক শক্তির রোষানলে পরে অনেক ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, বিশ্বের অনেক হতভাগা জাতি আছে যারা তাদের মাতৃভাষাকে হারিয়েছে, অথচ দু’শ বচরের ঔপনিবেশিক শাসনও আমাদের সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাকে বিনষ্ট করতে পারেনি আর মাত্র কয়েক দশকের আগ্রাসনকি আমাদের সমৃদ্ধ বাংলা গানের ভান্ডারকে ধ্বংস করে দিবে? আসুন আমরা আর একবার যুদ্ধে অবতীর্ন হই, না না ঢাল তলোয়ার কিংবা মেশিনগান দিয়ে নয়, আমাদের মানসিকতা আর কলম দিয়ে এই সব অপশক্তির বিরুদ্ধে চলুন আমরা রুখে দাঁড়াই।সবাই মিলে গেয়ে উঠিঃ


“গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শীদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”