রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৩

বিশ্ব পানি দিবসঃ পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সহযোগীতা



২০১৩ সালে উপাত্ত মতে বছরের ১১৫ টি দিনকে জাতিসংঘের বিশেষ দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছেহিসেব কষলে তাই বছরের প্রায় ৩২ শতাংশ দিনই কোন না কোন বিশেষ দিন। তবে এর মধ্যে একটি দিন বাংলাদেশের মত নদীমাতৃক দেশের কাছে অধিক গুরুত্ত্ব বহন করে, আর তা হচ্ছে ২২ মার্চ, বিশ্ব পানি দিবস। কেন বিশেষ গুরুত্ত্ব বহন করে সেই আলোচনায় পরে আসছি তার আগে এই দিনটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জেনে নেই। বিশ্ব পানি দিবসের  সূচনা ১৯৯২ সালে। ঐ বছর ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেরিওতে জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক অধিবেশনে একটি বিশেষ দিনকে স্বাদু পানি দিবস হিসেবে পালন করার কথা সুপারিশ করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৯৩ সালের ২২ শে মার্চকে প্রথম আন্তর্জাতিক পানি দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর স্বাদু পানির উপর এক একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ২২ শে মার্চ বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে পালিত পানি দিবসগুলিতে স্থান পেয়েছে নারী ও পানি, তৃষ্ণার জন্য পানি, পানির প্রতুলতা, ভুগর্ভস্থ পানি, ভাটির অধিবাসীর জীবন, একুশ শতকের পানি, পানি ও স্বাস্থ, উন্নয়নের জন্য পানি, ভবিষ্যতের জন্য পানি, জীবনের জন্য পানি, পানি ও সংস্কৃতি, পানির অপ্রতুলতা, পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, আন্তসীমান্ত পানি, পানির মান, শহরের জন্য পানি, পানি ও খাদ্যের নিশ্চয়তা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। এর মধ্যে পানি ও জীবনশিরোনামে একটি পানি দশক (১৯৯৫-২০০৫) পালিত হচ্ছে। এবছরের (২০১৩) পানি দিবসটি একটু ভিন্ন। তাজিকিস্তান ও আরো কয়েকটি দেশের প্রস্তাব অনুযায়ী ২০১০ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের সভায় ২০১৩ সালকে ঘোষণা করা হয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অফ ওয়াটার কোওপারেশন’ বা পানি নিয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগীতার বছর হিসেবে। একথা অনস্বীকার্য যে জলবায়ু পরিবর্তন ও দ্রুত নগরায়নের ফলে স্বাদু পানির চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সে প্রেক্ষাপটে এবারের পানি দিবসের মূল উদ্দেশ্য আসলে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় পারস্পরিক সহযোগীতা বৃদ্ধি। বাংলাদেশের মত একটি দেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে সিহভাগ পানির উৎসই হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ, এই বছরের পানি দিবস তাই অধিক গুরুত্ত্ব বহন করে। 

পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার সহযোগীতা বলতে আসলে আমরা কি বুঝি সেটা আগে দেখা যাক। একেবারে ক্ষুদ্র পরিসরে যদি চিন্তা করি, একটি পানির উৎস ঘিরে অনেকগুলো ব্যবহারকারী গড়ে উঠে। এরা হতে পারে গৃহস্থালী কাজে, কৃষিকাজে, শিল্পক্ষেত্রে, কিংবা বিনোদনক্ষেত্রে পানির ব্যবহারকারী। এত গেল মানুষের চাহিদার কথা, মানুষ ছাড়াও এই পানির উৎসকে কেন্দ্র করে রয়েছে জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্র। জীববৈচিত্র রক্ষা কিংবা শুধুমাত্র পানির উৎসটির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের জন্যও পানি বরাদ্দের প্রয়োজন আছে। এছাড়া উৎসটির পানির গুনগত মান রক্ষা করাটাও এই ব্যবস্থাপনার একটি অংশ। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে পানি ব্যবস্থাপনা বলতে আমরা শুধু  মানুষের জন্য পানির ব্যবহারকেই মনে করি যা কিনা আসলে আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকীসরূপ। একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। ধরা যাক একটি অঞ্চলে কৃষিকাজের জন্য সেচের সুবিধা দরকার এবং সেই উদ্দেশ্যে আমরা ঐ অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত নদীটিতে একটি ব্যারেজ নির্মান করে উজানের পানির স্তর একটু বৃদ্ধি করে সেখান থেকে সেচ খালের মাধ্যমে পানি কৃষি জমিতে যোগান দিলাম। ফলশ্রুতিতে ঐ এলাকায় বাম্পার ফলন হলো এবারে একটু গভীর ভাবে চিন্তা করি, ঐ নদীতে আগে হয়ত অনেক মাছ ছিল কিন্তু ব্যারেজ নির্মানের ফলে নদীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়াতে মাছের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিনষ্ট হলো। ফলশ্রুতিতে ঐ অঞ্চলের ভাটিতে যারা মৎসজীবি ছিলেন তাদের উপার্জন কমে যাবে, যা কিনা আদতে সেই অঞ্চলে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করবে। অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি শুধুমাত্র একটি উদ্দেশ্যে যদি আমরা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রন করি তা এক অঞ্চলে উন্নয়ন ঘটালেও অন্য অঞ্চলে সমস্যার সৃষ্টি করবে। সুতরাং সামষ্টিক ভাবে চিন্তা করলে হয়ত এই উন্নয়ন প্রকল্প আর উন্নয়ন প্রকল্প থাকলনা। অথচ শুরু থেকে যদি আমরা সমন্বিত ভাবে চিন্তা করতাম সেক্ষেত্রে হয়ত ব্যারেজ নির্মানের সময় ঐ নদীর মৎস সম্পদের অবাধ বা কিছুটা নিয়ন্ত্রত বাস্তুতন্ত্র নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রাখা যেত, সেটা ফিসপাস দিয়েই হোক কিংবা অন্য যেকোন ভাবেই হোক। একই প্রেক্ষাপটে আরেকটি উদাহরণ হতে পারে ঢাকার বুড়িগঙ্গার কথা। এই নদীটিকে আমরা শিল্প কারখানা, গৃহস্থালী ও নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে আমরা এতটাই গুরুত্ত্ব দিয়েছি যে একে ভৌতগতভাবে (পানির পরিমান কমিয়ে), রাসায়নিকগত ভাবে ( পানিতে প্রাকৃতিক ভাবে বিদ্যমান খনিজ লবনের পরিমান বাড়িয়ে) ও জৈবগত ভাবে (পানিতে বিদ্যমান অক্সিজেনের পরিমান কমিয়ে) প্রায় মেরে ফেলেছি। 

এবারে আরেকটু বৃহৎ ক্ষেত্রে সহযোগীতার কথা ভাবা যাক। বাংলাদেশের মোট পানিসম্পদের শতকরা মাত্র ৮.৫৬ ভাগ দেশের অভ্যন্তর থেকে আর ৯১.৪৪ ভাগ আসে দেশের বাইরে থেকে। ঋতুভিত্তিক বিশ্লেষন করলে এই বিপুল পানিসম্পদের শতকরা ৮০ ভাগই আসে বর্ষা মৌসুমে (জুন থেকে অক্টোবর) আর বাকী মাত্র ২০ ভাগ আসে শুষ্ক মৌসুমে। অর্থাৎ কিনা পানির চাহিদা যখন সর্বোচ্চ তখনই এর যোগান সর্বনিম্ন। এবারে চাহিদার দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। ২০০৮ সালের হিসেব মতে, বাংলাদেশের এই বিপুল পানিসম্পদের শতকরা মাত্র ২.৯৩ ভাগ আমরা ব্যবহার করি। এই ব্যবহৃত পানিসম্পদের সিংহভাগই (শতকরা ৮৮ ভাগ) কৃষিক্ষেত্রে, শতকরা ১০ ভাগ গৃহস্থালী ক্ষেত্রে, আর বাকী শতকরা ২ ভাগদেখা যাচ্ছে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে পানির ব্যবহারের শতকরা ৮৮ ভাগই হচ্ছে কৃষি যেখানে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এর হার শতকরা ৭০ ভাগ। অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে পানি ব্যবহারে হার শতকরা ১৮ ভাগ বেশি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে হিসেবে আনলে জাতিসংঘের তথ্য মতে আগামী ২০৫০ সালে খাদ্যের চাহিদা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শতকরা ৭০ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই হারকে ধরে নিলেও আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ হয় কৃষিক্ষেত্রে পানির ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক পানির ব্যবহারের দিকে তাকালে দেখা যায় তিনটি মন্ত্রনালয় সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানির ব্যবস্থাপনার কাজ করেঃ অতিক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প-কৃষি মন্ত্রনালয়, ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প-স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রনালয়, এবং বৃহৎ সেচ প্রকল্প- পানিসম্পদ মন্ত্রনালয়। এই ক্ষুদ্র বা বৃহৎ উভয় প্রকারের প্রকল্পগুলোর সেচ ব্যবস্থা ততটা কর্মদক্ষ নয়। ফলশ্রুতিতে সেচের জন্য সরবরাহকৃত পানির একটি বড় অংশ স্বতঃবাস্পীভবন প্রক্রিয়ায় বায়ুমন্ডলে চলে যায় বা চুয়ে মাটিতে চলে যায়। এই অবস্থার উন্নীতকরনের জন্য কর্মদক্ষ সেচ ব্যবস্থার পাশাপাশি সেচের জন্য পানির ব্যবস্থাপনার জন্য এই তিনটি মন্ত্রনালয়ের মধ্যে অধিক সমন্বয় প্রয়োজন। শুধু সেচ ছাড়াও বন্যা ব্যবস্থাপনা, নৌপরিবহন, পানি সরবরাহ, পানিভিত্তিক দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের মধ্যে সহযোগীতা ও পারস্পরিক উপাত্ত বিনিময় প্রয়োজন।

এবারে দেশের বৃত্তের বাইরে একটু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আসি। নদী যেহেতু কোন রাজনৈতিক সীমারেখা মেনে চলেনা তাই এর ব্যাপ্তি একাধিক দেশ জুড়ে হতেই পারে, যাকে বলা যেতে পারে আন্তর্জাতিক অববাহিকা। হিসেব মতে প্রায় ৮৬ শতাংশ দেশ কোন না কোন আন্তর্জাতিক নদী অববাহিকার অংশ। বিশ্বে প্রায় ২৭৬ টি আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকা আছে যার প্রায় ২৩ শতাংশ আফ্রিকায়, ২২ শতাংশ এশিয়ায়, ২৪.৫ শতাংশ ইউরোপে, ১৬.৫ শতাংশ উত্তর আমেরিকায় এবং বাকী ১৪ শতাংশ দক্ষিণ আমেরিকায়। আন্তর্জাতিক পরিসরে পানি ব্যবস্থাপনায় সহযোগীতা নিয়ে আসার জন্য এই নদীঅবাহিকার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগীতার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে। বিশেষতঃ আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে ‘আমার দেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে এর উপর একমাত্র আমারই অধিকার’ এই মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে। কিন্তু সেই পথে কতটা অগ্রসর বিশ্বের দেশগুলি? ১৯৯৭ প্রস্তাবিত নৌচলাচল ব্যাতিরেকে আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে জাতিসংঘের কনভেনশন কার্যকর হবার জন্য মাত্র ৩৫ টি দেশের অনুমোদন প্রয়োজন যা কিনা বিশ্বের সব দেশের মাত্র শতকরা ১৩ ভাগ। অথচ আজ পর্যন্ত মাত্র ১৬ টি দেশ ( প্রায় ৬ শতাংশ) তাতে স্বাক্ষর করেছে। সবচেয়ে অবাক হচ্ছে যে দেশের প্রায় ৯১ ভাগ পানি আসে আন্তর্জাতিক নদীর মাধ্যমে, সেই বাংলাদেশ এখনো ঐ কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। অথচ টিপাইমুখ প্রকল্প, তিস্তা চুক্তি বা অন্যান্ন অভিন্ন নদী নিয়ে পার্শবর্তী দেশের সাথে সংকট নিরসনে বাংলাদেশের মত দেশের ক্ষেত্রে এরকম আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সমর্থন দেয়াটা খুব জরুরী। 

প্রত্যেক বছর বিশ্ব পানি দিবস পালন করে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশ। জাতিসংঘের মাধ্যমে সভা সেমিনার হয়, পোষ্টারিং হয়, গণমাধ্যমে আলোচনা হয়, লেখালেখি হয়, কিন্তু পরদিন সকালে উঠে আমরা কি মনে রাখি আগের দিনের কথাগুলো? ২০০০ সালে জাতিসংঘের মিলেনিয়াম সামিত  শেষ হয়েছিল ২০১৫ সালের মধ্যে ৮ টি লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়নকে সামনে রেখে।বাংলাদেশ নিজেও এই মিলেনিয়াম ডিক্লেয়ারেশনে স্বাক্ষর করেছে। এই আটটি  লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে একটি হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা। ২০১৫ সালের মিলেনিয়াম গোলকে সামনে রেখে কোন দেশ কতটুকু অগ্রগতি করল তার বিবরন ইউএনডিপির ওয়েবসাইটে দেয়া আছে। সেখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আশান্বিত হবার মত কিছু পাওয়া যায়নি এই বিষয়ে। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সাথে পানি ব্যবস্থাপনায় সহযোগীতার বাস্তবায়ন অতীব গুরুত্ত্বপূর্ণ। 

শেষ করি একটি চমৎকার স্লোগানের কথা বলে। এবছর পানি দিবস উপলক্ষে সবার কাছে উন্মুক্ত ভাবে স্লোগান আহবান করা হয়েছিলবিশ্বের প্রায় ১৮০ টি দেশ থেকে ৫,৬৫৪ জন মানুষ মোট ১২,১৫১ টি স্লোগান প্রস্তাব করেছিল। সেখান থেকে বাছাই করে ভারতের মেঘা কুমারের একটি স্লোগান নির্বাচিত করা হয়েছে, আর সেটি হচ্ছেঃ Water, water everywhere, only if we share”  যার মূল কথা হচ্ছে একমাত্র সহযোগীতাই পারে বিপুল চাহিদার বিপরীতে পানির যোগানকে নিশ্চিত করতে। সেই সহযোগীতা নিশ্চিত করতে হবে স্থানীয় পর্যায়ে, দেশীয় পর্যায়ে এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে।