সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফর করছেন। তার সফরে আবারো উঠে এসেছে
তিস্তা চুক্তির প্রসংগ। শুধু তিস্তা নয়, গঙ্গা, বারাক, ব্রহ্মপুত্র, সারি,
ফেনী সহ সব অভিন্ন নদ-নদীর ক্ষেত্রে উজানের দেশের যেকোন উন্নয়ন অবকাঠামোর
পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়শঃই এই গবেষণায়
মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে উপাত্ত। এমনকি আলোচিত টিপাইমুখ প্রকল্প বা ভারতের
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে যেয়ে একমাত্র
উপাত্তের অভাবেই তা বিসর্জন দিতে হয়েছে। অথচ আমাদের যুক্ত নদী কমিশন
বাংলাদেশ ভারত অভিন্ন নদীগুলোর উপাত্তের একটি ভান্ডার হতে পারে। কিন্তু
উপাত্ত যুক্ত নদী কমিশনের কাছে থাকলেই কি সেটা সবার কাছে উন্মুক্ত হবে? এই
প্রসংগে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে এই লেখা।
১)
২)
উপরে যে অভিজ্ঞতার কথা লিখলাম, সেটা হয়ত নতুন কিছু নয়।
পাঠকের মধ্যে অনেকেরই হয়ত এরকম অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। তবে এই অভিজ্ঞতা শেয়ার করার
একমাত্র কারণ একটি পুরোনো বিষয়কে আবারো সামনে নিয়ে আসা, আর তা হলো পানিসম্পদ বিষয়ক
তথ্য বা উপাত্ত সবার কাছে উন্মুক্ত করা। আর শুধু পানিসম্পদ নয়, গবেষণার অবাধ
প্রবাহ নিশ্চিৎ করতে যথাযথ উপাত্তের উন্মুক্তকরণ জরুরী। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের
বাইরে একেবারে বিপরীত কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। আমার পিএইচডি গবেষণার জন্য উপাত্তের
প্রয়োজনে এখানকার অনেক সরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করতে হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপাত্ত
ইন্টারনেটে উন্মুক্ত, যেসব উপাত্ত উন্মুক্ত নয় সেগুলোর জন্য ইমেইলে বা ফোনে অনুরোধ
করলেই উপাত্ত পাওয়া যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপকের অনুরোধ সহ
ইমেইল প্রয়োজন হয়। এর চেয়ে বড় কোন কাঠখড় পোহাতে হয়নি। এমনকি আমার গবেষণার প্রয়োজনে
আমি এমন অনেক উপাত্ত বা মডেল ব্যবহার করেছি যা কিনা সবার কাছে উন্মক্ত করাও হয়না,
কিন্তু গবেষণার গুরুত্ত্ব অনুধাবন করে এখানকার সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা
সেটা আমাকে দিয়েছেন। শুধু একটি সম্মতিতে আসতে হয়েছে, তাদের অনুমতি ছাড়া এই উপাত্ত
আমি অন্য কাউকে দিতে পারবনা। অনেক ক্ষেত্রেই যে সব তথ্য সবার কাছে উন্মুক্ত নয়
সেটি উল্লেখ করতে আমার থিসিসে বা গবেষণা প্রবন্ধে তাদের নাম রেফারেন্স হিসেবে
দিয়েছি, এবং অবশ্যই তাদের অনুমতি নিয়ে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে গবেষণার কোন
বিষয়ে, সেটা উপাত্তই হোক বা মডেল হোক না কোন সাধারণ তথ্যই হোক, ইমেইল করার পরপরই
তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।
৩)
একই প্রেক্ষাপটে দুটো বিপরীত উদাহরণ দেখানো হলো। একই
প্রেক্ষাপট বলছি কারন দুটো ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য একটাইঃ গবেষণা। একটি দেশের সরকারের
পক্ষে একাই সবকিছু নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশের পক্ষে
সেটা হয়ত সম্ভবও নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতো রয়েছেই, এছাড়াও অনেক
প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছে যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। এই মানুষগুলো দেশে
থেকে দূরে থাকলেও দেশের বিভিন্ন সমস্যে নিয়ে তাদের গবেষণা করার সুযোগ ও ইচ্ছে
দুটোই রয়েছে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে যদি বাংলাদেশের গবেষণার জন্য
প্রয়োজনীয় উপাত্ত উন্মুক্ত করা হয়। উপরুন্ত, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে
গবেষণারত অনেক বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীরা শুধুমাত্র উপাত্তের এই জটিলতার কারনেই
বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। আমার মনে আছে আমার
অধ্যাপককে একবার বলেছিলাম আমি তোমার সাথে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কিছু
ফ্রিল্যান্স গবেষণা করতে চাই। উত্তরে ও জানিয়েছিল দেখ, বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে
গবেষণার মূল প্রতিবন্ধকতা একটাই-উপাত্ত। যদি উপাত্ত সংগ্রহ করতে পার সেক্ষেত্রে
এইখানকার কিছু গবেষণা আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও পরীক্ষা করে দেখতে পারি। আমার
অধ্যাপকের বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী বাংলাদেশের তাই বাংলাদেশের উপাত্ত সমস্যা নিয়ে
তার ধারনাও অজানা নয়।
আরেকটি বিষয়, উপাত্ত উন্মুক্ত করণের ক্ষেত্রে শুধু কিন্তু
অনুরোধের বিষয়ই আসেনা, আসে অধিকারের প্রসংগও। বাংলাদেশ সরকার এই উপাত্তগুলো সংগ্রহ
করে সাধারণ মানুষদের কর থেকে অর্জিত অর্থ থেকেই। অথবা, বিদেশী দাতা সংস্থার অনুদান
থেকে অর্থ সংগৃহীত হলেও সেটার ভার কিন্তু সাধারণ জনগণকেই পোহাতে হয়। সেক্ষেত্রে এই
উপাত্তের উপর মানুষের অধিকারও রয়েছে। প্রসংগত একটি অভিজ্ঞতা মনে পড়ল। আমার
পিএইচডির প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রকল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
প্রকল্পটির উদ্যোক্তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওসেনিক এন্ড এটমসফেরিক
এডমিনিষ্ট্রেশন বা NOAA। আমরা সেই প্রকল্পের
ওয়েবসাইট থেকে বিনামূল্যে উপাত্ত সংগ্রহ করতাম এবং সেসময় আমাদেরকে প্রতীজ্ঞা করতে
হতো যে আমরা এই উপাত্ত দিয়ে গবেষণা করে সে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লেখব সেখানে উল্লেখ
করবো যেঃ ‘এই উপাত্ত গুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ওকলাহোমার সাধারণ মানুষদের কর থেকে
অর্জিত অর্থ থেকে’।
পরিশেষে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, অনুরোধ বা
অধিকার যেটাকেই আপনারা বিবেচনা করেননা কেন, প্রয়োজনীয় সব উপাত্ত সবার কাছে
উন্মুক্ত করুন, অথবা, নিদেনপক্ষে এমন ব্যবস্থা রাখুন যেন ন্যুনতম প্রশাসনিক জটিলতা
ছাড়াই গবেষকরা পানিসম্পদ বিষয়ক উপাত্ত ও তথ্য সহজেই পেতে পারে।
ডঃ জাহিদুল ইসলাম- পানি বিশেষজ্ঞ ও লেখক, ইমেইলঃ zahidripon@gmail.com
বিদ্রঃ লেখাটি গত ৬ মার্চ ২০১৩ তারিখে বিডিনিউজ২৪ ডট কমে মতামত বিশ্লেষণ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে। লিঙ্ক এইখানে।
বিদ্রঃ লেখাটি গত ৬ মার্চ ২০১৩ তারিখে বিডিনিউজ২৪ ডট কমে মতামত বিশ্লেষণ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে। লিঙ্ক এইখানে।