সোমবার, ৩০ মার্চ, ২০০৯

এপার্টমেন্ট নাম্বার ৩২১

মানুষের মন বড় বিচিত্র।এখানে এই তুষারে ঢাকা দেশটাতে দুই বছরের বেশী সময় ধরে থাকলেও জায়গাটাকে আপন করে নিতে পারিনি, অথচ দেড় বছরের কিছুটা বেশি সময় ধরে যে বাসাটিতে আছি সেই বাসাটা ছাড়তে আজ মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার ঘরের সবকিছু এলোমেলো, কিন্তু কিছু গোছাতে ভাল লাগছেনা, তার চেয়ে বরং সচলের জন্য লিখতে ইচ্ছে করছে।এই বাসার সাথে জড়িয়ে আছে অসংখ্য স্মৃতি, আমার নিসংগ প্রবাস জীবনের অজস্র ভাললাগা মন্দলাগা অনুভুতিগুলো আমাকে বার বার এই ৩২১ নাম্বার এপার্টমেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।এই বাসাতে থেকেই আমার সচলে হাতেখড়ি, আমার প্রোফাইলে এই ঘরেরই বর্ননা দেয়া, এই ঘরটিতে জানালার ধারে বসেই আমার প্রাত্যাহিক আকাশ দেখা। শুধু কি তাই, দেশে আমার ছেলে নির্ঝরের ভুমিষ্ট হবার সংবাদ পাবার পরে আমার সেই লাফ দিয়ে টেবিল ল্যাম্প উল্টিয়ে ফেলে দেয়া, কিংবা জানালার পাশের রকিং চেয়ারটাতে বসে মিতুর সাথে টেলিফোনে রোমান্স বা ঝগড়ার মুহুর্তু গুলোত এই বাসাকে কেন্দ্র করেই।




মনে পড়ে যায় গত দেড় বছরের শুক্রবার, শনিবার, কিংবা অন্যান্ন ছুটির দিনের রাতগুলি কেটে গেছে এক অনাবিল আনন্দে। ভুল বললাম আনন্দ নয় আনন্দের অভিনয়; দেশ, মাটি, প্রিয় শহর, প্রেয়সী, পরিবার সবকিছুকে ভুলে থাকার এক ব্যার্থ চেষ্টা আমাদেরকে নিয়ে এসেছিল অনেক কাছে। আমরা কেউ একে অপরের বন্ধুনা কিন্তু যেন বন্ধুর চেয়ে অনেক বেশী কিছু।প্রতিটি শুক্রবার বিকেল যেন নিয়ে আসে এক উৎসবের আমেজ।সবাই আমরা ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র, আবার কেউ পাশ করে চাকুরী করছে; এরা সবাই সপ্তাহের পাঁচ দিন গাধার মত খাটুনি খেটেছে পড়াশুনা, গবেষণা, টিএ কিংবা অফিসের কাজে। দু’দিন সপ্তাহান্তের ছুটি আবার সেই গদ বাঁধা জীবন, একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর। তাই দরকার কিছু অখন্ড অবসরের, আড্ডার সেই সাথে ভুড়িভোজন।দেখা গেল কারো ফ্রিজে হয়ত দু’প্যাকেট মুরগী বা গরুর মাংস কিংবা একটা আস্ত ইলিশ মাছের খোঁজ পাওয়া গেছে, কেউ হয়তবা এই সেদিন নতুন বাসমতি চালের ব্যাগ এনেছে, ব্যাস তাতেই সই, সব জড়ো হল এপার্টমেন্ট ৩২১ এ, শুরু হল রান্না বান্না, আর তার ফাঁকে ২৯ এর আসর। 

আমরা দশ পনের জন মানুষ, কিন্তু মনে হয় যেন একটা পরিবার, ছোট্ট একটি বাংলাদেশ।কখনবা সমাজ, দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, খেলাধুলা নিয়ে তুমুল তর্ক বিতর্ক হচ্ছে আবার কখনোবা সেখানে চলে আসছে আউয়ুব বাচ্চু কিংবা জেমস।কোরাসের উচ্চস্বরে আমরা হয়ত চলে গিয়েছি সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে।আবার কখনো সেখানে ভর করছে ‘মিষ্টার গুপ্তের কালেকশনস’। ঈদের দিনগুলিতে সবার একযোগে নামাজ পড়তে যাওয়া, নামাজ শেষে মিশেনার পার্কের ভাইয়াদের বাসায় ভাবীদের হাতের মজার খাবার ধ্বংসের মিশন; একুশে ফেব্রুয়ারী, পহেলা বৈশাখ বা অন্যান্ন অনুষ্ঠানগুলিতে সবার একসাথে গমন ছিল একেবারে নিয়মের মধ্যে।

কারো হয়তবা একটা ছবি দেখতে ইচ্ছে করছে, কোন সমস্যা নেই আছে ফয়সাল, চাহিবা মাত্র টরেণ্ট নামাইতে যে বাধ্য থাকে। রেজা অতি সিরিয়াস ভঙ্গিতে আগের দিনের বিটিভির ‘দাস্তানে হাতেম তাঈ’ কিংবা ‘আলিফ লায়লার’ টাইটেল সং এর কথা ও সুরগুলি অবিকল নকল করে আমাদের শুনাত।ফারহানের কুত্তার জোকস কিংবা সর্ববিষয়ের পন্ডিতি নিয়ে আমরা কতইনা মজা করতাম।পদার্থ, রসায়ন, গনিত, প্রকৌশল, চিকিৎসা কি বিষয়ে জ্ঞ্যান নেই তার (!!)। মনজের সেই কিশোর কুমারের ‘বাসনা ইয়ে হাসিনা’ গানের রিমিক্স এর তালে তালে ২৯ এ জ্যাক ফাঁসানো, কিংবা সবুজের অভিনয়ে সৈকতের গায়ে হলুদের সেই দৃশ্য সবই আজ স্মৃতি হাতড়ে বের হচ্ছে।মনে পড়ে যাচ্ছে সাবু আর আফসানাদের বাসায় সেই গানের আসর যেখানে এলআরবি, মাইলস, ফিডব্যাক, কিংবা উইনিং এর আগের দিনের গানিগুলি আমাদেরকে নিয়ে যেত সেই সুদূর অতীতে।শুধু কি তাই মিলার ‘হাজার দর্শক মন মাতাইয়া’ গানের সাথে আমাদের সেই উৎচ্ছলতা আর সুসঞ্জিবের সেই কথার ‘বোমা’ ফাটানো সে সবই আজ স্মৃতি। 

মনে পড়ে যায় ‘ম’ রাজিবকে আমাদের ক্রিকেট দলের ‘অবৈতনিক’ ফিজিওথেরাপিষ্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলাম কিন্তু সে সর্বসাকুল্যে মাঠে গিয়েছিল এক দিন।মাঝে মাঝে ওর সেই চুল স্পাইক করা বা ‘ওগো দেখেছ আকাশে কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে’ নিয়ে আমাদের হাস্যরস ছিল প্রতি সপ্তাহান্তের ঘটনা।২০০৭ এর সেপ্টেম্বরে আগমন ঘটে আরেক রাজিবের, কিন্তু অবিকল শাইখ সিরাজের মত দেখতে বলে ওর নামই হয়ে গেল শাইখ আর কোন কারন ছাড়াই আমাদের নজরুলের নাম হয়ে গেল ‘চাষী’ ভাই। মাঝে মাঝে ভাবী অটোয়া ঘুরতে গেলে রাসেল ভাইয়ের আমাদের সাথে আড্ডা দেয়া, রাতদুপুরে ভুনা খিচুড়ী আর গোমাংস দিয়ে ভুড়িভোজন, আহার শেষে তৃপ্তির সিগেরেট ফুঁকা, আবার কখনো কখনো রাফাত ভাই কিংবা মোস্তফা ভাইদের ভাবীদের ম্যানেজ করে ২৯ খেলতে আসা কিংবা সাবু(আগের সাবু নয়) ভাইয়ের ‘ঘোড়া লাড়াবার’ সেই মজার কৌতুকগুলি কখনয় ভুলে যাবার নয়।আমদের সুমন ভাইয়ের মুখের ফুলঝুরি (মতান্তরে চাপা) কথাগুলো, লিয়াকত ভাইয়ের সেই ‘মুরগী’ খাওয়ানোর প্রতিজ্ঞা কিংবা রাত দুপুরে আমাদের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে কোমল পানীয় ‘ক্রাস’ কিনতে যেয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া সবই আজ অতীত।

২০০৮ এর সেপ্টম্বরে আগমন ঘটে আরেক রাজিবের।আমার আর রাজিবের চেহারায় মিল থাকায় লোকজন ধরেই নিল আমার ছোটভাই এসেছে বাংলাদেশ থেকে। সেই থেকে ওর নামও হয়ে গেল ‘ছোটে মিয়া’, আমাদের ইমরানত রীতিমত এটা নিয়ে ফেইসবুকে কবিতাই লিখে দিল। মনে পড়ে ইমরান আর জুনায়েদের সেই নটরডেমের বাংলার অধ্যাপক ‘মুখতার’ সারের অংগভঙ্গি প্রদর্শন মুগ্ধ হয়ে আমরা উপভোগ করতাম। ‘লালসালু’ উপন্যাসের হাসুনির মা’র আটপৌরে শাড়ি পড়ে ঢেকিতে পাড় দেবার যে অভিনয় করে দেখাতেন ‘মুখতার সার’ সেটা অবিকল আমাদের দেখাতে গিয়ে ইমরানের নামই হয়ে গেল ‘ঢাক কুরকুর’ সেখান থেকে সংক্ষেপে ‘ঢাক’।আর আমি বাংলাদেশী ছাত্র সংগঠনের সভাপতি হবার পরে আমার নিজের নাম হয়ে গেল ‘মেম্বর’। আমার রুমমেট আনন্দকে ঘিরে কার্ড খেলাতে অতিপটু রিপনের সেই বিখ্যাত ‘এডমন্টন ছেড়ে দেবার’ বা ‘বাউন্ডারীতে কেউ নেই’ ডায়ালগের কথা মনে আসলে হাসিতে দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হয়। মনে আছে মাঝে মাঝে কমেডি ছবি ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ এর প্রিমিয়ার শো হত আমাদের বাসায়। আনন্দের মুখের সেই ‘ইয়ে ভাস্কোদাগামা গান (বন্দুক)’ ডায়ালগ কিংবা কুমার শানুর গলা নকল করে নাকি সুরের গানগুলি গাইবার প্রতিভা মুদ্ধ করত আমাদের সবাই।তাজুলের সেই কোমর বাকিয়ে কার্ড ফেলবার ভঙ্গি, হামিদ ভাইয়ের হাতে গীটারের সুর, ম্যানইউ আর 'এনিমে' নিয়ে শাবিবের উচ্ছাস উম্মাদনা কিংবা আসিফ ভাইয়ের সেই মিষ্টি বানানো এবং ভাল মিষ্টি হওয়া সত্যেও আরো বেশী খাবার লোভে সেটার বদনাম করে যাওয়া সবই আমাদের সেই প্রাত্যাহিক দিনগুলির এক একটা অংশ ছিল।মনে আছে সবার জন্মদিন আমরা পালন করতাম একসাথে। জন্মদিনের কার্ডে সবার সিরিয়াস কিংবা কৌতুকসুলভ মন্তব্য আবার পাঠ করে শোনান হত। আমাদের উদ্দাম নৃত্য কলা কিংবা উচ্চস্বরে সংগীতের মুর্ছনায় বিরক্ত হয়ে বেশ কয়েকবার নিচতলার মানুষও ( আমাদের ভাষার ফ্রিক, নিরস মানুষ, আনন্দ বুঝেনা) উপরে চলে আসত অভিযোগ জানাতে। একবারত পুলিশ ডাকার হুমকিও দিল, কিন্তু কে শোনে কার কথা, কিছুদিন শান্ত হই আবার সেই নৃত্য গীত (!!) চর্চা। 

******************************************************
মানুষের জীবন থেমে থাকেনা, বয়ে চলে অবিরত।আমাদের জীবনও চলবে তার নিজস্ব গতিতে, হয়ত তার মোড় পরিবর্তন হবে, আমরা ব্যাস্ত হয়ে যাব পড়াশোনা, চাকুরী কিংবা জীবন গোছাতে। এই ৩২১ নাম্বার এপার্টমেন্টে নতুন ভাড়াটিয়া আসবে, নতুন করে সাজবে ঘর, হয়ত জানালায় দামী পর্দা লাগবে, মেঝেতে ঝকমকে কার্পেট কিন্তু ল্যাব থেকে দেরি করে আমার আর আসা হবেনা এই বাসায়, গ্রীষ্মের রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে আড্ডা হবেনা, নিচ থেকে কেউ কমপ্লেইন করবেনা। তবে হয়ত কোন একসময় এই বাসাকে ঘিরে অতীতের মুহুর্তুগুলো রোমন্থন করে আমাদের ভাল লাগবে আবার কখনোবা মনটা বিষন্ন হয়ে উঠবে সেই দিনগুলিকে ফিরে পাবার জন্য এই প্রত্যাশাটুকুইবা বা কম কিসের।