মুখবন্ধ
১৯৯২ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক অধিবেশনে একটি বিশেষ দিনকে স্বাদু পানি দিবস হিসেবে পালন করার কথা সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৯৩ সালের ২২ শে মার্চকে প্রথম আন্তর্জাতিক পানি দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর স্বাদু পানির উপর এক একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ২২ শে মার্চ আন্তর্জাতিক পানি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে পালিত পানি দিবসগুলিতে স্থান পেয়েছে নারী ও পানি, তৃষ্ণার জন্য পানি, পানির প্রতুলতা, ভুগর্ভস্থ পানি, ভাটির অধিবাসীর জীবন, একুশ শতকের পানি, পানি ও স্বাস্থ, উন্নয়নের জন্য পানি, ভবিষ্যতের জন্য পানি, জীবনের জন্য পানি, পানি ও সংস্কৃতি, পানির অপ্রতুলতা, পয়ঃনিস্কাশন ব্যাবস্থা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ন বিষয়।
এর মধ্যে ‘পানি ও জীবন’ শিরোনামে একটি পানি দশক (১৯৯৫-২০০৫) পালিত হচ্ছে। এইবারের পানি দিবষের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘আন্তঃসীমান্ত পানি’, যা দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে বহমান স্বাদু পানির প্রবাহ অথবা উৎস ( নদী অববাহিকা, নদী, ভুগর্ভস্থ পানি, হ্রদ, হিমবাহ) বিষয়ক সংঘাত বা সহযোগীতার বিষয়গুলিকে আমাদের সামনে তুলে ধরবে। বিষয়টি বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এবং বাংলাদেশের জন্য বলতে গেলে জীবন-মরন সমস্যা। সেই আঙ্গিকেই আমার এই নিবন্ধের ক্ষুদ্র প্রয়াস।প্রযুক্তি আর আবেগ একে অপরের বিপরীত হলেও আমি চেষ্টা করেছি এদের দু’জনকে হাত ধরে হাঁটতে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
প্রথমেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করি।জাতিসংঘের তথ্যমতে ২৬৩ টি স্বাদু পানির হ্রদ ও নদী অববাহিকা রয়েছে (স্বাদুপানির মোট পরিমানের শতকতা ৬০ ভাগ) যা বিশ্বের ১৪৫ টি দেশের সীমানাকে অন্তর্ভুক্ত করে যা কিনা পৃথিবীর মোট স্থলভাগের অর্ধেক, এবং পৃথিবীর শতকরা ৪০ ভাগ মানুষের বাসভুমি[১]। বলিভিয়া, চাদ, কঙ্গো, জাম্বিয়া সহ প্রায় তেত্রিশটি দেশ রয়েছে যাদের শতকরা ৯৫ ভাগ ভুখন্ড এক বা আন্তর্জাতিক নদীঅববাহিকার অংশ। এর থেকেও গুরুত্বপুর্ন হচ্ছে একটি নদী অববাহিকা প্রায়শই অনেকগুলি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে। উদাহরন সরূপঃ ইউরোপের দানিয়ুব নদীঅববাহিকা সতেরটি; কঙ্গো, নাইজার, নীল, রাইন, জাম্বেজী প্রমুখ নদীঅববাহিকা সমুহ নয়টির বেশী; এবং আমাজন, গংগা-ব্রম্মপুত্র-মেঘনা, মেকং, টাইগ্রীস-ইউফ্রেটিস-শাতউলআরাব, ভলগা প্রভৃতি নদী অববাহিকাগুলি কমপক্ষে পাঁচটি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে[২]। এছাড়া ভুগর্ভস্থ পানির উৎসত রয়েছেই। ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই এই সব আন্তঃসীমান্ত নদী বা হ্রদ সমুহ যুগে যুগে একাধিক দেশের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি করেছে। সময়ের সাথে সাথে আমাদের পরিবেশ যেমন দুষিত হচ্ছে যেই সাথে বাড়ছে পানির চাহিদা যা এই সংঘাতকে ভবিষ্যতে আরো বেগবান করবে। অথচ সংঘাত নয় সহযোগীতাই পারে এই সমস্যাকে সমাধান করতে। দেখা গিয়েছে গত ষাট বছরে পৃথিবীতে ২০০ টির মত আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছে যার বিপরীতে ৩৭ টি ক্ষেত্রে একাধিক দেশের মধ্যে সংঘাতের ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে[১]।সেই বিচারে এবারের পানি দিবসের মূল স্লোগানটি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং সুরমা-মেঘনা এই তিনটি নদীপ্রনালী বাংলাদেশে তৈরী করেছে অসংখ্য নদ-নদী, তাদের শাখানদী এবং উপনদী যা জালের মত বিস্তৃত হয়ে আছে এই দেশে।যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষদের সভ্যতা, যোগাযোগ ব্যাবস্থা, অর্থনীতি, শিল্প-বানিজ্য, বিনোদন, সর্বোপরি জীবন যাপনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে এই নদীগুলি। নদী যেমন আমাদের পরম বন্ধু তেমনি চরম শত্রুও।বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো সহ মোট ৫৮ টি নদী রয়েছে যারা ভারত(৫৫ টি) অথবা মায়ানমার (৩ টি) থেকে এদেশে প্রবেশ করেছে[৩]। সংগায়নের দিক থেকে এই সব নদীগুলিই বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নদী বলে বিবেচিত। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই সব আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো যথেষ্ট গুরুত্ত্ব বহন করে কারন আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হলেও তার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর পানির সিংহ ভাগই(শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি)আসে দেশের বাইরে থেকে, সুতরাং আমাদের উজানের দেশ ভারত বা মায়ানমারের নদীকেন্দ্রিক যেকোন কর্মকান্ডেরই কিছু না কিছু প্রভাব আমাদের দেশের উপর পরে। সমগ্র ব্যাপারটা একটি উদাহরনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করিঃ
পদ্মা নদীর ভারতে নাম গঙ্গা। ভারত সরকার ১৯৭৪-৭৫ সালে এই নদীর উপর একটি ‘ব্যারেজ’ নির্মান করে যা আমাদের কাছে ‘ফাঁরাক্কা ব্যারেজ’ নামে পরিচিত। এখানে বলে রাখা ভাল বাঁধ এবং ব্যারেজ এর মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে।বাঁধ হল নদীর প্রবাহকে সম্পূর্নভাবে বন্ধ করে দিয়ে উজানে হ্রদ নির্মান করে নদীর পানিকে পানি বিদ্যুৎ বা অন্য কোন কাজে ব্যাবহার করা (উদাহরন হিসেবে কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা বল যেতে পারে)। সেক্ষেত্রে বাঁধের পাশ দিয়ে একটি নিয়ন্ত্রিত বিকল্প প্রবাহ তৈরী করে সেটাকে ভাটিতে মুল নদীর সাথে সংযোগ দেয়া হয়। অন্যদিকে ব্যারেজ হল নদীর প্রবাহকে গেইট দিয়ে নিয়ন্ত্রন করে উজানের প্রয়োজন মিটানো (অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষিকাজের জন্য সেচের ব্যাবস্থা করা, যেমন বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজ)। দুই ক্ষেত্রেই ভাটিতে কি পরিমান পানি যাবে তা নির্ভর করে উজানের পানির ব্যাবহারের উপর।
শুস্ক মৌসুমে যখন নদীতে প্রবাহ কম থাকে কিন্তু কৃষকের পানি দরকার তার ধান আবাদের জন্য (উজানে এবং ভাটিতে) তখন উজানের কৃষক ব্যারেজের সুবিধা নেয় গেট বন্ধ করে দিয়ে। সেক্ষেত্রে ভাটির মানুষের সমস্যা হয় নিম্নরুপঃ
১) কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানি পায়না ফলে ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়।
২) নদীতে প্রবাহ কমে যাওয়ায় উপকূল এলাকায় সমুদ্রের লবনাক্ত পানি নদীতে চলে আসে, সেক্ষেত্রে নদীর আশেপাশের এলাকার গাছপালার (এক্ষেত্রে সুন্দরবন ও আবাদী জমি) মূল থেকে পানি বের হয়ে যায় (লবনাক্ত পানির ঘনত্ব বেশি আর মূলের ভিতরের পানির ঘনত্ব কম),ফলে উর্বরতা হারায় আমাদের আবাদী জমি ও ধ্বংস হয়ে যায় জাতীয় সম্পদ।
৩) শুস্ক মৌসুমে নদীর আশে পাশের মাটি পানি শুষে নেয় নদী থেকে। যেহেতু মূল নদীতেই পানি থাকেনা সুতরাং নদীরপাড়ের এলাকার ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়, সেচপ্রকল্প ব্যাহত হয় এবং দীর্ঘকাল ধরে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে একসময় তা বিরান মরুভুমিতে পরিনত হয়।
৪) নদীতে যেকোন বাধাই সেখানকার বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে, ফলে ব্যারেজের ভাটিতে মাছের স্বাভাবিক বিচরন ব্যাহত হয়, সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ভাটি অঞ্চলের জেলেরা যার জীবিকাই ছিল মাছ ধরা।
৫) নদী তার সাথে বয়ে নিয়ে চলে উজান থেকে আনা পলি।নদীতে হঠাৎ করে প্রবাহ কমে যাওয়ায় সে আর পলিকে বয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা রাখেনা, কিছুটা বৃদ্ধলোকের ঘাড়ে পাহাড়সম বোঝা চাপানোর মত।তখন সে ধপাস করে সব পলি ফেলে রেখে যায় ভাটি অঞ্চলে। এতে নদীর নাব্যতা কমে যায় যার প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারন করে বর্ষা মৌসুমে (পরে আলোচনা করা হবে)।
৬) ভাটির অঞ্চলে নদীকেন্দ্রিক যেকোন শিল্প ও যোগাযোগ ব্যাবস্থা ধংসের মুখে পতিত হয়।
বিপরীতে বর্ষা মৌসুমে, নদীতে অবাধ পানি সুতরাং এখন আর উজানে বেশি পানি দরকার নাই বরং পারলে ব্যারেজ দিয়ে সব পানি ছেড়ে দেয়।তখন ভাটি অঞ্চলে শুরু হয় নতুন সমস্যা যা আসলে শুস্ক মৌসুমের সমস্যার দ্বারাই তৈরীঃ
১) ব্যারেজের গেট হঠাৎ খুলে দেওয়ায় ধেয়ে আসা পানিতে ভেসে যায় অনেক কষ্টে ফলানো কৃষকের ধান। চেয়ে চেয়ে দেখা আর চোখের পানি ফেলা ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকেনা।
২) এখন নদীতে অনেক পানি কিন্তু শুস্ক মৌসুমে নদীতে পলি পড়ে নদীর গভীরতা কমে গিয়েছে, সুতরাং সেই পানি ছড়িয়ে পরে আশেপাশের এলাকায়, ভেসে যায় কৃষকের ঘরবাড়ি, গবাদি-পশু, পুকুরের মাছ।
৩) নদীতে এখন অনেক স্রোত, এখন কিন্তু আমার ভাটি অঞ্চলের নদীর ক্ষমতা অনেক বেশি। সে একেবারে ২২ বছরের যুবার মত, সে কিন্তু পারে এক গাদা পলি বয়ে নিয়ে যেতে এবং ফেলে দিতে সমুদ্ররের মোহনায় যাতে আমার দেশের ভুখন্ড বাড়ে। কিন্তু হায় উজান থেকে ক্ষয়ে আসা পলি আছড়ে পরে ব্যারেজের গায়ে। যেহেতু ব্যারেজ নির্মানের সময় গেটের স্থলে উচু করা হয়, সুতরাং নদী বেয়ে আসা পলির একটা বিরাট অংশ জমে থাকে ব্যরাজেরও উজানে। ফলে নদীর মোহনায় বড়েনা দেশের জমি বরং জোয়ার ভাটায় তা আরো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
এইভাবে শুস্ক আর বর্ষা মৌসুমে দুই বিপরীত বৈরীতায় গ্রাম বাংলার নদীপারের মানুষ তথা সমগ্র বাংলাদেশ হারায় সব কিছুই। রাজা যায় রাজা আসে, রাজনৈতিক ভাবে চুক্তিও হয় ( গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি ১৯৯৬), তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা হিসাব কষে নিবন্ধ লিখে, আন্তর্জাতিক অধিবেশনে বক্তব্য রাখে, কিন্তু কৃষকের হারানো ধান আর ফিরে আসেনা, বাংলার জেলে মাঝিও তার সন্তানদের দুবেলা অন্ন জোটাতে পারেনা, তাদের চোখের অশ্রু এককালের রাক্ষুসী পদ্মার চরের বালিতে শুকিয়ে যায় ।এখন আবার শুনছি ‘রিভার ইন্টার লিঙ্কিং প্রকল্প’, ওটা নিয়েও অনেক গবেষণা চলছে, কি জানি একদিন হয়ত ওটাও বাস্তবায়িত হবে। জাতিসংঘ বলছে ‘সংঘাত নয় সহযোগীতাই পারে এই সমস্যাকে সমাধান করতে’, কিন্তু আমরাত ছোট মাছ, বড় বড় রাঘব বোয়ালরা কি আমাদের পাত্তা দেবে? আমাদের সংঘাতের সাধ্য নেই আর আলোচনার সুযোগও খুব বেশী নেই, আমরা কেবল দাবী করতে পারি আর স্বপ্ন দেখতে পারি। তাই আজকের এই আন্তর্জাতিক পানি দিবসে আসুন আমরা সবাই মিলে সহমর্মীতার কথা বলি, সহযোগীতার পথে চলি আর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি যেখানে উজানের মানুষ তার ভাটির ভাইদের দুঃখ কষ্টের ভাগীদার হবে, মিলে মিশে আমরা সবাই নদীর শান্ত জলে গা ভেজাব, তা থেকে আহরন করব আমার জীবিকা।
তথ্যসুত্রঃ
[১] জাতিসংঘ পানি
[২] পানি ও নদীঅববাহিকা ইনষ্টিটিউট, ওরাগন বিশ্ববিদ্যালয়
[৩] আন্তঃসীমান্ত নদী, বাংলাপিডিয়া
ছবিসুত্রঃ আন্তর্জাল
বিদ্রঃ প্রথম প্রকাশ সচলায়তন