জাহিদুল ইসলাম, ফাহিম হাসান, ইশতিয়াক রউফ, রুমানা রিয়াজ আরিফিন, মুনাওয়ার হাফিজ, ও শান্তুনু বণিক
আমরা প্রবাসী বাংলাদেশী। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মত
আমরাও বাংলাদেশকে ধারণ করি বুকের একদম ভেতরে। তাই যখন রাত জেগে ক্রিকেটে বাংলাদেশের
বিজয় দেখি, কিংবা, গণিত অলিম্পিয়াডে তরুণ প্রজন্মকে ভাল করতে দেখি, তখন সাধারণ
বাংলাদেশীদের মত আমরাও গর্বিত হই। আবার যখন দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের
জন্য মর্যাদা হানিকর বা দুর্নীতির কোন খবর জানতে পারি, অন্য সবার মত আমরাও লজ্জিত হই। দেশে যখন
বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, আমরাও নিজেদের সামান্য সঞ্চয় তুলে পাঠিয়ে দেই
বাংলাদেশে। বিদেশে থেকেও যেন আমাদের সারা অস্তিত্ত্ব জুড়ে আছে লাল সবুজের একটি
দেশ, আমার, আমাদের বাংলাদেশ।
আমরা বাংলাদেশের সেই প্রজন্মকে ধারণ করি যারা মুক্তিযুদ্ধ
দেখেনি। আমরা সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা ভুল, বিকৃত ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে পড়ে বড়
হয়েছি। আমরা সেই দুর্ভাগা প্রজন্ম যারা পাকিস্তানীদের দোসরদেরকেই দেশে এবং দেশের
বাইরে একসময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ত্ব করতে দেখেছি। সেই প্রজন্মের একজন হয়ে আজ
যখন দেখতে পাই বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, তখন আমরাও বুক
ফুলিয়ে অন্যদের বলি- দেখ স্বাধীনতার একচল্লিশ বছর পার হলেও আজ আমরা বিশ্বাসঘাতকদের
বিচার করছি।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন আমরা শাহবাগে প্রতিবাদ
করছি? যেহেতু এই প্রতিবাদের সূচনা কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর পরই, আমরা কি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিপক্ষে? উত্তর হচ্ছে, না। প্রাথমিক প্রতিবাদ
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার লঘু শাস্তি প্রদানের বিরুদ্ধে শুরু হলেও আজ তা রূপ
নিয়েছে সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে। আমরা চাই বাংলাদেশের মাটিতে একজন যুদ্ধাপরাধীও
যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তাই শাহবাগ আন্দোলন কোন একটি নির্দিষ্ট
রায়ের বিরুদ্ধে নয়, এটি মূলত গত একচল্লিশ বছর ধরে ঝুলন্ত একটি প্রক্রিয়ার
স্বপক্ষের আন্দোলন। এই আন্দোলন মোটেই অতি আবেগী বাংলাদেশীদের কোন তাৎক্ষণিক
প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি অনেক অনেক বছর ধরে পুঞ্জীভূত বেদনা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। যদিও এর আগে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালালদের বিচারের ব্যাপারটি গণদাবীতে পরিণত হয়েছিল, তবে
সেটি তরুণ প্রজন্মকে এখনকার মত ভাবে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে পারেনি। শাহবাগ আন্দোলন তাই আজ আমাদের অস্তিত্ত্বের
আন্দোলন, আমাদের জাতীয়তার আন্দোলন, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে
দেওয়ার একটি আন্দোলন।
এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করতে আমরা প্রবাসী
বাংলাদেশীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একত্রিত
হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারের দাবীতে মুখর। নানা প্ল্যাকার্ড, ব্যানারের
মাধ্যমে বিশ্ববাসীর আমরা সামনে যুদ্ধাপরাধীদের কুকীর্তি তুলে ধরছি, তাদের বিচারের
দাবী নিয়ে সোচ্চার হচ্ছি। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশী হিসেবে আমাদের প্রয়াস শুধু এতেই
সীমাবদ্ধ নেই। আমরা সচেষ্ট থাকছি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে
আন্দোলনের যথাযথ মূল্যায়ন ও সত্য রিপোর্টিং হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে। বিগত
বছরগুলোয় যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থনকারীরা অত্যন্ত কৌশলের সাথে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে
বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করে রেখেছে। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে এই বিকৃত তথ্যের
ভিত্তিতে অসত্য খবর ছাপা হয়েছে আন্দোলনের শুরুর দিনগুলোয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে
স্থানীয় সংবাদদাতারা সম্পূর্ণ মিথ্যা সংবাদ ছেপেছেন। প্রবাসী ও অনলাইন
অ্যাক্টিভিস্টরা নিয়মিত চেষ্টা করে যাচ্ছেন এগুলো রোধ করতে। উদাহরণ হিসেবে বলা
যেতে পারে, শাহবাগ আন্দোলনের উপরে মাত্র কয়েকদিন আগে শুরু করা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের
কথা, যা
শুরু হয়েছিল মাত্র একটি প্যারাগ্রাফ দিয়ে, নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত-ছবি
যুক্ত হয়ে এখন এটি মূল্যবান একটি রেফারেন্স।
এই সক্রিয়তার উদ্দেশ্য মূলত বৈশ্বিক
প্রেক্ষাপটে বস্তুনিষ্ঠ খবরের সংকলন নির্মাণ। আজ আমাদের এই আন্দোলন বহির্বিশ্বে
কতটা গুরুত্ত্ব বহন করে সেটা তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন ফুটপ্রিন্টের। সেই ফুটপ্রিন্ট হতে পারে সংবাদপত্র, ব্লগ, এবং মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট। কিন্তু আসলে কতটা
বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে? ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় আন্দোলনরত জনতার
ছবি ছেপে ক্যাপশনে বলা হয় এটি জামায়াতের নেতাদের হয়রানির প্রতিবাদ। পরবর্তীতে ক্রমাগত
অভিযোগের ভিত্তিতে তারা এই ক্যাপশন সংশোধন করে। একইভাবে ৫ ফেব্রুয়ারি বিবিসি নিউজের
একটি প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যের ভুল উপস্থাপনের পাশাপাশি নানারকম
অপব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। শাহবাগের আন্দোলন এবং ক্রমাগত অভিযোগের পর ৮ ফেব্রুয়ারির
প্রতিবেদনে নিহতের সঠিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়। শুধু তাই না, এই রিপোর্টের প্রাথমিক প্রকাশে “ইসলামপন্থীদের ফাঁসির দাবি” লেখা হয়েছিল, যা প্রবল প্রতিবাদের ভিত্তিতে সংশোধন করে “যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি” করা হয়। এই
প্রক্রিয়া এখনও চলমান, কারণ এসোসিয়েটেড
প্রেস (এপি) ও এমেরিকান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি (এবিসি) সহ অনেক সংস্থার বাংলাদেশে
অবস্থিত প্রতিনিধিরা বিকৃত প্রতিবেদন পেশ করে যাচ্ছেন।
আজকের এই শাহবাগ আন্দোলন সাধারণ মানুষের
আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জমে থাকা ঘৃণার প্রকাশ, সর্বস্তরের
মানুষের সম্মিলিত কন্ঠস্বরে বিচারের দাবী। এই আন্দোলন মোটেই বিশেষ কোন রাজনৈতিক
দলের মতাদর্শকে তুলে ধরছে না। হাজারো অপপ্রচারের বন্যাকে আমলে না এনে সাধারণ জনগণ
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে অটল। শ্লোগানে মুখরিত শাহবাগ নতুন প্রজন্মের
পদচারণায় যেভাবে জেগে উঠছে তাতে একথা
স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সমর্থক সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে
আমাদের জয় সুনিশ্চিত। এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশে তাই মুষ্টিবদ্ধ
হয়েছে অসংখ্য প্রবাসীর হাত, বিশ্ববাসীর
কাছে তারা পৌঁছে দিতে চায় নতুন জয়ের বার্তা।
লেখক বৃন্দঃ কানাডা ও
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশী
বিদ্রঃ লেখাটি গত ১২ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ তে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছে।
লিঙ্কঃ এইখানে