মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ, ২০০৯

‘ক’ ম্যাডামকে নিয়ে আমাদের কাব্য প্রতিভার (!!) শুরু এবং শেষ

নীড় সন্ধানী’র ‘জানিদুস্ত’ শিরোনামের লেখাটি পড়ছিলাম। কাকতলীয় ভাবে আমার জীবনেও এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল যা হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল আর লিখে ফেললাম সচলায়তনের জন্য।

সময়টা বোধকরি ১৯৯১, আমি তখন টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র। আমাদের শ্রেনীশিক্ষীকা এবং বাংলার শিক্ষীকা ছিলেন ‘ক’ ম্যাডাম (আমি আসল নামটা ব্যাবহার করতে চাচ্ছিনা)। ম্যাডাম তখন সবে মাত্র শিক্ষকতায় যোগদান করেছেন, ছ’মাসও বোধ হয় হয়নি।বেশ ভাল পড়াতেন বলে ছাত্রদের মাঝে তিনি খুবি জনপ্রিয় ছিলেন। তখন বয়সটাই যেন কেমন সব মেয়েদেরই কিছুনা কিছু ভাল লাগে, সে আমাদের থেকে বয়সে ছোটই হোক আর বড়ই হোক।
‘ক’ আপার যে জিনিসটা আমাদের ছাত্রদের কাছে আকর্ষনীয় হয়েছিল তা হলো তার ফ্যাশন সচেতনতা। আমরা অনেকদিন ধরে লক্ষ্য করে দেখলাম যে ‘ক’ আপা এক শাড়ি পারতে দু’দিন পড়েননা, পড়লেও অনেক দিন পর পর। একজন দু’জনের কাছ থেকে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ল শ্রেনীর সবার মাঝে, এবং আবলীলায় তার একটি ছদ্মনাম হয়ে গেল ‘ফ্যাশান আপা’। এই জাতীয় ব্যাপার স্কুলে হরহামেশাই ঘটে, আমাদের মোটামুটি সব শিক্ষকেরই এক একটা ছদ্মনাম ছিল এবং আমরা পরস্পরের সাথে শিক্ষকদের নিয়ে যখন আলাপ করতাম তখন ঐসব ছদ্মনামেই তাদেরকে ডাকা হত। একটি কথা বলে রাখা জরুরী এই সব ছদ্মনাম কিন্তু নিছক মজা করেই রাখা হত, আমরা সবাই শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতাম মনে থেকেই এবং আজও করি। যাই হোক ‘ফ্যাশান আপা’ নাম দিয়েই আমরা ক্ষান্ত হলামনা, একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি সবাই জটলা হয়ে কিছু একটা করছে। সামনে এগুতেই ব্যাপারটা বুঝা গেল, আমাদের অপু ( অপুর্ব সরকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র, এখন ইষ্ট ওয়েষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) তার বাংলা খাতা খুলে বসেছে এবং কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছে। আশেপাশের সবাই তাকে যথেষ্ট সহযোগীতা করছে ব্যাপারটিতে। অবশেষে সবার অংশগ্রহনে যা বের হল তা আর কিছু নয় ‘ফ্যাশান আপা’ শীর্ষক কবিতার প্রথম দু’টি লাইন যার সিংভাগ দাবীদার অপুঃ

‘ফ্যাশান আপা ফ্যাশান করে
নিত্য নতুন শাড়ী পরে’
আমি ব্যাপারটাকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়ে আমার জীবনের প্রথম কাব্য প্রতিভার পরিচয় দিয়ে পরবর্তী দু’টি লাইন যোগ করলামঃ
‘কত শাড়ী আছে যে তার
কেউ জানেনা সচারচার’

হঠাৎ কোত্থেকে পিন্টু ( আব্দুল হামিদ খান, বুয়েটের তড়িৎ কৌশলের প্রাক্তন ছাত্র, এখন এরিকসনে কর্মরত) এসে জুটল। পিন্টুর মধ্যে আগে থেকেই কিছুটা কাব্য প্রতিভা (!!) ছিল। তার পরিচয় সে রাখল পরবর্তী দু’লাইনেঃ

‘তিনি আমাদের ক্লাস টিচার
মনে হয় যেন মার্গারেট থেচার’

যাই হোক এরি মধ্যে এসেম্বলীর বেল পড়ে গিয়েছে সবাই যথারীতি মাঠে গিয়ে জড়ো হলাম। একে একে শেষ হল প্রথম চারটি ক্লাস।টিফিন পিরিয়ডের সময় আমি অপুর খাতা থেকে কবিতাটি ছিড়ে দলা পাকিয়ে জানলা দিয়ে ফেলে দিলাম, কারন ক্লাসের কিছু ছেলেপেলে আমাদের এই কবিতা নিয়ে অন্যরকম আলোচনা করছিল। স্কুল জীবনে বোধ করি সবারই একটা নিজেদের দল এবং সেই সাথে তার প্রতিপক্ষ দল থাকে। সেই বিচারে আমাদেরও ছিল একটি প্রতিপক্ষ দল, তবে ব্যাপারটা গুরুত্ত্বপুর্ন কিছু ছিলনা কারন তা শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ ছিল প্রাইভেট শিক্ষক দের নোট নিজেদের মধ্যে আদান প্রদান, ক্রিকেট খেলায় দুই দল, খুব বেশী হলে ক্লাসের ফাকে কথা বার্তা বললে ক্লাস ক্যাপটেন এর কাছে নাম জমা দেয়া এই সব আরকি। যথারীতি টিফিন শেষ করে স্কুলের মাঠে বসে দু’টাকার বাদাম খেয়ে ক্লাসে এসেছি, হঠাৎ শুনি ক্লাসের কিছু ছেলেপেলে নিজে দের মধ্যে কথা বলছে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, কেউ বলছে ‘দিবে মাইর ইচ্ছা মত’, কেউবা বলছে ‘স্কুল থেকে বের করে দিবে’, আবার কেউ বলছে ‘তোরা কাজটি ভাল করিসনি কারন ওরাত শুধুমাত্র মজা করে লিখেছে কি দরকার ছিল ওটা ......’। 


যাই হোক বিস্তারিত জানলে পারলাম, আমরা যখন টিফিন পিরিয়ডে, তখন আমাদের প্রতিপক্ষ দলের কিছু ছেলে পেছনে গিয়ে আমার দলা পাকানো কবিতার কাগজটি খূঁজে বের করেছে এবং তা জমা দিয়েছে নুরুল আমীন সারের কাছে। নুরুল আমীন সার স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং আমাদেরকে খুব ভাল করেই চিনেন। কিছু ছেলের ভাষ্যমতে সার নাকি যার পর নাই বিষ্মিত হয়েছেন এবং ব্যাপারটি প্রধান শিক্ষককে অবহিত করেছেন। আমি কিছুতেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিলামনা যে একটি নিছক মজার বিষয়কে এভাবে গুরুত্বপূর্ন করার কি মানে আছে। মনে মনে নিজেকে ধিক জানাচ্ছিলাম কেন কাগজটা নিজের কাছে রাখলামনা এই ভেবে।যাই হোক টিফিন পিরিয়ডের পরে ক্লাশ শুরু হয়েছে, ক্লাসের মাঝখানে একটি নোটিশ নিয়ে দপ্তরীর প্রবেশ। ক্লাসের স্যার সেটি পরে শোনালেন, ‘জাহিদ, হামিদ, আপুর্ব , তোমাদেরকে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ডাকা হয়েছে’। দুরুদুরু বুক নিয়ে আমরা তিনজন চললাম প্রধান শিক্ষকের রুমের দিকে। যেয়ে দেখি সেখানে ‘ক’ আপা আর নুরুল আমীন সারও আছেন। আমরা মাথা নিচু করে তিনজন ঢুকলাম, দেখি সারের টেবিলে আমাদের কবিতার দলাপাকানো কাগজটি। বুঝতে বাকী রইলনা কপালে কি আছে, উত্তম মধ্যমত বটেই আরো অনেক কিছু হয়ত হবে। আমাদের কথা বলার তেমন সুযোগ পেলামনা আর পেলেও বোধকরি বলার কিছু ছিলনা। হেড সার হাতে একটা জোড়া বেত নিয়ে শুরু করলেন তিনজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে।কতক্ষন মারলেন মনে নেই, কারন বন্ধুদের (অথবা শত্রুদের) এহেন জঘন্য কর্মে আমরা তখন বাকরুদ্ধ এবং ‘ক’ আপার সামনে লজ্জায় দু’চোখ বন্ধ। শুধু মনে আছে আমাদের তিনজনকে হেডসার ঠেলে দিলেন ‘ক’ আপার পা ধরে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। মোটামুটি দুঃসহ একটা সময় কাটানোর পরে আমরা তিনজন মাঠ পেরিয়ে ফিরে আসলাম ক্লাসে। আমরা ঢুকার পরে কিছু মুখ তখন হাসি আর মজাতে মশগুল আর বাকীরা নিশ্চুপ। কোন মতে সেই ক্লাসটি শেষ হল। পরের ক্লাসটি ছিল সম্ভবত বিজ্ঞানের। কিন্তু আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে ক্লাসে আসলেন ‘ক’ আপা। আমার মনে আছে পুরো ক্লাসটা জুড়ে তিনি আমাদের কিছু কথা শুনিয়েছিলেন যা আমি হয়ত জীবনেও ভুলবনা, ইচ্ছে করছিল মাটি ফাঁক করে নিচে চলে যাই। একটা ক্লাসকে অনন্ত সময় বলে মনে হচ্ছিল। আসলেই আমাদের বলার মত কিছু ছিলনা কারন ব্যাপারটা আমরা করেছিলাম নিছক মজার ছলে, যদিও সেট বুঝানোর সাধ্য আমাদের ছিলনা। এর পরবর্তী কয়েকটি দিন ছিল আমাদের জন্য মরনসম, কারন যে শিক্ষকই ক্লাসে আসে প্রথমেই উল্লেখ করে, 

‘জাহিদ, হামিদ, অপুর্ব তোমরা একটু দাঁড়াওত, তোমাদেরত টিসি হয়ে যাবে’

সরকারী বিদ্যালয়ে যারা পরেছেন তাদের মনে থাকার কথা, উচ্চমাধ্যামিক বিদ্যালয়ে ‘টিসি ( ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) প্রদানের থ্রেট’ কত বড় ব্যাপার ছিল।ওই পর্যায়ের সর্বোচ্চ শাস্তি ওটাই ছিল। আমরা আগেও দেখেছি বিদ্যালয়ে কেউ আইন শৃংখলা ভাংগলে তার শাস্তি হত ‘টিসি প্রদান’।তার থেকে বেশী ভয়ে ছিলাম যদি বাসা থেকে বাবা মাকে ডেকে পাঠায়। যাই হোক কয়েকদিন বেশ দুরুদুরু বুকেই ক্লাস করতাম এবং টিফিন পিরিয়ডে তিনজন মিলে আলোচনা করতাম বাসায় চিঠি পাঠালে কিভাবে তা ম্যানেজ করব।যাই হোক পরে শ্রেনীর প্রথম দিকের ছাত্র হবার কারনেই বা অন্য কোন কারনেই হোক আমাদের আর কোন শাস্তি হয়নি। কিন্তু মনে আছে যতদিন বিদ্যালয়ে ছিলাম কখনই ‘ক’ আপার সাথে স্বাভাবিক হতে পারিনি আমরা সেই সাথে আমাদের সাথেও স্বাভাবিক হতে পারেননি ‘ক’ আপা। এসএসসি তে ভাল ফলাফল করার পরও একবার তার সাথে দেখা করার সাহস হয়নি। 

শ্রদ্ধেয় ‘ক’ আপা আপনি যেখানেই থাকুননা কেন, একটি ব্যাপার বলে রাখি আমদের ঐ ব্যাপারটি ছিল নিছক মজার, এর বেশী কিছু নয়, আমরা আপনাকে আগেও যেমন শ্রদ্ধা করতাম, আজও করি আর ভবিষ্যতেও করব। তবে আমি কখনই ক্ষমা করতে পারবনা আমাদের বন্ধুরূপী সেই শত্রুদেরকে যারা একটি সামান্য ব্যাপারকে অতিরঞ্জিত করে আমাদেরকে সেই লজ্জার মধ্যে ফেলেছিল। 

বিঃদ্রঃ আমাদের কাব্য প্রতিভার অপমৃত্যু সেদিনই ঘটেছিল, তার পরে ভুলেও কোনদিন কবিতায় হাত দেইনি।