সম্ভবত ২০০১ সালের দিকের কথা। মিরপুবে আপার বাসা থেকে বের হয়ে সন্ধ্যাবেলা আমি , জাকির ( জাকির হোসেইন, এখন সহকারী কমিশনার) আর এহসান ( এহসানুল হক, এখন এলজ়িইডি তে কর্মরত) কিছুক্ষন আড্ডা দিলাম ১০ নাম্বার গোল চক্করে কোন এক চায়ের দোকানে।তখন শুক্র শনিবারে বুয়েট বন্ধ থাকায় প্রায়ই আমি সপ্তাহান্তে মিরপুরে চলে আসতাম কিছুটা পারিবারিক ছোয়া পাবার আশায়। এহসানের চাচার বাসা আর জাকিরের বাসাও একি এলাকায় থাকাতে সপ্তাহান্তে আড্ডাটা বেশ ভালই জমত।সেরকমই এক আড্ডা শেষ করে চেপে উঠলাম বাসে, আপাতত গন্তব্য শাহাবাগ।বাস থেকে নেমে একটা সিগেরেট ধরিয়ে রাস্তা পার হয়ে যাদুঘরের সামনের রাস্তায় যেদিকে ফুলের দোকান গুলি থাকে সেখানে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছি। কিছুক্ষন পরে একটা রিকশা এসে থেমেছে।আমি বলি,
'কোথায় ?'
আর যাই হোক রিকশআলাদের বুয়েট চেনানো বেশ কঠিন। এরা বুয়েটের 'আহসানউল্লাহ হল' চেনে, দাঁতভাঙ্গা 'ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি' চেনে, কিন্তু বুয়েট চেনেনা। আমি তাই সবসময় বুয়েটে না বলে বলতাম পলাশী যাব, তাই যথারীতি বললাম,
'পলাশী কই যাবেন?'
আমি প্রমদ গুনি, এখন আবার বুয়েট ব্যাখ্যা করতে হবে।বললাম,
'পলাশীর মোড়ে, বুয়েট, চেন?'
'কেন চিনবনা ? উঠেন'
রিকশা চলছে , নিজেদের মধ্যে গল্পের ফাঁকে আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করি,
'পড়াশুনা করেছ কতদূর?'
'ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি এই বার, আমার বুয়েট পড়ার অনেক শখ'
আমি ও এহসান যথেষ্ট বিস্মিত।রিকশায় বসে রিকশালাদের সাথে গল্প জুড়ে দেবার অভ্যেস আমার অনেক দিনের কিন্তু এ ধরনের ধরনের অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। ততক্ষনে পলাশীর মোড়ে চলে এসেছি, হলে না যেয়ে সেখানেই নেমে পড়ি আমরা দু'জন। ছেলেটাকে ভাল মত লক্ষ্য করি, কত আর বয়স হবে বড়জোর ২০, স্বাস্থ ভালনা, কিছুটা কুঁজো।আমি জিজ্ঞেস করি ,
'হ্যা সেজন্যই ত গ্রাম থেকে চলে আসলাম'
আস্তে আস্তে তার সব কথা শোনা হল।ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছে গ্রামের কোন এক কলেজ থেকে।শুনেছে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দেবার আগে কোচিং করতে হয়। সেজন্য কিছু টাকা ঋণ করে ঢাকায় এসেছে, ভর্তি হয়েছে একটা কোচিং সেন্টারে।এখন রাতে রিকশা চালিয়ে সেই ঋন শোধ করছে আর নিজের খরচ যোগাচ্ছে। ঋণের টাকা শোধ হয়ে গেছে এখন হাতখরচের জন্য রাতে রিকশা চালায় । আমি আর এহসান স্তম্ভিত, দু'জনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়াতে জীবনে অনেক কিছুর অভাবেই আমরা অভ্যস্ত কিন্তু এ যে কঠিন বাস্তবতা। সিনেমা, নাটকে উপন্যাসে এরকম চরিত্রের দেখা মিলেছে, কিন্তু এরকম কারো সাথে পরিচয় হবার কথা ভাবিনি কখনো।
হলে আর যাওয়া হলনা, তার পরিবর্তে আমরা তিনজন গেলাম বকশীবাজারের মোড়ে একটি খাবারের দোকানে। তিনজন মিলে খাওয়া দাওয়া করে আসলাম তিতুমীর হলে এহসানের রুমে।ছেলেটিকে খুব ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বললাম, তুমি এইভাবে কষ্ট করে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবেনা। এক কাজ কর তোমার এই কয়েক মাসের হাতখরচের টাকাটা আমরা দেব, তুমি শুধু পড়াশুনা কর, মনে রেখ বুয়েটে তোমাকে ভর্তি হতেই হবে।
এর পরে ছেলেটি কিছুদিন এহসানের হলে এসেও ছিল ভর্তি পরীক্ষার আগে। বেশ কিছুদিন তাকে দেখিনা, এহসান জানালো ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে গেছে।কিছুদিন পরের কথা, আমি সন্ধ্যেবেলা হলের রুমে বসে গল্প করছি এমন সময় ছেলেটির প্রবেশ। চোখটা উজ্জ্বল, মুখখানি হাসিতে ভরপূর,
'ভাইয়া আমি বুয়েটে চান্স পেয়েছি'আমি উঠে যেয়ে জড়িয়ে ধরলাম। ছেলেটি চোখে জল ধরে রাখতে পারলনা, তবে সেটা কষ্টের নয়, আনন্দাশ্রু।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে, একই ভবনে ক্লাস হওয়াতে মাঝে মাঝে ছেলেটির সাথে দেখা হত, কথাও হত।সেই দিন গুলিও ফুরিয়ে গেল, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে শিক্ষকতায় যোগদান করলাম, পরে চলে এলাম বাইরে। আজও মাঝে মাঝে ছেলেটির কথা মনে হলে জীবন সংগ্রামে জয়ী কিছু মানুষের ছবি চোখে ভাসে।